বাঙ্গালী
Thursday 18th of April 2024
0
نفر 0

জান্নাতুল বাকিতে ওয়াহাবি দখলদারদের বর্বরতা ইহুদিবাদী চরিত্রের প্রকাশ

আবনা ডেস্ক : ৮ ই শাওয়াল ইসলামের ইতিহাসের এক শোকাবহ দিন। আজ থেকে ৯২ চন্দ্র বছর আগে এই দিনে ওয়াহাবি ধর্মদ্রোহীরা পবিত্র মক্কা ও মদিনায় ক্ষমার অযোগ্য কিছু পাপাচার ও বর্বরতায় লিপ্ত হয়েছিল। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা যখন পবিত্র জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র দ্বিতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ নিষ্পাপ উত্তরসূরির পবিত্র মাজার জিয়ারত করছিলেন ত
জান্নাতুল বাকিতে ওয়াহাবি দখলদারদের বর্বরতা ইহুদিবাদী চরিত্রের প্রকাশ

আবনা ডেস্ক : ৮ ই শাওয়াল  ইসলামের ইতিহাসের এক শোকাবহ দিন। আজ থেকে ৯২ চন্দ্র বছর আগে এই দিনে ওয়াহাবি ধর্মদ্রোহীরা পবিত্র মক্কা ও মদিনায় ক্ষমার অযোগ্য কিছু পাপাচার ও বর্বরতায় লিপ্ত হয়েছিল। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা যখন পবিত্র জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র দ্বিতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ নিষ্পাপ উত্তরসূরির পবিত্র মাজার জিয়ারত করছিলেন তখন ওয়াহাবি দুর্বৃত্তরা সেখানে ভাঙ্গচুর ও লুটপাট অভিযান চালায় এবং ওই নিষ্পাপ ইমামদের পবিত্র মাজারের সুদৃশ্য স্থাপনা ও গম্বুজগুলো মাটির সঙ্গে গুড়িয়ে দেয়।
এরপর বর্বর ও ধর্মান্ধ ওয়াহাবিরা আরো কয়েকটি পবিত্র মাজারের অবমাননা করে এবং এইসব মাজারের গম্বুজ ও  স্থাপনাগুলো ভেঙ্গে-চুরে ইসলাম অবমাননার ন্যক্কারজনক তাণ্ডব চালায়। এইসব মাজার ছিল বিশ্বনবী (সা.)'র  ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন,সাহাবি, স্ত্রী, বংশধর ও খ্যাতনামা আলেমদের।
তৎকালীন পত্র-পত্রিকার খবর থেকে জানা যায়, সৌদি রাজা আবদুল আজিজ জান্নাতুল বাকিতে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছিলেন। কিন্তু এটা যে লোক-দেখানো বিবৃতি ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, তিনি এইসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত কাউকে শাস্তি দেননি বা কাউকে গ্রেফতার কিংবা এ বিষয়ে তদন্ত করারও নির্দেশ দিয়েছেন বলে শোনা যায়নি। আসলে একজন ওয়াহাবি রাজা ওয়াহাবিদের সুপরিকল্পিত অপরাধযজ্ঞের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবেন-এটা ভাবাই যায় না।
জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে এসে বিশ্বনবী (সা.) বলতেন, “ তোমাদের ওপর সালাম! হে বিশ্বাসীদের আবাসস্থল! আল্লাহ চাইলে আমরাও শিগগিরই তোমাদের সঙ্গে মিলিত হব। হে আল্লাহ, আল-বাকির (জান্নাতুল বাকি কবরস্থানের) অধিবাসীদের ক্ষমা করুন।”
সুন্নি ও শিয়া সূত্রে বর্ণিত হাদিস অনুযায়ী বিশ্বনবী  হযরত মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর সাহাবায়ে কেরাম ও আত্মীয়-স্বজনদের কবরে সালাম দিতেন।
বিশ্বনবী (সা.) কবর জিয়ারতের সুন্নাতকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দান করেছিলেন। সম্ভবত এর অন্যতম কারণ এটাও ছিল যে এর মাধ্যমে তিনি মুসলমানদের মধ্যে বিভেদকামী এই ওয়াহাবি-সালাফি গোষ্ঠীর মুনাফেকি বা কপট চরিত্র উন্মোচন করবেন। এই সুন্নাতের মাধ্যমে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এটা স্পষ্ট করেন যে, একটি গতিশীল ইসলামী সমাজ সবসময় তার মৃত ব্যক্তিদের স্মরণ করে যেই মৃত ব্যক্তিরা মৃত্যুর পরেও খোদায়ী রহমত পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। অন্যদিকে শহীদদের অবস্থা আরো উন্নত। স্বয়ং মহান আল্লাহ বলেছেন,
 ‘যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়েছে তাদের তোমরা মৃত ভেবো না, বরং তারা জীবিত এবং তাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে জীবিকা-প্রাপ্ত।’ (সুরা আলে ইমরান-১৬৯)
অন্য একটি আয়াত হতে জানা যায় এই বিশেষ জীবন (বারজাখের জীবন) শুধু শহীদদের জন্যই নয়, বরং আল্লাহর সকল অনুগত ও সৎকর্মশীল বান্দার জন্য নির্ধারিত।
মহান আল্লাহ্ বলেছেন :
 ‘যারা আল্লাহ্ ও তাঁর প্রেরিত পুরুষের আনুগত্য করবে তারা সেই সব ব্যক্তির সঙ্গে থাকবে নবীগণ, সত্যবাদিগণ, শহীদগণ ও সৎকর্মশীলদের মধ্য হতে যাদের তিনি নিয়ামত দিয়েছেন। তারা কতই না উত্তম সঙ্গী!’ (সুরা নিসা-৬৯)
বিশ্বনবী (সা.)’র জন্য এটা কতই না হৃদয় বিদারক যে তাঁর প্রিয় আহলে বাইত, সাহাবি ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনের মাজারগুলো গুড়িয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে! জান্নাতুল বাকি কোনো সাধারণ কবরস্থান নয়। এখানে রয়েছে অন্তত সাত হাজার সাহাবির কবর। এখানে রয়েছে বিশ্বনবী (সা.)’র ফুপি বা পিতার বোন হযরত সাফিয়া ও আতিকার কবর। এখানেই রয়েছে বিশ্বনবী (সা.)’র শিশু পুত্র হযরত ইব্রাহিম (তাঁর ওপর অশেষ শান্তি বর্ষিত হোক)-এর কবর। এই পুত্রের মৃত্যুর সময় বিশ্বনবী (সা.) অশ্রু-সজল চোখে বলেছিলেন, “চোখগুলো থেকে পানি ঝরছে এবং হৃদয় শোকাহত, কিন্তু আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি উদ্রেককারী কথা ছাড়া অন্য কিছুই বলব না। আমরা তোমার জন্য শোকাহত হে ইব্রাহিম!”
জান্নাতুল বাকি হচ্ছে সে স্থান যেখানে সমাহিত হয়েছেন বিশ্বনবী (সা.)’র চাচা হযরত আবু তালিব (রা.)’র স্ত্রী ফাতিমা বিনতে আসাদ (সালামুল্লাহি আলাইহা)। এই মহীয়সী নারী বিশ্বনবী (সা.)-কে লালন করেছিলেন নিজ সন্তানের মত স্নেহ দিয়ে এবং তাঁকে কবরে রাখার আগে বিশ্বনবী (সা.) এই মহান নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য নিজেই ওই কবরে কিছুক্ষণ শুয়েছিলেন। রাসূল (সা.) তার জন্য তালকিন উচ্চারণ করেছিলেন শোকার্ত কণ্ঠে।  
জান্নাতুল বাকি হচ্ছে সেই কবরস্থান যেখানে বেহেশতী নারীদের সর্দার তথা খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতিমা (সা.) বিশ্বনবী (সা.)’র ইন্তিকালের পর যে ৯০ দিন নিজে বেঁচে ছিলেন প্রায়ই সেখানে গিয়েই শোক প্রকাশ করতেন। যেখানে বসে তিনি শোক প্রকাশ করতেন সেই স্থানটিকে বল হল বাইতুল হুজন বা শোক প্রকাশের ঘর। একই স্থানে কারবালার শোকাবহ ঘটনার পর  বিশ্বনবী (সা.)’র নাতি শহীদদের নেতা ইমাম হুসাইন (আ.) ও নিজের পুত্র হযরত আবুল ফজল আব্বাস (রা.) ’র জন্য শোক প্রকাশ করতেন মুমিনদের নেতা হযরত আলী (আ.)’র স্ত্রী উম্মুল বানিন (সা. আ.)। এখানেই মদিনাবাসী যোগ দিতেন শোক-অনুষ্ঠানে। এখানে প্রায়ই শোক প্রকাশের জন্য আসতেন ইমাম হুসাইন (আ.)’র স্ত্রী হযরত রাবাব (সা. আ.)। বিশ্বনবী (সা.)’র নাতনী ও ইমাম হুসাইন (আ.)’র বোন হযরত জয়নাব (সা. আ.) ও উম্মে কুলসুম (সা.আ.) নিয়মিত শোক প্রকাশের জন্য এখানেই আসতেন।
প্রায় ৯০ বছর আগেও জান্নাতুল বাকিতে টিকে ছিল বিশ্বনবী (সা.)’র ১২ জন নিষ্পাপ উত্তরসূরির মধ্য থেকে তাঁর নাতি হযরত ইমাম হাসান (আ.), অন্য নাতি ইমাম হুসাইন (আ.)'র পুত্র ইমাম জয়নুল আবেদিন (আ.), তাঁর পুত্র ইমাম মুহাম্মাদ বাকির (আ.) ও বাকির (আ.)'র পুত্র ইমাম জাফর সাদিক (আ.)’র সুদৃশ্য মাজার। কিন্তু বর্তমানে এ এলাকায় টিকে রয়েছে একমাত্র বিশ্বনবী (সা.)’র মাজার। ওয়াহাবিরা বিশ্বনবী (সা.)’র পবিত্র মাজার ভাঙ্গার জন্য বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেয়ার পরও মুসলমানদের প্রতিরোধের মুখে ও ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার ভয়েই তা বাস্তবায়নের সাহস করেনি।
ব্রিটিশ ও কাফিরদের সহযোগী ইহুদিবাদী চরিত্রের অধিকারী ওয়াহাবিরা কেবল মদিনায় নয় পবিত্র মক্কায়ও ইসলামের অনেক নিদর্শন ও পবিত্র মাজার ধ্বংস করেছে। এইসব মাজারের মধ্যে রয়েছে মক্কায় জান্নাতুল মোয়াল্লা নামক কবরস্থানে অবস্থিত বিশ্বনবী (সা.)’র স্ত্রী ও  প্রথম মুসলমান  উম্মুল মুমিনিন হযরত খাদিজা (সা. আ.)’র পবিত্র মাজার এবং বিশ্বনবী (সা.)’র  পুত্র হজরত কাসেম (আ.), চাচা হযরত আবু তালিব (রা.) ও দাদা হযরত আবদুল মুত্তালিব (আ.)সহ অন্যান্য পারিবারিক সদস্যদের মাজার।
ওয়াহাবিরা মদীনায় ওহুদ যুদ্ধের ঐতিহাসিক ময়দানে বিশ্বনবী (সা.)’র চাচা শহীদদের নেতা হযরত হামজা (সা.)’র মাজারসহ অন্যান্য শহীদ সাহাবিদের মাজারও ধ্বংস করেছে।
ওয়াহাবিরা এভাবে ইসলামের ইতিহাসের নিদর্শনগুলো ধ্বংস করছে ঠিক যেভাবে বায়তুল মোকাদ্দাস শহরে মুসলমানদের পবিত্র প্রথম কেবলা এবং এর আশপাশের  ইসলামী নিদর্শনগুলো ধ্বংসের চেষ্টা করছে দখলদার ইহুদিবাদীরা। ফিলিস্তিনের অনেক ইসলামী নিদর্শন ধ্বংস করেছে ইহুদিবাদীরা। অনেকেই মনে করেন ওয়াহাবিদের পৃষ্ঠপোষক সৌদি রাজবংশ (যারা তুর্কি খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ইংরেজদের সহায়তা করেছে এবং পুরস্কার হিসেবে হিজাজে বংশীয় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে) ছিল একটি ইহুদিবাদী ইহুদি গোত্রেরই বংশধর। এরা মুখে মুখে মুসলমান বলে দাবি করলেও সব সময়ই ইসলামের শত্রুদের সহযোগী।
আজ থেকে প্রায় ৩০০ বছর আগে ওয়াহাবি মতবাদের প্রবক্তা আবদুল ওয়াহহাব নজদি সৌদ বংশের সহায়তা নিয়ে ইবনে তাইমিয়ার বিভ্রান্ত চিন্তাধারা প্রচার করতে থাকে। তার ভুল দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে নজদি অলি-আওলিয়ার উসিলা দিয়ে দোয়া করা, তাদের মাজারে মানত করা ও শ্রদ্ধা জানানোসহ অলি-আওলিয়ার মাজার ও কবর জিয়ারতের মত ইসলামের মৌলিক কিছু ইবাদত এবং আচার-অনুষ্ঠানকে হারাম ও শির্ক বলে ঘোষণা করেছিল।  ফলে ওয়াহাবিরা মাজার ও পবিত্র স্থানগুলো ধ্বংস করে আসছে। শুধু তাই নয় নজদি তার চিন্তাধারার বিরোধীদেরকে কাফির ও তাদেরকে হত্যা করা ওয়াজিব বলে উল্লেখ করত।
অথচ বিশ্বনবী (সা.) নিজে কবর জিয়ারত করতেন এবং বিশেষ করে তাঁর মাতা হযরত আমিনা (সালামুল্লাহি আলাইহা)’র কবর জিয়ারত করতে ছুটে যেতেন। তিনি নিজের মায়ের কবরের পাশে কাঁদতেন। (আল মুস্তাদরাক, খণ্ড-১, পৃ.৩৫৭, মদিনার ইতিহাস, ইবনে শাব্বাহ, খণ্ড-১, পৃ.১১৮) আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, মহানবী (সা.) বলেছেন, “তোমরা কবর জিয়ারত কর। এই জিয়ারত তোমাদেরকে পরকালের স্মরণে মগ্ন করবে।”
ওয়াহাবিরা বিশ্বনবী (সা.)’র পবিত্র মাজারে এবং কারবালায় হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) মাজারে হামলা চালিয়ে মূল্যবান অনেক সম্পদ, উপহার ও নিদর্শন লুট করেছিল।
ইসলামের পবিত্র ও ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো ধ্বংস করে ওয়াহাবিরা শুধু মুসলিম উম্মাহর হৃদয়কেই ক্ষত-বিক্ষত করেনি, একইসঙ্গে মানব সভ্যতার অবমাননার মত জঘন্য কলঙ্কও সৃষ্টি করেছে। কারণ, প্রত্যেক জাতি ও সভ্যতাই নিজের পুরনো ঐতিহাসিক চিহ্ন ও নিদর্শনগুলোকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে সংরক্ষণ করে। এ জন্য বিপুল অংকের অর্থ খরচ করে থাকে জাতিগুলো। অথচ ওয়াহাবিরা ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনগুলোও ধ্বংস করে দিচ্ছে যাতে ভবিষ্যত প্রজন্মগুলো এইসব নিদর্শন সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে। এটা ইসলাম ও মানব সভ্যতার জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।
ওয়াহাবিরা  অতীতেও জান্নাতুল বাকিতে হামলা চালিয়ে নিষ্পাপ ইমামদের মাজার ধ্বংস করেছিল। প্রথমবার তারা হামলা চালিয়েছিল হিজরি ১২২১ সালে (১৮০০ খ্রিস্টাব্দে)। (এ সময় হিজাজে সৌদি ওয়াহাবিদের গঠিত প্রথম বিদ্রোহী ও অবৈধ সরকারটি নির্মূল হয়েছিল তুরস্কের ওসমানিয় খেলাফতের মাধ্যমে। ) সে সময়  ওয়াহাবিরা দেড় বছর ধরে মদীনাকে অবরুদ্ধ করে শহরটি দখল করতে সক্ষম হয় এবং বিশ্বনবী (সা.) পবিত্র মাজারের দামী পাথর ও সোনা-রূপাসহ মূল্যবান জিনিষগুলো লুট করে এবং জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে ধ্বংসযজ্ঞ ও লুটপাট চালায়। তারা পবিত্র মক্কায়ও হামলা চালিয়েছিল।  
তারা ওই একই বছর কেবল বিশ্বনবী (সা.)’র মাজার ছাড়া মক্কা ও মদীনায় সব মাজার ধ্বংস করে। শ্রদ্ধার জন্য নয়, বরং জনগণের ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে ও ভয়াবহ পরিণামের ভয়ে বিশ্বনবী (সা.)’র মাজার ধ্বংস করার সাহস তারা করেনি। ওয়াহাবিরা মক্কা ও মদিনার কাজি বা বিচারকদের অপসারণ করে সেখানে নিজেদের কাজি নিয়োগ করে। নবনিযুক্ত ওয়াহাবি কাজি বিশ্বনবী (সা.)’র মাজার বা কবর জিয়ারত থেকে জনগণকে বিরত রাখার চেষ্টা করতেন। মক্কা ও মদিনার জনগণকে জোর করে ওয়াহাবি মতবাদ মেনে নিতে বাধ্য করেছিল ওয়াহাবিরা।
ধর্মপ্রাণ সুন্নি ও শিয়া মুসলমানরা অর্থ ব্যয় করে আবারও জান্নাতুল বাকির মাজারগুলো পুনর্নির্মাণ করেন। কিন্তু ওয়াহাবিরা দ্বিতীয়বার মক্কা দখলের পর পর ১৩৪৪ বা ১৩৪৫ হিজরিতে তথা ১৯২৫ সালে মদীনা অবরোধ করে এবং প্রতিরোধাকামীদের পরাজিত করে এই পবিত্র শহর দখল করে। ওসমানিয় পুলিশদের শহরের বাইরে হটিয়ে  দিয়ে এবারও তারা জান্নাতুল বাকিতে অবস্থিত নবী (সা.)- পরিবারের নিষ্পাপ ইমামদের মাজারসহ সব মাজার ধ্বংস করে এবং লুটপাট চালায়। মুসলমানরা এই দিনটিকে ইয়াওমুল আলহাদাম বা ধ্বংসের দিন বলে অভিহিত করেছেন।
ওয়াহাবিরা এখানে বিশ্বনবী (সা.)’র  পিতা  হযরত আবদুল্লাহ (আ.), পুত্র ইব্রাহিম (আ.), মুমিনদের নেতা আলী (আ.)’র স্ত্রী উম্মুল বানিন প্রমুখের মাজারও ধ্বংস করে। এ ছাড়াও তারা মদীনায় ওহুদ পাহাড়ের মসজিদসহ এখানে বিশ্বনবী (সা.)’র চাচা হযরত হামজা (আ.)’র মাজার এবং ওহুদের অন্যান্য শহীদ সাহাবিদের মাজার ধ্বংস করে। এখানে ১২ জন শহীদ ও সাহাবিদের মাজারের মধ্যে হযরত মুসআব বিন উমাইর (রা.), জাফর বিন শামস (রা.) ও আবদুল্লাহ বিন জাহাসের মাজার ছিল লক্ষণীয়।
লন্ডন-ভিত্তিক হিজাজের ঐতিহাসিক নিদর্শন বিষয়ক আন্তর্জাতিক গ্রুপ জানিয়েছে, সৌদি আরবে ইসলামী নিদর্শনগুলোর শতকরা ৯৫ ভাগই ধ্বংস করে ফেলেছে ওয়াহাবিরা। ইসলামের দুই প্রধান কেন্দ্র তথা মক্কা ও মদিনায় ইসলামের প্রধান নিদর্শনগুলোর বেশির ভাগই ধ্বংস করে ফেলেছে তারা। অথচ ওয়াহাবিরা হিজাজে তথা সৌদি আরবে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের নিদর্শনগুলো রক্ষা করছে! এটা খুবই বিস্ময়কর ও লক্ষণীয় বিষয়। যেমন, খায়বরের মারহাব দুর্গ রক্ষা করছে তারা। মারহাব ছিল মদিনার অন্যতম ইহুদি গোত্র-প্রধান ও পালোয়ান যে হযরত আলী (আ.)’র সঙ্গে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে নিহত হয়েছিল। এমনকি ওয়াহাবিদের প্রথম শাসনামলের দিকে নির্মিত খ্রিস্টানদের একটি গির্জাকে ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে রক্ষা করছে ওয়াহাবিরা। অথচ বিশ্বনবী (সা.)’র পবিত্র স্মৃতি-বিজড়িত নিদর্শনগুলো ধ্বংস করছে তারা।
বিভিন্ন দলিল প্রমাণে দেখা গেছে ওয়াহাবিরা সৌদি আরবে, বিশেষ করে, মক্কা ও মদিনায় অলি-আওলিয়ার মাজার বা কবর ধ্বংসের পাশাপাশি তাদের অবমাননার জঘন্য ও দুঃখজনক পদক্ষেপও নিয়েছে। যেমন, ওয়াহাবিরা মক্কায় বিশ্বনবী (সা.)’এর স্ত্রী ও প্রথম মুসলমান উম্মুল মুমিনিন হযরত খাদিজা (সালামুল্লাহি আলাইহার) বাসভবনটিকে ধ্বংস করে সেখানে টয়লেট নির্মাণ করেছে। তারা ‘মৌলুদুন্নবি’ নামে খ্যাত বিশ্বনবী (সা.)’র জন্মের স্থানটিকে পশু রাখার স্থানে পরিণত করেছে।
ওয়াহাবিদের নারকীয় তাণ্ডব আজও অব্যাহত রয়েছে। প্রতিদিন তাদের অনুগত সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত হচ্ছে ইরাক, পাকিস্তান ও সিরিয়ার নিরপরাধ নারী, পুরুষ ও শিশু। শুধু তাই নয় তারা লাশের অবমাননা করে কলিজা বের করে তা চিবিয়ে খেতেও দ্বিধা করছে না। মানুষ-খেকো এই ওয়াহাবিদের নৃশংসতা বিশ্বনবী (সা.)’র চাচা ও শহীদদের নেতা হযরত হামজার কলিজা-খেকো নারী হিন্দার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। হিন্দা ছিল ইসলামের সবচেয়ে বড় শত্রু  আবু-সুফিয়ানের স্ত্রী ও মুয়াবিয়ার মা তথা ইয়াজিদের দাদী।
কেউ কেউ বলে থাকেন যে সৌদি রাজ-পরিবার আসলে “দোমনেহ” নামের বিভ্রান্ত ইহুদিবাদী গোষ্ঠীর বংশধর। এই গোষ্ঠী ভণ্ড  ইহুদিবাদী নবী ‘শাব্বিটি জিভি’র অনুসারী। তারা প্রকাশ্যে ইসলামের অনুসারী বলে দাবি করত। কিন্তু তারা বাস্তবেমদ্যপ ও নির্বিচার যৌনাচার বা যৌন অনাচারসহ নানা ঘৃণ্য কাজে অভ্যস্ত ছিল।
আজ বিশ্বের মুসলমানদের সচেতন হতে হবে এবং মক্কা ও মদীনার মত পবিত্র শহরগুলো পরিচালনার দায়িত্ব থেকে ওয়াহাবিদের সরিয়ে দিয়ে তা মুসলমানদের প্রকৃত প্রতিনিধিদের কাছে অর্পণ করতে হবে।  

পবিত্র কোরআন ও ইসলামের দৃষ্টিতে কবরের উপর সৌধ নির্মাণ
পবিত্র কোরআন কবরের উপর সৌধ নির্মাণের বিষয়টি নিয়ে সুস্পষ্ট কিছু না বললেও কোরআনের আয়াত হতে এ সম্পর্কিত বিধান পাওয়া যায়। এ যুক্তিতে যে-

১। কবরের উপর সৌধ নির্মাণ আল্লাহর নিদর্শনগুলোর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের শামিল। মহান আল্লাহ্ পবিত্র কোরআনে তাঁর নিদর্শনগুলোর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে নির্দেশ দিয়েছেন, কারণ তা অন্তরের পরহেজগারির (আত্মসংযম) প্রমাণ।
যেমন বলা হয়েছে, ومن یعظّم شعائر الله فإنّها من تقوی القلوب “যারা আল্লাহর (দীনের) নিদর্শনসমূহের সম্মান করে তা অন্তরের পরহেজগারির প্রমাণস্বরূপ।”  ‘شعائر’ শব্দটি ‘شعیره’ শব্দের বহুবচন যার অর্থ নিদর্শন ও প্রমাণ। ‘আল্লাহর নিদর্শন’ (شعائر الله)  হলো এমন কোন প্রতীক যা আল্লাহর দিক নির্দেশক। যদি কেউ আল্লাহর নিকট পৌঁছাতে চায় (নৈকট্য পেতে চায়) তবে ঐ প্রতীকের মাধ্যমে তাতে পৌঁছাতে পারে। অবশ্য ‘আল্লাহর নিদর্শন’ অর্থ যদি তাঁর দীনের নিদর্শন বুঝায় তবে আয়াতটির অর্থ হবে যদি কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে চায় তবে তাঁর দীনের নিদর্শনগুলোর স্থান প্রদর্শনের মাধ্যমে তা অর্জন করতে হবে।
পবিত্র কোরআনে সাফা ও মারওয়াকে আল্লাহর নিদর্শন ও চিহ্ন বলা হয়েছে,
إنَّ الصفا والمروة من شعائر الله
“নিশ্চয়ই সাফা ও মারওয়া (পর্বত দু’টি) আল্লাহর (দীনের) নিদর্শন।”
কোরবানির উদ্দেশ্যে যে উটকে মিনায় নিয়ে যাওয়া হয় তাকেও আল্লাহর নিদর্শন বলা হয়েছে, و البدنَ جعلناها لکم من شعائر الله “আমরা কোরবানির হৃষ্টপুষ্ট উষ্ট্রকে তোমাদের জন্য আল্লাহর (দীনের) নিদর্শন বানিয়েছি।”
এ বিষয়গুলো ইবরাহীমের ধর্মের (দীনে হানিফের) নিদর্শনগুলোর অন্তর্ভুক্ত। মুজদালিফাকেمَشعَر বলা হয়, কারণ তা আল্লাহর দীনের নিদর্শন ও প্রতীক স্বরূপ। হজ্জ্বের সকল আচারই আল্লাহর দীনের নিদর্শন কারণ তা একত্ববাদী ও অবিকৃত ধর্মের প্রতীকস্বরূপ।
যেহেতু এই আচারগুলো আল্লাহর দীনের নিদর্শনস্বরূপ এবং মানবজাতিকে একত্ববাদী ও অবিকৃত ঐশী দীনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, সেহেতু নিঃসন্দেহে বলা যায়, আল্লাহর নবী ও ওলিগণ তাঁর দ্বীনের সর্বোচ্চ নিদর্শন। কারণ তাঁরা হলেন নিষ্পাপ, কখনোই অন্যায়কর্ম করেন না এবং তাঁদের বাণী ও কর্ম সত্যের অনুরণন। তাঁরা এমন এক আদর্শ যাদের অনুসরণে একত্ববাদ ও মহাসত্যের পথ খুঁজে পাওয়া যায়।
যখন মহানবী (সা.), তাঁর স্থলাভিষিক্ত প্রতিনিধি (পবিত্র ইমামগণ) ও আল্লাহর অন্যান্য ওলিগণ এরূপ বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী তখন তাদের সকল স্মৃতি সংরক্ষণ যেমন তাঁদের কবর, তা সংরক্ষণের নিমিত্তে তার উপর সৌধ ও গম্বুজ নির্মাণ আল্লাহর নিদর্শনের প্রতি সম্মানেরই নমুনা স্বরূপ। কারণ এরূপ কর্ম সেই ব্যক্তিবর্গের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে করা হয়, যাদের কর্ম, বাণী ও নির্দেশনা মানুষকে আল্লাহর দিকে পরিচালিত করে।
কুরতুবী তাঁর তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘আল্লাহর নিদর্শন হলো এমন কিছু যা তাঁর দীনের চিহ্ন ও স্মৃতি বহন করে বিশেষত যেসব বিষয় দীনের আচারের পথে সংশ্লিষ্ট।
মিশরীয় লেখক প্রফেসর আব্বাস মাহমুদ আক্কাদ কারবালা ও ইমাম হুসাইনের মাজার সম্পর্কে বলেছেন : ‘কারবালা এমন একস্থান যেখানে মুসলমানরা শিক্ষাগ্রহণ ও ইমাম হুসাইনের স্মরণের জন্য যায়। অমুসলমানরাও সেখানে দর্শনের জন্য যায়। কিন্তু যদি ঐ ভূমির প্রকৃত মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হয় তবে অবশ্যই তা সেই সব ব্যক্তির জিয়ারতের স্থান হওয়া উচিত যারা স্বজাতির জন্য বিশেষ পবিত্রতা ও মর্যাদায় বিশ্বাসী। কারণ জিয়ারতের স্থানগুলোর মধ্যে ইমাম হুসাইনের মাজার হতে উত্তম কোন স্থানের কথা আমার জানা নেই।’

২। মহানবীর পবিত্র আহলে বাইতের সদস্যদের কবরগুলোর উপর সৌধ নির্মাণ মহানবীর নিকটাত্মীয়দের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ স্বরূপ।
পবিত্র কোরআন সুস্পষ্টরূপে আল্লাহর নবীর  রক্ত-সম্পর্কীয় নিকটাত্মীয়দের প্রতি ভালবাসা পোষণের নির্দেশ দিয়েছে-
قل لا أسئلکم علیه أجراً إلا المودَّةَ فی القربی
 “তোমাদের হতে আমি আমার (রিসালাতের দায়িত্বের) কোন বিনিময় চাই না কেবল আমার অতি-নিকটাত্মীয়দের প্রতি ভালোবাসা ছাড়া।
নিঃসন্দেহে মহানবীর অতি-নিকটাত্মীয়দের কবর সংরক্ষণের নিমিত্তে তার উপর সৌধ নির্মাণ করে জিয়ারতকারীদের জন্য তা চিহ্ন হিসেবে উপস্থাপন তাঁদের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ স্বরূপ। কারণ প্রতিটি ভালোবাসারই প্রকাশ আছে এবং শুধু তাঁদের আনুগত্য করা ও তাঁদের প্রতি আন্তরিক ভালবাসা পোষণ করাই ভালোবাসার নিদর্শন নয়, বরং সৌধ নির্মাণের মাধ্যমে তাঁদের কবর সংরক্ষণও তাঁদের প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন, যেহেতু এরূপ কর্ম কোন সূত্রেই নিষিদ্ধ করা হয় নি। (আবুশ শুহাদা, পৃ. ৫৬)

৩। আল্লাহর ওলীদের কবরের উপর সৌধ নির্মাণ পবিত্র গৃহগুলোকে সমুন্নত রাখার নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত, মহান আল্লাহ্ পবিত্র কোরআনে অনুমতি দিয়েছেন যেসব গৃহে আল্লাহর নাম স্মরণ করা হয় তা সমুন্নত করার।
 فی بیوت اذن الله أن ترفع و یذکر فیها اسمه یسبح له فیها بالغدو والاصال...لا تلههم تجارةٌ ولا بیع عن ذکرالله
 “আল্লাহ যেসব গৃহকে (যাতে তাঁর নূর রয়েছে) মর্যাদায় উন্নীত করার এবং সেগুলোতে তাঁর নাম উচ্চারণ করার আদেশ দিয়েছেন, সেখানে সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে এমন লোকেরা যাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে, নামাজ প্রতিষ্ঠা করা থেকে এবং জাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখে না।” (সূরা নূর : ৩৬-৩৭)
উপরিউক্ত আয়াত হতে আমাদের বক্তব্যের সপক্ষে দু’টি প্রমাণ উপস্থাপন করা যায়।
প্রথমত উপরিউক্ত আয়াতে গৃহ বলতে শুধু মসজিদ বুঝানো হয়নি, বরং আয়াতের উদ্দেশ্য মসজিদসহ যে কোন স্থান যেখানে আল্লাহর নাম স্মরণ করা হয়, যেমন নবীগণ ও তাঁদের স্থলাভিষিক্ত পবিত্র প্রতিনিধিদের গৃহ। এমনকি এ দাবীও সত্য যে, উপরিউক্ত আয়াতটিতে মসজিদ ভিন্ন অন্য গৃহের বা ঘরগুলোর কথা বলা হয়েছে। কারণ ঘর বলতে যে কোন চার দেয়াল ও ছাদ বিশিষ্ট স্থানকে বুঝানো হয়। যেমন পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে :
 ولو لا أن یکونَ الناس أُمَّةً واحدةً لجعلنا لمن یکفر بالرحمن لبیوتهم سُقفاً من فضَّةٍ و معارج علیها یظهرون
“যদি সব মানুষের এক মতাবলম্বী (কাফের) হয়ে যাওয়ার আশংকা না থাকত তবে যারা দয়াময়কে (আল্লাহকে) অস্বীকার করে তাদের ঘরগুলোর ছাদ ও সিঁড়িকে যা দিয়ে তারা উপরে যেত আমি রৌপ্য নির্মিত করে দিতাম।” (সুরা যুখরুফ-৩৩)
উপরিউক্ত আয়াত হতে বোঝা যায় আরবি ভাষায় যে, কোন ছাদ বিশিষ্ট কক্ষকেই গৃহ ((بیت)) বলা হয়। তদুপরি হাদিসগুলোয় বলা হয়েছে মসজিদ ছাদ-বিহীন হওয়া মুস্তাহাব। তাই উল্লিখিত আয়াতে গৃহ বলতে মসজিদ ভিন্ন অন্য গৃহের কথা বলা হয়েছে। উপরন্তু রাসূলের আহলে বাইতের সূত্রে ইমাম বাকির (আ.) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, উপরিউক্ত আয়াতে গৃহ বলতে নবীগণ ও হযরত আলীর গৃহের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
পবিত্র কাবাগৃহকে বাইতুল্লাহ্ বলা হয়, কারণ তার ছাদ রয়েছে।

দ্বিতীয়ত আয়াতে যে সমুন্নত করার কথা বলা হয়েছে তার দু’রকম অর্থ হতে পারে :
ক) গৃহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও আধ্যাত্মিক মর্যাদা দান যেমনটি আমরা এ আয়াতটিতে পড়ি و رفعناه مکاناً علیاً “আমরা তার মর্যাদাকে সমুন্নত করেছি।”
খ) আয়াতের লক্ষ্য বাহ্যিক ও বস্তুগত উন্নয়ন অর্থাৎ ঐরূপ গৃহ বা স্থানের যেমন ওলীদের কবরের উপর সৌধ নির্মাণের মাধ্যমে গৃহ বা কবরকে উন্নীত করা।
জামাখশারী তাঁর তাফসীর গ্রন্থে বলেছেন : গৃহকে উন্নীত করার অর্থ গৃহের কাঠামোকে উচ্চ করা যেমনটি নিম্নোক্ত আয়াতে বলা হয়েছে-
وإذ یرفع إبراهیم القواعد من البیت و إسماعیل
 “(স্মরণ কর) যখন ইবরাহীম ও ইসমাইল কাবাগৃহের ভিত্তিকে উন্নীত করেছিল।” অথবা কাবাগৃহের প্রতি মর্যাদা দেখানোও সম্মান প্রদর্শন।
তাফসীরে রুহুল বায়ানে বলা হয়েছে (أن ترفع) উন্নীত করার অর্থ উচ্চ করা অথবা সেগুলোর মর্যাদাকে বৃদ্ধি করা।
যদি আয়াতটিতে উন্নীত করার অর্থ বাহ্যিক ও কাঠামোগত উন্নয়নের কথা বলা হয়ে থাকে তবে তা সুস্পষ্টভাবে আল্লাহর নবী ও ওলীদের কবরকে উন্নীতকরণের দলিল হবে। বিশেষত যখন মহানবী (সা.) সহ তাঁর আহলে বাইতের কয়েকজন ইমাম তাঁদের গৃহেই সমাধিস্থ হয়েছিলেন। আর যদি উন্নীতকরণের অর্থ মর্যাদা দান ও অবস্তুগত উন্নয়ন হয়ে থাকে তবে তার অর্থ হবে নবী ও আল্লাহর ওলীদের গৃহ ও কবরগুলোর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নিমিত্তে তা সংরক্ষণ করা, সৌধ নির্মাণ ও তার মেরামত করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। আল্লামা সুয়ূতী আনাস ইবনে মালিক ও কুরাইদা হতে বর্ণনা করেছেন যে, মহানবী (সা.) فی بیوت اذن أن ترفع আয়াতটি পাঠ করলে একব্যক্তি তাঁকে জিজ্ঞেস করল : ‘এখানে কোন গৃহগুলোর কথা বলা হয়েছে?’
রাসূল (সা.) বললেন : ‘নবীগণের গৃহগুলো’। হযরত আবু বকর রাসূলকে তখন হযরত আলী ও ফাতিমার গৃহের দিকে ইঙ্গিত করে জিজ্ঞেস করলেন : ‘হে আল্লাহর রাসূল! এই গৃহটিও কি ঐসব গৃহের অন্তর্ভুক্ত, আল্লাহ্ ও আপনার দৃষ্টিতে যার প্রতি মর্যাদা প্রদর্শন করা উচিত।’ তিনি বললেন : ‘এই গৃহটি ঐ গৃহগুলোর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ।’


প্রাথমিক যুগের অনুসরণীয় মুসলমানদের কর্ম ধারায় কবরের উপর স্মৃতিসৌধ নির্মাণ:
ইসলামের ইতিহাসের প্রতি লক্ষ্য করলে আমরা দেখি, ইসলামের আবির্ভাবের যুগ থেকেই মুসলমানদের মধ্যে কবরের উপর সৌধ নির্মাণের প্রচলন ছিল এবং এ বিষয়টি কখনোই সাহাবী ও তাবেয়ীদের প্রতিবাদের মুখোমুখি হয় নি। ইতিহাসের পরিক্রমায় প্রথমবারের মত ওয়াহাবীরা এ রীতির বিরুদ্ধে মৌখিক ও ব্যবহারিকভাবে প্রতিবাদ শুরু করে। মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত এ রীতির কিছু উদাহরণ এখানে উল্লেখ করছি :
১। মুসলমানরা রাসূলের পবিত্র দেহ মোবারককে ছাদ বিশিষ্ট গৃহে দাফন করেন। তখন থেকেই তা সাহাবাদের সম্মানের স্থান হিসেবে পরিগণিত হতো।
হুসাইন ইবনে আহমান ইবনে মুহাম্মদ যিনি আবিল খাজ্জাজ বাগদাদী নামে প্রসিদ্ধ তৃতীয় ও চতুর্থ শতাব্দীর একজন কবি যিনি হযরত আলীর প্রশংসায় রচিত উচ্চমানের কাসীদা যা তিনি তাঁর পবিত্র রওজার সন্নিকটে রচনা করেছেন তাতে আমিরুল মুমিনিনের কবরের উপর নির্মিত সাদা গম্বুজের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন :
يا صاحب القبة البيضاء على النجف
من زار قبرك واستشفى لديك شفى
زوروا ابا الحسن الهادى لعلكم
تحظون بالاجر و الاقبال و الزلف
‘হে নাজাফের সাদা গম্বুজের অধিকারী,
যে আপনাকে জিয়ারত করে শাফা (আরোগ্য) চায় সে শাফা লাভ করে,
তোমরা হেদায়েতকারী আবুল হাসানের (আলীর) কবর জিয়ারত কর,
যাতে পুরস্কার, সৌভাগ্য ও নৈকট্যের অধিকারী হতে পার।’
৩। বুখারী তাঁর সহী গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে, হাসান ইবনে হাসান ইবনে আলী (আঃ) মৃত্যুবরণ করলে তাঁর স্ত্রী তাঁর কবরের উপর ছাউনী দিয়ে তাঁর নিকট বসে একবছর নিয়মিত ক্রন্দন করেছিল।
মোল্লা আলী কারী উক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেছেন: ‘বাহ্যিকভাবে বোঝা যায় কবরের উপর ছাউনী এ উদ্দেশ্যে দেয়া হয়েছিল যে, যাতে করে তাঁর বন্ধু ও শুভাকাঙ্খীরা তাঁর কবরের নিকট এসে কোরআন তেলাওয়াত, জিকির করতে পারে এবং তার সঙ্গীরা তাঁর জন্য দোয়া ও মাগফেরাত কামনার জন্য সেখানে যায়।’
৪। সাইয়্যেদ বাকরী বলেছেন : ‘কবরের উপর সৌধ নির্মাণের নিষেধাজ্ঞা হতে নবী-রাসূল, শহীদ ও সৎকর্মশীল বান্দারা বহির্ভূত।’
৫। ইবনে শাবাহ বর্ণনা করেছেন, ‘আকীল ইবনে আবি তালিব তার নিজগৃহে কূপ খনন করার সময় একটি পাথরের সন্ধান পান যাতে লেখা ছিল : এই কবরটি সাখর ইবনে হারবের কন্যা হাবীবার। আকীল তখন কবরটি ঢেকে দিয়ে তার উপর একটি গৃহ নির্মাণ করলেন।’
৬। সামহুদী হযরত হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিবের কবরের বর্ণনা দিয়ে বলেন : ‘তার কবরের উপর সুন্দর, মজবুত ও উঁচু একটি গম্বুজ রয়েছে... আব্বাসীয় খলিফা নাসিরুদ্দীনের (৫৭৫-৬২২) শাসনামলে তা নির্মিত হয়েছে।
৭। ইবনে সা’দ তার তাবাকাত গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, ‘উসমান ইবনে মাজউনের মৃত্যুর পর জান্নাতুল বাকীতে তাকে দাফনের পর রাসূল (সা.) তার কবরের উপর স্থায়ী কিছু স্থাপন করলেন এবং বললেন : ‘এটি তার কবরের চিহ্ন।’
আমর ইবনে হাজম বলেছেন : ‘উসমান ইবনে মাজউনের কবরের নিকট উঁচু কিছু স্থাপিত দেখলাম যা প্রতীকের মত ছিল।’
মুতাল্লাব বর্ণনা করেছেন, ‘উসমান ইবনে মাজউনের মৃত্যু ও দাফনের পর মহানবী (সা.) নির্দেশ দিলেন পাথর জাতীয় কিছু আনার। একব্যক্তি ভারী একটি পাথর আনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে মহানবী (সা.) আস্তিন গুটিয়ে পাথরটি উঠালেন ও উসমান ইবনে মাজউনের কবরের কাছে স্থাপন করলেন এবং বললেন : ‘তার কবরের চিহ্ন রাখতে চাই।’
৮। ইবনে সা’দ ইমাম বাকির (আ.) হতে বর্ণনা করেছে, ‘রাসূলের কন্যা ফাতিমা হযরত হামজার কবরের কাছে যেতেন ও তা পরিপাটি ও সংস্কার করতেন।’
৯। বুখারী বর্ণনা করেছেন যে, আবদুর রহমান ইবনে আবি বাকরের মৃত্যুর পর হযরত আয়েশা নির্দেশ দিয়েছিলেন তার কবরের উপর তাঁবু স্থাপনের এবং একজনের উপর তা দেখাশোনার দায়িত্ব আরোপ করেন।
১০। হযরত উমর রাসূলের স্ত্রী জয়নাব বিনতে জাহাশের কবরের উপর তাঁবু নির্মাণের নির্দেশ দেন এবং কেউ তার এ কাজে বাধা দেয় নি।
(রেফারেন্স: । সূরা বাকারা : ১৫৮।  । সূরা হাজ্জ্ব : ৩৬।  । তাফসীরে কুরতুবী, ১২তম খ-, পৃ. ৫৬।  । সূরা শুরা : ২৩।  । সূরা যুখরুফ : ৩৩।  । তাফসীরে আল বুরহান, বাহরানী, ৩য় খ-, পৃ. ১৩৭।  । সূরা মারইয়াম : ৫৭।  । আল কাশশাফ, ২য় খ-, পৃ. ৩৯০।  । রুহুল বায়ান, ৬ষ্ঠ খ-, পৃ. ১৫৮।  । দুররূল মানসূর, ৫ খ-, পৃ. ৫০।  । ওয়াফিয়াতুল আইয়ান, ১ম খ-, পৃ. ১৭০; আল মুনতাজাম, ৭ম খ-, পৃ. ২১৬, রওজাতুল জান্নাত, ৩য় খ-, পৃ. ১৪৮।  । সহীহ বুখারী, কিতাবুল জানাযিয়া, হাদীস নং ৬২।  । ইয়ানাতুত তালেবীন, ২য় খ-, পৃ. ১২০।
 । তারিখুল মাদিনাতুল মুনাওয়াারাহ, ১ম খ-, পৃ. ১২০।  । ওয়াফাউল ওয়াফা, ২য় খ- দ্রষ্টব্য।  । তাবাকাতে ইবনে সা’দ, ৩য় খ-, পৃ. ২৯১।
 । তাবাকাতে ইবনে সাদ, ৩য় খ-, পৃ. ২৮৯।  । সুনানে আবি দাউদ, ৩য় খ-, পৃ. ২১১; আস সিরাতুল হালাবীয়া, ২য় খ-, পৃ. ৯৫।  । তাবাকাতে ইবনে সাদ, ২য় খ-, পৃ. ১১৯। । সহীহ বুখারী, ২য় খ-, পৃ. ১১৯।  । তাবাকাতে ইবনে সাদ, ৮ম খ-, পৃ. ৮০। ) #


source : abna
0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

পরকালের জন্য প্রস্তুতি এবং ...
মুবাহেলা
ইমাম মাহদী (আ.)এর আগমন একটি অকাট্য ...
গাদিরে খুম
হযরত ফাতেমার চরিত্র ও কর্ম-পদ্ধতি
কবর জিয়ারত
আল কুরআনের দৃষ্টিতে মানব জীবনের ...
তাকওয়া হাসিলের উপায়
আদর্শ মানব হযরত মুহাম্মদ (সা.) - ১ম ...
কেন আশুরার সংস্কৃতি ও হুসাইনি ...

 
user comment