আবনা ডেস্ক : মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) হাত থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন বিজিবির নায়েক আব্দুর রাজ্জাক। তার ফিরে আসার আগে আমরা এ বিষয় নিয়ে কথা বলেছিলাম বিডিআর (বর্তমান বিজিবি)'র সাবেক ডিজি মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমানের সঙ্গে।
তিনি রেডিও তেহরানের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে বললেন, নায়েক রাজ্জাককে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় আমাদের জন্য বার্তা হচ্ছে তারা বাংলাদেশকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছে। আমাদের শক্তি নিয়ে তারা একধরণের উপহাস করছে। ভবিষ্যতে এ ধরণের ঘটনা ঘটলে তার জবাব দিতে হবে যেভাবে আমরা দুই হাজার সালে দিয়েছিলাম।
তিনি বলেন, নায়েক রাজ্জাকের ঘটনার বার্তায় তারা আমাদের জানাচ্ছে যে- মিয়ানমার আমাদের প্রতিবেশী হলেও তারা বন্ধু রাষ্ট্র নয়; তারা আমাদের শক্র। রাজ্জাকের ঘটনায় তারা শালীনতা অতিক্রম করেছে। ঘটনাটি গোটা জাতির জন্য অপমানজনক। ভবিষ্যতে এধরণের ঘটনা ঘটলে তার মোকাবেলা করতে হবে।
ফজলুর রহমান আরো বলেন, আমরা মিয়ানমারকে দুই হাজার সালে যে শিক্ষা দিয়েছিলাম নাফ নদীতে বাঁধ দেয়া নিয়ে রাজ্জাকের ঘটনাটি হতে পারে তারই প্রতিশোধ নেয়ার একটা চেষ্টা। ফলে মিয়ানমারের ব্যাপারে আমাদের আরো সতর্ক হতে হবে।
পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।
রেডিও তেহরান: বিজিবি সদস্য নায়েক আব্দুর রাজ্জাককে ধরে নিয়ে গেছে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি। ধরে নিয়ে যাওয়ার বেশ কয়েকদিন পর তারা শর্তসাপেক্ষে পতাকা বৈঠক করতে রাজি হয়েছে। কীভাবে দেখছেন ঘটনাটিকে?
আ ল ম ফজলুর রহমান: বিজিবির নায়েক আব্দুর রাজ্জাককে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)'র ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে আমি খুবই উদ্বেগের সাথে দেখছি। শুধু তাই নয় নায়েক রাজ্জাককে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর মিয়ানবার বারবার তার অবস্থান পরিবর্তন করেছে।
প্রথমে তারা বললো যে, রাজ্জাককে ফেরৎ দেয়ার শর্ত হিসেবে বানভাসী যে ৫৫৫ জন বাংলাদেশিকে তারা উদ্ধার করেছে; তাদেরকে ফেরৎ নিতে হবে। তার আগে অবশ্য বিজিবির পক্ষ থেকে আমাদের অবস্থানের কথা মিয়ানমারকে জানানো হয়েছিল। আর এই জানানোর পর মিয়ানমার যে বক্তব্য দিয়েছিল সেটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।
মিয়ানমার বলেছিল অনুপ্রবেশকারী হিসেবে নায়েক রাজ্জাকের বিচার হবে শাস্তি হবে তারপর তাকে ফেরৎ দেয়া হবে।
এরপর দেখলাম বিজিবির মহাপরিচালক বললেন, বিনা শর্তে নায়েক রাজ্জাককে মুক্ত করা হবে। এ প্রসঙ্গে প্রথমে বলা হয়েছিল ৫ জনের একটি টিম মিয়ানমারে মংডুতে যাবে তারপর বিজিপির সাথে আলোচনা মাধ্যমে এটার সমাধান করা হবে।
এরপর মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে বললো যে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে নায়েক রাজ্জাককে হস্তান্তর করা হবে। আর উভয় পক্ষের মধ্যে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে হস্তান্তর করাটাই হচ্ছে আসল নিয়ম। কিন্তু এর আগে মিয়ানমার যে তালবাহনা করে সময়টা নিল সেটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। মিয়ানমারের এই সময় ক্ষেপণের ব্যাপারটাতে মনে হয় তারা এক ধরণের লুকোচুরি খেলা খেলেছে। তবে এর কূটনৈতিক বিষয়টি আমাদের খুব সিরিয়াসলি নেয়া উচিত ছিল। কারণ একটি প্রতিবেশী দেশ আমাদের সাথে এ ধরণের ব্যবহার করতে পারে না।
রেডিও তেহরান: বিজিবি সদস্যকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন- এটা নিতান্তই ভুল বোঝাবুঝি। কিন্তু পরে দেখা গেল ব্যাপারটি মোটেই তা নয়। মন্ত্রী কেন চটজলদি ওই মন্তব্য করেছেন? কী মনে হয় আপনার?
আ ল ম ফজলুর রহমান: আমার মনে হয়েছে বোধহয় স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী বিষয়টিকে গভীরভাবে নেননি। তিনি মনে করলেন-তারা বলছে অনুপ্রবেশ আর আমরা বলছি যে আমাদের জলসীমায় আমরা ছিলাম। এ ধরণের একটা ভুল বোঝাবুঝির কারণে হয়তো তারা নায়েক রাজ্জাককে ধরে নিয়ে গেছে। পতাকা বৈঠকের পর হয়তো তারা নায়েক রাজ্জাককে আমাদের কাছে হস্তান্তর করবে। এখানে উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কিছু নেই। উনি হয়তো একটা সাধারণ ধারণা থেকে এধরণের মন্তব্য করেছেন।
আবার এমনও হতে পারে যে বিজিবির পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রীকে হয়তো ব্রিফ করা হয়েছিল যে ঘটনাটি খুবই স্বাভাবিক। মাঝে মাঝে এধরণের ঘটনা ঘটতেই পারে। তবে খুব শিগগিরি এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এ দুটো বিষয়ের ওপর ভিত্তি করেই উনি হয়তো একটা ভাসাভাসা মন্তব্য করেছেন। কিন্তু পরে যখন দেখা গেল বিষয়টি হালকা কিছু নয়; মিয়ানমার বিষয়টিকে খুবই গুরুত্বের সাথে নিয়েছে এবং বিজিবির পক্ষ থেকে যখন উদ্বিগ্ন হওয়ার কথা জানানো হলো তখন আর বিষয়টি ভুল বুঝাবুঝির পর্যায়ে থাকেনি। তারপর যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সেটা আপনারাও জানেন আমরাও জানি।
রেডিও তেহরান: বিজিবি সদস্য আব্দুর রাজ্জাককে মুক্ত করার বিষয়ে সরকারের যে উদ্যোগ তা কী যথেষ্ট বলে মনে হয়? নাকি আরো কিছু করণীয় রয়েছে?
আ ল ম ফজলুর রহমান: আব্দুর রাজ্জাককে মুক্ত করার ক্ষেত্রে যে পথ আছে বলে আমি মনে করি সেটা হচ্ছে বিজিবির পক্ষ থেকে তৎপর হওয়া। তবে তারা যেটুকু তৎপর হয়েছিল তা খুব একটা কাজে দেয়নি। কেন কাজে দেয়নি সেটা ভিন্ন একটা বিষয় হয়তো অন্য কোনো সময় বিষয়টি নিয়ে আমি আলোচনা করব। কিন্তু সরকার যখন দেখল যে বিজিবির তৎপরতায় রাজ্জাককে মুক্ত করা যাচ্ছে না তখনই মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডাকা হয়েছিল এবং বিষয়টি তাকে অবহিত করা হয়েছে। একইসাথে মিয়ানমারের জবাবও সরকার পেয়েছে। তারপরপরই আমরা দেখলাম যে খুব দ্রুত পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকল। তারা তখন বললো যে একটি কমিটি গঠিত হবে এবং তারা সেখানে যাবে ও আলোচনার ভিত্তিতে রাজ্জাককে মুক্ত করে দেয়া হবে। তো বারবার মিয়ানমারের অবস্থান পরিবর্তন নিয়ে আমার ধারণা হয়েছে যে, সরকার যথেস্ট ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে।
রেডিও তেহরান: সীমান্ত থেকে বিজিবি সদস্য অপহৃত হওয়ার ঘটনায় সমগ্র জাতি লজ্জিত হয়েছে বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন। বিএনপিসহ অনেকে বলেছেন, বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। এ অভিযোগ কতটা সত্য?
আ ল ম ফজলুর রহমান: দেখুন বিষয়টি একেবারে দিনের মতো পরিষ্কার যে বিজিবির একজন নায়েক পদবীর সদস্যকে মিয়ানমারের সীমান্ত পুলিশ বিজিপি সদস্যরা আমাদের জলসীমায় অনুপ্রবেশ করে ধরে নিয়ে গেল। এরপর তারা ফেসবুক, সোশ্যাল মিডিয়াসহ তাদের মিডিয়াতে হ্যান্ডকাপ পরা এবং লুঙ্গি পরা অবস্থায় রাজ্জাকের ছবি প্রকাশ করল। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে তাকে এমন নির্যাতন করা হয়েছে যে নাক দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। অন্য একটা ছবিতে দেখা গেল রাজ্জাকের সমস্ত জিনিষপত্র অর্থাৎ গোলা-বরুদসহ সবকিছু সামনে সাজিয়ে রেখে তাকে পিছনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। এসব ঘটনার পর তাকে নিয়ে আমরা ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন হয়েছিলাম একইসাথে চিন্তিতও ছিলাম।
এধরণের বিষয় হওয়ার কথা নয়। একটি প্রতিবেশী দেশ তার প্রতিবেশী দেশের সৈনিকের ওপর এধরণের আচরণ করতে পারে না। রাজ্জাকের ওপর এধরণের নির্যাতন চালিয়ে মিয়ানমার আমাদেরকে যে বার্তাটা দিয়েছে সেটা হচ্ছে তারা আমাদের প্রতিবেশী হতে পারে তবে আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র নয় এই মুহূর্তে। মিয়ানমারের আচরণ শালীনতা ছাড়িয়ে গেছে। তাদের আচরণ পুরোপুরি শক্রতামূলক বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। আর তাদের এই বার্তাটা গোটা জাতির জন্য লজ্জা ও অপমানজনক। আর এ বিষয়ে আমাদের জাতীয় সংসদে মাননীয় সংসদ সদস্যগণ যে আলোচনা করেছেন সেজন্য আমি তাদেরকে স্বাগত জানাই। তারা এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জাতিকে অবহিত করেছেন।
আর মিয়ানমার সম্পর্কে ভবিষ্যতে আমাদেরকে আরো সতর্ক হতে হবে। তাদের সম্পর্কে আমাদের সন্দেহমুক্ত হওয়া যাবে না। ভবিষ্যতে যখন মিয়ানমারের সাথে এ ধরনের বিষয় নিয়ে ড্রিল করব তখন অসম্ভব দৃঢ়তার সাথে পশ্চাৎশক্তিসহ এগিয়ে যেতে হবে। কোনো কিছুই হালাকভাবে নিলে চলবে না।
রেডিও তেহরান: মিয়ানমার সীমান্তে মাঝেমধ্যেই এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে। এমন ঘটনা এড়ানোর জন্য কি করা উচিত বলে আপনি মনে করেন?
আ ল ম ফজলুর রহমান: দেখুন মিয়ানমারের ঘটনা সত্যি দুঃখজনক। এ ব্যাপারে আমাদের কঠোর হতে হবে। তবে দেশের ভেতের কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা প্রসঙ্গে পুলিশ যে উক্তি করেছে তা দেশের মানুষের জন্যে করেছে। তবে অস্ত্র খেলা করার জন্য নয় বলে পুলিশের পক্ষ থেকে যেকথা বলা হয়েছে সেটাকে আমি ঠিকভাবে নেইনি। তাদের এ ধরণের উক্তি অবাঞ্ছিত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত। কারণ হচ্ছে দেশের পুলিশ বাহিনী দেশের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দেবে তাদেরকে আশার বাণী শুনাবে। কিন্তু তারা যে বাণী শুনিয়েছে তা অনাকঙ্ক্ষিত এবং অনভিপ্রেত। এ বিষয়ে অবশ্য সরকার বুঝবেন। দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন এধরণের উক্তি করেন তা কিভাবে নেয়া উচিত।
আর মিয়ানমারের বিষয়টি সম্পর্কে বলতে চাই, বারবার এধরণের ঘটনা মিয়ামারের পক্ষ থেকে ঘটানো হচ্ছে। আর তারই ষোলকলা পূর্ণ হলো নায়েক রাজ্জাকের ঘটনার মধ্যে দিয়ে।
তো এঘটনার মধ্যে দিয় মিয়ানমার আমাদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছে। আমাদের শক্তি নিয়ে তারা একধরণের উপহাস করছে।
তবে আমরা দুই হাজার সালে মিয়ানমারকে পরাজিত করেছিলাম। তাদের একজন নেভি এবং একজন সেনাবাহিনীর দুইজন মেজর জেনারেলের অধীনে দুই ডিভশন সৈন্যের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ করেছিলাম। ঘটনাটি ছিল তারা নাফ নদীতে বাঁধ দিচ্ছিল এবং আমাদের প্রায় আটাশ শ' একর জমি তারা দখল করে নিয়েছিল। আমি তখন বিডিআরের ডিজি ছিলাম। মিয়ানমারের সেই কাজের বিরুদ্ধে আমি আমার আড়াই হাজার সৈন্য যুদ্ধ ক্ষেত্রে পাঠাই। সাড়ে বারো লাখ গোলাবারুদ সৈন্যদের সাথে ছিল। আরো সাড়ে বারো লাখ গোলাবারুদ মজুদ করে রাখি। পুরো কমান্ড আমার হাতে ছিল। সেখানে তিনদিন পুরো যুদ্ধ চলে। মোট ৬ দিন উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিরাজ করেছিল। সেই যুদ্ধে আমাদের হাতে মিয়ানমারের ছয়শ' সৈন্য মারা যায়।
এরপর মিয়ানমার আমাদেরকে একটি চিঠি দেয়। চিঠির ভাষাটা ইংরেজিতে এমন ছিল- We invite a delegation from Bangladesh to discuss on outstanding matter between two countries without any pre-condition.
তারা তখন পরাজয় মেনে নেয়। তৎকালীন তাদের শান্তি-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান লি থান সুই সব কূটনীতিক ডেকে বলেছিলেন আমরা আর কোনো যুদ্ধ চাই না। তখন আমরা মিয়ানমারকে একটা শিক্ষা দিয়েছিলাম। এই রাজ্জাকের ঘটনাটি হতে পারে তারই প্রতিশোধ নেয়ার একটা চেষ্টা।
আমি বলব যে ২০০৯ সালে বিজিবির যে দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে তারপরও এই বাহিনীর ক্ষমতা খর্ব হয়নি। আমাদের বাহিনী ঠিকই আছে। শুধু এই বাহিনীর মনোবল চাঙ্গা করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিজিবি প্রধানের পক্ষ থেকে তাদেরকে একটা আশ্বাস দিতে হবে যে আমাদের পক্ষ থেকে যা কিছু করণীয় তা আমরা করব। মিয়ানমার যতবড় শক্তিই হোক না কেন দরকার হলে আমরা তাদের মোকাবেলা করব। যেমনটি আমরা দুই হাজার সালে করেছিলাম।
এ ধরণের আশ্বাসবাণী সরকার ও বাহিনী প্রধানের তরফ থেকে অবশ্যই দিতে হবে এবং জনগণকে এ আশ্বাস দিতে হবে মিয়ানমার যাকিছু করুক না কেন ভবিষ্যতে এরকম কিছু করলে আমরা গোটা জাতি একতাবদ্ধ হয়ে আমাদের বাহিনীর পেছনে থাকব এবং মিয়ামানের বিপক্ষে যা কিছু করণীয় আমরা তা করব। এই ধরণের আশ্বাস আমি সরকার এবং বাহিনী প্রধানের পক্ষ থেকে আশা করি।#
source : abna