মহানবী (স.) হযরত মুহাম্মাদ (স.) এর জীবনের অন্তিম মুহূর্তে হযরত ফাতেমা (সা. আ.) প্রচন্ড ক্রন্দন করছিলেন। মহানবী (স.) তাঁকে নিজের কাছে ডেকে কিছু বললেন। ঐ কথা শোনার পর হযরত যাহরা (সা. আ.) এর ক্রন্দন আরো তীব্রতা পেল। অতঃপর তিনি (স.) তাকে পূনরায় কিছু বললেন, এতে ফাতেমা (সা. আ.) মুচকি হাসলেন। পরবর্তীতে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছিলেন : আল্লাহর রাসূল (স.) প্রথমে আমাকে বললেন : ‘এ ব্যাথাতেই আমার মৃত্যু হবে'। তার মুচকি হাসির কারণ জিজ্ঞেস করা হলে উত্তরে তিনি বলেন, তিনি (স.) বলেছিলেন : ‘আমার আহলে বাইতের মধ্য হতে তুমিই হচ্ছো প্রথম ব্যক্তি যে আমার সাথে মিলিত হবে'।
আহলে বাইত (আ.) বার্তা সংস্থা আবনার রিপোর্ট : আল্লাহর রাসূল (স.) দীর্ঘ ২৩ বছর যাবত ঐশী বাণী প্রচার ও জনগণকে এর প্রতি আহবান এবং স্বীয় রেসালত প্রচারের লক্ষ্যে বিভিন্ন বাধা-বিঘ্নতা পার করার পর অবশেষ ১১ হিজরী'র ২৮শে সফর [১] চারদিন অসুস্থ [২] থাকার পর ইন্তিকাল করেন এবং তাঁর পবিত্র দেহ মোবারক মসজিদে নববী সংলঘ্ন তাঁর কক্ষেই দাফন করা হয়।
মহানবী (স.) এর জীবনের শেষ দিনগুলি
আল্লাহর রাসূল (স.) তাঁর অসুস্থতা গুরুতর হওয়ার আগের রাতে হযরত আলী (আ.) এর হাত ধরে এক দল লোকের সাথে জান্নাতুল বাকী কবরস্থানে যান। সেখানে তিনি কবরে শায়িতদের উদ্দেশ্যে সালাম প্রেরণ করেন অতঃপর তাদের জন্য দীর্ঘক্ষণ ধরে ইস্তিগফার করেন। অতঃপর হযরত আলী (আ.) কে বললেন : ‘জীবরাইল প্রতি বছর একবার করে পরিপূর্ণ কুরআন আমার উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ হতেন, কিন্তু এ বছর দু'বার এ ঘটনা ঘটেছে। আর এ বিষয়টির মাধ্যমে আমার মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসা ব্যতীত আর কিছুই বোঝায় না।[৩]
অতঃপর আলী (আ.) কে বললেন : ‘যদি আমি দুনিয়া হতে বিদায় নিই তবে তুমি আমাকে গোসল দেবে'।[৪] অন্য এক রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেছিলেন : যদি কাউকে কোন প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকি তবে তার উচিত আমার নিকট এসে তা চাওয়া, যদি আমি কারো নিকট ঋণী থাকি তবে সে যেন আমাকে সে সম্পর্কে অবগত করে'।[৫]
কিছু কিছু স্ত্রী ও সাহাবাদের অবাধ্যতা ও বিরূপ আচারণে অতিষ্ঠ মহানবী (স.) বিদআতের পথ রুখতে বলেছিলেন : ‘হে লোক সকল! ফেতনার আগুন প্রজ্বলিত হয়েছে, ফেতনাসমূহ আঁধার রাতের ন্যায় আবির্ভূত হয়েছে। আমার বিপক্ষে তোমাদের নিকট কোন দলীলই নেই; কেননা কুরআন যা কিছু হালাল করেছে তা ব্যতীত আমি কোন কিছুকেই হালাল করিনি এবং কুরআন যা কিছু হারাম করেছে তা ব্যতীত আমি কোন কিছুকেই হারাম করিনি'।[৬]
মহানবী (স.) এ বিষয়ে সতর্ক করে দেয়ার পর ‘উম্মু সালামাহ' (রা.) বাড়ীতে গেলেন এবং সেখানে দু'দিন অবস্থান করলেন।
তিনি বললেন : হে আল্লাহ্ তুমি সাক্ষী থেকো আমি সত্য বিষয়াদির প্রচার করেছি।[৭] অতঃপর মহানবী (স.) স্বীয় বাড়ীতে গেলেন এবং একটি দলকে তলব করে বললেন : ‘আমি কি তোমাদেরকে ‘উসামা'র সৈন্যদলে যোগ দান করার নির্দেশ দেয়নি? কেন তোমরা যাওনি? আবু বকর বললেন : গিয়েছিলাম; কিন্তু আপনার সাথে পূনরায় সাক্ষাতের জন্য এসেছি। উমর বললেন : অন্য কাফেলার লোকদের নিকট হতে আপনার শারীরীক অবস্থার খবরা-খবর জিজ্ঞাসা করা পর্যন্ত ধৈর্য্যধারণ পারিনি।[৮]
নির্দেশ অমান্য করায় রাসূল (স.) অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হলেন এবং সে অসুস্থ অবস্থাতেই তিনি মসজিদে গিয়ে অভিযোগকারীদের উদ্দেশ্যে বললেন : উসামা'র নেতৃত্বের বিষয়ে এ সব কি মন্তব্য আমি শুনছি। তোমরা এরপূর্বেও তার পিতার নেতৃত্বকে কটাক্ষ করেছো। আল্লাহর কসম সে সৈন্যদলের নেতৃত্ব দানের ক্ষেত্রে যোগ্য ছিল এবং তার পুত্র উসামাও এ কাজের জন্য যোগ্য। মহানবী (স.) অসুস্থ অবস্থাতেই তার সাথে দেখা করতে আসা লোকদের উদ্দেশ্যে বারংবার বললেন উসামার সৈন্য দলকে রওনা করো।[৯] তিনি এখানে উসামা'র সৈন্য দলে যোগ দান করার বিষয়ে অবাধ্যদের প্রতি অভিসম্পাত করেছেন।[১০]
অতঃপর তিনি জ্ঞান হারালেন, এমতাবস্থায় সকল নারী ও শিশুরা ক্রন্দন করছিলো। কিছুক্ষণ পর মহানবী (স.)-এর জ্ঞান ফিরে এল। তিনি নির্দেশ দিলে তাকে কলম এবং দোয়াত এনে দেওয়ার জন্য, যাতে তিনি তাতে এমন কিছু লিখে দেবেন যে, পরবর্তীতে তোমরা কখনই গোমরাহ ও পথভ্রষ্ট হবে না। এ সময় তাদের মধ্যে কিছু লোক উঠে কলম, কাগজ ও দোয়াত আনতে চলে গেল। উমার বললেন : মহানবী (স.) এর অসুস্থতা তীব্র আকার ধারণ করেছে, ((إرجع فإنه یهجر)) ফিরে এসো, কেননা তিনি ভুল বকছেন [নাউজুবিল্লাহ]। তোমাদের নিকট কুরআন রয়েছে, তোমাদের জন্য আল্লাহর কিতাবই যথেষ্ট।[১১] উপস্থিতদের কিছু উমরের কথার বিরোধিতা করলেন এবং কয়েকজন তার কথার সমর্থন করলো। মহানবী (স.) তাদের মতানৈক্য ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথাবার্তায় অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন : ‘ওঠো এবং আমার নিকট হতে দূর হয়ে যাও'। [১২]
শেষ মুহূর্তে মহানবী (স.) এর ওসিয়ত
অন্যান্যদের উপস্থিতিতে মহানবী (স.) আলী (আ.) এর দিকে তাকালেন এবং তার উদ্দেশ্যে ওসিয়ত করতে চাইলেন, বললেন : কাছে এসো। অতঃপর তিনি নিজের যেরা (যুদ্ধের সময় ব্যবহৃত ইস্পাতের তৈরী জামা), তলোয়ার, আংটি ও সিল আলী (আ.) কে দিয়ে বললেন : ‘বাড়ীতে যাও'। এর কিছুক্ষণ পর তাঁর অসুস্থতা তীব্র আকার ধারণ করলো। তিনি পূনরায় স্বাভাবিক হওয়ার পর আলী (আ.) কে কাছে না পেয়ে স্ত্রীদের উদ্দেশ্যে বললেন : ‘আমার ভাই ও সহচর কোথায়'। তারা আবু বকরকে ডেকে পাঠালেন। তিনি আসলে মহানবী (স.) পূনরায় একই বাক্য পূনরাবৃত্তি করলেন। অতঃপর তারা উমরকে ডেকে নিয়ে এলেন। কিন্তু মহানবী (স.) আবার বললেন : ‘আমার ভাই ও সহচর কোথায়'। উম্মু সালামাহ বললেন : তিনি আলীকে খোঁজ করছেন, তাকে আসতে বলো।[১৩] আলী (আ.) আসলেন, অতঃপর তারা দু'জনে কানে কানে কিছুক্ষণ কথা বললেন। যখন আলী (আ.) কে জিজ্ঞেস করা হল যে মহানবী (স.) কি বলেছেন?
তিনি উত্তরে বললেন : আমাকে তিনি জ্ঞানের ১০০০টি অধ্যায়ের শিক্ষা দিয়েছেন এবং প্রতিটি অধ্যায় হতে আমার জন্য ১ হাজারটি অধ্যায় উন্মুক্ত হয়েছে। আর আমাকে কিছু কাজের কথা বলেছেন, যেগুলোকে আমি অবশ্যই আঞ্জাম দেব।[১৪] ঐ অবস্থায় মহানবী (স.) কয়েকবার বললেন : ((ما ظن محمد بالله لو لقی الله و هذه عذره عنده))
জীবনের শেষ দিনগুলির একটিতে তিনি মুসলমানদেরকে মসজিদে উপস্থিত হওয়ার লক্ষ্যে আহবান জানানোর জন্য হযরত বিলাল (রা.) কে নির্দেশ দিলেন। তিনি জনগণের উদ্দেশ্যে বললেন, যদি তিনি কারো নিকট ঋণী থাকেন তবে তারা যেন দাবী করে। মহানবী (স.) এ কথার কেউ কোন উত্তর দিল না, তিনি এ কথাকে তিনবার পূনরাবৃত্তি
source : www.abna.ir