আবনা : ব্রিটিশ পার্লামেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত তিন সাহসী কন্যা রুশনারা আলী, টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক ও রূপা আশা হক। এর মধ্যে প্রথমবারের মতো ব্রিটেনে এমপি নির্বাচিত হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনি, শেখ রেহানার মেয়ে ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি টিউলিপ। রুশনারা আলী পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। আর লেবারদের হারানো আসন পুনরুদ্ধার করেছেন ড. রূপা হক।
এবারের নির্বাচনে যুক্তরাজ্যের প্রধান তিনটি দল থেকে মোট ১১ বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত প্রার্থী এমপি পদে লড়েছেন। তাদের মধ্যে লেবার পার্টি থেকে সাতজন, লিবারেল ডেমোক্র্যাটস পার্টি থেকে তিনজন ও কনজারভেটিভ পার্টি থেকে একজন মনোনয়ন পেয়েছেন। তবে জয়ী তিনজনই লেবার পার্টি থেকে লড়েছিলেন।
সিলেটি কন্যা রুশনারা আলী : ২৪ হাজার ভোটের বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশের সিলেটের মেয়ে রুশনারা আলী। যুক্তরাজ্যের বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বো আসনে লেবার পার্টির প্রার্থী রুশনারা পেয়েছেন ৩২ হাজার ৩৮৭ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ পার্টির ম্যাথু স্মিথ পেয়েছেন মাত্র ৮ হাজার ৭০ ভোট। বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বো আসনের ৮০ হাজার ভোটারের ৬৩.৯ শতাংশ এবার ভোট দিয়েছেন। বাঙালি অধ্যুষিত এ এলাকার ভোটাররা যে রুশনারাকেই আবারও পার্লামেন্টে পাঠাবে তা একরকম নিশ্চিতই ছিল।
গত নির্বাচনে সাড়ে ১১ হাজার ভোটে জয়ী রুশনারা এবার ব্যবধান দ্বিগুণ করলেন। সমর্থকদের আশা ছিল, লেবার পার্টি ক্ষমতায় গেলে রুশনারা হবেন মন্ত্রী। নির্বাচনে তিনি দাপটের সঙ্গে জিতলেও তার দলের জয়ের আশা ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে। বুথফেরত জরিপে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি স্পষ্টই এগিয়ে আছে।
সিলেটের বিশ্বনাথে ১৯৭৫ সালে জন্ম নেয়া রুশনারা মাত্র সাত বছর বয়সে বাবা-মার সঙ্গে লন্ডনে পাড়ি জমান। ২০১০ সালে প্রথম বাঙালি হিসেবে তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন। ৪০ বছর বয়সী এ পার্লামেন্টারিয়ান লেবার পার্টির হয়ে শিক্ষা ও আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়ক শ্যাডো মিনিস্টারের দায়িত্বে ছিলেন। সেপ্টেম্বরে ইরাকে সামরিক হামলায় সংসদে লেবার পার্টি সমর্থন দেয়ায় রুশনারা শ্যাডো মিনিস্টারের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এছাড়া পার্লামেন্টারি ট্রেজারি সিলেক্ট কমিটির সদস্য হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ডিগ্রিধারী রুশনারা পরামর্শক সংস্থা ইয়ং ফাউন্ডেশনের একজন সহযোগী পরিচালক। আপরাইজিং নামের একটি দাতব্য সংগঠনেরও নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি।
বঙ্গবন্ধুর নাতনি টিউলিপ : যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে চমক দেখিয়ে প্রথমবার নির্বাচনে দাঁড়িয়ে সহজেই এমপি নির্বাচিত হয়েছেন ৩২ বছর বয়সী টিউলিপ সিদ্দিক। যিনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি। লেবার পার্টির টিউলিপ লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড কিলবার্ন আসনের প্রতিনিধিত্ব করবেন।
গত নির্বাচনের ফল এবং এবারের ভোটের প্রচারের শুরু থেকেই প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস থাকায় ব্রিটিশ গণমাধ্যমের নজর ছিল হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড কিলবার্ন আসনের দিকে। বৃহস্পতিবার দিনভর ভোটাভুটি শেষে অধিকাংশ আসন থেকে লেবার প্রার্থীদের পরাজয়ের খবর আসতে থাকলেও ১১৩৮ ভোটে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির প্রার্থীকে পরাজিত করেন টিউলিপ।
টিউলিপ ২৩ হাজার ৯৭৭ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ পার্টির প্রার্থী সায়মন মার্কাস পেয়েছেন ২২ হাজার ৮৩৯ ভোট। লিবারেল ডেমোক্র্যাটস পার্টির মাজিদ নাওয়াজ তিন হাজার ৩৯ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছেন। এ আসনে এবার ভোট পড়েছে ৬৭.৩ শতাংশ।
ফল ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় টিউলিপ বলেন, ‘আপনারা যারা আমাকে চেনেন, তারা জানেন যে কঠিন এ কাজের মাত্র শুরু হল।’ মা শেখ রেহানা, স্বামী ক্রিস পার্সি, ভাই রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক, বোন রূপন্তী, রাজনীতিক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী ও সমর্থকদের সঙ্গে নিয়ে সারা রাত গণনা কেন্দ্রেই ছিলেন তিনি। সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে টিউলিপ বলেন, ‘মা, ভাইয়া, রূপী, আম্মুজি... আনোয়ার মামা আর আমার স্বামী... পাঁচ মাস তারা অনেক খেটেছেন।’
এদিকে টিউলিপ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এমপি নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে দুই দেশের পার্লামেন্টে একই পরিবারের সদস্য থাকার ‘নজির’ তৈরি হল বলে মন্তব্য করেছেন তার মা শেখ রেহানা। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আমার জীবনে আমার বাবা সংসদে ছিলেন; আমার বোন, এখন আমার মেয়ে। এর থেকে গর্ব আর কি হতে পারে।’ টিউলিপের মা হিসেবে পরিচয়ে নতুন করে ‘গর্বিত’ হয়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি গর্বিত পিতার সন্তান, গর্বিত বোনের ছোট বোন আর এখন আমার টিউলিপের মা।’
শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট মেয়ে শেখ রেহানা ও শফিক সিদ্দিকীর মেয়ে টিউলিপ লন্ডনের মিচামে জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশব কেটেছে বাংলাদেশ, ভারত এবং সিঙ্গাপুরে। ১৫ বছর বয়স থেকে তিনি হ্যাম্পস্ট্যাড অ্যান্ড কিলবার্নে বসবাস করছেন। এ এলাকায় স্কুলে পড়েছেন ও কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। লন্ডনের কিংস কলেজ থেকে পলিটিক্স, পলিসি ও গভর্মেন্ট বিষয়ে তার স্নাতকোত্তর ডিগ্রি রয়েছে। মাত্র ১৬ বছর বয়সে লেবার পার্টির সদস্য হওয়া টিউলিপ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গ্রেটার লন্ডন অথরিটি এবং সেইভ দ্য চিলড্রেনের সঙ্গেও কাজ করেছেন। ২০১০ সালে ক্যামডেন কাউন্সিলে প্রথম বাঙালি নারী কাউন্সিলর নির্বাচিত হন তিনি।
পাবনার মেয়ে রূপা আশা হক : হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর ২৭৪ ভোটের ব্যবধানে যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট নির্বাচনে জয় পেয়েছেন রূপা আশা হক। রূপার আদি বাড়ি বাংলাদেশের পাবনায়। ৪৩ বছর বয়সী রূপা ব্রিটিশ পার্লামেন্টে উত্তর-পশ্চিম লন্ডনের ইলিং সেন্ট্রাল অ্যান্ড অ্যাকটন আসনের প্রতিনিধিত্ব করবেন। নির্বাচনে লেবার পার্টির প্রার্থী রূপা পেয়েছেন ২২ হাজার ২ ভোট। আর ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির প্রার্থী এনজি ব্রে পেয়েছেন ২১ হাজার ৭০১ ভোট।
এ আসনে এবার ভোট পড়েছে ৭১ শতাংশ। লেবার পার্টির জন্য এ আসনটি পুনরুদ্ধার করার পথে রূপা হক পেয়েছেন ৪৩.২ শতাংশ ভোট। প্রায় ৭০ হাজার ভোটারের এ আসনে ২০১০ সালের নির্বাচনে লেবার প্রার্থীকে হারতে হয়েছিল ৩ হাজার ৭১৬ ভোটের ব্যবধানে। সেই ফল উল্টে দেয়ার কঠিন কাজটিই করেছেন ড. রূপা।
রূপ হক কেমব্রিজে পড়েছেন রাজনীতি, সামাজিক বিজ্ঞান ও আইন। আর কিংস্টন ইউনিভার্সিটিতে এতদিন পড়িয়েছেন সমাজ বিজ্ঞান, অপরাধ বিজ্ঞান, গণমাধ্যম ও সংস্কৃতি অধ্যয়নের মতো বিষয়। এর আগে ডেপুটি মেয়র হিসেবে স্থানীয় সরকারেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ১৯৭২ সালে ইলিংয়ে জন্ম নেয়া রূপা হক ১৯৯১ সালে লেবার পার্টির সদস্য হন। তিনি একাধারে লেখক, মিউজিক ডিজে, কলামনিস্ট হিসেবে পরিচিত। আর তার ছোট বোন কনি হক বিবিসির ব্লু পিটার শো উপস্থাপনার কল্যাণে ব্রিটিশদের কাছে খুবই পরিচিত মুখ। এর আগে ২০০৫ সালের নির্বাচনে চেশাম ও এমারশাম আসন থেকে লেবার পার্টির মনোনয়ন পেলেও নির্বাচিত হতে পারেননি রূপা। এছাড়া ২০০৪ সালে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে নির্বাচনেও প্রার্থী হয়েছিলেন তিনি।
গোপালগঞ্জে আনন্দের বন্যা : গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, টিউলিপ সিদ্দিকী গ্রেট ব্রিটেনের পার্লামেন্ট মেম্বার নির্বাচিত হওয়ায় গোপালগঞ্জ ও টুঙ্গিপাড়ায় আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে আনন্দের বন্যা বইছে। ভোটে জয়ী হওয়ার খবর পেয়ে এসব নেতাকর্মী আনন্দ উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে। এক অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করে আনন্দ প্রকাশ করে। বিতরণ করা হয় মিষ্টি-মণ্ডাই।
source : abna