বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক ও মহামানব। মানুষের জন্য আত্ম-সংশোধন, সর্বোত্তম চরিত্র গঠন ও চিরস্থায়ী সুখ বা সৌভাগ্যের পথ-নির্দেশনা পাওয়া যায় এই মহামানবের বাণীতে। অমূল্য শিক্ষামূলক সেইসব দিক-নির্দেশনা ক্রমান্বয়ে তুলে ধরার উদ্যোগ নিয়েছি আমরা। আজ আমরা আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ.)'র কাছে বর্ণিত বিশ্বনবী (সা.)'র কিছু অমূল্য বাণী তুলে ধরব।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র, উত্তরাধিকারী ও সঙ্গী আলী (আ.)-কে সম্বোধন করে বলেছেন:
হে আলী! ইয়াকীন (তথা অবিচল বিশ্বাস)-এর একটি চিহ্ন হলো আল্লাহকে রাগান্বিত করে কাউকে খুশী করবে না। আর আল্লাহ্ তোমাকে যা দান করেছেন তার জন্য কাউকে প্রশংসা করবে না। আর যা তোমাকে দেননি সেজন্য কাউকে ভর্ৎসনা করবে না। কারণ, কোনো লোভীর লোভ জীবিকা আনতে পারে না, আবার কোনো অনিষ্টকামীর অপছন্দ তা রুখতে পারে না। নিশ্চয় মহান আল্লাহ্ স্বীয় প্রজ্ঞা ও মর্যাদায় আনন্দ এবং খুশীকে ইয়াকীনের মধ্যেই নিহিত রেখেছেন। আর দুঃখ এবং কষ্টকে নিহিত রেখেছেন সন্দেহ আর ক্রোধের মধ্যে।
হে আলী! আসলে মূর্খতার চেয়ে দারিদ্র্য আর কিছু নেই। আর বিচক্ষণতার চেয়ে ফলদায়ক আর কোনো সম্পদ নেই। স্বার্থপরতার চেয়ে ভয়ঙ্কর আর কোনো একাকিত্ব নেই। আর পরামর্শের চেয়ে ভালো কোনো সহযোগিতা নেই। চিন্তা করার মতো কোনো বুদ্ধিবৃত্তি নেই। আর সচ্চরিত্রের মতো কোনো বংশ পরিচয় নেই। আর চিন্তার মতো কোনো ইবাদত নেই।
বিশ্বনবী (সা.) আরো বলেছেন, হে আলী! কথার রোগ হলো মিথ্যা আর জ্ঞানের রোগ বিস্মৃতি, ইবাদতের রোগ অলসতা, দানের রোগ করুণা দেখানো ও এ জন্য গর্ব করা, সাহসিকতার রোগ অত্যাচার, সৌন্দর্যের রোগ অহংকার আর বংশের রোগ বড়াই।
হে আলী! সত্যের ওপর থাকবে। তোমার মুখ দিয়ে যেন কখনো মিথ্যা বের না হয়। কখনো বিশ্বাসঘাতকতা বা খিয়ানতের দুঃসাহস করো না। আল্লাহকে এমনভাবে ভয় করো যেন তুমি তাঁকে দেখছ। তোমার জান-মালকে দীনের জন্য উৎসর্গ করো। সৎ চরিত্রের অধিকারী হও এবং সেগুলোকে কাজে লাগাও। আর অসৎ চরিত্রের সঙ্গ বর্জন করে চল এবং তা থেকে দূরে থাক।
হে আলী! আল্লাহর কাছে খুবই প্রিয় কাজ তিনটি : যে ব্যক্তি আল্লাহর নির্দেশিত ফরজ কাজগুলো পালন করে সে হলো সবচেয়ে আবেদ লোক, আর যে ব্যক্তি আল্লাহর পক্ষ থেকে নিষিদ্ধ কাজগুলো থেকে বেঁচে চলে সে হলো সবচেয়ে সংযমী মানুষ। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তার জন্য যে জীবিকা নির্ধারিত করেছেন তাতেই তুষ্ট থাকে, সে হলো সবচেয়ে সামর্থ্যবান ব্যক্তি।
বিশ্বনবী (সা.) আরো বলেছেন, হে আলী! তিনটি কাজ উত্তম চরিত্রের অন্তর্ভুক্ত: যে ব্যক্তি তোমার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেছে তার সাথে সম্পর্ক গড়বে, যে তোমাকে বঞ্চিত করেছে তাকে তুমি দান করবে আর যে তোমার প্রতি অন্যায় করেছে তাকে তুমি ক্ষমা করবে।
হে আলী! পরিত্রাণকারী তিনটি: তোমার জিহ্বাকে সংযত রাখবে, তোমার ভ্রান্তির জন্য ক্রন্দন করবে আর (ফিতনার সময়) তোমার ঘরে আশ্রয় গ্রহণ করবে।
হে আলী! কর্মের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় তিনটি: তোমার নিজের থেকে লোকজনের প্রতি ন্যায্য আচরণ করবে, আল্লাহর কারণে তোমার ভাইয়ের সাথে সমান হবে। আর সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করবে।
বিশ্বনবী (সা.) আরো বলেছেন, হে আলী! আল্লাহর সৌন্দর্য তিনটি বিষয়ে: যে ব্যক্তি আল্লাহর কারণে তার মুমিন ভাইয়ের সাক্ষাতে গমন করে অর্থাৎ সে আল্লার জিয়ারতকারী। আর আল্লাহর জিয়ারতকারীর সম্মান রক্ষা করা আল্লাহরই কর্তব্য। তাই সে যা কামনা করে তিনি তা দান করেন। যে ব্যক্তি নামায পড়ে অতঃপর দোয়া-দরুদ ও মোনাজাতে অতিবাহিত করে পরবর্তী নামায পর্যন্ত। অতএব, সে আল্লাহর মেহমান। আর আল্লাহর মেহমানের সম্মান রক্ষা করা আল্লাহরই কর্তব্য। আর হজ্ব এবং ওমরাহ্ এ দু’টি হলো আল্লাহর কাছে দূতের আগমন। আর আগন্তুক দূতের মর্যাদা রক্ষার কর্তব্য আল্লাহরই।
হে আলী! তিনটি কাজের সওয়াব দুনিয়া ও আখিরাতে বিস্তৃত: হজ্ব যা দারিদ্র্য দূর করে, সদকাহ্ যা বিপদ থেকে রক্ষা করে আর আত্মীয়ের সম্পর্ক জোড়া লাগানো যা আয়ু বৃদ্ধি করে।
হে আলী! তিনটি জিনিস রয়েছে যা কোনো ব্যক্তির মধ্যে না থাকলে তার কর্ম সফল হয় না: আত্মসংযম যা তাকে মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের অবাধ্যতা থেকে বাঁচায়, বিদ্যা যা তাকে নির্বুদ্ধিতার অজ্ঞতা থেকে রক্ষা করে, আর বুদ্ধিমত্তা যা দিয়ে মানুষের সাথে সে মানিয়ে চলবে।
হে আলী! তিন শ্রেণীর লোক কিয়ামতের দিন আরশের ছায়ায় থাকবে: যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের জন্য সেটাই চায় যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে। যে ব্যক্তি কোনো কাজের মুখোমুখি হলে ততক্ষণ পর্যন্ত সে কাজে পা বাড়ায় না কিংবা পিছিয়ে আসে না যতক্ষণ সে না জানে যে, কাজটি আল্লাহর পছন্দের নাকি অপছন্দের। আর যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের ছিদ্রান্বেষণ করতে যায় না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই ত্রুটিটি নিজের মধ্যে থেকে সংশোধন না করে ফেলে। কেননা, যখনই একটি ত্রুটি সংশোধন করে নেয় নতুন আরেকটি ত্রুটি দৃষ্টিগোচর হয়। সুতরাং মানুষের জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে।
হে আলী! পুণ্যের দরজা তিনটি: মনের উদারতা, মিষ্ট ভাষা, আর কষ্ট ও উৎপাতে ধৈর্যধারণ।
বিশ্বনবী (সা.) আরো বলেছেন, হে আলী! তাওরাতে চারটি কথার পাশে আর চারটি বাণী রয়েছে : যে ব্যক্তি দুনিয়ার প্রতি মোহগ্রস্ত হয় সে আল্লাহর ওপর রাগান্বিত হয়ে (দিনাতিপাত করে)। যে ব্যক্তি তার ওপর নিপতিত বিপদের জন্য অভিযোগ করে সে আল্লাহর বিরুদ্ধেই নালিশ করে। যে ব্যক্তি কোনো ধনাঢ্যের নিকট এসে নিজেকে হীন করে তার এক-তৃতীয়াংশ ঈমান বিনষ্ট হয়ে যায়। আর এ উম্মতের মধ্যে দোযখে যাবে সেই ব্যক্তি যে আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে উপহাস ও খেলনার পাত্র বানাবে।
চারটি জিনিসের পাশে চারটি জিনিস থাকে : যে রাজা হয়, সে স্বেচ্ছাচারিতা করে, যে পরামর্শ করে না অনুতপ্ত হয়, যেমন আচরণ করবে তেমনই আচরণ পাবে, আর অভাব হলো বড় মৃত্যু। তাঁকে প্রশ্ন করা হলো, স্বর্ণ-রৌপ্যের অভাব? উত্তরে বলেন : দীন-এর (ধর্মীয় জ্ঞান ও ঈমানের) অভাব।
হে আলী! কিয়ামতের দিন প্রত্যেক চোখই ক্রন্দনরত থাকবে তিনটি চোখ ব্যতীত : যে চোখ আল্লাহর রাস্তায় বিনিদ্র রাত কাটায়, যে চোখ আল্লাহর নিষিদ্ধ হারাম থেকে অবনত থাকে, আর যে চোখ আল্লাহর ভয়ে অশ্রু ঝরায়।
হে আলী! ধন্য সেই মুখমণ্ডল যার দিকে আল্লাহ্ তাকিয়ে দেখেন যে, এমন পাপের জন্য সে ক্রন্দনরত যে সম্পর্কে আল্লাহ্ ব্যতীত আর কেউ খবর রাখে না।
বিশ্বনবী (সা.) আরো বলেছেন, হে আলী! তিনটি জিনিস ধ্বংসকারী। আর তিনটি বিষয় পরিত্রাণ দানকারী : ধ্বংসকারী তিনটি হলো: রিপুর কামনা যার অনুসরণ করা হয়, কৃপণতা যা মেনে চলা হয় আর মানুষের আত্ম-পূজা। অপরদিকে পরিত্রাণ দানকারী তিনটি বিষয় হলো: সন্তুষ্টি ও ক্রোধের মধ্যে ন্যায়পরায়ণ থাকা, সামর্থ্য ও অভাবের মধ্যে মিতচারী হওয়া, আর গোপনে ও প্রকাশ্যে আল্লাহকে ভয় করে চলা যেন তুমি তাঁকে দেখছ। আর যদি তুমি না দেখতে পাও, তিনি তোমাকে দেখছেন।
হে আলী! তিনটি ক্ষেত্রে মিথ্যা সুন্দর: (ন্যায়, সত্য ও ধর্মের পথে পরিচালিত) যুদ্ধে ধোঁকাবাজি, তোমার স্ত্রীকে (সন্তুষ্ট করার জন্য) প্রতিশ্রুতি দান, আর মানুষের মধ্যে মীমাংসার কাজে।
হে আলী! তিনটি ক্ষেত্রে সত্য কুৎসিত: (মনোমালিন্য বা দ্বন্দ্ব সৃষ্টিতে সহায়ক) একের কথা অন্যকে বলা, কোনো পুরুষকে তার স্ত্রী (বা পরিবার) সম্পর্কে (অপছন্দনীয়) সংবাদ দেয়া এবং কোনো সৎ কাজের দাবীদার ব্যক্তির দাবীকে অস্বীকার করা।
হে আলী! চারটি কাজ অনর্থক: পূর্ণ উদরে আহার করা, উজ্জ্বল চন্দ্রের উপস্থিতিতে আলো জ্বালানো, লবণাক্ত জমিতে চাষ করা এবং অপাত্রে উপকার করা।
বিশ্বনবী (সা.) আরো বলেছেন, হে আলী! চার ধরনের লোক রয়েছে যাদের দ্রুত শাস্তি দেয়া হয়: যে ব্যক্তির প্রতি তুমি উপকার করো, অথচ প্রতিদানে সে তোমার অপকার করে, যে ব্যক্তির ওপর তুমি জুলুম করো না, কিন্তু সে তোমার ওপর অত্যাচার করে, যে ব্যক্তির সাথে তুমি চুক্তিবদ্ধ হও এ ইচ্ছা বা সংকল্প নিয়ে যে তুমি চুক্তির প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে আর তার সংকল্প হলো চুক্তি ভঙ্গ করা, আর যে ব্যক্তির সাথে তুমি আত্মীয়তার সম্পর্ক জোড়া লাগাও, অথচ সে সম্পর্ক ছিন্ন করে।
হে আলী! চারটি জিনিস যার মধ্যে থাকে তার ইসলাম পরিপূর্ণ হয়: সততা, কৃতজ্ঞতা, লজ্জা এবং সদাচরণ।
হে আলী! মানুষের কাছে নিজের অভাব বা চাহিদাগুলো কম প্রকাশ করাই হলো নিরভবতা আর মানুষের কাছে নিজের অভাবগুলো বেশি প্রকাশ করাই হল লাঞ্ছনা ও দারিদ্র্য।
মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে এইসব অমূল্য বাণী মেনে চলার তাওফিক দিন। আমিন।
[সুত্র ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার : "তুহাফুল উকুল আন আলের রাসূল (সা.)","আলে রাসূল (সা.) থেকে বুদ্ধিমানদের জন্য উপহার"। মূল: শেখ আবি মুহাম্মাদ আল হাসান ইবনে আলী ইবনেল হুসাইন ইবনে শুবাত আল-হাররানি (রহ.), হিজরী চতুর্থ শতকের প্রখ্যাত পণ্ডিত। বঙ্গানুবাদ: আব্দুল কুদ্দুস বাদশা, সম্পাদনা : এ কে এম আনোয়ারুল কবির]
source : alhassanain