ইসলামের অন্যান্য এবাদতের মত হজের লক্ষ্যও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। তাই এই পবিত্র নিয়ত নিয়েই পুণ্যভূমি মক্কাতে প্রবেশের আগে কয়েকটি বিশেষ স্থান থেকে শুরু হয় হজের আনুষ্ঠানিকতা। এসব স্থানকে বলা হয় মিকাত। এখানে এহরামের কাপড় পড়ে হজ-যাত্রীরা বলেন, লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা...। এর তাৎপর্য হল, সব কিছুই আল্লাহকে স্মরণ করে শুরু করতে হয়। আমরা সব সময়ই আল্লাহর আহ্বানে সাড়া দিতে প্রস্তুত বা তাঁর পূর্ণ আনুগত হতে প্রস্তুত। আমরা দুনিয়ার অসৎ, শোষক ও স্বৈরাচারী প্রবল শক্তিগুলোকে অস্বীকার করছি। অস্বীকার করছি আল্লাহ ছাড়া অন্য সব শক্তির প্রভুত্বের দাবীকে। আজ আমরা আল্লাহর সামনে উপস্থিত হয়েছি সেই পোশাক পরে যে পোশাকে একদিন আমরা কিয়ামতের ময়দানে আপনার সামনে হাজির হব।
মুসলমানদের নামাজের কিবলা হল কাবা ঘর। এমন কোনো মুহূর্ত নেই যখন মুসলমানরা এই ঘরের দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করছেন না বা রুকু-সিজদা করছেন না। এখানে মুসলমানরা মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও শান-শওকতের সামনে হন নতজানু।
হ্জ উৎসব ও ইবাদত হযরত ইব্রাহিম (আ.)’র দোয়ার ফসল। সেদিন তিনি তাঁর দোয়ায় বলেছিলেন:
“হে আমাদের প্রভু! আমি আমার বংশধরদের মধ্য হতে একজনকে তোমার পবিত্র ঘরের কাছে পানিহীন ও ঘাসহীন অনুর্বর উপত্যকায় বসবাসের জন্য রাখলাম । হে প্রভু! এটা এ জন্য যে, তারা যেনো নিয়মিত নামাজ কায়েম করে। সুতরাং মানুষের মধ্যে কিছু লোকের হৃদয়কে তাদের প্রতি ভালোবাসাতে পূর্ণ করে দাও এবং ফলমূল দিয়ে তাদের জীবিকার ব্যবস্থা কর যেনো তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারে।”(১৪:৩৭)
সেই থেকে শুরু হয় পবিত্র হজের প্রচলন। মহাবরকতময় এই উৎসবের নানা আনুষ্ঠানিকতার রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন তাৎপর্য ও শিক্ষা। হজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটি হল আল্লাহর প্রকৃত বান্দা বা দাস হতে আগ্রহী হওয়ার প্রমাণ দেয়া।
সুরা হজের ২৭ ও ২৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:
' মানুষের মধ্যে হজের ঘোষণা প্রচার কর। তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং সব ধরনের চিকন উটের পিঠে সওয়ার হয়ে দূর-দূরান্ত থেকে। যাতে তারা তাদের কল্যাণের স্থান পর্যন্ত পৌছে এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম স্মরণ করে তাঁর দেয়া চারপেয়ে জন্তু জবাই করার সময়। এরপর তোমরা তা থেকে খাও এবং দুঃস্থ-অভাবগ্রস্তকে আহার করাও। এরপর তারা যেন দৈহিক ময়লা দূর করে দেয়, তাদের মানত পূর্ণ করে এবং এই সংরক্ষিত গৃহের তাওয়াফ করে।'
মহানবী (সা.) মক্কার কুরাইশ মুশরিক ও কাফিরদের বাধার কারণে বহু বছর মাতৃভূমি মক্কা ছেড়ে মদীনায় থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। হজের সুযোগ আসার পর বিশ্বনবী (সা.) একতা ও সংহতির ডাক দিয়ে মিকাতে বা হজ যাত্রার প্রথম স্টেশনে এলেন। এরপর তিনি গোসল সেরে ইহরামের পোশাক পরলেন। এরপর তিনি প্রত্যেক পর্বে গভীর প্রেম ও অপূর্ব ভঙ্গিমায় তালবিয়া পড়লেন তথা মহান আল্লাহর প্রশংসা ও শ্রেষ্ঠত্বের কথা তুলে ধরে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। এরপর যখন তার সামনে এলো পবিত্র কাবাঘর তখন তিনি তাঁর দুই হাত উপরে তুলে উচ্চারণ করলেন: আল্লাহু আকবার। আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ। এরপর দোয়া করলেন: হে আল্লাহ ! এই ঘরের মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব ও কল্যাণ বাড়িয়ে দিন। আর যারা ওমরা ও বড় হজ করতে আসবে তাদের সম্মান ও কল্যাণ বাড়িয়ে দিন। এরপর তিনি কাবার দিকে গেলেন এবং হাজরে আসওয়াদ পাথরে হাত বুলালেন এবং কাবার চারদিকে প্রদক্ষিণ করলেন।
কাবাঘর কেবলই প্রথম ইবাদত-কেন্দ্র নয়। এটি মানুষের জন্য সুপথ প্রদর্শনের ও বরকত দানের প্রথম ঘর। কুরআনের দৃষ্টিতে এই ঘর মুসলমানদের নিরাপত্তার কেন্দ্র, তাদের সম্মেলন ও ঐক্যের কেন্দ্র এবং নিরাপত্তার কেন্দ্র।
মহানবী (সা.) মদীনা থেকে হজ করতে গিয়েছিলেন উটে চড়ে। তার উটের চালক আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহে কবিতা আবৃত্তি করে বলছিলেন: “হে মুশরিক ও কাফিরদের সন্তানরা! মহনবী (সা.)-এর জন্য পথ খুলে দাও। তোমরা জেনে রাখ, তিনি সব কল্যাণের উৎস ; অর্থাৎ তাঁকে মেনে নেয়া ও তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের মধ্যেই কেবল কল্যাণ নিহিত আছে। হে প্রভু! আমি তাঁর বাণীতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি এবং তাঁর রিসালাতে বিশ্বাস স্থাপন করা সংক্রান্ত আপনার নির্দেশ সম্পর্কেও আমি জ্ঞাত।”
মহানবী (সা.) উটে বসেই পবিত্র কা’বা তাওয়াফ করলেন। এবার তিনি ইবনে রাওয়াহাকে নিম্নোক্ত বিশেষ দুআ তাঁর কণ্ঠে পাঠ এবং অন্যদেরও তাঁর সাথে তা পাঠ করার নির্দেশ দেন :
“কেবল আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন মাবুদ নেই। তিনি এক-অদ্বিতীয়। তিনি তাঁর অঙ্গীকার পালন করেছেন (তিনি অঙ্গীকার করেছিলেন যে, তোমরা অর্থাৎ মুসলমানরা শীঘ্রই মহান আল্লাহর ঘর কাবা জিয়ারত করবে), নিজ বান্দাকে (মহানবীকে) সাহায্য করেছেন, তাওহীদের সেনাবাহিনীকে সম্মানিত করেছেন এবং একাই তিনি কুফর ও শির্কের সব গোষ্ঠীকে পরাজিত করেছেন।”
মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ঐক্য গড়ে তোলা হজের অন্যতম লক্ষ্য। হজের সময় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলমানরা পরস্পরের দুঃখ-দুর্দশা ও সমস্যা সম্পর্কে জানার পাশাপাশি একে-অপরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে পারে এবং কাফির ও মুশরিকদের ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। আর এ জন্যই বারাআত বা কাফির-মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা হজের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ।
মিনায় শয়তানকে পাথর নিক্ষেপের সাথে জড়িয়ে আছে হযরত ইব্রাহীম (আঃ)'র স্মৃতি। একমাত্র সন্তান ইসমাইল (আঃ)কে কোরবানী করতে উদ্যত হবার সময় শয়তান তাঁকে এ কাজে বিরত রাখার জন্য কুমন্ত্রণা দেয়ার চেষ্টা করে। তাই তিনি শয়তানকে তাড়ানোর জন্য কঙ্কর নিক্ষেপ করেছিলেন। নিজের মনকে ও সমাজকে শয়তানের বা তাগুতি শক্তিগুলোর হাত থেকে রক্ষার মহাশিক্ষা রয়েছে এ ঘটনায়।
....কাবাতে লুটাবো শির-২
সুদূর মক্কা মদিনার পথে আমি রাহি মুসাফির,
বিরাজে রওজা মোবারক যথা মোর প্রিয় নবীজীর।।
বাতাসে যেখানে বাজে অবিরাম
তৌহিদ বাণী খোদার কালাম,
জিয়ারতে যথা আসে ফেরেশতা শত আউলিয়া পীর।।
মা ফাতেমা আর হাসান হোসেন খেলেছে পথে যার
কদমের ধূলি পড়েছে যেথায় হাজার আম্বিয়ার,
সুরমা করিয়া কবে সে ধূলি
মাখিব নয়নে দুই হাতে তুলি,
কবে এ দুনিয়া হ'তে যাবার আগে রে কাবাতে লুটাব শির।।
( বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম)
হজ সব ধরনের আত্মকেন্দ্রীকতা ও আল্লাহ ছাড়া অন্য সব কিছুর নির্ভরতা থেকে মুক্ত হওয়ার শিক্ষা দেয়। বলা হয় মুমিনের হৃদয় আল্লাহর বাসস্থান। এ ঘরে যদি সামান্যতম পাপ-পঙ্কিলতা থাকে তাহলে সে খাঁটি মুমিন হতে পারবে না। তাই হজ পালনের সময় মুমিন বিভিন্ন অবস্থায় কেবল আল্লাহকেই স্মরণ করেন। কখনও একাকী বা নির্জনে, কখনও বা প্রশান্ত অবস্থায় এবং কখনওবা অস্থির ও ব্যাকুল হৃদয়ে এদিক-সেদিকে ছুটে গিয়ে খোদা-প্রেমের আকুলতা প্রকাশ করেন।
পাহাড়ে, মরু-প্রান্তরে, সমতলে, জলে-স্থলে ও দিন বা রাতে প্রভুর প্রেম ছাড়া হজ যাত্রীর মনে কোনা শান্তি ও সুখ নেই। খোদা-প্রেমিক সব খানেই দেখেন আল্লাহর অপার মহিমার নিদর্শন। এভাবে খোদা-প্রেমিক হজযাত্রী অন্য-সব কিছুর আকর্ষণ থেকে নিজেকে মুক্ত করে সবচেয়ে খাঁটি ও প্রকৃত প্রেমের জগতে বিচরণ করেন হজ নামক মহাপ্রেমের মিলন-মেলায়।
পুণ্যভূমি মক্কায় পদধূলি পড়েছে হাজারো নবী-রাসূলের। এখানেই একদিন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ(সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইত এবং ন্যায়পরায়ণ অনেক সাহাবা একত্ববাদের ঝাণ্ডা তুলে ধরেছিলেন অকল্পনীয় ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে।
এই মক্কাতেই একদিন বিশ্বনবী (সা.)’র পূর্বপুরুষ হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর সন্তান হযরত ইসমাইল (আ.) খোদা-প্রেমের এক অতি-উচ্চ এবং কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। এখানেই পবিত্র হজের প্রাক্কালে আরাফাতের ময়দানে নয়ই জিলহজ বা আরাফাত দিবসে শহীদদের সর্দার হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) জীবনে শেষবারের মত হজ পালনকালে উপহার দিয়েছিলেন খোদাপ্রেমের অমর বাণীতে সিক্ত অনন্য-মুনাজাত দোয়ায়ে আরাফাহ। ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আত্মত্যাগের রেকর্ড গড়ার প্রস্তুতি নেয়ার প্রাক্কালে উচ্চারিত ইমামের অশ্রু-ভেজা অনন্য সেই দোয়া হজযাত্রীদের অন্তরকে আজো বেদনা-বিধুর করে।
পবিত্র হজ জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের ফরিয়াদ তুলে ধরার উপযুক্ত স্থান। পরের বছর অর্থাৎ ৬০ হিজরিতে এখানে ইয়াজিদের ও উমাইয়া শাসকদের জুলুম নিপীড়ন তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন হযরত ইমাম হুসাইন (আ)। প্রকৃত ইসলামী শাসন না থাকলে যে হজকে যে পরিপূর্ণভাবে আদায় করা যায় না এবং সেক্ষেত্রে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টাই যে বেশি জরুরি তা তুলে ধরেছিলেন তিনি হজের মাত্র কয়েক দিন আগে মক্কা ত্যাগ করে। মহানবী (সা.)ও কুফরি শক্তিকে পরাজিত করার পর সাহাবিদের নিয়ে হজ করতে গিয়েছিলেন।
হজ মুসলমানদের জন্য শান্তি প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানায়। অথচ পবিত্র মক্কা ও মদিনার সেবক হবার দাবিদার রাজতান্ত্রিক এক শাসকগোষ্ঠী পবিত্র হজের মৌসুমে যুদ্ধ ও রক্তপাত নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও আজও ইয়েমেনের নিরীহ মুসলমানদের ওপর নির্বিচার বোমা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ও ধ্বংস করছে দেশটির সব ধরনের অবকাঠামো। প্রায় ৬ মাস ধরে সৌদি সরকারের নির্বিচার হামলায় নিহত হয়েছে প্রায় ৬ হাজার ইয়েমেনি মুসলমান যাদের মধ্যে রয়েছে অন্তত এক হাজার শিশু ও নারী। এমনকি ইয়েমেনের মুসলমানদেরকে এ বছর হজও করতে দেয়া হচ্ছে না। অথচ পবিত্র কুরআনের আয়াত অনুযায়ী মহান আল্লাহর ঘর জিয়ারতে মুসলমানদেরকে বাধা দেয়ার অধিকার কারোই নেই।
কাবা ঘরকে বলা হয় মসজিদুল হারাম। এর অর্থ মহান আল্লাহর সংরক্ষিত এই স্থানে সবাই নিরাপদ। এখানে মানুষ, পশু-পাখি, মশা-মাছি, গাছপালা, ফুল ও এমনকি ঘাসও সব ধরনের অনিষ্ট থেকে মুক্ত।
কাবা ঘর নির্মিত হয়েছিল হযরত আদম (আ.)’র জীবদ্দশায়। পৃথিবীর প্রথম ইবাদত গৃহ কাবা নির্মাণ শেষে তিনি তার চারদিকে প্রদক্ষিণ করেছিলেন।হযরত ইব্রাহিম (আ.) এ ঘর পুনর্নির্মাণ করেছিলেন যাতে তার পরিবার ও বিশ্বের মুসলমানরা এখানে নামাজ আদায় করতে পারেন। বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি এক দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত লাব্বাইক বলবে তার সব গোনাহ মাফ হয়ে যাবে ও সে হয়ে পড়বে নবজাতক শিশুর মত নিষ্পাপ।
আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.) কাবা ঘরের গুরুত্ব ও মহত্ত্ব তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন,
“মহান আল্লাহ কাবাঘরের স্থান নির্ধারণ করেছেন পাথুরে পাহাড় ও স্বল্প পানিযুক্ত একটি কম জনবসতিপূর্ণ এলাকায় তাদের জাগরণের ও দৃঢ়তার মাধ্যম হিসেবে। তিনি চেয়েছেন আদম ও তাঁর সন্তানরা যেন এ ঘরমুখি হয় এবং তাদের মনকে এদিকে কেন্দ্রীভূত করে ও এ ঘরের চারদিকে ‘লা-ইলাহ ইল্লাল্লাহ’ বা আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই-একথা বলে। আল্লাহ যদি চাইতেন তাহলে নিজের ঘরকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাল ও সুন্দরতম স্থানে প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। তিনি এ ঘরের পাথরগুলোকে সবুজ মর্মর বা লাল চুনি পাথরের করতে পারতেন। কিন্তু আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে নানা বিপদ-আপদের মধ্যে পরীক্ষা করেন। তিনি চান তারা নানা অভাব-অনটনের মধ্যেও তাঁর ইবাদত করুক। তাই তিনি তাদেরকে দুঃখ-দুর্দশায় নিপতিত করেন। এসব কিছুই দেয়া হয়েছে তাদের মন থেকে সব ধরনের অহংকার ও গরিমা দূর করার জন্য এবং তাদেরকে বিনয়ী করে তোলার জন্য এবং তাঁর দয়া ও ক্ষমা সহজতর করার উপায় হিসেবে।”
কাবা মুসলমানদের ইবাদতের মূল অক্ষ এবং মুসলমানদের সামাজিক জীবনের প্রাণকেন্দ্র। মুসলমানরা প্রতিদিন কাবামুখি হয়ে ৫ বার নামাজ আদায় করেন। আর এই জিলহজ মাসে বিশ্বের বিশ থেকে ৪০ লাখ মুসলমান কাবাকে ঘিরে গড়ে তোলেন ঐক্য, সহমর্মিতা ও ভালবাসার মিলন-মেলা। এভাবে কাবাকে ঘিরে মুসলমানদের তথা আল্লাহর কাছে আত্ম-সমর্পিত মানুষদের তৌহিদি চেতনার সবচেয়ে সুন্দরতম ও সম্মিলিত শক্তির প্রকাশ ঘটছে।
মহানবী (সা.) বলেছেন, যে কেউ সাত বার আল্লাহর ঘর প্রদক্ষিণ করবে তার প্রতিটি পদক্ষেপের জন্য সৎকর্মের সওয়াব লেখা হয় ও একটি করে গোনাহ মাফ করা হয় এবং তার মর্যাদাও এক স্তর বাড়িয়ে দেয়া হয়।
...কাবাতে লুটাবো শির-৩
হজ হচ্ছে মহান আল্লাহর অভিমুখে বা আল্লাহর দিকে সফর। আল্লাহর দিকে সফর বলতে প্রকৃত অর্থে আল্লাহ ছাড়া অন্য সব-মুখী প্রবণতা ত্যাগ করাকে বোঝায় এবং শুধু আল্লাহর সান্নিধ্য চাওয়াকে বোঝানো হয়।
নামাজী যেমন নামাজ পড়ার আগে অজুর মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করেন, তেমনি হজযাত্রীকে পবিত্রতা অর্জনের লক্ষ্যে বৈধ-উপায়ে অর্জিত ইহরামের পোশাক পরতে হয় এবং গোসলের মাধ্যমে সবধরনের বাহ্যিক ও আত্মিক গোনাহ ধুয়ে ফেলার বা বর্জনের অঙ্গীকার করতে হয়। হজের মধ্যে বিভিন্ন বংশ, শ্রেণী, পদমর্যাদা, গায়ের বর্ণ কিংবা ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাই পবিত্রতার প্রতীক শ্বেত-শুভ্র কাফনের পোশাক পরে ইসলামের সাম্যের চেতনাই তুলে ধরেন।
হজযাত্রী সেলাইবিহীন এই সাদা পোশাক পরে কেবল আল্লাহর আনুগত্যের পোশাক পরার ও গোনাহ বা সব ধরনের আনুগত্যহীনতা থেকে দূরে থাকার শপথ নেন। সেলাই করা পোশাক পরে অন্য সময় ইবাদত বৈধ হলেও হজের সময় সেলাই করা পোশাক খুলে ফেলা বলতে রূপক বা প্রতীকী অর্থে নিজের তৈরি পাপের পর্দা ত্যাগ করাকে বোঝায়। হজের মধ্যে বিচার-দিবস ও কিয়ামত তথা পুনরুত্থানের মহড়া তথা হাশরের ময়দানের মহড়া দেয়া হয়।
হজের মধ্যে তালবিয়া উচ্চারণের তাৎপর্য হল, হে আল্লাহ! আমি যা সত্য ও সঠিক তা-ই যেন বলি, অন্যায় কথা বা অন্যায় সাক্ষ্য থেকে যেন দূরে থাকি। এভাবে জিহ্বা ও চিন্তার পবিত্রতা তথা আত্মিক-পবিত্রতা অর্জন হজের অন্যতম লক্ষ্য। ইহরামের তাৎপর্য হল, আল্লাহর নির্দেশিত হালাল ও হারামকে সব সময় মেনে চলার অঙ্গীকারে অটল থাকা।
আল্লাহর ঘর তাওয়াফের অর্থ হল, মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই মানুষের সমস্ত তৎপরতার লক্ষ্য হওয়া উচিত, দুনিয়ার ঘর-বাড়ী নয়, আল্লাহর ঘরই মানুষের প্রকৃত ঠিকানা। হাজরে আসওয়াদ বা পবিত্র কালো পাথরে হাত রাখা বা চুমো দেয়ার তাৎপর্য হলো আল্লাহর প্রতীকী হাতে হাত রেখে তাঁর নির্দেশ পালনের অঙ্গীকার করা বা তাঁর নির্দেশকেই শিরোধার্য মনে করা। সাঈ বা সাফা ও মারওয়াতে দৌড়ানোর অর্থ হলো ভয় ও আশার মাঝামাঝি অনুভূতি নিয়ে ইহকালীন এবং পারলৌকিক কল্যাণ লাভের জন্য চেষ্টা-সাধনা করা। এর সাথে জড়িয়ে আছে নব-জাতক সন্তানের পিপাসা মেটানোর জন্য বিবি হাজেরার প্রচেষ্টার পূণ্য-স্মৃতি।
আরাফাতে অবস্থানের তাৎপর্য হল আল্লাহ সম্পর্কে জানা, আল্লাহ যে সর্বশক্তিমান এবং সব জানেন ও সব-কিছুই যে তাঁর কাছেই চাওয়া উচিত- এইসব বিষয়ে চেতনাকে শানিত করা।
আরাফাতে অবস্থিত জাবাল আর রাহমাত নামক পর্বত মুমিন বা বিশ্বাসীদের জন্য আল্লাহর বিশেষ রহমতের প্রতীক। মোটকথা আরাফাতের ময়দান শাহাদত, মারেফাত ও এরফানকে উপলব্ধির ক্ষেত্র। হজ-যাত্রীরা এখানে স্মরণ করেন অনেক মহামানবের অমর কীর্তিকে এবং পাঠ করেন ইমাম হুসাইন (আ)'র অমর 'দোয়ায়ে আরাফা'। আরাফাত ও মিনার মধ্যবর্তী স্থান মাশআরুল হারাম নামক স্থানে রাত্রি যাপন হজের আরেকটি বড় দিক। এখানে রাত্রি যাপনের দর্শন হল নিজের মধ্যে খোদাভীতির চেতনা ও শ্লোগানকে বদ্ধমূল করা। এখানে থেকে হাজিরা শয়তানকে পাথর মারার জন্য পাথরের নুড়ি সংগ্রহ করেন। শয়তানের সাথে মোকাবেলার জন্য তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জন পূর্ব শর্ত।
মিনায় শয়তানকে পাথর বা কঙ্কর নিক্ষেপের সাথে জড়িয়ে আছে হযরত ইব্রাহীম (আঃ)'র স্মৃতি। তিনি যখন একমাত্র সন্তান ইসমাইল (আঃ)কে কোরবানী করতে উদ্যত হন তখন শয়তান মানুষের ছবি ধরে তাঁকে এ কাজে বিরত রাখার জন্য কুমন্ত্রণা দেয়ার চেষ্টা করে। এ অবস্থায় তিনি শয়তানকে তাড়ানোর জন্য কঙ্কর নিক্ষেপ করেছিলেন।
নিজের মনকে ও সমাজকে শয়তানের বা তাগুতি শক্তিগুলোর হাত থেকে রক্ষার মহাশিক্ষা রয়েছে এ ঘটনায়।
আর এ মহাশিক্ষাকে বদ্ধমূল করার জন্যেই হজের অন্যতম দিক হল শয়তানের প্রতি পাথর নিক্ষেপ।
অন্যকথায় শয়তানকে পাথর ছোঁড়া বলতে মানুষের ভেতরকার অভ্যন্তরীণ কুপ্রবৃত্তি দমন করার পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রের শোষক এবং তাগুতি শক্তির বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ করাকে বোঝায়। বর্তমান যুগে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোই শয়তানের ভূমিকায় অবতীর্ণ। তাই তাদের দোসর ও অনুচরদের বিরুদ্ধে সক্রিয় হবার শপথ নেয়া এবং সমাজে প্রকৃত ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য সাংস্কৃতিক, আর্থিক, রাজনৈতিক ও প্রয়োজনে সামরিক সংগ্রামে লিপ্ত হওয়া হজের অন্যতম শিক্ষা।
কোরবানী করার সুপ্ত অর্থ হল নিজের মনের সমস্ত কূপ্রবৃত্তি এবং কামনা-বাসনাকে আল্লাহর নির্দেশের কাছে বিসর্জন দিতে হবে। যে প্রাণ বা সন্তান-সন্ততি মানুষের সবচেয়ে প্রিয় তা-ও প্রয়োজনে আল্লাহর জন্য বিলিয়ে দেয়ার শিক্ষা দিয়ে গেছেন হযরত ইব্রাহীম ও হযরত ইসমাইল (আঃ)।
কাবা ঘর তাওয়াফ শেষ করার পর হাজিকে মাকামে ইব্রাহীমের পেছনে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে হয়। এর প্রতীকী তাৎপর্য হল, হাজিকে ইব্রাহিম (আঃ)'র মত পবিত্র হতে হবে এবং একনিষ্ঠ একত্ববাদী হয়ে নামাজ পড়তে হবে। এভাবে নিজেকে শুদ্ধ, পবিত্র ও যোগ্য করার পরই হাজি বা ঈমানদার মানুষ সমাজ-সংস্কারে নিয়োজিত হতে পারেন।
হজ আধ্যাত্মিক এবাদতের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সামাজিক এবাদত। মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক ও সামাজিক ঐক্য গড়ে তোলা হজের অন্যতম লক্ষ্য। হজের সময় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলমানরা পরস্পরের দুঃখ-দুর্দশা ও সমস্যা সম্পর্কে জানার পাশাপাশি একে-অপরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে পারে এবং কাফির ও মুশরিকদের ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। আর এ জন্যই বারাআত বা কাফির-মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা হজের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ।
হজের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হল, আল্লাহর নির্দেশ ও আইনকে সব কিছুর উপরে প্রাধান্য দেয়া। হযরত ইসমাইল (আঃ) যেমন আল্লাহর নির্দেশে নিজেকে পিতার হাতে কোরবানী করতে রাজী হয়েছিলেন এবং ইসলামকে দূষণ ও বিকৃতির হাত থেকে রক্ষার জন্য হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) যেভাবে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন তেমনি আমাদেরকেও ইসলামের স্বার্থে চরম আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। প্রতি বছর হজ আমাদেরকে সে জন্য প্রস্তুতি নেয়ার, প্রশিক্ষণ নেয়ার এবং যোগ্যতা অর্জনের ডাক দিয়ে যায়। #
রেডিও তেহরান/এএইচ
source : irib