দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের প্রচলিত বিশ্বাস হলো- মুমূর্ষু কিংবা মৃত্যু পথযাত্রীকে তওবা পড়ানো হলে তার মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়। তাই তাদের তওবা পড়ানোর জন্য মুন্সি-মাওলানাদের আনা হয়। অর্থাৎ তওবাকে ধরা হয় জীবনের অন্তিম পর্যায়ের একটি কাজ। এর পর আর তওবাকারীর বেঁচে থাকারে কোনো সম্ভাবনা নেই!
এমন ধারণা ইসলাম সমর্থন করে না। এটা সম্পূর্ণ অমূলক। তওবা করলে মমূর্ষু ব্যক্তির মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়- এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বিশ্বাস। ইসলামের দৃষ্টিতে তওবার মানে জীবনের অবসান নয়; বরং তওবার অর্থ হলো- গোনাহমুক্ত নতুন জীবন লাভ।
তওবা আরবি শব্দ। অর্থ প্রত্যাবর্তন করা, ফিরে আসা। কোরআন ও হাদিসে শব্দটি আল্লাহর নিষেধকৃত বিষয়সমূহ পরিত্যাগ করা ও তার আদেশকৃত বিষয়সমূহর দিকে ফিরে আসা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। ইসলামি ধর্মতত্ত্বে শব্দটি নিজের কৃত পাপের জন্য অনুতপ্ত হওয়া, তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং তা পরিত্যাগের দৃঢ় সংকল্পকে বোঝায়।
তওবার আক্ষরিক অর্থ ফিরে আসা। ইসলামি শরিয়তে এর অর্থ অতীত পাপকাজ থেকে ফিরে আসা এবং ভবিষষ্যতে তা না করার দৃঢ় সংকল্প করা। ইসলামি স্কলারদের মতে তওবা হলো- গোনাহ পরিত্যাগ করে আল্লাহর আনুগত্যের দিকে ফিরে আসা এবং অন্তর থেকে আল্লাহতায়ালার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা।
এক কথায় তওবার অর্থ হলো- আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন। মানুষের পক্ষ থেকে যখন কোনো গোনাহ হয়ে যায়, তখন তার কর্তব্য হলো- আল্লাহতায়ালার কাছে তওবা-ইস্তেগফার করা। তওবার শর্তের মাঝে রয়েছে-
কৃত অপরাধটি হক্কুল্লাহ বা আল্লাহর হক (বিধি-নিষেধ লঙ্ঘন) সম্পর্কিত হলে চারটি কাজ করতে হবে। তাহলে তওবা পূর্ণাঙ্গ হবে। কাজগুলো হলো- ১. গোনাহ ছেড়ে দেওয়া, ২. লজ্জিত ও অনুতপ্ত হওয়া।, ৩. ভবিষ্যতে এ ধরনের গোনাহ না করার দৃঢ় সংকল্প করা ও ৪. কোনো ফরজ-ওয়াজিব ছুটে থাকলে মাসয়ালা অনুযায়ী তার কাজা-কাফফারা আদায় করা।
আর অপরাধটি যদি হয় হক্কুল ইবাদ তথা বান্দার হক (অধিকার) সংক্রান্ত হয়, তাহলে আরও একটি কাজ করতে হবে। যার অধিকার নষ্ট করা হয়েছে তার পাওনা বা অধিকার আদায় করতে হবে কিংবা তার কাছ থেকে ক্ষমাগ্রহণ করে দায়মুক্ত হতে হবে। এভাবে আল্লাহর কাছে নিজের কৃতকর্ম কিংবা পাপরাশির জন্য কান্নাকাটি ও অনুতাপের অশ্রু ফেলার নাম হলো- তওবা।
আল্লাহতায়ালার দরবারে তওবা ও ক্ষমাপ্রার্থনা যে কোনো ভাষায় করা যায়, নিজের ভাষায়ও করা যায়। তেমনি হাদিসে তওবা-ইস্তেগফারের যে দোয়াগুলো আছে সেগুলো পড়েও তওবা-ইস্তেগফার করা যায়। তওবার ভাষা নির্দিষ্ট নয়।
তওবা করা তারই দায়িত্ব, যার দ্বারা কোনো গোনাহের কাজ হয়ে গেছে। নিজের গোনাহর জন্য নিজেকেই অনুতপ্ত হতে হবে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে হবে। তওবা হলো- মুমিন জীবনের সার্বক্ষণিক আমল। হজরত রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষ্পাপ হওয়া সত্ত্বেও দিনে সত্তর থেকে একশ’ বার ইস্তেগফার করতেন বলে হাদিসে উল্লেখ আছে।
কোনো আলেমের হাত ধরে, কিংবা তার বলে দেওয়া শব্দেই তওবা-ইস্তেগফার করতে হবে- এটা জরুরি নয়। আর নিজের তওবা নিজে করা যাবে না, কারও মাধ্যমে করতে হবে- এমন ধারণাও ঠিক নয়। শুধুমাত্র তওবার ক্ষেত্রে উল্লেখিত শর্তগুলো মানা জরুরি। বর্ণিত শর্ত না মেনে শুধু কারও বলে দেওয়া বাক্যগুলো উচ্চারণ করলে তওবা আদায় হবে না।
সাধারণভাবে তওবার জন্য অজু অপরিহার্য নয়। তবে কেউ যদি তওবার নামাজ আদায় করতে চায়, তাহলে অন্যান্য নামাজের মতোই তাকে অজু করতে হবে। এ প্রসঙ্গে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যদি কেউ কোনো গোনাহ করে ফেলে অতঃপর পূর্ণ পবিত্রতা অর্জন করে নামাজে দাঁড়ায় এবং আল্লাহর কাছে গোনাহ মাফ চায়; তাহলে আল্লাহ তার গোনাহ মাফ করে দিবেন। অতঃপর নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোরআনে কারিমের একটি আয়াত তেলাওয়াত করলেন, ‘এবং তারা সেই সব লোক, যারা কখনও কোনো মন্দ কাজ করে ফেললে বা নিজেদের প্রতি জুলুম করলে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজেদের গোনাহর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আর কে আছে আল্লাহ ছাড়া, যে গোনাহ ক্ষমা করতে পারে? আর তারা জেনেশুনে তাদের কৃতকর্মের ওপর অবিচল থাকে না।’-সূরা আল ইমরান : ১৩৫; জামে তিরমিজি
সুতরাং তওবাকে মৃত্যু ত্বরান্বিতের কারণ মনে করা, অজু ছাড়া তওবা হয় না কিংবা তওবার সময় অন্যের সহযোগিতা অপরিহার্য- ইত্যাদি হচ্ছে ভ্রান্ত ও ভিত্তিহীন ধারণা। ইসলামি শরিয়তে এর কোনো ভিত্তি নেই।
বাংলাদেশ সময়: ২০২০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৭, ২০১৬
এমএ/
source : abna24