মরহুম বাদশাহ যখন সিংহাসনে বসেন তখন তিনি এ কথা ভালো করে জানতেন যে, রাজপরিবারের দুই প্রধান শাখার মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব সমগ্র রাজবংশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। এ কারণে তিনি রাজপরিবারের অভ্যন্তরে বিপজ্জনক দ্বন্দ্ব পরিহার এবং শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের কিছুটা ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা ও নতুন বিধিমালা প্রণয়নের চেষ্টা করেন।
ক্ষমতা হস্তান্তর সহজতর করার লক্ষ্যে আনুগত্য কমিশন গঠন করা হয়। বাদশাহর নির্দেশে রিয়াদে রাজদরবারে রুদ্ধদ্বার বৈঠকের আয়োজন করা হয়। এসব বৈঠকের আলোচনা সম্পর্কে সদস্যরা কোনো কিছু প্রকাশ না করার প্রতিশ্রুতিতে অটল থাকেন। প্রতিটি বৈঠকে সব সদস্যের যোগদান বাধ্যতামূলক ছিল। দুই-তৃতীয়াংশের ভোটে সিদ্ধান্ত অনুমোদন করা হয়। সমানসংখ্যক ভোটের ক্ষেত্রে কমিশনের প্রধান ভোট দিতে পারবেন। তিনি হলেন সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ আব্দুল আজিজের পৌত্রদের মধ্যে সবচেয়ে বড়। এর উপপ্রধান হলেন দ্বিতীয় বয়োজ্যেষ্ঠ পুতাছেলে।
বাদশাহর মৃত্যুর পর কমিশন যুবরাজের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কাজটি সুসম্পন্ন করে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন বাদশাহর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘোষণা প্রদান করেন।
যুবরাজ নিয়োগের বিষয়টি একান্তভাবেই বাদশাহর নিজস্ব পছন্দের বিষয়, তবে তিনি ইচ্ছা করলে এ ক্ষেত্রে কমিশনের পরামর্শ নিতে পারেন। তিনি তা পছন্দের তিন ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করতে পারেন, কমিশন তাদের তিনজনকেই প্রত্যাখ্যান করলে তারা একজন প্রার্থীর নাম প্রস্তাব করতে পারেন। বাদশাহ যদি তাকে প্রত্যাখ্যান করেন তাহলে সদস্যরা সব প্রার্থীর ওপর ভোটে দেবেন এবং যিনি সর্বাধিক ভোট পাবেন তিনিই যুবরাজ হিসেবে নিয়োগ পাবেন।
বাদশাহ আব্দুল আজিজের ছেলেদের সবাই অনেক বয়স্ক এবং নানা ধরনের রোগাক্রান্ত হওয়ায় কমিশন তাদের নিয়োগের ক্ষেত্রে কিছু স্বাস্থ্যগত মানদণ্ড নির্ধারণ করেছেন। বাদশাহ যদি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন অথবা বাদশাহ ও যুবরাজ উভয়েই একই সময়ে মারা যান সে ক্ষেত্রে ক্ষমতার বিষয়টি অস্থায়ী কমিশনের কাছে ন্যস্ত করা হবে। তারা এক সপ্তাহের মধ্যে আব্দুল আজিজের সন্তানদের মধ্য থেকে একজনকে বাদশাহ হিসেবে মনোনীত করবে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে সরকারের নিয়ন্ত্রণ স্থিতিশীলতা বিধান করা এবং অভ্যন্তরীণ জরুরি পরিস্থিতি সামাল দেয়া।
সৌদি আরববিষয়ক অনেক বিশেষজ্ঞ ও পর্যবেক্ষক মনে করেন যে, কমিশন দেশটির পরিস্থিতিকে সহজ করার পরিবর্তে জটিল করে তুলছে। কারণ তারা নিজেরাই ক্ষমতার দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক ব্লক গঠনকে উৎসাহিত করে এবং ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট সঙ্কট নিরসনে অসমর্থ হয়।
আল সউদ সরকার উত্তরাধিকার কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে এবং তাতে পরিবারের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা পরিলক্ষিত হয়। এর শীর্ষে রয়েছেন বাদশাহর ভাইয়েরা, এরপর তাদের ছেলেরা, এরপর পরিবারের অন্য সদস্যরা। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর পদগুলো বণ্টনে এক অন্যন্য নিয়ম মেনে চলা হয়। রাষ্ট্রের সম্পদ ও প্রতিটি চুক্তির থেকে প্রাপ্ত অর্থ ও ভাতা তাদের মধ্যে বিলিবণ্টন করা হয়। বাদশাহ আব্দুল আজিজের ৩৭টি ছেলের সবাই সমমর্যাদার অধিকারী এবং তাদের বয়সও কাছাকাছি। তাদের সবাই সিংহাসন অথবা অন্তত সিনিয়র গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়ার আশা করেন।
আব্দুল আজিজের দ্বিতীয় প্রজন্ম পৌত্ররা সিংহাসন ও ক্ষমতার লড়াইয়ের বাইরে রয়ে গেছেন। গত কয়েক দশক ধরে তারা ক্ষমতার বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। এতে তারা সম্পদ পুঞ্জীভূত করার কাজেই বেশি মনোযোগ দিতে পেরেছেন। অনেক বিশেষজ্ঞ, রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষক অবশ্য এর সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তারা মনে করেন, তরুণ প্রিন্সদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব পরে ক্ষমতা হস্তান্তর বেশ জটিল করে তুলতে পারে। আরেক দল মনে করেন, সৌদি আরবের রাজনৈতিক অবস্থা বেশ স্থিতিশীল এবং ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। সংবিধানের পঞ্চম ধারায় বলা হয়েছে, সৌদি আরব হচ্ছে নিরঙ্কুশ রাজতান্ত্রিক দেশ। প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহর ছেলেরা ও তাদের ছেলেরা বংশপরম্পরায় দেশ শাসন করবেন। কুরআন ও সুন্নাহর আদর্শের প্রতি তারা অনুগত থাকবেন।
সবচেয়ে ক্ষমতাধর ৩ জন
বাদশাহ আবদুল্লাহর মৃত্যুর পর নতুন বাদশাহ হয়েছেন সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সউদ। এ ছাড়া একই সাথে প্রিন্স মুকরীম যুবরাজ এবং প্রিন্স মোহাম্মদ বিন নায়েফকে উপযুবরাজ নিয়োগ দেয়া হয়েছে। রাজপরিবারের এই নতুন তিন উত্তরাধিকারী হচ্ছেন দেশটির সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি।
সূত্র : দ্য টেলিগ্রাফ
source : নয়াদিগন্ত