এক
সাংখ্য মতে প্রকৃতি ও পুরুষ অনাদি ও নিত্য। প্রকৃতি জড়,পুরুষ চেতন। প্রকৃতি বিষয়,পুরুষ বিষয়ী;অর্থাৎ প্রকৃতি কর্ম (مفعول),পুরুষ কর্তা (فاعل)।
হার্বাট স্পেনসরের মতে বস্তুর উৎপত্তি ও বিনাশ নাই,অবস্থান্তর আছে। স্যার উইলিয়াম ব্রুকস্ বলেন : সমস্ত মৌল উপাদান বা পদার্থ (elements) এক চরম উপাদান বা পদার্থের (protyle) বিশেষ অবস্থায় বিশেষ সংঘাতজনিত বিকার মাত্র। এ চরম উপাদান ও মৌল পদার্থই প্রকৃতি।
সাংখ্য মতে প্রকৃতি ও পুরুষ বিশ্বের চরম দ্বৈতরূপ (ultimate quality)। গীতায় সাংখ্যোক্ত এ প্রকৃতি ও পুরুষকে পরম পুরুষের দু’টি সত্তা বা বিধা (aspect) বলে স্বীকার করা হয়েছে। গীতার মতে পরম পুরুষই চরমতত্ত্ব। সাংখ্যোক্ত প্রকৃতি ও পুরুষ চরম নয়। জীব ও জড় পরম পুরুষের বিভাব মাত্র। প্রকৃতি ও পুরুষ-জীব ও জড় এ দুয়ের সমন্বয়ে যে একত্বে উপনীত হওয়া যায়,সাংখ্যে তার আভাস না থাকলেও গীতায় তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
প্রখ্যাত দার্শনিক ম্যাক্সমুলার তাঁর ‘ইন্ডিয়ান ফিলসফি’ নামক গ্রন্থে এ কথারই স্বীকৃতি দান করেছেন। তিনি বলেন :
It was true that sankhy Philosophy was accused of atheism but that atheism was very different from what we meant by it. It was the negation of the necessity of admitting an active or limited personsal God.১
পরবর্তীকালে পতঞ্জলি যে তত্ত্ব প্রকাশ ও প্রচার করেন,তাতে ঈশ্বরকে সাংখ্যোক্ত পুরুষ বলে স্বীকার করা হয়নি;তাতে প্রকৃতপ্রস্তাবে যে ঈশ্বরতত্ত্ব ব্যাখ্যাত হয়েছে তাকে ‘ঈশ্বর-সাংখ্য’ বলা যেতে পারে।
বেদান্তেও গীতার মতের সমর্থন পাওয়া যায়,সাংখ্যের দ্বৈতবাদের স্বীকৃতি সেখানে অনুপস্থিত। বেদান্তের মতে ব্রহ্মই একমেবাদ্বিতীয়ম,ব্রহ্মই চরম;এ বিশ্বে বিভিন্ন ভূতে বিকশিত স্বয়ম্ভূ (খোদা) ভিন্ন আর কিছুরই অস্তিত্বের স্বীকার করা যায় না।
প্রকৃতি ছাড়া আরো একটা উপাদান বা ভূতের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়। তার নাম power, force বা energy । এ আবার দু’রকমে প্রকাশ পায়। এক প্রকার হলো জৈবশক্তি বা physical force এবং দ্বিতীয় প্রকার হলো জীবশক্তি বা psychic force । জৈবশক্তিকে কয়েকভাগে ভাগ করা হয়েছে : তাপ (heat),আলো (light),বিদ্যুৎ (electricity),আকর্ষণ (megnetism)। জীবশক্তিকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে : জীবশক্তি (psychic force) এবং প্রাণশক্তি (vital force)।
ভারতীয় দর্শন এ মৌল উপাদানগুলোকে ‘ভূত’ নামে আখ্যাত করেছে। উপনিষদের পঞ্চ ভূত : ক্ষিতি,অপ,তেজ,মরুৎ ও ব্যোম উপরিউক্ত মৌল উপাদানগুলোরই নামান্তর মাত্র। জরথুস্ত্রবাদীদদের মতে এগুলোই আবার আব,আতশ,খাক ও বাদ-এ চার উপাদানে রূপ পেয়েছে।
অদ্বৈত মতে যাঁরা বিশ্বাস করেন,তাঁদের মতে জীবই ব্রহ্ম,তবে আমাদের কাছে জীব ও ব্রহ্মের যে বিভিন্ন রূপ প্রতীয়মান হয় তা বস্তুত সত্য নয়। তা মায়া মাত্র। জীব ও ব্রহ্ম যে অভিন্ন এ তত্ত্বজ্ঞান দৃঢ় হলেই অবিদ্যা বা মোহের নিবৃত্তি ঘটে। তাই অদ্বৈত মতে জীব ও ব্রহ্মজ্ঞানের ঐক্য জ্ঞানই মুক্তির উপায়।
গৌতম বুদ্ধ জীব ও ব্রহ্মজ্ঞানের এ ঐক্যবোধের সীমান্তে এসে সর্বজ্ঞানের বিসর্জন দেওয়ার প্রত্যয়েই নির্বাণের পথ খুঁজেছেন।
বিশিষ্ট অদ্বৈত মতে আরো একটু এগিয়ে এসে বলেছে : পরম পুরুষ থেকেই জীবের উৎপত্তি,তাতেই তার স্থিতি এবং তাতেই তার লয়। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে “মিনহা খালাকনাকুম,ফিহা নুয়িদুকুম ও মিনহা নুখরিজুকুম তারাতান উখরা।” অর্থাৎ তা থেকেই তোমাদের সৃষ্টি করেছি,তাতেই তোমাদের ফিরিয়ে নেব এবং তা থেকেই তোমাদের আবার বের করব।
বিশিষ্ট অদ্বৈত মতে পুরুষ ও প্রকৃতি উভয়ের মধ্যেই পরম পুরুষ বা পরমেশ্বর অন্তর্যামীরূপে বিরাজমান। অর্থাৎ প্রকৃতি ও পুরুষের মধ্যে পরম পুরুষের বিকাশ মাত্র। তাই প্রকৃতি ও পুরুষ এ দু’টি পরম পুরুষের প্রকার,বিভাগ,রূপভেদ মাত্র। চিৎ ও জড় তারই নজিররূপে তারই রূপ বা প্রকাশ মাত্র। তিনি আত্মা থেকে আত্মার অন্তরে অবস্থিত। আত্মা তার ‘জ্ঞা’ নয়,আত্মা তার শরীর। তিনি আত্মায় থেকে আত্মারই অন্তরীক্ষে বিদ্যমান অন্তর্যামী। বিশিষ্ট অদ্বৈত মতে,ব্রহ্মা যখন অত্যন্ত ব্যস্ত,তখন জীব কোন মতেই ব্রহ্মাংশ বা খণ্ড ব্রহ্ম হতে পারে না। জীব ব্রহ্মের বিভূতি। এঁদের মতে পরম পুরুষ বা মুক্তপুরুষ কোনমতেই ব্রহ্মের স্বরূপ ‘ঐক্য’ লাভ করতে পারেন না। এ তাঁর স্বভাব বা জাতে (ذات) নেই। পুরুষ ও প্রকৃতি ব্রহ্মের স্বভাব প্রাপ্ত হন ব্রহ্মোচিত গুণ লাভ করেন বটে,কিন্তু ব্রহ্মের সঙ্গে একীভূত হন না। অর্থাৎ এটা তাঁর ‘সিফাত’ (صفات) মাত্র। অদ্বৈতবাদীর মতে জীব মোহমুক্ত হয়ে ব্রহ্মের সাথে একত্বপ্রাপ্ত হয়। দ্বৈতবাদের মুক্তি ঠিক এরূপ নয়। এখানেই দ্বৈত ও অদ্বৈতবাদের পার্থক্য।
শংকরের মতে নির্গুণ ব্রহ্মই সত্য;সগুণ ব্রহ্ম সত্য নয়। অর্থাৎ যা ঘটে তা সব সত্য নয়। মায়াবাদীদের মতও অনুরূপ। রামানুজের মতে একমাত্র সগুণ ব্রহ্মই সত্য;নির্গুণ ব্রহ্ম অসত্য। অদ্বৈতবাদীরা ব্রহ্মকে নির্গুণ,নির্বিশেষ ও অলংকারহীন মনে করেন। বিশিষ্ট দ্বৈতবাদীরা ব্রহ্মকে সগুণ,সবিশেষ ও সালঙ্কার বলে বিশ্বাস করেন। এঁদের মতে পরম পুরুষ ব্রহ্ম প্রেমময়,দয়াময় ও শক্তিমান।
গীতাও এ মতের সমর্থন ও পোষণ করে। অদ্বৈতবাদীর মত দ্বৈতভেদ বা প্রকৃতিভেদ মায়া বা কল্পনা মাত্র। বিশিষ্টাদ্বৈতবাদীর মতে জগতে যে বিভিন্ন বৈচিত্র্যের লীলা প্রত্যক্ষীভূত হয়,তা ব্রহ্ম বা পরম পুরুষেরই প্রকার বা বিধা (aspect)। বিধার মাধ্যমে প্রকৃতির কাছে স্পষ্ট প্রকাশিত বলেই তাঁর নাম ‘বিধি’। আর যেভাবে বিভাবিত হয়,বা যে নিয়মে নিয়ন্ত্রিত হয় তার নাম ‘বিধান’ বা নিয়ম। সেমেটিক শাস্ত্রে যাকে বলে,‘আল হুকমু’। স্মর্তব্য : ইনিলহুকুম ইল্লা লিল্লাহ্-বিধান তো একমাত্র আল্লাহরই।
গীতার মতে প্রকৃতি ও পুরুষ,জড় ও চিৎ উভয়ই পরমাত্মার বা ব্রহ্মের প্রকার বা বিধা। এ দুয়েরই সংযোগে সমস্ত ভূতের (elements) উৎপত্তি। যা নিহিত বা বিলীন (Potent) তার প্রকাশই সৃষ্টি (emergence)। এ বিশ্বে নিষ্প্রাণ উপাদান (dead matter)-এর অস্তিত্ব নেই। সব কিছুই বা সব ভূতই তার জীবনে বা বিধায় উজ্জীবিত ও তাঁর নূরে বা ভাতিতে আলোকিত-ভাস্বর চিন্ময়। ব্রহ্ম থেকেই সকল বস্তুর উৎপত্তি-তাতেই তাদের জীবন এবং পরিশেষে তাতেই সব বিলীন হবে। এ জগত মায়া বা কল্পনা নয়,অলীক নয়,জগতে যা কিছু আছে,তা হয় প্রকৃতি,না হয় পুরুষ। প্রকৃতি ও পুরুষ যখন পরম ব্রহ্মেরই বিধা বা প্রকার তখন এক ব্রহ্ম ব্যতীত আর কিছুর অস্তিত্ব খোঁজা নিরর্থক। তিনি এক,অদ্বিতীয়,তাঁর মতো কেউ নেই,তাঁকে ছাড়া বহু নেই। তিনিই বহু বিধায় বিকশিত। তাই তিনি একমেবাদ্বিতীয়ম। তিনি ইচ্ছাময়। যখন তিনি বহু হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন,ইরাদা করেন,তখনই তিনি ‘বহুশ্যাম’-‘আমি বহু হব’ বলে বিধায় বিভাত হন।
সেমিটিক মতে আল্লাহ্ এক,অদ্বিতীয়,অভাবশূন্য,তিনি জনকও নহেন,প্রজাতও নহেন,তাঁর সমকক্ষ সমজাতের সমবিধার কিছু নেই।১ক তিনি একক। আল্লাহ্ আকাশ ও পৃথিবীর আলো অর্থাৎ তাঁর আলোতেই সৃষ্টি দৃষ্টিগোচর বিভাত।১খ বিধান,বিহিত বা নির্দেশনা তাঁরই।২ তিনি ইচ্ছাময়,সর্বশক্তিমান। যখনই তিনি কোন কিছুর ইচ্ছা পোষণ করেন তখন তিনি বলেন : ‘হও’,আর অমনি তা হয়ে যায়।৩ অর্থাৎ এ পরিদৃশ্যমান জগৎ তাঁরই ইচ্ছায় সৃষ্ট,তাঁরই ইচ্ছার বিধা। তাঁর ইচ্ছার ওপরে কারো ইচ্ছা কার্যকরী হওয়ার নয়। সাধারণ ভাষায় ‘খোদার ওপর কারো খোদকারি’র অবকাশ নেই।
আত্মা বা রুহের বিনাশ বা মৃত্যু নেই। শরীরের বিনাশে আত্মার বিনাশ হয় না। যেমন,কোন দৃশ্য যা আমি দেখেছি,আমার মনে অঙ্কিত হয়ে রয়েছে;সে দৃশ্যের আবির্ভাব আর ঘটবে না,কিন্তু আমার কাছে তার ছবি চিরন্তন স্বাক্ষর রেখে গেছে। ‘সে নবজগতে কাল-স্রোত নাই,পরিবর্তন নাহি’।৪
আত্মা নিত্য শাশ্বত। সাধারণত চিদাভাসই,যাকে brain consciousness বলা হয়,আমাদের নিকট আত্মা বলে প্রতীয়মান হয়। আরও একটু এগিয়ে গেলে,আবার মন বা mind,প্রজ্ঞা বা intellect এবং ইচ্ছা বা will-কেই আত্মা বলে মনে হয়। কিন্তু প্রকৃতপ্রস্তাবে এদের কোনটিই আত্মা নয়। এগুলো অপরাপর বিধামাত্র। এ সবগুলোকে মিলিয়ে নিম্নস্তরের ‘আত্মা’ বা lower self বলা চলে। এগুলো কিছুতেই ঊর্ধ্বস্তরের আত্মা বা higher self নয়। অন্য কথায়,এগুলো চিন্মাত্র নয়,চিদাভাস মাত্র।৫ চিদাভাস যখন আত্মায় বিলীন হয়,কেবল তখনই বলতে পারে ‘সো অহং’-তিনিই আমি এবং ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’-আমিই ব্রহ্ম। এ প্রসঙ্গেই স্মরণ করা যেতে পারে : ‘আনাল হক’-আমিই সত্য;‘আনা হুয়া’-আমিই তিনি;‘হুয়া আনা’-তিনিই আমি।
কথাটা রূপকে এভাবে বলা যায় : এ শিশির বিন্দু,সমুদ্র নয়;কিন্তু সমুদ্রের আভাস এতে আছে। এ শিশির বিন্দুকে চিদাভাস বা lower self বলে মনে করে নিলে এবং সমুদ্রকে চিস্ময় বা higher self মনে করে নিলে,শিশির বিন্দু যখন সমুদ্রে নিমজ্জিত হয় তখনই সে বলতে পারে,‘সমুদ্রই আমি,আমিই সমুদ্র’। অর্থাৎ লীন অবস্থায় ‘তিনি’ ও ‘আমি’,‘সো’ এবং ‘অহং’,সমুদ্র ও শিশিরের পার্থক্য-জ্ঞান লুপ্ত হওয়াই স্বাভাবিক। যখন আলাদা সত্তা নেই তখন আলাদা করে বলব কি করে? এ যেন অনেকটা শরবতের মতো। চিনি ও পানি যখন মিশে গেছে,তখন পানি এবং চিনি প্রত্যেকের পক্ষে যেমন ‘শরবতই আমি’ এবং ‘আমিই শরবত’ বলায় অসংগতি দেখি না,তেমনি ‘সত্যই আমি,আমিই সত্য’ ‘আনাল হক’ বলায়ও অসংগতি দুর্নিরীক্ষ্য।
ভাগবতে এ ‘অহং’-কে এভাবে দেখা হয়েছে : ভগবান চিৎ ও কর্মময়। তাঁর ইচ্ছা রূপ পরিগ্রহ করে জগতে অবতীর্ণ হন দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের জন্য-সৃষ্টির রক্ষার জন্য,তাঁর অংশাবতাররূপে। তাই তিনি বলেন,‘যুগে যুগে সম্ভবামি’। তাই দেখি কৃষ্ণ ভগবানেরই স্বরূপ,তাঁরই অংশ। শয়তানের তাণ্ডবলীলায় ধরিত্রী যখন টলটলায়মান,তখন তা রক্ষার উদ্দেশ্যে ভগবান নিজেই কৃষ্ণ রূপ ধরে ধরায় নেমে আসেন। তাঁর মানবীয় লীলা তাই ভগবত লীলারই নামান্তর। তাঁর জীবলীলা একটি প্রতীকি মাত্র। তিনি স্বয়ং ভগবান,স্রষ্টা এবং পালনকর্তা অর্থাৎ ভর্তা। তিনি স্রষ্টা,ষোড়শ সহস্র গোপিনী সৃষ্টি। তিনি পুরুষ,তারা প্রকৃতি। এ সঙ্গে তুলনীয় : খালেক-স্রষ্টা ও মাখলূক-সৃষ্টি।
সৃষ্টির মধ্যে নানাভাবে,নানা বিধায় বিভাসিত তিনি পুত্র-বন্ধু-সখা হিসেবে কেলী করেছেন। তাঁরই ইচ্ছায় নিজেকে বিলিয়ে দেওয়াই সৃষ্টির (আবদ বা বান্দার) কাজ আর তা-ই সৃষ্টির উদ্দেশ্য। ভাগবতের পরমেশ্বরের বিষ্ণু অবতার পরিকল্পে অংশাবতার হিসাবে কৃষ্ণকে ভগবান জ্ঞানে সাধনা-ভজনা করা তাই এক শ্রেণীর লোকের ধর্মমতে পরিণত হলো। এরাই বৈষ্ণব। ভাগবতের মতে ভক্ত ও ভগবানের সম্পর্ক কর্তা ও কর্মের সর্ম্পক,বিষয়ী (Subject) ও বিষয় (Object)-এর সর্ম্পক। সৃষ্টিই ভক্ত,স্রষ্টাই ভগবান। ভক্তের কর্তব্য ভগবানের পূজা (ইবাদাত) করে যাওয়া। বর দেওয়া বা না দেওয়া ইচ্ছাময়ের ইচ্ছা।
কিন্তু ভাগবতের বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অনুধ্যান ও অনুষ্ঠান কেবল কৃষ্ণেই সীমাবদ্ধ রইল না। আরো আগে অবতারবাদ ক্রমে তাদের বিশ্বাস তথা অনুষ্ঠানকেও আচ্ছন্ন করে ফেলল। পরে পঞ্চদশ শতাব্দীতে শ্রী চৈতন্য দেবের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে এ ভাবধারায় যেমন এলো পরিবর্তন,তেমনি এর অনুষ্ঠানেও এলো সংশোধন বিশোধন। ভক্ত ভগবানের সম্পর্ক মেনে নিয়ে বৈষ্ণব নিজস্ব চিন্তাধারা অনুযায়ী কৃষ্ণকেই ভগবানের অবতার অর্থাৎ সাক্ষাৎ ভগবান মানবরূপে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছেন,মনে করে। তাঁদের মতে ভগবানকে সেবা মানেই কৃষ্ণের সেবা। রাধা ভাবে বিভাবিত বৈষ্ণব সে ভাবেই কৃষ্ণকে ভজনা করেছে। চৈতন্য দেবের আমলে প্রচারিত পরিবর্তিত ও সংস্কৃত বৈষ্ণব ধারায় এ সংস্কারের সঙ্গে যুক্ত হলো আরো একটি ভাব। ভক্তরা বিশ্বাস করল,শ্রী চৈতন্য দেবের মধ্যে ভগবানের দ্বিভাবে বিহারকল্প শ্রী কৃষ্ণ ও শ্রী রাধা একই মূর্তিতে মানবরূপে রূপ পরিগ্রহ করেছে। এ রাধাকৃষ্ণ যুগল কল্পধ্যানে শ্রী চৈতন্য তৎকালে শ্রী কৃষ্ণের মতো পূজিত হতে থাকল। রাধা যেমন প্রেয়সীরূপে কৃষ্ণের অনুরাগে জীবন কাটিয়েছে এবং তার মধ্যেই সত্যিকার ভক্তের স্বরূপ ফুটে উঠেছে,ঠিক তেমনি গৌরাঙ্গরূপে আত্মাহুতি দিয়ে পরবর্তীকালে বৈষ্ণব নিজেকে কৃতার্থ মনে করেছে। ভগবানস্বরূপ চৈতন্য,তাঁর ভজনায় নিজেকে বিলীন করে দেওয়াতেই তো ভক্তের সার্থকতা। তাই বৈষ্ণব নিজের ভক্তি,বাৎসল্য,সখ্য,দাস্য,মধুর ইত্যাদি নানারসে সিক্ত করে অভিব্যক্ত করতে চায়। কৃষ্ণের সাথে চরম মিলনে সুখ একমাত্র মধুর বা প্রেম রসেই। এতেই জীবের স্ফূর্তি। তাই প্রেয়সীরূপে কৃষ্ণকে নিজের দয়িত জ্ঞানে সেবার মাধ্যমে সর্ব ধর্মকর্মের অভিব্যক্তি জ্ঞান করা হলো। ভগবান পুরুষ ভক্ত পরা বা প্রকৃতি। পুরুষের কামনা-বাসনায় নারী রূপে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে নিজের অস্তিত্ব যেমনটি উপলব্ধি করা যায়,তেমনটি আর কিছুতে করা যায় না। তাই বৈষ্ণবের কাছে ভগবান প্রেমিক দয়িত এবং ভক্ত প্রেয়সী দয়িতা। সেজন্য রাধিকার জবানীতে যখন বৈষ্ণব ভক্ত বলেন :
সই কেবা শুনাইল শ্যামনাম।
কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো
আকুল করিল মোর প্রাণ ॥
তখন বুঝতে বাকী থাকে না যে,এ রাধা,প্রেম-পাগলিনী রাধা। এ প্রেম যখন ঊর্ধ্বে উঠে রাধাকে ভাবের তুরীয় মার্গে নিয়ে যায়,তখন দেহ,বস্তু কিছুই স্পষ্ট থাকে না। যা থাকে তা হলো :
রজকিনী প্রেম
নিকষিত হেম
কামগন্ধ নাহি তায়।
রূপজ মোহ,দেহজ প্রেম বৈষ্ণবের প্রেম নয়। প্রেয়সী বিরহিনী উন্মাদিনী রাধা ভাবে বিভাবিত ভক্তের প্রেমিক দয়িত কৃষ্ণের কাছে আত্মসমর্পণেই আনন্দ,তা-ই চরম চাওয়া ও পাওয়া। এর বাইরে সে ভাবতে পারে না। পারে না বলেই সে কেঁদে বলে :
জনম অবধি হাম রূপ নেহারলু
নয়ন না তির পিত ভেল।
লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখলু
হিয় জুড়ন না গেল ॥
দুই
মুসলিমের চিন্তাধারায় এ ভাব কী রূপ পেয়েছে তার স্বরূপ বিশ্লেষণ করে দেখা যাক।
মুসলিম সুফীমতে আল্লাহ্ নির্গুণ নয়,সগুণ! সব কিছুই আল্লাহ্ থেকে সৃষ্ট হযেছে সত্য,কিন্তু সবটাই একটা নিয়মের ভিতর দিয়ে হয়েছে,বিধান অনুসারে হযেছে। সে নিয়ম হলো : হযরত রাসূলে কারীম (স) নিজেই বলেছেন,“আনা মিন নূরিল্লাহি,ওয়া কুল্লু শায়য়ীন মিন নূরী” : “আমি আল্লাহর নূর থেকে সৃষ্ট এবং জগতের তামাম বস্তু আমার নূর থেকে সৃষ্ট।”৬
আল্লাহ্ গোপন ছিলেন,প্রকাশ হতে চাইলেন,সৃষ্টি করতে চাইলেন। তাই তিনি স্বীয় অস্তিত্ব থেকে,নিজের নূর থেকে আর এক অস্তিত্বের,আর এক নূরের সৃষ্টি করলেন। তা-ই নূরে মুহাম্মদী। এ নূরে মুহম্মদী তাঁর বিধা বা প্রকার নয়। সে নূর তৈরি করতে গিয়ে তিনি দ্বিধাবিভক্ত হলেন না। এক বাতি থেকে আর এক বাতি জ্বালালে যেমন উভয়ই এক থেকে উদ্ভূত একই সত্তা,অথচ একে অপর থেকে পৃথক,আল্লাহর নূর থেকে নূরে মুহম্মদী সৃষ্টি করাও তদ্রূপ। এ নূরে মুহম্মদীই সৃষ্টির মূলীভূত কারণ বা পুরুষ এবং সৃষ্টিই প্রকৃতি বা জড়। যেমন বৃষ্টির ফোটা সৃষ্টি না করলে উদ্ভিদ তথা জীবজগৎ সৃষ্টি করতেন না। তিনি বৃষ্টি আর আমরা উদ্ভিদ ও জীবজগৎ। উভয়েরই মূল উৎস সেই ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’ পরম পুরুষ বা আহাদ। আর জড় বা প্রকৃতি,চিৎ বা আত্মার বিধা বা প্রকার নয়,বরং চিৎ বাতেন (গুপ্ত) এবং প্রকৃতি বা জড় তার বহিঃপ্রকাশ বা জাহেরী রূপ মাত্র। কোরআন বলে : ‘হুয়াল আউয়ালু ওয়াল আখেরু,হুয়া জ্জাহেরু ওয়াল বাতেনু” : তিনিই আদি ও তিনিই অন্ত এবং তিনিই ব্যক্ত ও তিনিই অব্যক্ত (গুপ্ত ও প্রকাশিত)।৭ সেরূপ মানুষের আত্মা বাতেন,মানব দেহ আত্মার বহিঃপ্রকাশ-জাহের। পরমাত্মা ও মানবাত্মায় এবং সৃষ্টি ও মানবদেহে সাদৃশ্য আছে বলেই আত্মা ও পরমাত্মার মিলন সম্ভবপর। হযরত রাসূলে কারীম (সা.) বলেন : ‘কুল্লু শায়য়ীন ইয়ারজেউ ইলা আসলিহি’-প্রত্যেক বস্তুই তার মৌল সত্তায় ফিরে যায়। কোরআন বলে : ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজেউন। আমাদের সকলের আগমন আল্লাহ্ থেকে আল্লাহরই জন্য এবং তাঁরই দিকে,তাঁতেই প্রত্যাবৃত্ত হতে হবে। এ প্রত্যাবর্তন স্বীয় উৎস বা আসলের দিকেই প্রত্যাবর্তন।
আল্লাহ্ থেকে যে নূরে মুহম্মদীর প্রকাশ,সে নূরে মুহম্মদীরই প্রকাশ সর্বত্র। হযরত মুহম্মদ (স)-এর মধ্যে নূরুল্লাহ্,নূরে মুহম্মদীরূপে বিশেষ বিকাশ লাভ করেছিল বলে বিশ্বের আদর্শ এবং শেষ পয়গাম্বর হতে পেরেছিলেন। এ নূরে মুহম্মদীই আউলিয়া আবদালের মধ্যেও বিকাশ লাভ করে। তাই তাঁরাও আল্লাহর দীদার বা সাক্ষাৎ পান এবং মিলন লাভ করেন। কিন্তু কেবল সাক্ষাৎলাভ বা মিলনেই তিনি আল্লাহ্ হয়ে যান না,বরং তিনি আল্লাহতে বিলীন হওয়ার আনন্দে বিহ্বল হন। কিন্তু দেহের পার্থক্য এবং মৃত্যুর পরেও অবয়ব বা অস্তিত্বের পার্থক্য (separate entity) একেবারে ঘুচবার নয়। তার ধারণা হতে পারে সে ক্ষুদ্র অগ্নিশিখা,এক বিরাট অগ্নিকুণ্ডে নিপতিত হলো। তাতে পরিণামে সে-ই অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হলো।৮ কিন্তু তার জ্ঞান ও গুণ,‘জাত ও সিফাত’ কখনই অনুরূপ বিরাট বা পূর্ণ হতে পারে না। বিরাটের যে স্তরে সে একীভূত হলো সে গণ্ডি অতিক্রম করা সহজসাধ্য নয়। যদি বা যুক্তির খাতিরে মেনে নেওয়াও যায় যে,তা হয়তো সাধ্যের অতীত নয়। কিন্তু বিরাটের সর্বত্র,সব রহস্যের অন্তঃপ্রদেশে সে ছড়িয়ে পড়তে,পৌঁছে যেতে পারে কি না,কিংবা তা আদৌ সম্ভবপর কি না সে সম্বন্ধে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। মিলনের অবস্থা একটা আত্মহারা আত্মলয়ের অবস্থা। সুফীদের পরিভাষা একে ‘ফানাফিল্লাহ্’ বা আল্লাহতে আত্মলীন হওয়া এবং ‘বাকাবিল্লাহ্’ বা আল্লাহর মধ্যে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা অর্থাৎ তাঁর অস্তিত্বে নিজের অস্তিত্ব লোপ করা,বলা যায়। এ এক অভূতপূর্ব অবস্থা। কিন্তু তাকে তো ভৌতিক দেহের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য চেতন লোকে বা জাগতিক কার্যকলাপে ফিরে আসতে হয়;তাই তাকে বিচ্ছেদ অনুভব করতে হয়। অথচ তাও যে বিরাটের অন্তের কৎচিৎ,বিভাব,স্বভাব,প্রকৃতি,গুণ,জ্ঞান ও শক্তি লাভে পরিপুষ্ট সে সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তাই বলে তা কোন ক্রমেই গীতায় ব্যাখ্যাত বিরাট বা অসীমের অবতার বা যুগে যুগে জন্মলাভ নয়।৯ তাই তাঁর পক্ষে কারো পিতা হওয়া বা পুত্র হওয়ার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিবর্তন সিদ্ধ নয়।
তিনি সমীম মানবীয় কার্যকলাপের বাইরে অসীম। সসীম অসীম থেকে কিঞ্চিৎ জ্ঞান,গুণ,সান্নিধ্য,শক্তি লাভে সমর্থ। বৌদ্ধের নির্বাণ বা শূন্যবাদও এ সত্যের আলোকে শূন্যে মিলিয়ে যায়। ইসলাম এভাবে প্রাচীন ও আধুনিক সব ধর্মের গোঁড়ামি,গোঁজামিল ও অস্পষ্টতা দূরীভূত করেছে। হযরত রাসূলে কারীম (স)-এর পূর্বে নূরে মুহম্মদী এবং তাঁর জ্ঞানের,মারিফাতের এরূপ চরম বিকাশ লাভ ঘটেনি বলে ধর্মে অপূর্ণতা ছিল,অস্পষ্টতা ছিল এবং সর্ব যুগে সর্ব দেশে এ অস্পষ্ট বিকাশই ধর্মকে পূর্ণতা থেকে বঞ্চিত রেখেছিল। ইসলাম নানা প্রদীপের মিটিমিটি আলোর প্রভাকে এক নিমিষে সূর্যোদয়ের মতো স্পষ্ট,সুষ্ঠু ও সর্বাঙ্গ সুন্দর করে তুলল।
কোরআন বলছে : “ফিতরাতুল্লাহিল্লাতি ফাতারান্নাসা আলাইহা”-আল্লাহ তায়ালার প্রকৃতিই সে প্রকৃতি যা দিয়ে মানবপ্রকৃতি সৃষ্টি করা হয়েছে। হযরত রাসূলুল্লাহ্ (স) বলেছেন : “তাখাল্লাকু বি আখলাকিল্লাহে” আল্লাহর গুণে বিভূষিত হও। সুতরাং ইসলামী তাসাউফ হিন্দু দর্শনের নানা মুনীর নানা মত নয় এবং তা কোন ধর্মশাস্ত্র থেকে ধার করাও হয়নি। অথবা এ ধারণা হযরত মুহম্মদ (স)-এর পর প্রক্ষিপ্ত বা অনুপ্রবিষ্ট হয়নি। হযরত মুহম্মদ (স) নিজে যে ঘোষণা করেছেন : “মান আরাফা নাফসাহু ফাকাদ আরাফা রাব্বাহু”-যে নিজেকে চিনেছে সে তাঁর প্রভুকে চিনেছে। এতেই বোঝা যায় যে,হিন্দু দর্শন,আর তাতে বিবৃত ‘পুরুষ-প্রকৃতি’,‘সো অহং’,‘অহং ব্রহ্মাস্মি’-এ সব মতবাদ এবং ইসলাম দর্শন,আল্লাহ্,নূরে মুহম্মদী,‘আনাল হক’ মতবাদ এক নয়। তুলনায় আল্লাহ্ ও বান্দার সম্পর্ক,রাসূল ও নূরে মুহম্মদীর সম্পর্ক,খালেক ও মাখলূকের সম্পর্ক এবং এর যৌক্তিকতা অত্যন্ত স্পষ্ট। অবশ্য মু’তাযিলা,আল আশ‘আরি,বাতেনিয়া প্রভৃতি মুসলিম স্বাধীন চিন্তাবিদদের মতবাদে সূক্ষ্ম তার্কিকতায় আমরা প্রবেশ করছি না।
এতে পরিষ্কার বোঝা যায় যে,ধর্মীয় ধারণায় পুরুষ ও প্রকৃতি ভাবধারা ক্রমে পরিপুষ্ট এবং আবর্জনা ও প্রক্ষেপ রহিত হয়ে পৃথিবীর শেষ ধর্মমত ইসলামে এসে পূর্ণ ও সর্বাঙ্গ সুন্দর রূপ লাভ করেছে। প্রকৃতপ্রস্তাবে পৃথিবীর সর্বকালের সর্বধর্মের সমন্বিত নির্যাস ইসলামে এসে রূপ ধারণ করেছে। বিশিষ্ট অদ্বৈতবাদ,গীতা ইত্যাদির মতের সঙ্গে কিঞ্চিৎ মিল দেখা যায় বলেই ইসলামী তাসাউফে এ ধারণাকে বিশিষ্ট অদ্বৈতবাদ বা গীতার অনুকরণ মনে করা ভুল হবে।
রাসূলুল্লাহ্ (স) সর্বশেষ নবী। তাঁর পরেও মহাপুরুষের আর্বিভাব হয়নি,এমন নয়। কিন্তু তাঁদের আধ্যাত্মিক উন্নতি হযরতের সমান হতে পারেনি। তা কেউ দাবিও করেননি। প্রাচীন ধর্মমতসমূহ,যেমন খ্রিষ্ট,ইহুদী,বৌদ্ধ এসব ধর্মেরও তৎকালীন সম্পূর্ণতা ছিল। কিন্তু কালের গতিতে বিশ্বের সবকিছুকে নিয়ে যতদিন কিয়ামত না হয় ততদিনের জন্য সব দেশের ও সবকালের মতামত মানুষের উন্নতি-অবনতি,স্বাভাবিক জীবনযাপন সম্বন্ধে ইসলামের নির্দেশ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে,তাকে অনায়াসে সম্পূর্ণাঙ্গ জীবনপদ্ধতি বলা চলে। দীন মানে যদি জীবনপদ্ধতিই হয়,সত্যিকার জীবনযাপন প্রণালীই হয়,তবে সে জীবনপদ্ধতির চরম বিকাশ পরিব্যাপ্তি ও প্রসার ইসলাম এনে দিয়েছে। মানবতার স্বাভাবিক পরিশীলন পরিবর্ধন প্রাকৃতিক নিয়ম হক্কুল্লাহর পরিপোষক নির্দেশ ইসলামী বিধানে রয়েছে। এ জন্যই কুরআনে অন্যান্য ধর্ম বিধানের স্বীকৃতি রয়েছে এবং পরিশেষে বলা হয়েছে : “আলইয়াওমা আকমালতু লাকুম দীনাকুম ওয়া আতমামতু আলাইকুম নিয়মাতি ওয়া রাদিইতু লাকুমুল ইসলামা দীনা”-আজ তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পরিপূর্ণ করে দিলাম,তোমাদের ওপর আমার নেয়ামত সম্পূর্ণ করে দিলাম,আর ইসলামকে তোমাদের জন্য দীন হিসাবে (জীবনবিধান বা ধর্ম) মনোনীত করলাম।
প্রাচীন ধর্মমতসমূহে জীবনের সমাধান রয়েছে। কিন্তু তা বিশুদ্ধ চরম বা পূর্ণাঙ্গ (Perfect) নয়। পরিপূর্ণ মানবসত্তার সমগ্র গুণ নিয়ে হযরত মুহম্মদ (স)-এর জন্ম। হযরত আবু বকর (রা),হযরত উমর (রা),হযরত ওসমান (রা),হযরত আলী (রা) এবং পরবর্তীকালে ইমামগণ হযরতের নূর থেকেই আলো পেয়েছেন এবং তাঁরই ব্যাখ্যাত জীবনব্যবস্থার ব্যাখ্যা করেছেন। শংকর,নানক,বাবর,আকবর,চৈতন্য,রামমোহন,রামকৃষ্ণ-এঁরাতো আরো পরের,স্ব স্ব মতের ব্যাখ্যাতা মাত্র।
অনেকেই প্রশ্ন করেন,পরে নবী বা রাসূল কি আর আসবেই না? তবে মানুষ ধর্ম লাভ করবে কি করে? এক একজন নবীর যে প্রভাব,ধর্ম-জীবন গঠনের ক্ষেত্রে যার একান্ত প্রয়োজন,তা কি করে সম্ভব হবে? প্রকৃতপ্রস্তাবে ইসলামই প্রকৃত শেষ ধর্ম,যার পরে এ ধর্মমতে ইজতিহাদ বা সংস্কারের প্রয়োজন হলেও নবী বা রাসূলের প্রয়োজন হবে না।
ইসলামের দু’টি দিক বা ভাগ রয়েছে : এক বহিরঙ্গ বা ব্যবহারিক দিক বা শরীয়ত। সর্বসাধারণের উপযোগী তার সংজ্ঞা। অপর,অন্তরঙ্গ বা মারিফাত। বিশেষ অনুশীলনী নির্ভর বিশেষোপযোগী তার সূত্র। সাধারণ পন্থায় সম্যক শান্তি লাভ,আত্মোৎকর্ষ এবং আত্মোৎসর্গ সম্ভবপর নয় বলেই মারিফাত বা বিশেষ পন্থার প্রয়োজনীয়তা। এ বিশেষ পথে ক্রমবিকাশ কয়েকটি স্তুরের মধ্যস্থতায় সম্ভব,তাই শরীয়তের পরে তরিকত,এরপরে হাকীকত এবং শেষ পর্যায়ে মা’রিফাত-এভাবে নির্দেশ করা হয়েছে। মারিফাত শব্দের অর্থ জ্ঞান,জানা;যে জানায় বিশ্বকে জেনে নিজের মধ্যে বিশ্বকে পুরে,নিজেকে জানার মাধ্যমে পরম প্রতিপালক স্রষ্টাকে জানা যায়। এই জ্ঞানই প্রকৃত জ্ঞান এবং সব জ্ঞানের পরিণত রূপ। আর এই জানা প্রকৃত জানা বলেই সুফীমতে একেই মা’রিফাত বলা হয়।
অনেকের ধারণা সুফীবাদ ইরান থেকে আরবে আমদানি হয়েছ্। কিন্তু আমরা দেখিয়েছি কি করে প্রকৃত ইসলাম তথা সুফীবাদও হযরত রাসূলুল্লাহ্ (স) থেকেই বিশ্বে প্রসার লাভ করেছে।
প্রকৃতপ্রস্তাবে সুফীবাদের ব্যাখ্যা ও অনুশীলনী হযরত (স)-এর বহু পরে ইরানের স্বর্ণযুগে তথায় পরিশীলিত হয়েছিল। আর পারস্য সাহিত্য এবং ইরানী সুফীবাদের প্রভাবে প্রভাবিত ওয়ালি-আউলিয়াদের মাধ্যমে এ বিশেষ প্রক্রিয়া আমাদের দেশে প্রচারিত হয়। পারস্য সাহিত্যের ভাবধারার শ্রেষ্ঠ সম্পদ এই সুফীবাদে অভিব্যক্তি লাভ করেছে। ওমর খৈয়াম,ফেরদৌসী,সা’দী,জামী,রুমী-সকলেই এ সত্যের পথিক,সাধক,ভাবুক এবং সুফীবাদের প্রত্যক্ষ অনুশীলনকারী।
এ কথা আগেই বলা হয়েছে যে,ইসলামী মতে সুফী নিজেকে প্রেমিক এবং স্রষ্টাকে প্রেমময় মনে করেন এবং সেভাবে রূপকের ব্যবহারিক স্বরূপে তা অভিব্যক্ত করেন। ভারতীয় ভাবধারায় ভাগবতের অনুসারী বৈষ্ণব অনুরূপভাবেই ভগবানকে প্রেমময় প্রেমিক এবং নিজেকে প্রেমিকার আসনে বসিয়ে ধ্যান করেন। এ দু’ধারায় পার্থক্য বিস্তর। এ পার্থক্য কেবল প্রক্রিয়ার পার্থক্য নয়-বিশ্বাস এবং প্রবণতার পার্থক্যও। শরীয়ত কুরআন-হাদীসের যাহেরী শিক্ষা। এ শরীয়তকে আলেমগণ পাঁচভাগে ভাগ করেছেন : হালাল-বৈধ,হারাম-নিষিদ্ধ,মুহকাম-স্পষ্ট,মুতাশাবেহ্-রূপক,মিছাল-দৃষ্টান্ত।১০ এখানে উল্লেখযোগ্য যে,‘হরফে মোকাত্তেয়াত’ মানে ‘সংকেত অক্ষর’,যেমন আলিফ-লাম-মিম,ইয়া-সিন ইত্যাদি মুতাশাবেহ্ থেকে আলাদা নয়।
হালাল এবং হারাম স্পষ্ট আদেশ ও নিষেধ। সুতরাং এ দু’টি মুহকামেরই অন্তর্গত। আর মিছালও মূলত রূপক,সুতরাং মুতাশাবেহ্। কোরআনকে অর্থাৎ কোরআনের হুকুমকে ব্যাখ্যা করার জন্য হাদীসের প্রয়োজন। সুতরাং এ সবই হাদীসের বিষয়বস্তু এবং হাদীসই এ সবের মূল ব্যাখ্যা বা সম্প্রসারণ। অতএব,মুহকামই শরীয়ত এবং মুতাশাবেহ্ই মারিফাত। মুহকাম বুঝতে কোরআন-হাদীসই যথেষ্ট। এলমে জাহের-ইজমা,কিয়াস,ফিকাহ্,উসূল-এসব জানলেই মুহকাম বুঝতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু মুতাশাবেহ্ অনুরূপ জাহের এলেম কালাম দ্বারা বোঝা যায় না। সুতরাং মূল প্রতিপাদ্য বুঝতে হলে এবং অনুশীলন করতে হলে রাসূলের মতো গুণ এবং জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তির ব্যাখ্যা বা আত্মিক প্রভাবের একান্ত প্রয়োজন। রাসূল (স) এবং খলীফাদের দু’টি কাজই করতে হয়েছে,আর সে যুগে তার প্রয়োজনও ছিল। এই যুগে জাহের এলেম কালাম বা শরীয়ত বোঝার জন্য এক অর্থে অনুরূপ কারও দরকার হয় না। কেননা কুরআন ও হাদীস লিপিবদ্ধ হয়েছে এবং অপরাপর ধর্মপুস্তকের মতো এতে কোনও প্রক্ষেপ প্রবেশ লাভ করেনি। তবে এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে,ওয়ালিয়ে ফকীহ্ তথা সঠিক যোগ্যতাসম্পন্ন মুজতাহিদের প্রয়োজনীয়তা অনিবার্যভাবে স্বীকার করে নিতে হবে। হযরত আলী (রা)-এর পর থেকে তেমন উভয়বিধ গুণসম্পন্ন লোকের হাতে রাজশক্তি অর্পণ করা সম্ভব হলো না। কাজেই শরীয়তই অনুরূপ জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে।
তিন
হযরত মুহম্মদ (স) যেভাবে ইসলামের ব্যাখ্যা করে গেছেন,তাঁর পরবর্তীকাল,আজ প্রায় সাড়ে চৌদ্দশ বছর যাবত মানব জাতির সংস্কৃতির ইতিহাসে ব্যবহারিক শক্তি ও আধ্যাত্মিক উন্নতির এক প্রধান উৎস হয়ে আছে। তাওহীদ বা এক আল্লাহর ওপর একনিষ্ঠ বিশ্বাস ও তাঁর হুকুম ও নির্দেশ অনুযায়ী জীবনব্যবস্থার ওপর ইসলামের প্রতিষ্ঠা। এ জীবনব্যবস্থার মূল উৎস কুরআন। শাণিত তরবারির মতো সংশয়চ্ছেদী সুদৃঢ় ইমান,আত্মবিশ্বাস,সর্বশক্তিমান করুণাময় আল্লাহ্ ও তাঁর নিয়ন্ত্রণে বিশ্বাস ও নির্ভরতা এর শিক্ষা। ইহ-পরকালে বিশ্বাস,হাশরে ও বিচারে বিশ্বাস,ঐহিক ও পারত্রিক বিশ্বাস এবং জীবনকে ভালোবেসে আত্মমর্যাদায় বলীয়ান হয়ে অমর জীবনের অধিকারী হওয়ার দৃঢ় প্রত্যয়ের এক অমোঘ বাণী এ কুরআন এনে দিয়েছে। মানুষ যে কেবল আল্লাহর সৃষ্ট বান্দাই নয়,তাঁর প্রিয় বন্ধুও আল্লাহর পরই তাঁর প্রতিনিধিরূপে প্রতিষ্ঠিত তার সত্তা,সে যে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ এ কথা এ যাবত আর কোন ধর্মপুস্তকে এমনিভাবে,মানুষের মর্যাদাকে এতখানি ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে পারেনি। এখানেই এর বিশ্বজনীনতা ও সর্বজনীনতা প্রতিষ্ঠিত। হযরতের জীবনী,উপদেশ ও অনুভূতির বিকাশই কোরআন-প্রচারিত ধর্মের আধ্যাত্মিক ও বাহ্যিক আদর্শ বিচ্ছিন্ন,বিক্ষিপ্ত আদর্শহীন গোটা মানব জাতিকে এই মানবতার ধর্মে দীক্ষিত করে,একই প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করে উচ্ছৃংখল ও অমানুষিক অন্ধকার জীবন থেকে সুন্দর সুষ্ঠু আলোকোজ্জ্বল জীবনের সন্ধান প্রদান এ ইসলামের প্রবলতম মানসিক প্রেরণার আদর্শ। এক আল্লাহর প্রতি অবিচল বিশ্বাসের বলে হযরত রাসূলে কারীম (স) ছিলেন বলীয়ান এবং আন্তরিক সত্য প্রেরণা ও মানসিক বলের দ্বারাই দুর্ধর্ষ বেদুইন আরব জাতিকে বশীভূত,অনুরাগী ও ভক্ত করে নিতে সমর্থ হয়েছিলেন। প্রধানত আরব জাতির সমাজের পরিধির মধ্যে মানুষের কর্তব্য নিয়ে ব্যাপৃত ছিলেন বলে এবং বিদ্যা বিচারশীলতার আবহাওয়ার বেড়ে উঠেছেন বলে কুরআনের বাণীর হুবহু ব্যাখ্যায় তাঁর বাণী ও কর্মে গভীর আধ্যাত্মিক দৃষ্টি ও পারমার্থিক সত্যের উপলব্ধির পরিচয় ফুটে উঠেছে।
এ বিশ্বের কোন কিছুই স্থিতিশীল নয়,সব কিছুই গতিশীল সব ব্যাপারের মতো ইসলামের মধ্যেও একটা গতি বা ক্রমবিকাশের ধারা লক্ষ্য করি। পরবর্তীকালে ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন জাতির সংঘাত,সংস্রব ও মিলনের ফলে নতুন নতুন ভাবধারা এসে ইসলামে অনুপ্রবেশ লাভ করল। এসব ভাবধারার গ্রহণ ও বর্জনের ফলে ইসলামের আরবীয় অনুষ্ঠানাদির মধ্যে পরিবর্তনের সূচনা করল। তাতে করে একদিকে ধর্মীয় ব্যাখ্যা যেমন সমৃদ্ধি লাভ করল,তেমনি একদল লোকের কাছে নব নব ভাবধারা ‘বিদায়াত’ বা অভিনব বলে মনে হলো। প্রাচীনপন্থী শরীয়তসর্বস্ব আলেমগণ এ বিদায়াতকে সুনজরে দেখতে পারলেন না এবং ধর্মের ব্যাপারে এ ধরনের মিশ্রণ ও নবীন মত এবং নবীন ব্যাখ্যার বিরোধিতা করতেও পিছপা হলেন না। তাঁদের মতে ইসলামের পরবর্তী সংস্করণে এ সকল মত বিভ্রান্তির স্তরে নিয়ে যেতে পারে এবং ইসলামের শুচিতা রক্ষা ও শরীয়তের মৌলত্ব থেকে দূরে নিয়ে যেতে পারে,এ আশংকায় তাঁরা উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়লেন। তারই ফলে,ইসলামের প্রথম প্রসারের পর্যায়ে আরব ভূখণ্ডে প্রথম সূচিত ইসলামের সাথে (ইরানী,সিরীয়,বিজান্তীয়,গ্রীক,মিশরীয় প্রভৃতি জাতির সঙ্গে) যখন প্রথম সংঘর্ষ ও সংঘাত ঘটলো এবং পরবর্তীকালে অর্থনৈতিক,মানসিক ও ধর্মীয় ব্যাপারে যখন পরস্পর বোঝাপড়া আরম্ভ হলো এবং এর ফলে জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো ধর্মের ক্ষেত্রেও নানা দৃষ্টিভঙ্গি ও মতবাদের আত্মপ্রকাশ ঘটলো,তখন শরীয়তপন্থী প্রাচীন ও ‘গোঁড়া’ সম্প্রদায় এসব অভিনব মিশ্রিত ভাবধারার অনুষ্ঠানাদি ও আচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন। এতে অনেক সময় বিচার-নিষ্ঠার চাইতে আচার-নিষ্ঠাই প্রাধ্যান্য পেয়েছে,এতে কোন সন্দেহ নেই।
এসব নতুন ধারণা ও মতবাদের বিচারে সুফীবাদ সম্বন্ধেও মতানৈক্যের অবকাশ ঘটল। প্রকৃত সুফীবাদ যদিও হযরত রাসূলে কারীম (স) থেকেই আরম্ভ হয়েছিল,সে সাধনার মূল যদিও তাঁর জীবিতকালেই শিকড় মেলে গোড়া শক্ত করে নিয়েছিল,তবুও এ ধারার সাধনায় যখন বিভিন্ন দেশীয় নানা উপাদান এসে মিশ্রিত হলো এবং সাধকদের অনুভূতি,দর্শন,দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণে ক্রমে শরীয়তবহির্ভূত আচার প্রক্ষিপ্ত হলো তখন তা অনেকেই মনে-প্রাণে গ্রহণ করলো,আবার অনেকেরই তা গ্রহণ করার স্থৈর্য রইল না। অনেকেই একে ইসলামের স্বাভাবিক বিকাশ এবং গতি ও পরিণতির শুভ ফল বলে গ্রহণ করতে পারল না। আপাতদৃষ্টিতে এ নতুন ভাবধারায়,চিন্তায়,ধ্যানে,আচারে-আচরণে যখন শরীয়ত-প্রদর্শিত বিচার-বুদ্ধি অপেক্ষা কল্পনা ও ভাবুকতার জটিলতা ও বিচিত্র বিকাশ প্রকট হয়ে উঠল,তখন শরীয়তপন্থীদের পক্ষে তা আরো অগ্রহণোপযোগী মনে হলো।
সুফী দর্শন ও চেতনায় পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষ গ্রীক,ইরানীয়,মিশরীয়,এমনকি ভারতীয় চিন্তা ও দার্শনিকতার প্রভাব একে কঠোর শরীয়ত পন্থা থেকে সরিয়ে অনেকখানি দূরে দুর্বোধ্য অথচ সহজ মারিফাত পন্থায় নিয়ে এসেছিল। সহজ ও সরল বুদ্ধি মানুষের পক্ষে,কর্মী বাস্তবপন্থী মানুষের পক্ষে,সরল সহজ পথের নির্দেশ গ্রহণ এবং ধর্মভীরু কর্তব্যপরায়ণ জনহিতৈষী ও আচারনিষ্ঠ সৎ লোক তৈরি হওয়ার জন্য শরীয়ত এক অতি উত্তম পন্থা,সন্দেহ নাই। কিন্তু এর মধ্যে চিত্তকে অন্তর্মুখী করার,আত্মাকে অনুভূতির রঙে অনুরঞ্জিত করার ও ভাবনার রসে অনুসিঞ্চিত করার কোন বিধান আছে বলে আপাতদৃষ্টিতে চোখে পড়ে না। হযরত মূসা (আ) ও হযরত ঈসা (আ)-এর প্রচারিত ধর্মেও অনুরূপ ব্যবস্থা পরিলক্ষিত হয়। তৌরাত বা Old Testament,ধর্মশাস্ত্র তোরাহ,মূসার পাঁচ কেতাব,ঐতিহাসিক ও ভাববাদীদের রচিত ২১ খানি গ্রন্থ নেভীইন,প্রার্থনা,স্তোত্র উপাখ্যান,ইতিহাস ও ভবিষ্যদ্বাণী,কেথুভিন-এ সবের সমন্বিত রূপ। তৌরাত ও তৌরাতপন্থিদের ব্যবহার এবং তামলুদ গ্রন্থ বা তৌরাত ব্যাখ্যাশাস্ত্র ইত্যাদিতে বিধৃত জীবনধারা ইঞ্জিল বা New Testament -এ বিধৃত জীবনব্যবস্থায় বেশ পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও ইসলাম এ দু’ধারাকে অস্বীকার করলো না,বরং এগুলোকেও ‘কেতাব’ বা ঐশী গ্রন্থ বলে গ্রহণ করে ইহুদী ও খ্রিস্টানদের জীবনপদ্ধতিকে সংশোধিত করে গ্রহণ করে তার নবতর রূপ দান করতে চেষ্টা করল। এ দু’টি গ্রন্থেই বিধৃত জীবনপদ্ধতি কঠোর বহিরাচরণে সীমিত। ইসলাম এ সীমাকে অনেকখানি শিথিল করে প্রসারিত ও উদার করে দিয়ে জীবনের নব রূপায়নের প্রয়াস পেল। তবে মূলত এক আল্লাহরই স্বীকৃতি ও ইবাদাত এসব জীবনপদ্ধতির মূল বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও পরবর্তীকালে এর মধ্যে প্রক্ষেপ প্রবেশের সুযোগ পায়। তারই ফলে সংস্করণের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ইসলাম সব পরিবর্তন ও সংস্করণ রহিত করে দিল। আর নতুন কোন ধর্মের প্রয়োজন রইল না। তাই নতুন ভাবধারা বাহ্যিক আচার ও নবতর রূপে ইসলামভিত্তিক বিশ্বাসে সুফী মতবাদের অনুপ্রবেশকে শরীয়তপন্থী মুসলিম সুনজরে দেখতে পারেন না। তাঁদের কারো কারো মতে ইসলামী প্রগতির অর্থ নতুন ভাবধারা গ্রহণ নয়। তাই যখন অন্তরঙ্গ ও গভীর আল্লাহ্প্রীতি,সৃষ্টি ও স্রষ্টার অভেদত্ব ও সঙ্গে সঙ্গে পরমাত্মার সাথে জীবাত্মা বা আল্লাহর সঙ্গে বান্দার প্রেমের সম্বন্ধ,আল্লাহকে প্রেমিকা ও মানবাত্মাকে প্রেমিক বা প্রেমাস্পদরূপে বর্ননা,এরূপ বোধ কল্পনা ধ্যান-ধারণা সাধনা ও আরাধনা নিয়ে যখন ইরানে নবম-দশম শতাব্দীর দিকে সুফী সাধনার চরম বিকাশ ঘটল,ধর্ম সাধনার ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব বিপ্লবের সৃষ্টি হলো,তখন শরীয়তবাদী তাকে উগ্রতা মনে করে অতি ভাববাদিতা বেশরায়ী বলে আখ্যা দিলেন এবং তথাকথিত শরীয়তহীন সুফীবাদকে বরদাশত করতে চাইলেন না। প্রকৃতপ্রস্তাবে এর মূল শিকড় হযরত মুহম্মদ (স)-এর কাল থেকে থাকলেও এর প্রসারিত এবং বিস্তৃত ও কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত রূপ ধর্ম সাধনার ইতিহাসে এক আলোড়নের সৃষ্টি করল। আগেই উল্লেখ করেছি,এ মতবাদ গঠনে ও ক্রমবিকাশে নানা জাতির উপাদান আহৃত ও সঞ্চিত হয়ে এতে প্রভাব বিস্তার করেছিল। আরবীয় তথা সেমেটিক বিশ্বাস ও ইসলামী সংস্কারের পরিপ্রেক্ষিতে তার সংস্কৃত ভাবধারা,গ্রীক দার্শনিক আফলাতুন ও তাঁর অনুবর্তী নব্য প্লেটোনিক দার্শনিকদের ঐশ্বরিক সভা ও কার্য বিষয়ে চিন্তা ও বিচার,ইরানের জরথুস্ত্রীয়বাদের নিষ্ঠা ও তৎসম্বন্ধে আকাঙ্ক্ষা,সত্যান্বেষণ ও নৈতিক একাগ্রতা,মধ্য যুগের ইরানী সভ্যতার নাগরিকতা,ভাবুকতা,সৌন্দর্যপ্রীতি ও রোমান্সবাদ সব কিছু মিশে এক মনোমুগ্ধকর অন্তরের আবেগময় অতীন্দ্রিয় কল্পলোকের সৃষ্টি করলো। ইসলামআশ্রিত এ ভাবাবেগের মধ্যে সুফীদের এ কল্পলোকের বিকাশ বিশ্বমানবের পক্ষে সাগ্রহে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। সুফী দর্শন ও অনুভূতির দ্বারা আরবদের মধ্য থেকে আরম্ভ হয়ে বিস্তার লাভ করেছিল বলে এর প্রথম দিককার ইতিহাসের খোঁজ আরবীয় সাধকের মধ্যেই পাওয়া যাবে। বিভিন্ন ভাবধারায় সঞ্জীবিত সুফীমতের দু’জন প্রধান আরবীয় সাধক ও ইমাম শরফুদ্দীন ইবনুল ফরীদ ও মুহীউদ্দীন মুহাম্মদ বিন আলী ইবনে আরাবী দ্বাদশ শতকে বর্তমান ছিলেন। কিন্তু ইরানেই সুফী সাধনার উৎকর্ষ ঘটে। শ্রেষ্ঠ কবি,দার্শনিক,চিন্তাশীল ও দীক্ষাদাতা ইরানেই জন্মগ্রহণ করেন। সেইজন্য অনেকের ধারণা,সুফীবাদ ইরানেই বিশেষ ধর্মধারী,ইসলামে প্রক্ষিপ্ত ভাবধারা অনুযায়ী সৃষ্ট ভাবধারায় উজ্জীবিত। সুফী সাধক বায়েযিদ বিস্তামী,জুনায়েদ বাগদাদী,হুসায়ন বিন মনসুর আল হাল্লাজ,সুফী কবি ও দার্শনিক আবু সাঈদ ইবনে আবীল খায়ের,আবুল মজদ মজদুদ সানাই,ফরীদুদ্দীন আত্তার,জালালুদ্দীন রুমী এবং তাঁর গুরু শামস-ই তাব্রিজী,দার্শনিক আবু হামিদ মুহাম্মদ আল গাযালী,মুহাম্মদ শামসুদ্দীন হাফিজ,নূরুদ্দীন আবদুর রহমান জামী,ওমর খৈয়াম,ফেরদৌসী,সা’দী-এঁরা সকলেই ইরানী ছিলেন।
যা হোক,বাংলা-পাক-ভারত উপমহাদেশে মুসলিম আগমনের সাথে সাথে ইসলামের একটি অন্তরঙ্গ সাধনায় একটি লক্ষণীয় পথ হিসাবে তাসাউফ এদেশেও আসে। সুফী-পীর-দরবেশরা দেশের নানা স্থানে খানকাহ্ বা আশ্রম তৈরি করে বসবাস করতে থাকেন ও ইসলাম প্রচার করেন। এর ফলে স্বেচ্ছায় বহু হিন্দু ও বৌদ্ধ ইসলাম গ্রহণ করে। এ সুযোগে উপমহাদেশীয় ধর্মীয় চিন্তা ও সাধনায়,আধ্যাত্মিক জীবনে ও আধ্যাত্মিক সাধানার প্রকাশক কাব্যসাহিত্যেও সুফীবাদ প্রভাব বিস্তার করে। উপমহাদেশের মধ্যযুগের ভক্তিমূলক সাধনায়,সমার্গীয় বৈরাগী ও সাধুদের চিন্তায় গৌড়ীয় মতের বৈষ্ণব প্রমুখ প্রেমাশ্রয়ী ধর্ম সম্প্রদায়ে ও সাহিত্যে সুফী অনুভূতির প্রভাবে এবং সুফী সাহিত্যের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে পরবর্তী বাংলা-পাক-ভারতীয় সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন সাধনে সহায়ক হয়েছিল।
হযরত রাসূলে কারীম (স)-এর পরে বেশ কিছুকাল পর্যন্ত রাজ্য জয় ও ইসলাম প্রচারে কেটে গেল। তখন তাঁদের মধ্যে গভীর রহস্যবাদের বা গভীর চিন্তার সূক্ষ্ম বিচারের সময় খুব কম ছিল। ইসলামের ব্যবহারিক ও শরীয়তের দিকটিই তখন প্রকট হয়েছিল বেশি। কিন্তু তাই বলে সংসারত্যাগী দু’চারজন আল্লাহ্ভক্ত ভাবুকের যে জন্ম হয়নি তা নয়। প্রথম দিকে এরা বান্দা ও স্রষ্টার সম্পর্ক স্থাপন করেছিল প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্কের মতো। সুফীমতের প্রেমের সম্বন্ধ আরো অনেক পরের। এঁদের সাধনার প্রধান অঙ্গ ছিল আত্মদমন,আত্মসংযম,শাস্ত্রানুবর্তিতা,শান্তি প্রিয়তা,একান্তে বসে সাধনা,জপতপ,আল্লাহর প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা নিবেদন এবং ব্যর্থ আচার-নিষ্ঠতার বর্জন ইত্যাদি।
এঁদের মধ্যে খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আবু হাশিম শামী-ই সর্বপ্রথম ‘সুফী’ নামে অভিহিত হন। পরে এর অর্থ আরো ব্যাপক হয়। ‘সুফী’ শব্দের অনেকগুলো অর্থ রয়েছে। কিন্তু ‘পশম’,‘পশমী কাপড়’ এবং পরে ‘পশমী কাপড়ধারী’ ওয়ালী-দরবেশ,ভাবুক,আল্লাহ্প্রেমিককেই বোঝানো হয়েছে। শীততাপ নিবারণ করার জন্য প্রথমে ধারণা করলেও পরবর্র্তীকালে ‘পশমী কাপড়’ কম্বল বা আলখাল্লা সুফীদের নিজস্ব আবরণ ও আভরণ হিসাবে গৃহীত হয়েছে। দ্বাদশ শতকের শেষের দিকে লক্ষণ সেনের সভায় যে ‘শেক’-এর আগমনকথা উল্লেখ ‘শেক শুভোদয়া’ গ্রন্থে দেখা যায়,তিনিও এ ধরনের সুফীই ছিলেন। একে ‘এনাম্বর ধর : শূর : শিরোবেষ্টন তৎপর : ’বলা হয়েছে। সুফীবাদ বা সুফীইজমকে আরবীতে ‘তাসাউফ’ বলা হয়। এ থেকে দিব্যজ্ঞান,দিব্যানুভূতি,আল্লাহ্তত্ত্ব এসব অর্থেও শব্দটি ব্যবহৃত হয়।
ইসলামের প্রথম পর্যায়ে সপ্তম শতাব্দীতে মহানবী (স)-এর আহলে বাইতের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব হযরত আলী (আ) মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে জান্নাত লাভের আশা ও জাহান্নামের শাস্তির ভয়মুক্ত ইবাদত-বন্দেগীর কথা ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন : “হে ইলাহ্! আমি না তোমার দোযখের আগুনের ভয়ে,আর না তোমার জান্নাত পাওয়ার লোভে তোমার ইবাদত করেছি;বরং আমি তোমাকে ইবাদতের যোগ্য পেয়েছি বলেই তোমার ইবাদত করেছি।”১১
তিনি আরো বলেছেন : “নিশ্চয়ই একদল লোক (পুরস্কার পাওয়ার) আশায় মহান আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করে। তাই তাদের ইবাদত হচ্ছে ব্যবসায়ীদের ইবাদত তুল্য;আরেক দল লোক আছে যারা (জাহান্নামের শাস্তির) ভয়ে মহান আল্লাহর ইবাদত করে। তাই তাদের ইবাদত দাসদের ইবাদত তুল্য;আবার আরেক দল আছে যারা মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশস্বরূপ তাঁর ইবাদত করে,তাই তাদের ইবাদত মুক্তমন স্বাধীন ব্যক্তিদের ইবাদত।”১২
এরপর খ্রিষ্টীয় নবম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত প্রায় চৌদ্দ-পনের জন সুফী সাধকের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এ সময়েই তাপসী রাবেয়া জীবিত ছিলেন। তিনি নবম শতকের প্রারম্ভে দেহত্যাগ করেন। ইনিই সুফীদের মধ্যে প্রথম প্রেম-ভক্তির পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন। ফলাফল বা জান্নাত-জাহান্নাম নিরপেক্ষ প্রতিপালক প্রভুতে অনুরক্তিই এ সাধনার মূলকথা। এ সময়েই আরো কয়েকজন ইরানী সুফীর আবির্ভাব ঘটে। এখন থেকেই সুফী সাধনায় ইরানীদেরও আবির্ভাব ও প্রতিষ্ঠা শুরু হয়।
সুফী মতবাদের দ্বিতীয় যুগের আরম্ভ হয় খ্রিস্টীয় নবম শতকের শেষ অর্ধেক থেকে দশম শতকের প্রথম অর্ধেক পর্যন্ত। এ সময়ে আবু ইয়াজীদ বিস্তামী ও জুনায়দ বাগদাদী নামক দু’জন ইরানী সুফী ইমামের অনুভূতিতে ও শিক্ষায় সর্বপ্রথম সর্বভূতে আল্লাহর অধিষ্ঠান এবং ‘অহং ব্র হ্মাস্মি’ বাদের প্রকাশ্য প্রতিষ্ঠা লক্ষ্য করা যায়। ইসলামী আধ্যত্মিকতার ক্ষেত্রে সুফীবাদের সাধনায় এই প্রথম ‘আনাল হক’-‘আমি সত্য’ প্রকাশ্যে ব্যবহৃত হতে থাকে। এ মহাবাক্য পরে হুসায়ন বিন মনসুর আল হাল্লাজের মুখে প্রচারিত হয়ে শরীয়তপন্থীদের বিরাগের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং এজন্য মনসুর আল হাল্লাজের প্রাণ-দণ্ডাদেশ হয়। আল্লাহর নিরানব্বই নামের মধ্যে ‘হক’ একটি। ইরানের দার্শনিক ও সুফীদের কাছে এ ‘হক’ নাম ‘আল্লাহ্’ নামের প্রতিস্পর্ধী হয়ে ওঠে। ‘হক’ মানে সত্য;আমি সত্য,আমার আত্মা সত্য,আত্মার মূল নূরে মুহম্মদী সত্য,আল্লাহ্ সত্য,সত্য ছাড়া মিথ্যা নেই। এ ধারণা থেকেই ‘সত্য’ শব্দটি ‘খুদা’ শব্দের বিকল্প হয়ে দাঁড়ায়,ফার্সীতে ‘খোদা’-খোদ (স্বয়ং) + আমোদ-(এসেছেন),মানে সংস্কৃতশাস্ত্রে যাকে ‘স্বয়ম্ভূ’ বলা হয়,তা-ই।
‘হক’ শব্দের অত্যধিক প্রয়োগ ইরানী সুফীবাদে যে লক্ষ্য করা যায় এর কারণ আছে। স্মরণ রাখতে হবে যে,ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পূর্বে ইরানীদের মধ্যে যে জরথুস্ত্রীয় ধর্ম প্রচলিত ছিল তার উৎস দ্বৈতবাদমূলক। দুনিয়ায় নেক ও পাপ,সত্য ও মিথ্যা,‘আহুরমাযদা’ ও ‘আহ্রিমান’ এঁদের দ্বন্দ্ব সবসময়ই লেগে রয়েছে। মানুষের সৃষ্টির উদ্দেশ্য,তার কর্তব্য সজ্ঞানে সত্যের জন্য,নেকের জন্য,আহুরমাযদার পক্ষ নিয়ে,মিথ্যা ও পাপের বিরুদ্ধে,আহ্রিমানের বিরুদ্ধে লড়াই করা। নেকী-বদীর যুদ্ধে,সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্বে মানুষ মাত্রই সত্যের সৈনিক। পরবর্তীকালে ইসলাম এলে তার মধ্যেও এ দ্বৈতভাবের আবিষ্কার কিছুমাত্র আয়াসসাধ্য কাজ বলে বিবেচিত হয়নি। আল কুরআনেও আল্লাহর পথের বিরোধী শক্তি ইবলিস বা শয়তানকে বেশ ক্ষমতার অধিকারী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। শয়তান চিরকাল মানুষকে বিপথে নিতে চেষ্টা করবে,কুপথ-বিপথ মনোরম বলে দেখাবে আর মানুষ সজ্ঞানে তার বিরোধিতা করে আল্লাহর পথে চলতে চেষ্টা করবে। এ দ্বন্দ্বই জীবনসংগ্রাম। অতএব,ইসলাম আগমনের সাথে সাথে আহুরমাযদা ও আল্লাহ্ এবং আহ্রিমান ও শয়তান এক না হলেও ধারণার দিক থেকে এদের বিরুদ্ধবাদিতা স্বীকার করে নেয়া হলো। সুতরাং ‘আল্লাহর’ ‘হুকুক’ বা সত্যতা ‘হক’ শব্দে ‘বাতিল’ অনর্থ শব্দের প্রতি বিরোধী ধারণা প্রকট হলো।
প্রথম যুগের সুফীরা কতগুলো নতুন ধারণা নিয়ে এলেন। বাগদাদের সুফী মারুফ আল কারখী একজন মস্তান বা দিব্যোন্মদ সাধক পুরুষ ছিলেন। ইনি নবম শতাব্দীর প্রথম দিকে ৮১৫ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। ইনি ইরানী বংশোদ্ভূত আরবী ভাষাভাষী পণ্ডিত ছিলেন। তিনি তপস্যা ও কৃচ্ছ্র সাধনা অপেক্ষা অনুভূতির দিকে বেশি নজর দিয়েছিলেন। তিনি বলতেন,ভক্তিই মুক্তির পথ,কিন্তু তা মানুষের সাধনায় মিলে না,তা আল্লাহর দান,তিনি যাকে করুণা করেন তাকে দান করেন। উপিনিষদেও অনুরূপ বাণী রয়েছে :
নায়মাত্মা প্রবচনে লভ্যো
ন মেধয়া,ন বহূনা শ্রুতেন।
যমেবৈষ বৃনুতে তেন লভ্যস্তশ্যেষ
আত্মা বিবৃণুতে তনুং স্বাম ॥
মারুফ প্রথমে তাসাউওফের সংজ্ঞা এভাবে নির্ণয় করেন : “আত তাসাউফু আল আখজু বিল হাকায়িকে ওয়াল আসু মিম্মা ফীল আযাদিল খালাকে।”-তাসাউফ হচ্ছে সত্য বস্তুসমূহের উপলব্ধি। আর সৃষ্ট জীবগণের হাতে যা রয়েছে তা ত্যাগেই উপলব্ধির সূচনা। এক কথায়,বিষয়-নিস্পৃহতার ওপরই তত্ত্বজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত। আবু সোলায়মান ইরাকী১৩ সুফী চিন্তায় মারিফাতের বা অতীন্দ্রিয় জ্ঞানকে,শাস্ত্রাতীত অনুভূতিজাত আধ্যাত্মিক বোধকে একটি প্রধান স্থান দিলেন। এই মারিফাত জ্ঞান গ্রীকদের genosis-এর কল্পনা থেকে গৃহীত হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন,কিন্তু ইরানী মারিফাতের জ্ঞানে গ্রীক প্রভাব থাকলেও ইসলাম তা পরিশোধন করে এক শুদ্ধ তত্ত্বজ্ঞানের বিকাশের মাধ্যমে এর স্ফূর্তির ধারাবাহিকতার উল্লেখ করেছে। এরপর এলেন মিশর দেশের আবুল ফয়েয সাওবান বিন ইবরাহীম যুন্নূন আল মিসরী।১৪ ইনি মারিফাতবাদকে মেনে নিয়ে আল্লাহর সত্তায় বিলীন হয়ে মানুষ যে আনন্দ রসের১৫ অনুভূতিতে অবগাহন করে,তা-ই জীবনে একমাত্র কাম্য বলে প্রচার করেন।
‘আনাল হক’ মন্ত্রের অন্যতম প্রধান সাধক হুসায়ন বিন মনসুর আল হাল্লাজ ‘আনাল হক’ তাসবিহ্ প্রকাশ্যে ঘোষণা করার জন্য শরীয়তপন্থীদের বিরাগভাজন হন এবং এরা মনসুরের এ দাবিকে খোদা-ই দাবি বলে ইসলামবিরোধী পাপ বলে ঘোষণা করে। তারপর তাঁকে হত্যা করা হয়। হাল্লাজের দর্শন ও অনুভূতির প্রকাশকে শরীয়তপন্থী কাজী ও মোল্লারা সহ্য করতে পারলেন না বটে,কিন্তু অনুভূতিপ্রবণ ভাবুক-সমাজ তাঁকে জীবনমুক্ত মহাপুরুষের সম্মান দিল। হাল্লাজ ইসলাম-জগতে এক শ্রেষ্ঠ শহীদের আসনে আসীন হলেন। তিনি অসাধারণ পণ্ডিত ছিলেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব ও সাধনার অতুলনীয় প্রভাব পরবর্তী সুফীজগতে সর্বজনস্বীকৃত সত্য বলে গণ্য হলো। আল্লাহর ভাবে তিনি কতখানি বিভোর হয়েছিলেন তা তাঁর পুত্র ও মুরিদগণ লিখে গেছেন। তাঁকে চাকুক মারা হয়েছে। দুই হাত ও দুই পা কেটে ফেলা হয়েছে। একরাত্রি এ অবস্থায় তাঁকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। তার পরদিন শৃঙ্খলবদ্ধ অবস্থায় কারাগার থেকে হত্যার জন্য আনা হয়েছে। তিনি শিষ্যদের সাথে হেসে কথা বলছেন,উপদেশ দিচ্ছেন। এ অবস্থায় দেখে একজন শিষ্য জিজ্ঞাসা করলেন : প্রভু,আপনার এ অবস্থা কেন? তিনি উত্তরে বললেন : তাঁর রূপের আদর এরূপই,যে তাঁর সঙ্গে মিলন চায়,তাকে এভাবেই তিনি টেনে নেন। তারপর এ শ্লোকটি রচনা করে আবৃত্তি করলেন :
“নাদিমী গায়র মানসুবিন ইলা শায়য়িন মিনাল হয়ফি।
সাকানী মিছলা মা আশরিবু কাফি লিজ্জায়বি বিজ্জয়ফি ॥
ফালাম্মা দারাতিল কাসি দায়া বিন তাইওয়াস্ সাইফি।
কা যি মান আশরিবুয়াহ মায়াতিন্নিনি ফি সাইফি ॥”
“আমার বন্ধু দয়ামায়ার সাথে সম্পর্কের বাইরে,আমায় তিনি পান করালেন যা তিনি নিজে পান করেন,যেমন মেহমানের সঙ্গে মেজবান করেন। পানপাত্র ঘুরে আসার পর তিনি মাথা কাটার জন্য চামড়ার ‘নাত’ ও তরবারি আনিয়ে নিলেন। তাঁর এমনি নিয়ম। তিনি গ্রীষ্মকালে মহানাগের সাথে সুরা পান করেন।”
এরপর হাল্লাজ যথারীতি সালাত আদায় করে সাথীদের উপদেশ ও উৎসাহ দিয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হলেন। চাবুক মারার কালেও তিনি ‘আহাদ’ ‘আহাদ’-‘এক’ ‘এক’ বলে চিৎকার করেছেন।
মনসুরকে সুফী সাধকমালার মধ্যমণি বলা চলে। তাঁর তিরোধানের পর সুফী মতবাদ,দর্শন ও চিন্তা বিশিষ্ট রূপ পরিগ্রহ করতে থাকে। মনসুর ও তাঁর পূর্ববর্তী এবং সমসাময়িক সত্যদ্রষ্টাদের অনুভূতির আধারে,পরবর্তী যুগের mystic বা মরমিয়া কবি ও দার্শনিকগণ ইরাকে,আরবে,সিরিয়ায়,মিশরে,স্পেনে,তুর্কিস্তানে,ইরানে,মধ্য এশিয়ায় ও পাক-ভারতে আরবী,ফার্সী ও অন্যান্য ভাষায় কাব্য-কবিতা ও বিচারপূর্ণ গ্রন্থ লিখে বিরাট এক সুফী সাহিত্যের সৃষ্টি করেন। এভাবে চর্চা ও অনুশীলনীর কোমলতা ও ভাবপ্রবণতা বিশ্বমানবের দৃষ্টিতে সুন্দরতম ও শোভনতর করে তুলে ধরা হলো।
ওয়ালি গাযালীর মতো দার্শনিকও তাসাউফের সৌন্দর্য ও বিরোধকে মিটিয়ে দিয়ে ইসলামী বিচার ও যুক্তিতর্কের অবতারণা করে বিশ্বমানবের হিতার্থে প্রয়োগের পক্ষে যুক্তি দেন। ইবনুল ফরীদ,ইবনুল আরাবী,হাকীম সানাই,মওলানা জালালুদ্দীন রুমী,শামসুদ্দীন হাফিজ,নূরুদ্দীন জামী-এঁরা সকলেই মানুষকে নতুন পথের সন্ধান দিয়েছেন। মানুষের মনের ও আত্মার সমস্ত দ্বার খুলে দিয়ে তাতে জান্নাত বা ফিরদৌসের হাওয়া বইয়েছেন। সমগ্র মানব জাতির জন্য এঁরা ভাবুকতায়,সৌন্দর্যের ও আধ্যাত্মিক আনন্দের অক্ষয় ভাণ্ডার খুলে দিয়েছেন। সুফী পণ্ডিতরা দার্শনিক খুঁটিনাটির সঙ্গে সুফী অনুভূতি ও উপলব্ধি কল্পনা ও কাব্যের প্রসারণ,বিচার-বিশ্লেষণ ও বর্গীকরণ করে ধারণাটিকে সাধারণ মানুষের পক্ষে হয়তো একটু জটিল করে তুলেছেন। কিন্তু তাতে ক্ষতি হয়নি। সাধারণ মানুষ মনসুর হাল্লাজের বাণী ও সাধনা,ইবনুল ফরীদ,ইবনুল আরাবী,ফরীদুদ্দীন আত্তার,মওলানা রুমী,হাফেজ ও জামীর ফার্সী ও আরবী কবিতা থেকে রস আহরণ করে ভাবে নিমগ্ন হতে পারে,আধ্যাত্মিক চিন্তা ও অনুভূতির ক্ষেত্রে আরব পারস্য তথা পৃথিবীর মুসলমানদের এ এক শ্রেষ্ঠ দান। বাংলাদেশ ও পাক-ভারত,সিরিয়া,ইরাক,আরব ও পারস্যের এ ভাবধারায় উজ্জীবিত হয়ে আধ্যাত্মিক ভাবধারা ও সাহিত্যের পরিপুষ্টি সাধনে সমর্থ হয়েছে।
ইরানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুফী কবি নূরুদ্দীন জামী রচিত সুফীমত সার-সংগ্রহ স্বরূপ ‘ল বাইহ’ বা ‘রশ্মিরাজি’ নামক গ্রন্থ থেকে একটি মোনাজাতের উদ্ধৃতি দিচ্ছি। কবিতাটির আরম্ভ আরবীতে,উপসংহার ফার্সীতে। মোনাজাতটি গদ্যে এরূপ দাঁড়ায় :
“হে আল্লাহ্! প্রতিপালক,ক্ষুদ্র বিষয় বাসনা থেকে আমাদের মুক্ত করো। সমস্ত বস্তুর সত্য স্বরূপকে আমাদের দেখাও। আমাদের বিচার চক্ষুর ওপরে যে গাফিলতির পর্দা পড়েছে তা সরিয়ে দাও। প্রত্যেক বস্তু যেমনটি আছে তেমনটি দেখাও। বাতিল বা অসত্যকে আমাদের কাছে সত্য বলে প্রকাশ করো না। সত্যের সৌন্দর্যের ওপর অসত্যের পর্দা ঢেকে দিও না। পরিদৃশ্যমান রূপসমূহকে তোমার সৌন্দর্যের ঔজ্জ্বল্যের প্রতিচ্ছায়া করো। এগুলোকে আবরণের ও দূরত্বের কারণ করো না। এ সকল মায়াময় কাল্পনিক চিত্রকে আমাদের জ্ঞান ও সত্য দর্শনের আয়ত্তে এনে দাও। এগুলোকে অজ্ঞান অন্ধত্বের আয়ত্ত করো না। আমাদের অভাব ও প্রবাস আমাদের দোষেই ঘটে। আমাদের মধ্যে আমাদের ফেলে রেখো না,বরং আমাদের থেকেই আমাদের মুক্তি দাও। আমাদের তোমায় জানতে দাও।”
অন্যতম সুফী সাধিকা রাবেয়ার একটি প্রার্থনা এরূপ : প্রভু! যদি জান্নাতের লোভে তোমার ইবাদাত করে থাকি,তাহলে তা আমার জন্য হারাম করো,যদি জাহান্নামের ভয়ে তোমার সাধনা করে থাকি,তাহলে সে জাহান্নামের আগুনে আমাকে পুড়িয়ে মারো। আর যদি শুধু তোমার জন্য,তোমারি সন্তুষ্টির জন্য তোমার আরাধনা করে থাকি,তবে তোমার দর্শন থেকে বঞ্চিত করো না,হে দয়ালু করুণানিদান প্রভু!
সুফী সাধনা,ভাবধারা ও দর্শন যুগে যুগে আমাদের চিন্তাধারা,জীবনপদ্ধতি ও সংস্কৃতি তথা কাব্য-সাহিত্যের প্রেরণা যোগাবে এবং আমাদের ধ্যান-ধারণা ও অধ্যাত্ম সাধনায় উজ্জীবিত করবে,এ সম্বন্ধে সন্দেহ নেই।
তথ্যপঞ্জি
১. মাক্স মুলার, ইন্ডিয়ান ফিলসফি, পৃ: ৮৯৫, আল-কুরআন-১১২-১ থেকে ৪।
১ক. আল কুরআন, সূরা ইখলাস : ১-৪।
১খ. الله نور السماوات و الأرض - আল কুরআন, সূরা নূর : ৩৫।
২ إن الحكم إّلا لِّله - আল কুরআন, সূরা আনআম : ৫৭; সূরা ইউসূফ : ৪০; সূরা নূর : ৩৫।
৩ - إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَيْئًا أَنْ يَقُولَ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ আল কুরআন, সূরা ইয়াসীন : ৮২।
৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গীতাজ্ঞলি।
৫. Lower self এবং Higher self কথাগুলো পাশ্চাত্য দর্শনের। আমাদের বিবেচনায় এ দু’টিও প্রমাদপূর্ণ। কারণ self, self -ই। এর Lower এবং Higher নেই। যা আছে তা বিধা বা aspect -এর বিভিন্নতা।
৬. আল হাদীস।
৭. আল কুরআন : সূরা হাদীস : ৩।
৮. আনাল হক-আমিই সত্য। অহং ব্রহ্মাস্মি-আমি ব্রহ্ম। সো অহং- সে-ই আমি, আমিই সে।
৯. যুগে যুগে সম্ভাবামি- গীতা।
১০. এ শ্রেণীবিভাগ, শরীয়তের আহ্কাম সম্বন্ধে ফকীহ্-মুজতাহিদদের প্রচলিত বিভাজন থেকে আলাদা।
১১. নাহজুল বালাগাহ্, সংক্ষিপ্ত জ্ঞানগর্ভমূলক বাণী নং ২৯০।
১২. নাহজুল বালাগাহ্, সংক্ষিপ্ত জ্ঞানগর্ভমূলক বাণী নং ২৩৭।
১৩. ইনি ৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন।
১৪. ইনি ৮৬০ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন।
১৫. একে وحد বলে।
লেখক : ড. কাজী দীন মুহম্মদ, সাবেক অধ্যাপক,বাংলা বিভাগ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,সাবেক মহাপরিচালক,বাংলা একাডেমী ও সাবেক উপ-উপাচার্য,এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। (জ্যোতি, ২য় বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা)
source : alhassanain