হযরত আলী (আ.) এর পবিত্র জন্মবার্ষিকীতে আপনাদের সবার প্রতি রইলো প্রাণঢালা অভিনন্দন ও মোবারকবাদ। এ দিনটি ইরানে বাবা দিবস হিসেবে পালিত হয়। পৃথিবীতে যতো মহান মনীষীর জন্ম হয়েছে তাঁদের অন্যতম একজন হলেন ইমাম আলী (আ.)। তিনি এমন এক মহামানব ছিলেন,যাঁর সম্মান-মর্যাদা,জ্ঞান ও সাহসী ভূমিকা ইসলামের ইতিহাসে চির স্মরণীয় হয়ে আছে। ইসলামের ইতিহাসে রাসূলে খোদার পর ধর্মীয়,সাংস্কৃতিক এবং জ্ঞান-গবেষণার ক্ষেত্রে যাঁর চেষ্টা-প্রচেষ্টাকে যুগান্তকরী বলে মনে করা হয় তিনি হলেন হযরত আলীর (আ.)।
ইবনে আব্বাস মহানবীর নিকট থেকে বর্ণনা করেছেন : “আলী আমার উম্মতের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানী এবং বিচারকার্যে সকলের চেয়ে উত্তম।” মহানবী (সা.) বলেন :
(انا مدينة العلم و علي بابها فمن أراد العلم فليقتبسه من عليّ)
“আমি জ্ঞানের শহর,আলী তার দ্বার। যে কেউ জ্ঞানার্জন করতে চায় সে যেন আলী থেকেই জ্ঞানার্জন করে।”
ইবনে মাসউদ বলেন : “মহানবী (সা.) আলীকে ডাকলেন এবং তাঁর সাথে একান্তে বসলেন। যখন আলী ফিরে আসলেন,তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম কী আলোচনা করছিলেন? তিনি বললেন : মহানবী (সা.) জ্ঞানের সহস্রটি দ্বার আমার জন্য উন্মুক্ত করলেন,প্রত্যেকটি দ্বার থেকে আবার সহস্র দ্বার উন্মুক্ত হয়!
একদা হযরত আলী (আ.) মিম্বারে বললেন :
(يا معشر النّاس سلوني قبل ان تفقدوني)
“হে লোক সকল! আমাকে হারানোর পূর্বেই,আমার কাছে জিজ্ঞাসা কর।”
আমার নিকট থেকে জেনে নাও,কেননা পূর্ববর্তী ও উত্তরবর্তীদের জ্ঞান আমার নিকট বিদ্যমান। আল্লাহর শপথ,যদি বিচারের দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয়,ইহুদীদের জন্য তাদের কিতাব থেকে,ইঞ্জিলের অনুসারীদের জন্য সে কিতাব থেকে,যবূরের অনুসারীদের জন্য তাদের কিতাব থেকে,আর কোরআনের অনুসারীদের জন্য কোরআন থেকে তবে সেভাবেই বিচার করব... আল্লাহর শপথ,আমি কোরআন ও তার ব্যাখ্যায় সকলের চেয়ে জ্ঞানী।
অতঃপর পুনরায় বললেন :
(سلوني قبل ان تفقدوني)
আমাকে হারানোর পূর্বেই আমাকে জিজ্ঞাসা কর। কোরআনের যে কোন আয়াত সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞাসা কর,আমি তার জবাব দিব; বলতে পারব তার অবতীর্ণ হওয়ার সময় সম্পর্কে,কার উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ হয়েছে,নাসেখ ও মানসূখ সম্পর্কে,আর বলতে পারব সাধারণ ও বিশেষ আয়াত সম্পর্কে,মোহকাম ও মোতাশাবিহ আয়াত সম্পর্কে,মাক্কী ও মাদানী আয়াতসমূহ সম্পর্কে...।
ইহুদীদের কিছু আলেম আবু বকরের নিকট এসেছিল এবং তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল : আমরা তৌরাতে পড়েছি যে নবীর উত্তরসূরী হবে সর্বাপেক্ষা জ্ঞানী ব্যক্তি,যদি তুমি এ উম্মতের নবীর উত্তরসূরী হয়ে থাক,তবে আমাদেরকে বল যে,আল্লাহ্ কি আকাশে আছেন,না ভূপৃষ্ঠে?
আবু বকর জবাব দিল : তিনি আকাশে আরশের উপর অধিষ্ঠিত আছেন।
তারা বলল : তাহলে ভূপৃষ্ঠে তিনি নেই। সুতরাং জানা গেল যে,তিনি কোথাও আছেন আবার কোথাও বা নেই।
আবু বকর বলল : এটা কাফেরদের কথা। দূর হও,নতুবা তোমাদেরকে হত্যা করার নির্দেশ দিব।
তারা ইসলামকে উপহাস করতে করতে ফিরে যাচ্ছিল। হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) তাদের একজনকে ডেকে বললেন : আমি জানি,তোমরা কী জিজ্ঞাসা করেছ এবং কী জবাব পেয়েছ;তবে জেনে রাখ যে ইসলাম বলে : মহান আল্লাহ্ স্বয়ং স্থানের অস্তিত্ব দানকারী,সুতরাং তিনি কোন স্থানে সীমাবদ্ধ নন এবং কোন স্থান তাঁকে ধারণ করতে অক্ষম;কোন প্রকার সংলগ্ন ও স্পর্শ ব্যতীতই তিনি সর্বত্র বিরাজমান এবং তাঁর জ্ঞান সবকিছুকেই পরিবেষ্টন করে আছে...।
ইহুদী পণ্ডিতগণ ইসলামে বিশ্বাস স্থাপন করলেন এবং বললেন : ‘আপনিই নবীর উত্তরাধিকারী হওয়ার যোগ্য,অন্য কেউ নয়।
‘কোদামাত ইবনে মাযয়ূন’ নামক একব্যক্তি মদ পান করেছিল। ওমর তার উপর শরীয়তের বিধান প্রয়োগ করতে চেয়েছিল (অর্থাৎ এক্ষেত্রে ৮০ টি চাবুক মারতে হবে)। কোদামা বলল : আমার উপর চাবুক প্রয়োগ করা অপরিহার্য নয়। কারণ,মহান আল্লাহ্ বলেন : যারা বিশ্বাস করেছে ও সৎকর্ম করেছে তারা (পূর্বে) যা ভক্ষণ করেছে সে ব্যাপারে তাদের কোন গুনাহ নেই; যদি তারা সাবধানতা অবলম্বন করে (ও আত্মসংযমী হয়),বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে; (সূরা মায়িদাহ : ৯৩।)
ওমর তাকে শাস্তি প্রয়োগ থেকে বিরত থাকল। হযরত আলীর নিকট এ সংবাদ পৌঁছল। তিনি ওমরের নিকট গেলেন এবং ওমরের নিকট জানতে চাইলেন,কেন আল্লাহর বিধান প্রয়োগ করনি? ওমর প্রাগুক্ত আয়াতটি পাঠ করল। ইমাম বললেন : কোদামাহ এ আয়াতের অন্তর্ভূক্ত নয়। কারণ,যারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম সম্পাদন করে,তারা আল্লাহর হারামকে হালাল করে না;কোদামাহকে ফিরিয়ে আন এবং ওকে তওবা করতে বল। যদি তওবা করে তবে তার উপর আল্লাহর বিধান প্রয়োগ কর। নতুবা তাকে হত্যা করতে হবে। কারণ মদ পানের নিষিদ্ধতাকে অস্বীকার করে সে ইসলাম থেকে বহিস্কৃত হয়েছে।
কোদামাহ একথা শুনে ফিরে এসে তওবা করল এবং পাপাচার থেকে বিরত থাকল। কিন্তু ওমর জানতো না যে,তার শাস্তির পরিমাণ কতটুতু হবে। সুতরাং ইমাম আলীর নিকট জিজ্ঞাসা করেছিল। তিনি বললেন : আশিটি চবুক।
আল্লামা মাজলিসি কাশশাফ,ছা’লাবী ও খতিবের ‘আরবাইন’ থেকে বর্ণনা করেছেন যে,এক নারী ওসমানের সময় ছয় মাসে বাচ্চা জন্ম দিয়েছিল। ওসমান ব্যভিচারের হদ জারি করার হুকুম দিল। কারণ,হতে পারে এ বাচ্চা তার স্বামী থেকে নয় এবং সে পূর্বেই কারো মাধ্যমে অন্তঃসত্তা হয়েছিল। তাই তাকে পাথর নিক্ষেপে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিল।
ইমাম এ ঘটনা শুনে ওসমানকে বললেন : আমি মহান আল্লাহর কিতাব নিয়ে এ ব্যাপারে তোমার সাথে বিতর্ক করতে চাই। কারণ মহান আল্লাহ্ এক আয়াতে অন্তঃসত্তা থেকে দুগ্ধ পান করানো পর্যন্ত ত্রিশ মাস সময়ের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন :
(وحمله و فصاله ثلاثون شهرا)
গর্ভ ধারণ থেকে স্তন্য পান সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত,সময় হলো ত্রিশ মাস। (সূরা আহকাফ : ১৫)। অন্যত্র স্তন্য পানের সময়কাল ২৪ মাস বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
যেমন :
(والوالدات يرضعن اولادهنّ حولين كاملين لمن اراد ان يتمّ الرّضاعة)
“মায়েরা তাদের সন্তানদের পূর্ণ দু’বছর দুধ পান করাবে,(এ বিধান) তার জন্য যে (সন্তানের) দুধপানের কাল পূর্ণ করতে চায়।” (সূরা বাকারা : ২৩৩)
অতএব,যদি নিশ্চিতরূপে চব্বিশ মাস নির্ধারিত হয়ে থাকে,তবে প্রথম আয়াতের মতে যে গর্ভধারণ ও স্তন্য প্রদানের মোট সময় কাল ত্রিশ মাস বলে উল্লেখ করা হয়েছে,এতদুভয়ের অন্তর ছয় মাস হয়ে থাকে,যা গর্ভধারণের সর্বনিম্নকাল। অতএব,এ নারী কোরআনের মতে কোন প্রকার পাপাচারে লিপ্ত হয়নি...।
অতঃপর ওসমানের আদেশে তাকে মুক্তি দেয়া হলো। জ্ঞানীগণ ও আমাদের ফকীহগণ এ দু’আয়াত ব্যবহার করেই গর্ভধারণের সর্বনিম্ন সময় কাল ছয় মাস বলে জানেন। অর্থাৎ স্বীয় বৈধ পিতার বীর্য থেকে ছয় মাসে বাচ্চা জন্ম গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু তা অপেক্ষা কম সময়ে বাচ্চা জন্ম গ্রহণ করতে পারে না। হযরত আলীর মতও এরকমই ছিল।
আল কাফি গ্রন্থে হযরত ইমাম সাদেক (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত আলী (আ.)এর খেলাফত কালে এক ব্যক্তি জাবাল থেকে আল্লাহর ঘর যিয়ারাতের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন তাঁর সাথে তার গোলামও ছিলো। গোলামটি ভুল করায় মালিক তাকে মারধর করলে সে অন্যায়ভাবে তার প্রভুকে বললো, আমি তোমার গোলাম নই বরং তুমি আমার গোলাম। এই বিবাদ এমন পর্যায়ে পৌঁছালো যে তারা পরস্পরকে হুমকি পর্যন্ত দিচ্ছিলো। এভাবে তারা কুফায় পৌঁছালে সুষ্ঠু বিচারের আশায় হযরত আলী(আ.) এর নিকটে গেল এবং মালিকটি হযরত আলীকে বললেন ঃ হে আমীরুল মুমেনিন এই গোলামটি আমার, সে অন্যায় করায় আমি তাকে শাস্তি দিয়েছি। এখন সে বলে আমি তোমার গোলাম না। গোলাম কছম খেয়ে বললো সে আমার গোলাম, আমার বাবা হজ্জ্ব সম্পর্কে জ্ঞান দেয়ার জন্য তার সাথে আমাকে পাঠিয়েছেন, এখন সে অন্যায়ভাবে বলছে তুমি আমার গোলাম। তার উদ্দেশ্য হলো আমার ধন-সম্পদ আত্মসাৎ করা। মালিক কছম খেয়ে বললো, সে যা বলছে মিথ্যা বলছে। হযরত আমীরুল মুমেনিন তাদেরকে বললেন, এখন তোমরা বাড়ী যাও। আগামীকাল এসো বিচার করে দিবো । সকল বিভেদ ত্যাগ করে সত্য কথা বলবে। লোকজন বলাবলি করছিলো বিষয়টা বেশ জটিল, এ রকম সমস্যা কখনো দেখিনি, দেখা যাক হযরত আলী (আ.) কেমন করে সমাধান করেন। ঐ দুই ব্যক্তি চলে যাওয়ার পর হযরত আলী (আ.) কাম্বারকে নির্দেশ দিলেন নিকটবর্তী একটি দেয়ালের গায়ে মাথা পরিমাণ মাপের দুটি ছিদ্র করতে। সকাল হলে হযরত আলী (আঃ) কাম্বারকে বললেন, আমার তরবারিটা তোল যখন বলবো গোলামের মাথাটা কেটে ফেলো । মারার জন্য উদ্বুদ্ধ হবে কিন্ত মারবেনা শুধু ভয় দেখাবে। লোকজনও ধীরে ধীরে ঐ স্থানে জমা হতে লাগলো । এরপর ঐ দুই ব্যক্তি ঐ স্থানে উপস্থিত হলে আলী (আ.) তাদের সাথে কথা বলে বুঝতে পারলেন তারা দুজনই নিজ নিজ কথার উপর অটল রয়েছে । তাই তিনি বললেন, আমি দেখতে পাচ্ছি তোমরা দুজনই মিথ্যা বলছো । অতএব তোমরা দুজনই ঐ ছিদ্রের মধ্যে মাথা ঢুকাও। উভয়েই যখন তাদের মাথা দেয়ালের ছিদ্রে ঢুকিয়ে দিল তখন হযরত আলী (আ.) কাম্বারকে নির্দেশ দিলেন ঃ কাম্বার গোলামের মাথাটা কেটে দু’ভাগ করে দাও। একথা শোনার সাথে সাথেই প্রকৃত গোলামটি দ্রুত তার মাথাটি ছিদ্র থেকে বের করে নিল । অতঃপর হযরত আলী (আ.) গোলামকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি বলোনি আমি গোলাম না ? গোলাম বললো : জ্বি! হে আমিরুল মুমেনিন, কারণ সে আমাকে প্রচুর প্রহার করেছিল, তাই আমি অস্বীকার করেছিলাম আমার প্রভুকে । এরপর হযরত আলী (আ.) গোলামকে মালিকের হাতে তুলে দিতে নির্দেশ দিলেন।
source : alhassanain