ইমাম শব্দের অর্থ
‘ইমাম’ বা নেতা তাকেই বলা হয়, যে একদল লোককে নির্দিষ্ট কোন সামাজিক, রাজনৈতিক, বৈজ্ঞানিক অথবা ধর্মীয় লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যে নেতৃত্ব প্রদানের দায়িত্ব গ্রহণ করে। অবশ্য নেতা তার নেতৃত্বের পরিধির বিস্তৃতি ও সংকীর্ণতার ক্ষেত্রে সময় ও পরিবেশগত পরিস্থিতির অনুসারী পবিত্র ইসলাম ধর্ম মানব জীবনের সকল দিক পর্যবেক্ষণপূর্বক তার জন্যে নীতিমালা প্রণয়ন করেছে।
ইসলাম মানুষের আধ্যাত্মিক জীবন বিশ্লেষণপূর্বক তার জন্যে প্রয়োজনীয় পথর্নিদেশ দান করেছে। পার্থিব জীবনের ক্ষেত্রে এবং মানুষের ব্যক্তিগত জীবন যাপন ও তার পরিচালনার ব্যাপারেও ইসলামের হস্তক্ষেপ রয়েছে। ঠিক একইভাবে মানুষের সামাজিক (পার্থিব) জীবন ও তার পরিচালনার (রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা) ক্ষেত্রেও ইসলামের নির্দেশ রয়েছে।
উপরে মানব জীবনের যেসব দিক সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, তার ভিত্তিতে ইসলামী নেতৃত্ব তিনটি দিকে গুরুত্বের অধিকারী। সেই দিক গুলো হচ্ছে: ইসলামী শাসন ব্যবস্থা, ইসলামী জ্ঞানমালা ও আইন কানুন বর্ণনা এবং আধ্যাত্মিক জীবনে নেতৃত্ব ও পথ নির্দেশনার দিক। শীয়াদের দৃষ্টিতে ইসলামী সমাজের জন্যে উক্ত গুরুত্বপূর্ণ তিনটি দিকের নেতৃত্ব দানের জন্যে নেতার প্রয়োজন অপরিহার্য। যিনি ইসলামী সমাজের এ তিনটি দিকের উপযুক্ত নেতৃত্ব দেবেন অবশ্যই তাকে মহান আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.)-এর দ্বারা মনোনীত হতে হবে। অবশ্য মহান আল্লাহ্র নির্দেশে বিশ্বনবী (সা.) এই মনোনয়ন কার্য সম্পন্নও করে গেছেন।
ইসলামী শাসনব্যবস্থা ও মহানবী (সা.)-এর উত্তরাধিকার
মানুষ তার আল্লাহ প্রদত্ত স্বভাব দিয়ে অতি সহজেই এ বিষয়টি উপলব্ধি করে যে, কোন দেশ, শহর গ্রাম বা গোত্র এবং এমনকি গুটি কয়েক লোক সম্বলিত কোন একটি সংসারও একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির নেতৃত্ব ছাড়া চলতে পারে না। একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির নেতৃত্ব ছাড়া সমাজের চাকা সচল রাখা সম্ভব নয়। একজন নেতার ইচ্ছাই সমাজের অসংখ্য ব্যক্তির ইচ্ছার উপর প্রভুত্ব করে। এভাবে সে সমাজের প্রতিটি ব্যক্তিকে তার সামাজিক দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করে। সুতরাং একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির নেতৃত্ব ছাড়া সমাজের গতি অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে না। তাই অতি অল্প সময়ের মধ্যেই নেতাহীন ঐ সমাজ ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতে বাধ্য।
যার ফলে এক ব্যাপক অরাজকতা ঐ সমাজকে ছেয়ে ফেলবে। সুতরাং, উক্ত যুক্তির উপর ভিত্তি করে নিঃসন্দেহে এ কথা বলা যায় যে, সমাজ পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত (সে সমাজ বৃহত্তরই হোক অথবা ক্ষুদ্রতরই হোক) নেতা, সমাজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে যার অবদান অনস্বীকার্য তিনি যদি কখনও অস্থায়ীভাবে অথবা স্থায়ীভাবে তার পদ থেকে অনুপস্থিত থাকেন, তাহলে অবশ্যই তার ঐ অনুপস্থিতকালীন সময়ের জন্যে অন্য কাউকে দায়িত্বশীল হিসেবে নিয়োজিত করে যাবেন। এধরণের দায়িত্বশীল কোন নেতা কোনক্রমেই এমন কাজ করতে প্রস্তুত হবেন না, যার ফলে নিজের দায়িত্বের পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর কারণে নেতার অভাবে ঐ সমাজের অস্তিত্ব ধ্বংসোন্মুখ হয়ে পড়বে। কোন পরিবারের কর্তাব্যক্তিও যদি কিছুদিনের জন্যে অথবা কয়েক মাসের জন্যে পরিবারের সদস্যদের ত্যাগ করে দূরে কোথাও ভ্রমনে যান। তখন অবশ্যই তিনি তার অনুপস্থিতকালীন সময়ে সংসার পরিচালনার জন্যে পরিবারের কাউকে (অথবা তৃতীয় কোন ব্যক্তিকে) দায়িত্বশীল হিসাবে নিয়োগ করে যান। কোন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক বা স্কুলের প্রধানশিক্ষক অথবা দোকানের মালিক, যাদের অধীনে বেশ ক’জন কর্মচারী কর্মরত, তারা যদি অল্প ক’ঘন্টার জন্যেও কোন কারণে কর্মস্থল ত্যাগ করেন, তাহলে অধীনস্থ কাউকে তার অনুপস্থিতকালীন সময়ে তার দায়িত্ব পালনের জন্যে নিযুক্ত করে যান। আর অন্যদেরকে ঐ নবনিযুক্ত দায়িত্বশীলের আনুগত্য করার নির্দেশ দেন। ইসলাম এমন এক ধর্ম, যা আল্লাহ প্রদত্ত মানব প্রকৃতি অনুযায়ী পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ্র ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। ইসলাম একটি সামাজিক আদর্শ যার প্রকৃতি এমন এক দৃষ্টান্তমূলক যে, পরিচিত ও অপরিচিত সবাই ঐ আদর্শের দর্পন থেকে এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পারে। মহান আল্লাহ ও বিশ্বনবী (সা.) এই আদর্শের সামাজিকতার ক্ষেত্রে যে মহান অবদান রেখেছেন, তা সবার কাছেই অনস্বীকার্য। এই ঐশী আদর্শ পৃথিবীর অন্য কিছুর সাথেই তুলনাযোগ্য নয়। মহানবী (সা.)-ও ইসলামের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন সামাজিক বিষয়ই পরিত্যাগ করতেন না। যখনই কোন শহর বা গ্রাম মুসলমানদের দ্বারা বিজিত হত, সম্ভাব্য সংক্ষিপ্ত সময়ে বিশ্বনবী (সা.) তার পক্ষ থেকে কাউকে ঐ অঞ্চলের শাসনকর্তা ও স্বীয় প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে পাঠাতেন। এমনকি জিহাদ পরিচালনার উদ্দেশ্যে প্রেরিত সেনাবাহিনীর জন্যে প্রয়োজন বোধে (অত্যাধিক গুরুত্বের কারণে) একাধিক সেনাপতিও তিনি নিযুক্ত করতেন। এমনকি ঐতিহাসিক ‘মুতার’ যুদ্ধে বিশ্বনবী (সা.) চারজন সেনাপতি নির্বাচন করেছিলেন। যাতে প্রথম সেনাপতি শাহাদত বরণ করলে দ্বিতীয় সেনাপতি দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। দ্বিতীয়জন শাহাদত বরণ করলে তৃতীয়জন দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। আর এইভাবে এ ধারা বাস্তবায়িত হবে। রাসুল (সা.)-এর এসকল কার্যের মাধ্যমেই নেতা নিয়োগের গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে যায়। একইভাবে বিশ্বনবী (সা.) তার স্বীয় উত্তরাধিকারের বিষয়েও সম্পূর্ণ সজাগ ছিলেন। তিনি স্বীয় উত্তরাধিকারী নির্ধারণের ব্যাপারে কখনোই পিছপা হননি। যখনই তিনি প্রয়োজন বোধে মদীনার বাইরে যেতেন, তখনই তিনি কাউকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করে যেতেন এমন কি যখন তিনি মদীনার উদ্দেশ্যে মক্কা নগরী ত্যাগ করে ছিলেন, যখন কেউই সে সংবাদ সম্পর্কে অবহিত ছিল না তখনও মাত্র অল্প ক’দিনের জন্য স্বীয় ব্যক্তিগত দায়িত্ব পালন ও জনগণের গচ্ছিত আমানত দ্রব্যাদি মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার জন্যে মক্কায় হযরত ইমাম আলী (আ.)-কে নিজের স্থলাভিষিক্ত করে যান। এভাবেই বিশ্বনবী (সা.) মৃত্যুর পূর্বে স্বীয় ঋণ পরিশোধ ও বিশ্বাসগত অসমাপ্ত কার্যাবলী সম্পাদনের জন্যে ইমাম আলী (আ.)-কে নিজের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নির্বাচিত করেছিলেন। তাই শীয়ারা বলে: উপরোক্ত দলিলের ভিত্তিতে এটা আদৌও কল্পনাপ্রসূত নয় যে, বিশ্বনবী (সা.) মৃত্যুর পূর্বে কাউকে তাঁর উত্তরাধিকারী বা স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নির্বাচিত করে যাননি। মুসলমানদের প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা এবং ইসলামী সমাজের চালিকা শক্তি নিয়ন্ত্রণের জন্যে কাউকেই মহানবী (সা.) মনোনীত করে যাননি, এটা এক কল্পনাতীত ব্যাপার বটে। এক শ্রেণীর আইনকানুন ও কিছু সাধারণ আচার অনুষ্ঠান, যা সমাজের অধিকাংশ জনগণের দ্বারা বাস্তবে স্বীকৃত ও সমর্থিত, তার উপর ভিত্তি করেই একটি সমাজের সৃষ্টি হয়। আর ঐ সমাজের অস্তিত্ব টিকে থাকার বিষয়টি সম্পূর্ণ রূপে ন্যায়বিচার ভিত্তিক ও দায়িত্বশীল একটি প্রশসানের অস্তিত্বের উপরই নির্ভরশীল। এটা এমন কোন বিষয় নয় যে, মানব প্রকৃতি এর গুরুত্ব ও মূল্য সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করবে। কোন বিজ্ঞ ব্যক্তির কাছেও এটা কোন অজ্ঞাত বিষয় নয় এবং এটা ভোলার বিষয়ও নয়, কারণ, ইসলামী শরীয়তের (বিধান) সূক্ষ্মতিসূক্ষতা ও বিস্তৃতি একটি সন্দেহাতীত ব্যাপার। আর এ ব্যাপারটিও অনস্বীকার্য যে, বিশ্বনবী (সা.) এ ব্যাপারে অত্যাধিক গুরুত্বারোপ করতেন এবং এপথে তিনি নিজের সর্বস্ব উৎসর্গ করেছেন। তাঁর ঐ আত্মত্যাগ, অসাধারণ চিন্তাশক্তি, প্রজ্ঞার শ্রেষ্ঠত্ব, সূক্ষ্ম ও সঠিক দৃষ্টিভঙ্গী এবং সুক্ষ্ম বিশ্লেষণ ক্ষমতার (ওহী ও নবুয়তের সাক্ষ্য ছাড়াও) বিষয়টি নিঃসন্দেহে বির্তকের উর্ধ্বে। শীয়া ও সুন্নী উভয় দলেরই মত নির্বিশেষে বর্ণিত ‘মুতাওয়াতির’ (বিশ্বস্ত) হাদীস অনুযায়ী (‘ফিৎনা’ অধ্যায়ের হাদীস) বিশ্বনবী (সা.) তাঁর অন্তর্ধানের পর ইসলামী সমাজ যেসব র্দূনীতিমূলক সমস্যায় আক্রান্ত হবে, তার ভবিষ্যতবাণী করেছেন। ঐসব সমস্যার মধ্যে যেসব সমস্যাগুলো ইসলামকে অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, উমাইয়া বংশ সহ আরও অন্যান্যদের খেলাফত লাভের বিষয়টি তার মধ্যে অন্যতম। কারণ: তারা ইসলামের পবিত্র আর্দশকে তাদের বিভিন্ন ধরণের অপবিত্রতা ও অরাজকতামূলক জঘণ্য কাজে ব্যবহার করেছে। এ ব্যাপারে বিশ্বনবী (সা.) তাঁর হাদীসে বিস্তারিতভাবে ভবিষ্যতবাণী করেছেন। বিশ্বনবী (সা.) তাঁর মৃত্যুর হাজার হাজার বছর পরের ইসলামী সমাজের খুঁটিনাটি বিষয়াদি ও সমস্যা সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত সচেতন এবং সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ভবিষ্যতবাণীও করে গেছেন। তাহলে এটা কি করে সম্ভব যে, যিনি তাঁর পরবর্তী সুদুর ভবিষ্যতের ব্যাপারে এত সচেতন, অথচ স্বীয় মৃত্যু পরবর্তী মূহুর্তগুলোতে সংঘটিত ঘটনাবলীর ব্যাপারে আদৌ সচেতন নন?! বিশ্ব নবী (সা.)-এর পরবর্তী উত্তরাধিকারের মত এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি কি তাহলে তিনি ইচ্ছাকৃত ভাবে অবহেলা করেছেন, অথবা এটাকে গুরুত্বহীন একটি বিষয় হিসেবে গণ্য করেছেন? এটা কেমন করে সম্ভব যে, খাওয়া পরা, ঘুমানো এবং যৌন বিষয়াদির মত মানব জীবনের শতশত খুঁটিনাটি বিষয়ের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশ তিনি জারী করেছেন, অথচ ঐ ধরণের একটি অতি মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তিনি সম্পূর্ণরূপে নীরবতা পালন করেছেন? নিজের উত্তরাধিকারীকে তিনি মনোনীত করে যাননি? ধরে নেয়া যাক (যদিও এটা অসম্ভব একটি ধারণা) যে, মহানবী (সা.) তাঁর স্থলাভিষিক্ত নির্বাচনের দায়িত্বভার মুসলমানদের উপরে ছেড়ে দিয়েছেন, তাহলে এ ব্যাপারে অবশ্যই বিশ্বনবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট বর্ণনা থাকার কথা। এ ব্যাপারে অবশ্যই জনগণের প্রতি তাঁর প্রয়োজনীয় নির্দেশনা থাকা উচিত। কারণঃ ইসলামী সমাজের অস্তিত্ব ও বিকাশ এবং ইসলামী নির্দশনাবলীর অস্তিত্ব এ বিষয়টির উপর সম্পূর্ণ রূপে নির্ভরশীল। তাই এ ব্যাপারে সমগ্র মুসলিম উম্মতকে সদা সচেতন থাকতে হবে। অথচ, এব্যাপারে বিশ্বনবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট কোন নির্দেশনার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণঃ যদি এমন সুস্পষ্ট কোন নির্দেশনার অস্তিত্ব থাকত, তাহলে নিশ্চয়ই বিশ্ব নবী (সা.)-এর পরে তার স্থলাভিষিক্তের পদাধিকারী নির্ধারণের ব্যাপারে এত মতভেদের সৃষ্টি হত না। অথচ আমরা দেখতে পাই যে, প্রথম খলিফা ওসিয়তের (উইল) মাধ্যমে দ্বিতীয় খলিফার কাছে খেলাফত হস্তান্তর করেছিলেন।
দ্বিতীয় খলিফা তার মৃত্যু পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের ব্যাপারে একটি ‘খলিফা নির্বাচন কমিটি’ গঠন করেছিলেন। ছয় সদশ্য বিশিষ্ট ঐ কমিটির প্রতিটি সদস্যই দ্বিতীয় খলিফার দ্বারা মনোনীত হয়েছিলেন। ঐ কমিটির খলিফা নির্বাচন সংক্রান্ত মূলনীতিও তিনি নিজেই নির্ধারণ করেছিলেন। যার ভিত্তিতেই তৃতীয় খলিফা নির্বাচিত হন। তৃতীয় খলিফা নিহত হওয়ার পর চতুর্থ খলিফা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হন। পঞ্চম খলিফা চতুর্থ খলিফার ওসিয়তের (উইল) মাধ্যমে নির্বাচিত হন। এরপর মুয়াবিয়া যে পঞ্চম খলিফা হযরত ইমাম হাসান (আ.)-কে বলপূর্বক সন্ধিচুক্তিতে বাধ্য করার মাধ্যমে খেলাফতের পদটি ছিনিয়ে নেন। তারপর থেকেই খেলাফত রাজতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়। আর তখন থেকেই জিহাদ, সৎকাজে আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ, ইসলামী দন্ড বিধি প্রয়োগ, ইত্যাদি ইসলামী নির্দেশনাবলী একের পর এক ক্রমান্নয়ে ইসলামী সমাজ থেকে উধাও হতে থাকে। এভাবে বিশ্বনবী (সা.)-এর সারা জীবনের লালিত সাধনা ধুলিস্যাৎ হয়ে গেল। [উপরোক্ত বিষয়টি নিম্নোক্ত গ্রন্থ সমূহে বর্ণিত হয়েছে। তারীখে ইয়াকুবী, ২য় খন্ড, ২৬-৬১ নং পৃষ্ঠা। সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, ২২৩-২৭১ পৃষ্ঠা। তারীখে আবিল ফিদা, ১ম খন্ড ১২৬ নং পৃষ্ঠা। গায়াতুল মারাম, ৬৬৪ নং পৃষ্ঠা---ইত্যাদি।]শীয়ারা আল্লাহ প্রদত্ত মানব প্রকৃতি এবং জ্ঞানী ও প্রজ্ঞা সম্পন্ন ব্যক্তিদের জীবনাদর্শ অনুযায়ী এ বিষয়ে ব্যাপক পর্যালোচনা ও অনুসন্ধান চালায়। তারা ফিৎরাত বা মানব প্রকৃতি সঞ্জীবনী ইসলামী আর্দশের মূল দৃষ্টিভঙ্গীর প্রতি গভীর দৃষ্টিপাত, মহানবী (সা.)-এর অনুসৃত সামাজিক পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ এবং মহানবী (সা.)-এর মৃত্যু পরবর্তী দুঃখজনক ঘটনাবলী অধ্যয়ন করে। মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুর পর ইসলাম ও মুসলমানরা যেসব র্দূদশা ও জটিল সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছিল তারও আদ্যোপান্ত আলোচনা করে। এছাড়াও ইসলামের প্রাথমিক যুগের ইসলামী প্রশাসকদের ইসলামের ব্যাপারে ইচ্ছাকৃত উদাসীনতার বিষয়টিও সূক্ষ্মা তিসূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করে। উক্ত গবেষণার মাধ্যমে শীয়ারা একটি সুনিশ্চিত ফলাফলে পৌঁছুতে সক্ষম হয়। আর তা হচ্ছে এই যে, বিশ্বনবী (সা.)-এর পরবর্তী স্থলাভিষিক্ত নির্ধারণের ব্যাপারে তাঁর পক্ষ থেকে যথেষ্ট পরিমাণ বর্ণনার অস্তিত্ব ইসলামে বিদ্যমান। এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনের বহু আয়াত এবং বিশ্বনবী (সা.)-এর বর্ণিত অসংখ্য হাদীস রয়েছে, যার সত্যতা ও নির্ভরযোগ্যতা অকাট্যরূপে প্রমাণিত ও সর্বজনস্বীকৃত। এ ব্যাপারে ‘বিলায়ত’ সংক্রান্ত আয়াত এবং গাদীরে খুমের হাদীস, ‘সাফিনাতুন্ নুহ’-এর হাদীস, ‘হাদীসে সাকালাইন্তু ‘হাদীসে হাক্ক’ ‘হাদীসে মান্যিলাত’ নিকট আত্মীয়দের দাওয়াত সংক্রান্ত হাদীস সহ আরও অসংখ্য হাদীসের কথা উল্লেখযোগ্য। [রাসুল (সা.) এর উত্তরাধিকারী হিসেবে হযরত ইমাম আলী (আ.) এর অধিকার সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের বেশ কিছু আয়াত উল্লেখযোগ্য। যেমন, মহান আল্লাহ্ বলেন: “তোমাদের অভিভাবক (পথ নির্দেশক) তো আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুল এবং মু’মিন বান্দাদের মধ্যে যে নামায প্রতিষ্ঠা করে এবং রুকু অবস্থায় যাকাত প্রদান করে।” (-সুরা মায়েদা, ৫৫ নং আয়াত।) সুন্নী ও শীয়া উভয় তাফসীরকারকগণই এ ব্যাপারে একমত যে, পবিত্র কুরআনের উপরোক্ত আয়াতটি একমাত্র হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর মর্যাদায়ই অবর্তীণ হয়েছে। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা স্বরূপ শীয়া ও সুন্নী উভয় সমপ্রদায়ের বর্ণিত অসংখ্য হাদীসও এ কথারই প্রমাণ বহন করে। এ বিষয়ে রাসুল (সা.) এর সাহাবী হযরত আবুযার গিফারী (রা.) বলেনঃ “একদিন মহানবীর পিছনে যোহরের নামায পড়ছিলাম। এ সময়ে জনৈক ভিক্ষুক সেখানে উপস্থিত হয়ে সবার কাছে ভিক্ষা চাইল। কিন্তু কেউই ঐ ভিক্ষুককে সাহায্য করল না। তখন ঐ ভিক্ষুক তার হাত দু’টো আকাশের দিকে উঠিয়ে বললোঃ ‘হে আল্লাহ্ তুমি সাক্ষী থেকো, রাসুল (সা.)-এর এই মসজিদে কেউই আমাকে সাহায্য করলো না। ঐ সময় হযরত ইমাম আলী (আ.) নামাযরত অবস্থায় ছিলেন। তিনি তখন রুকুতে ব্যস্ত ছিলেন। হযরত আলী (আ.) তখন রুকু অবস্থাতেই হাতের আঙ্গুল দিয়ে ঐ ভিক্ষুকের প্রতি ইশারা করলেন। ঐ ভিক্ষুকও ইমাম আলী (আ.) এর ইঙ্গিত বুঝতে পেরে তাঁর হাতের আঙ্গুল থেকে আংটি খুলে নিল। এ দৃশ্য দেখে মহানবী (সা.) আকাশের দিকে মাথা উচিঁয়ে এই প্রার্থনাটি করেছিলেন:‘হে আল্লাহ্ আমার ভাই হযরত মুসা (আ.) তোমাকে বলেছিল আমার হৃদয়কে প্রশস্ত করে দাও এবং আমার কাজগুলোকে করে দাও সহজ। আমার জিহ্ববার জড়তা দূর করে দাও যাতে সবাই আমার বক্তব্য অনুধাবন করতে পারে। আর আমার ভাই হারূনকে আমার প্রতিনিধি ও সহযোগীতে পরিণত কর।’ তখন তোমার ঐশীবাণী অবর্তীণ হলঃ ‘তোমার ভাইয়ের মাধ্যমে তোমার বাহুকে আমরা শক্তিশালী করব এবং তোমাকে প্রভাব বিস্তারের শক্তি দান করব। সুতরাং, হে আল্লাহ্! আমিও তো তোমারই নবী। তাই আমাকেও হৃদয়ের প্রশস্ততা দান কর। আমার কাজগুলোকেও করে দাও সহজ। আর আলীকে আমার প্রতিনিধি ও সহযোগী হিসেবে নিযুক্ত কর।” হযরত আবুযার (রা.) বললেনঃ “রাসুল (সা.)-এর কথা শেষ না হতেই পবিত্র কুরআনের আলোচ্য আয়াতটি অবর্তীণ হল”। [যাখাইরূল উকবা (তাবারী) ১৬ নং পৃষ্ঠা, ১৩৫৬ হিজরী মিশরীয় সংস্করণ।]
একই হাদীস সামান্য কিছু শাব্দিক পার্থক্যসহ নিম্নোক্ত গ্রন্থসমূহে উল্লেখিত হয়েছে। (দুররূল মানসুর, ২য় খন্ড, ২৯৩ নং পৃষ্ঠা। গায়াতুল মারাম- বাহ্রানী, এ বইয়ের ১০৩ নং পৃষ্ঠায়।)
আলোচ্য আয়াতের অবতরণের ইতিহাস বর্ণনায় সুন্নী সুত্রে বর্ণিত ২৪টি হাদীস এবং শীয়া সুত্রে বর্ণিত ১৯টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
মহান আল্লাহ্ বলেন: “আজ কাফেররা তোমাদের ‘দ্বীন্তু থেকে নিরাশ হয়ে গেছে। অতএব তাদেরকে ভয় করো না বরং আমাকে ভয় কর। আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীন্তুকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম। তোমাদের প্রতি আমার অবদান (নিয়ামত) সম্পূর্ণ করে দিলাম, এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।” (-সুরা মায়েদা ৩ নং আয়াত। )
বাহ্যত উক্ত আয়াতের বক্তব্য হচ্ছে এই যে, এই আয়াত অবর্তীণ হওয়ার পূর্বে কাফেররা এই ভেবে আশ্বান্বিত ছিল যে, শীঘ্রই এমন একদিন আসবে, যেদিন ইসলাম ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু মহান আল্লাহ্ উক্ত আয়াত অবর্তীণের মাধ্যমে চিরদিনের জন্যে কাফেরদেরকে নিরাশ করলেন। আর এটাই ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব লাভ ও তার ভিত্তিকে শক্তিশালী হওয়ার কারণ ঘটিয়েছিল। এটা সাধারণ কোন ইসলামী নির্দেশজারীর মত স্বাভাবিক কোন ঘটনা ছিল না। বরং এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল, যার উপর ইসলামের অস্তিত্ব টিকে থাকা নির্ভরশীল ছিল। এই সুরার শেষের অবর্তীণ আয়াতও আলোচ্য বিষয়ের সাথে সম্পর্কহীন নয়।
মহান আল্লাহ্ বলেছেন: “হে রাসুল! পৌঁছে দিন আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবর্তীণ হয়েছে। আর যদি আপনি এরূপ না করেন তবে আপনি তাঁর (প্রতিপালকের) রিসালাতের কিছুই পৌঁছালেন না। আল্লাহ্ আপনাকে মানুষদের (অনিষ্টা) হতে রক্ষা করবেন।” (সুরা মায়েদা, ৬৭ নং আয়াত।)
উক্ত আয়াত থেকে প্রতীয়মাণ হয় যে, মহান আল্লাহ্ এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছেন, যা সাধিত না হলে ইসলামের মূলভিত্তি ও বিশ্বনবী (সা.) এর এই মহান মিশন বা রিসালত চরম বিপদের সম্মুখীন হবে। তাই আল্লাহ্ এ ব্যাপারে বিশ্বনবী (সা.) কে নির্দেশ দেন। কিন্তু বিশ্বনবী (সা.) ঐ গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সাধিত হওয়ার ব্যাপারে জনগণের বিরোধীতা ও বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হওয়ার আশংকা করলেন। এমতাবস্থায় ঐ গুরুত্বপূর্ণ কাজটি অতিদ্রুত সমাধা করার জন্যে জোর তাগিদ সম্বলিত নির্দেশ মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে বিশ্বনবী (সা.)এর প্রতি জারী করা হয়। মহান আল্লাহ্ বিশ্বনবী (সা.)-এর প্রতি উদ্দেশ্য করে বলেছেন যে, ঐ গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সমাধানের ব্যাপারে অবশ্যই অবহেলা কর না এবং ঐ ব্যাপারে কাউকে ভয়ও কর না। এ বিষয়টি অবশ্যই ইসলামী শরীয়তের কোন বিধান ছিল না। কেননা এক বা একাধিক ইসলামী বিধান প্রচারের গুরুত্ব এত বেশী হতে পারে না যে, তার অভাবে ইসলামের মূলভিত্তি ধ্বংস হয়ে যাবে। আর বিশ্বনবী (সা.) -ও কোন ঐশী বিধান বর্ণনার ক্ষেত্রে আদৌ ভীত ছিলেন না।
উপরোক্ত দলিল প্রমাণাদি এটাই নির্দেশ করে যে, আলোচ্য আয়াতটি ‘গাদীরে খুম’ নামক স্থানে হযরত ইমাম আলী ইবনে আবি তালিবের (আ.) বিলায়াত সংক্রান্ত ব্যাপারে অবর্তীণ হয়েছে। অসংখ্য সুন্নী ও শীয়া তাফসীরকারকগণই এ ব্যাপারে ঐ ঘটনায় ঐক্যমত পোষণ করেন।
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বলেন: “বিশ্বনবী (সা.) হযরত ইমাম আলী (আ.) এর প্রতি সবার দৃষ্টি আর্কষণ করেন। এরপর বিশ্বনবী (সা.) ইমাম আলী (আ.) এর হাত দু’টো উপরদিকে উত্তোলন করেন। এমনকি বিশ্বনবী (সা.) হযরত আলী (আ.) এর হাত এমনভাবে উত্তোলন করেছেন যে, মহানবী (সা.) এর বগলের শুভ্র অংশ প্রকাশিত হয়ে পড়েছিল। এমতাবস্থায় পবিত্র কুরআনের এই আয়াতটি অবর্তীণ হয় ঃ “আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীন্তুকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম। তোমাদের প্রতি আমার অবদান (নেয়ামত) সম্পূর্ণ করে দিলাম, এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।” (সুরা মায়েদা, ৩ নং আয়াত। )
উক্ত আয়াতটি অবর্তীণ হওয়ার পর মহানবী (সা.) বললেন: ‘আল্লাহ্ আকবর’ কারণ, বিশ্বনবী (সা.) এর পরবর্তী উত্তরাধিকারী হিসেবে হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর ‘বিলায়াত’ (কর্তৃত্ব) প্রমাণিত হওয়ার মাধ্যমে আজ আল্লাহ্র নেয়ামত ও সস্তুষ্টি এবং ইসলামের পূর্ণত্বপ্রাপ্তি ঘটলো। অতঃপর উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে মহানবী (সা.) বললেনঃ “আমি যাদের অভিভাবক, আজ থেকে আলীও তাদের অভিভাবক। হে আল্লাহ্! আলীর বন্ধুর প্রতি বন্ধু বৎসল হও ও আলীর শত্রুর সাথে শত্রুতা পোষণ কর। যে তাকে (আলীকে) সাহায্য করবে, তুমিও তাকে সাহায্য কর। আর যে আলীকে ত্যাগ করবে, তুমিও তাকে ত্যাগ কর।”
জনাব আল্লামা বাহ্রানী তার ‘গায়াতুল মারাম’ নামক গ্রন্থের ৩৩৬ নং পৃষ্ঠায় উক্ত আয়াতের অবতরণের কারণ প্রসঙ্গে সুন্নী সূত্রে বর্ণিত ৬টি হাদীস এবং শীয়া সূত্রে বর্ণিত ১৫টি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন।
সারাংশ: ইসলামের শত্রুরা ইসলামকে ধ্বংস করার স্বার্থে কোন প্রকার অনিষ্ট সাধনে কখনোই কুন্ঠাবোধ করেনি। কিন্তু এত কিছুর পরও তারা ইসলামের সামান্য পরিমাণ ক্ষতি করতেও সক্ষম হয়নি। ফলে ব্যর্থ হয়ে তারা সবদিক থেকেই নিরাশ হয়ে পড়ে। কিন্তু এর পরও শুধুমাত্র একটি বিষয়ে তাদের মনে আশার ক্ষীণ প্রদীপ জ্বলছিল। আর সেই আশার সর্বশেষ বস্তুটি ছিল এই যে, তারা ভেবে ছিল, যেহেতু মহানবী (সা.)-ই ইসলামের রক্ষক ও প্রহরী, তাই তার মৃত্যুর পর ইসলাম অভিভাবকহীন হয়ে পড়বে। তখন ইসলাম অতি সহজেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু ‘গাদীরে খুম’ নামক স্থানে সংঘটিত ঐতিহাসিক ঘটনা তাদের হৃদয়ে লুকানো আশার শেষ প্রদীপটাও নিভিয়ে দিল। কারণ, ‘গাদীরে খুমে’ মহানবী (সা.), হযরত ইমাম আলী (আ.) কে তাঁর পরবর্তী দায়িত্বশীল ও ইসলামের অভিভাবক হিসেবে জনসমক্ষে ঘোষণা প্রদান করেন। এমনকি বিশ্বনবী (সা.) হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর পর ইসলামের এই দায়িত্বভার মহানবী (সা.)-এর পবিত্র বংশ তথা হযরত আলী (আ.) এর “ভবিষ্যত বংশধরদের” জন্যে নির্ধারণ করেন। (এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্যের জন্যে হযরত আল্লামা তাবাতাবাঈ রচিত ‘তাফসীর আল্ মিজান্তু নামক কুরআনের তাফসীরের ৫ম খন্ডের ১৭৭ থেকে ২১৪ নং পৃষ্ঠা এবং ৬ষ্ঠ খন্ড ৫০ থেকে ৫৪ নং পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।)
হাদীসে গাদীরে খুম
বিশ্বনবী (সা.) বিদায় হজ্জ শেষে মদীনার দিকে ফিরে যাচ্ছিলেন, পথিমধ্যে ‘গাদীরেখুম’ নামক একটি স্থানে পৌঁছানোর পর পবিত্র কুরআনের সুরা মায়েদার ৬৭ নম্বর আয়াতটি অবর্তীণ হয়। মহানবী (সা.) তাঁর যাত্রা থামিয়ে দিলেন। অত:পর তাঁর আগে চলে যাওয়া এবং পেছনে আগত সকল মুসলমানদেরকে তাঁর কাছে সমবেত হবার আহ্বান করেন। সবাই মহানবী (সা.)এর কাছে সমবেত হবার পর তাদের উদ্দেশ্যে তিনি এক মহামূল্যবান ও ঐতিহাসিক বক্তব্য প্রদান করেন। এটাই সেই ঐতিহাসিক ‘গাদীরে খুমের’ ভাষণ হিসেবে পরিচিত। এই ভাষণের মাধ্যমেই তিনি হযরত ইমাম আলী (আ.)-কে তাঁর পরবর্তী উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করেন।
হযরত বুরআ’ (রা.) বলেনঃ “বিদায় হজ্জের সময় আমি মহানবীর পবিত্র সান্নিধ্যে উপস্থিত ছিলাম। যখন আমরা ‘গাদীরে খুম’ নামক স্থানে পৌঁছলাম, তখন মহানবী (সা.) আমাদেরকে ঐ স্থানটি পরিস্কার করার নির্দেশ দিলেন। এরপর তিনি হযরত ইমাম আলী (আ.)-কে তাঁর ডান দিকে এনে তাঁর হাত দু’টো জনসমক্ষে উপর দিকে উঁচিয়ে ধরলেন। তারপর তিনি বললেনঃ “আমি কি তোমাদের অভিভাবক (কর্তা) নই? সবাই উত্তর দিল, আমরা সবাই আপনারই অধীন। অতঃপর তিনি বললেনঃ আমি যার অভিভাবক ও কর্তা আলীও তার অভিভাবক ও কর্তা হবে। হে আল্লাহ্! আলীর বন্ধুর সাথে বন্ধুত্ব কর এবং আলীর শত্রুর সাথে শত্রুতা কর। এরপর দ্বিতীয় খলিফা ওমর বিন খাত্তাব হযরত আলী (আ.) কে সম্মোধন করে বললেনঃ ‘তোমার এই অমূল্য পদমর্যাদা আরও উন্নত হোক! কেননা তুমি আমার এবং সকল মু’মিনদের অভিভাবক হয়েছ।’ -আল্ বিদায়াহ্ ওয়ান নিহায়াহ্, ৫ম খন্ড, ২০৮ নং পৃষ্ঠা, এবং ৭ম খন্ড, ৩৪৬ নং পৃষ্ঠা। যাখাইরূল উকবা, (তাবারী), ১৩৫৬ হিজরী মিশরীয় সংস্করণ, ৬৭ নং পৃষ্ঠা। ফুসুলুল্ মুহিম্মাহ্, (ইবনে সাব্বাগ), ২য় খন্ড, ২৩ নং পৃষ্ঠা। খাসাইসুন্-নাসাঈ, ১৩৫৯ হিজরীর নাজাফীয় সংস্করণ, ৩১ নং পৃষ্ঠা।
জনাব আল্লামা বাহ্রানী (রহঃ) তার ‘গায়াতুল মারাম’ নামক গ্রন্থে সুন্নী সূত্রে বর্ণিত ৮৯ টি হাদীস এবং শীয়া সুত্রে বর্ণিত ৪৩টি হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়েছেন।
সাফিনাতুন্ নূহের হাদীস
হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেনঃ মহানবী (সা.) বলেছেন যে, ‘আমার আহলে বাইতের উদাহরণ হযরত নুহ (আ.) এর নৌকার মত। যারা নৌকায় আরহণ করল, তারাই রক্ষা পেল। আর যারা তা করল না তারা সবাই ডুবে মরল’। (‘যাখাইরূল উকবা’ ২০ নং পৃষ্ঠা। ‘আস সাওয়াইকুল মুহরিকাহ (ইবনে হাজার)’ মিশরীয় সস্করণ, ৮৪ ও ১৫০ নং পৃষ্ঠা। ‘তারীখুল খুলাফাহ (জালালুদ্দিন আস্ সুয়ুতী)’ ৩০৭ নং পৃষ্ঠা। ‘নরূল আব্সার (শাবালঞ্জি)’ মিশরীয় সংস্করণ, ১১৪ নং পৃষ্ঠা।)
জনাব আল্লামা বাহরানী, তার ‘গায়াতুল মারাম’ নামক গনে'র ২৩৭ নং পৃষ্ঠায় সুন্নীদের ১১টি সুত্র থেকে এবং শীয়াদের ৭টি সুত্র থেকে এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
হাদীসে সাকালাইন
হযরত যাইদ বিন আরকাম (রা.) বলেনঃ মহানবী (সা.) বলেছেনঃ “মনে হচ্ছে আল্লাহ্ যেন আমাকে তাঁর দিকেই আহ্বান জানাচ্ছেন, অবশ্যই আমাকে তার প্রত্যুত্তর দিতে হবে। তবে আমি তোমাদের মাঝে অত্যন্ত ভারী (গুরুত্বপূর্ণ) দু’টো জিনিস রেখে যাচ্ছিঃ তা হচ্ছে আল্লাহ্র এই ঐশীগ্রন্থ (কুরআন) এবং আমার পবিত্র আহলে বাইত। তাদের সাথে কেমন ব্যবহার করবে, সে ব্যাপারে সর্তক থেকো। এ দু’টো (পবিত্র কুরআন ও আহলে বাইত) জিনিষ ‘হাউজে কাউসারে’ (কেয়ামতের দিন) আমার সাথে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত কখনোই পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না।” (আল্ বিদাহয়াহ্ ওয়ান্ নিহায়াহ্ ৫ম খন্ড, ২০৯ নং পৃষ্ঠা। যাখাইরূল উকবা, (তাবারী) ১৬ নং পৃষ্ঠা। ফুসুলুল্ মুহিম্মাহ্, ২২নং পৃষ্ঠা। খাসইসুন্ -নাসাঈ, ৩০ নং পৃষ্ঠা। আস্ সাওয়াইকুল মুহরিকাহ্, ১৪৭ নং পৃষ্ঠা।)
গায়াতুল মারাম’ গ্রন্থে' আল্লামা বাহরানী ৩৯টি সুন্নী সুত্রে এবং ৮২টি শীয়া সুত্রে উক্ত হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ‘হাদীসে সাকালাইন্’ একটি বিখ্যাত ও সর্বজনস্বীকৃত এবং অকাট্যভাবে প্রমাণিত সুত্রে বর্ণিত। উক্ত হাদীসটি অসংখ্য সুত্রে এবং বিভিন্ন ধরণের বর্ণনায় (একই অর্থে) বর্ণিত হয়েছে। উক্ত হাদীসের সত্যতার ব্যাপারে সুন্নী ও শীয়া, উভয় সমপ্রদায়ই স্বীকৃতি প্রদান করেছে। এ ব্যাপারে তারা উভয়ই সম্পূর্ণরূপে একমত। আলোচ্য হাদীসটি এবং এ ধরণের হাদীস থেকে বেশ কিছু বিষয় আমাদের কাছে প্রমাণিত হয়। তা হলঃ
১. পবিত্র কুরআন যেভাবে কেয়ামতের দিন পর্যন্ত মানব জাতির মাঝে টিকে থাকবে, মহানবী (সা.) এর পবিত্র আহলে বাইত ও তাঁর পাশাপাশি মানব জাতির মাঝে কেয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকবেন। অর্থাৎ এ বিশ্বের কোন যুগই ইমাম বা প্রকৃত নেতাবিহীন অবস্থায় থাকবে না।
২. বিশ্বনবী (সা.) মানব জাতির কাছে এই দু’টো অমূল্য আমানত গচ্ছিত রাখার মাধ্যমে তাদের সর্বপ্রকার ধর্মীয় ও জ্ঞানমূলক প্রয়োজন মেটানো এবং বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে গেছেন। মহানবী (সা.) তাঁর পবিত্র আহলে বাইতগণকে (আ.) সকল প্রকার জ্ঞানের অমূল্য রত্ন ভান্ডার হিসেবে মুসলমানদের মাঝে পরিচিত করিয়ে দিয়েছেন। মহানবী (সা.) তাঁর পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) যে কোন কথা ও কাজকেই নির্ভরযোগ্য হিসেবে ঘোষণা করেছেন।
৩. পবিত্র কুরআন ও মহানবী (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইতকে অবশ্যই পরস্পর থেকে পৃথক করা যাবে না। মহানবী (সা.)-এর আহলে বাইতের পবিত্র জ্ঞানধারা থেকে মুখ ফিরিয়ে তাদের উপদেশ ও হেদায়েতের গন্ডি থেকে বেরিয়ে যাবার অধিকার কোন মুসলমানেরই নেই।
৪. মানুষ যদি পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) আনুগত্য করে এবং তাঁদের কথা মেনে চলে, তাহলে কখনোই তারা পথভ্রষ্ট হবে না। কেননা, তারা সর্বদাই সত্যের সাথে অবস্থান করছেন।
৫. মানুষের জন্যে প্রয়োজনীয় সর্বপ্রকার ধর্মীয় ও অন্য সকল জ্ঞানই পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) কাছে রয়েছে। তাই যারা তাঁদের অনুসরণ করবে, তারা কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না, এবং তারা অবশ্যই জীবনের প্রকৃত সাফল্য লাভ করবে। অর্থাৎ, পবিত্র আহলে বাইতগণ (আ.) সর্ব প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে মুক্ত ও পবিত্র।
এ থেকেই বোঝা যায় যে, পবিত্র আহলে বাইত বলতে মহানবী (সা.) এর পরিবারের সকল আত্মীয়বর্গ ও বংশধরকেই বোঝায় না। বরং পবিত্র আহলে বাইত বলতে নবী বংশের বিশেষ ব্যক্তিবর্গকেই বোঝানো হয়েছে। ইসলাম সম্পর্কে পূর্ণজ্ঞানের অধিকারী হওয়া এবং সর্বপ্রকার পাপ ও ভুল থেকে তাঁদের অস্তিত্ব মুক্ত ও পবিত্র হওয়াই ঐ বিশেষ ব্যক্তিবর্গের বৈশিষ্ট্য। যাতে করে তাঁরা প্রকৃত নেতৃত্বের গুণাবলীর অধিকারী হতে পারেন। ঐ বিশেষ ব্যক্তিবর্গ হচ্ছেনঃ হযরত ইমাম আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) এবং তাঁর বংশের অন্য এগারোজন সন্তান। তাঁরা প্রত্যেকেই একের পর এক ইমাম হিসেবে মনোনীত হয়েছেন। একই ব্যাখ্যা মহানবী (আ.) এর অন্য একটি হাদীসে পাওয়া যায়।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেনঃ “আমি মহানবী (সা.) কে জিজ্ঞাস করলাম যে, আপনার যেসব আত্মীয়কে ভালবাসা আমাদের জন্যে ওয়াজিব, তাঁরা কারা? মহানবী (সা.) বললেনঃ ‘তাঁরা হলেন আলী, ফাতিমা, হাসান এবং হোসাইন।” (ইয়ানাবী-উল-মুয়াদ্দাহ্, ৩১১ নং পৃষ্ঠা।)
হযরত যাবির (রা.) বলেনঃ বিশ্বনবী (সা.) বলেছেনঃ “মহান আল্লাহ্ প্রত্যেক নবীর বংশকেই স্বীয় পবিত্র সত্তার মাঝে নিহিত রেখেছেন। কিন্তু আমার বংশকে আলীর মাঝেই সুপ্ত রেখেছেন।” (ইয়ানাবী-উল-মুয়াদ্দাহ্, ৩১৮ নং পৃষ্ঠা।)
হাদীসে হাক্ক
হযরত উম্মে সালমা (রা.) বলেন “আমি আল্লাহ্র রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেছেনঃ ‘আলী পবিত্র কুরআন ও সত্যের সাথে রয়েছে। আর পবিত্র কুরআন ও সত্যও আলীর সাথে থাকবে এবং তাঁরা ‘হাউজে কাওসারে আমার সাথে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত কখনই পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না।” উক্ত হাদীসটি ‘গায়াতুল মারাম’ গ্রন্থের ৫৩৯ নং পৃষ্ঠায় একই অর্থে সুন্নী সূত্রে ১৪টি এবং শীয়া সুত্রে ১০টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
হাদীসে মান্যিলাত্
হযরত সা’দ বিন ওয়াক্কাস (রা.) বলেনঃ “আল্লাহ্র রাসুল (সা.) হযরত আলী (আ.) কে বলেছেনঃ ‘তুমি কি এতেই সন্তুষ্ট নও যে, তুমি (আলী) আমার কাছে মুসা (নবী) আর হারূনের মত? শুধু এই টুকুই পার্থক্য যে, আমার পর আর কোন নবী আসবে না।” (বিদায়াহ্ ওয়ান্ নিহায়াহ্, ৭ম খন্ড, ৩৩৯ নং পৃষ্ঠা। যাখাইরুল উকবা, (তাবারী ), ৫৩ নং পৃষ্ঠা। ফুসুলুল মুহিম্মাত, ২১ নং পৃষ্ঠা। কিফায়াতুত তালিব (গাঞ্জী শাফেঈ), ১১৪৮-১৫৪ পৃষ্ঠা। খাসাইসুন্-নাসাঈ, ১৯-২৫ নং পৃষ্ঠা। আস্ সাওয়াঈকুল মুহ্রিকাহ্, ১৭৭ নং পৃষ্ঠা।) ‘গায়াতুল মারাম’ গ্রন্থের ১০৯ নং পৃষ্ঠায় জনাব আল্লামা বাহরানী উক্ত হাদীসটি ১০০টি সুন্নী সুত্রে এবং ৭০টি শীয়া সুত্রে বর্ণনা করেছেন।
আত্মীয়দের দাওয়াতের হাদীস
মহানবী (সা.) তাঁর নিকট আত্মীয়দেরকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। আমন্ত্রিত অতিথিদের খাওয়া শেষ হওয়ার পর তিনি তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেনঃ“এমন কোন ব্যক্তির কথা আমার জানা নেই, যে আমার চেয়ে উত্তম কিছু তার জাতির জন্যে উপহার স্বরূপ এনেছে। মহান আল্লাহ্ তোমাদেরকে তাঁর প্রতি আহ্বান জানানোর জন্যে আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যে আমাকে এ পথে সহযোগিতা করবে? আর সে হবে আমার উত্তরাধিকারী এবং আমার খলিফা বা প্রতিনিধি। উপস্থিত সবাই নিরুত্তর রইল। অথচ আলী (আ.) যদিও উপস্থিত সবার মাঝে কনিষ্ঠ ছিলেন, তিনি বললেনঃ ‘আমিই হব আপনার প্রতিনিধি এবং সহযোগী’। অতঃপর মহানবী (সা.) নিজের হাত তাঁর ঘাড়ের উপর রেখে বললেনঃ ‘আমার এ ভাইটি আমার উত্তরাধিকারী এবং আমার খলিফা। তোমরা সবাই অবশ্যই তাঁর আনুগত্য করবে’। এ দৃশ্য প্রত্যক্ষের পর উপস্থিত সবাই সেখান থেকে উঠে গেল এবং এ বিষয় নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতে লাগল। তারা জনাব আবু তালিবকে বললঃ “মুহাম্মদ তোমাকে তোমার ছেলের আনুগত্য করার জন্যে নির্দেশ দিয়েছে।” (তারীখু আবিল ফিদা, ১ম খন্ড, ১১৬ নং পৃষ্ঠা।)
এ জাতীয় হাদীসের সংখ্যা অনেক, যেমনঃ হযরত হুযাইফা বলেন মহানবী (সা.) বলেছেনঃ “তোমরা যদি আমার পরে আলীকে খলিফা ও আমার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নিযুক্ত কর, তাহলে তোমরা তাকে একজন দিব্য দৃষ্টি সম্পন্ন পথ প্রর্দশক হিসেবেই পাবে, যে তোমাদেরকে সৎপথে চলতে উদ্বুদ্ধ করবে। তবে আমার মনে হয় না যে, এমন কাজ তোমরা করবে।” (খলিফাতুল আউলিয়া, আবু নাঈম, ১ম খন্ড, ৬৪ নং পৃষ্ঠা। কিফায়াতুত তালিব, ৬৭ নং পৃষ্ঠা, ১৩৫৬ হিজরীর নাজাফিয় মুদ্রণ।)
হযরত ইবনু মারদুইয়াহ্ (রা.) বলেনঃ মহানবী (সা.) বলেছেন যে, “যে ব্যক্তি আমার মতই জীবন যাপন ও মৃত্যুবরণ করতে চায় এবং বেহেশতবাসী হতে চায়, সে যেন আমার পরে আলীর প্রেমিক হয় ও আমার পবিত্র আহলে বাইতের অনুসারী হয়। কারণ, তারা আমারই রক্ত সম্পর্কের ঘনিষ্ঠ আত্মিয়বর্গ এবং আমারই কাদামাটি থেকে সৃষ্টি হয়েছে। আমার জ্ঞান ও বোধশক্তি তারাই লাভ করেছে। সুতরাং হতভাগ্য সেই, যে তাঁদের পদমর্যাদাকে অস্বীকার করবে। অবশ্যই আমার সুপারিশ (শাফায়াত) থেকে তারা বঞ্চিত হবে”। (-মুন্তাখাবু কানযেল উম্মাল, মুসনাদে আহমাদ, ৫ম খন্ড, ৯৪ নং পৃষ্ঠা।]
উপরোক্ত আয়াত ও হাদীস সমূহের বক্তব্যে শীয়াদের বক্তব্যেরই সর্মথন পাওয়া যায়। অবশ্য ঐসব হাদীসের যথেষ্ট অপব্যাখ্যা করা হয়েছে। আর এই অপব্যাখ্যার মাধ্যমে ঐগুলোর মূল অর্থকে গোপন রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।পূর্বোক্ত আলেচনার পক্ষে কিছু কথা
বিশ্বনবী (সা.) জীবনের শেষ দিনগুলো যখন অসুস্থ অবস্থায় কাটাচ্ছিলেন। তখন একদল সাহাবী রাসুল (সা.)-এর কাছে উপস্থিত ছিলেন। হযরত রাসুল (সা.) সাহাবীদেরকে নির্দেশ দিলেনঃ “আমার জন্যে কাগজ ও কলম নিয়ে এসো। কারণ, আমি এমন কিছু তোমাদের জন্য লিখে রেখে যেতে চাই, যা মেনে চললে তোমারা কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না”। উপস্থিত সাহাবীদের মধ্যে কিছু লোক বললোঃ ‘এ লোক তো অসুস্থতার ফলে প্রলাপ (?) বকছে। কারণ, আল্লাহ্র কুরআনই তো আমাদের জন্যে যথেষ্ট’!! এ নিয়ে উপস্থিত সাহাবীদের মধ্যে হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল। রাসুল (সা.)-এ অবস্থা দেখে বললেনঃ তোমারা এখান থেকে উঠে পড়। আমার কাছ থেকে দুর হয়ে যাও। আল্লাহ্র রাসুলের কাছে হৈ চৈ করা উচিত নয়’। [আল্ বিদায়াহ্ ওয়ান্ নিহায়াহ্, ৫ম খন্ড, ২৭৭ নং পৃষ্ঠা। শারহু ইবনি আবিল হাদিদ, ১ম খন্ড, ১৩৩ নং পৃষ্ঠা। আল্ কামিল ফিত্ তারীখ (ইবনে আসির), ২য় খন্ড, ২১৭ নং পৃষ্ঠ। তারীখুর রাসুল ওয়াল মুলুক (তাবারী), ২য খন্ড, ৪৩৬ নং পৃষ্ঠা।]
পূর্বোক্ত অধ্যায়ের বিষয়বস্তু এবং এ অধ্যায়ে বর্ণিত ঘটনা প্রবাহ যদি আমরা আলোচনা করি, তাহলে দেখতে পাব যে, যারা রাসুল (সা.)-এর ঐ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সেদিন বাধা প্রদান করেছিল, তারাই রাসুল (সা.)-এর মৃত্যুর পর খেলাফত নির্বাচনের ঘটনা থেকে লাভবান হয়েছিল। বিশেষ করে তারা হযরত আলী (আ.) ও তাঁর অনুসারীদের অজ্ঞাতসারেই ‘খেলাফত নির্বাচনের’ পর্বটি সম্পন্ন করে।
তারা হযরত আলী (আ.) ও তাঁর অনুসারীদের বিপরীতে ঐ কাজটি সম্পন্ন করেছিল। এরপর সন্দেহের কোন অবকাশ থাকে না যে, উপরোক্ত হাদীসে বর্ণিত ঘটনায় মহানবী (সা.) তাঁর পরবর্তী উত্তরাধিকারী বা স্থলাভিষিক্ত হিসেবে হযরত আলী (আ.)-এর নাম ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন। মহানবী (সা.)-এর নির্দেশ বাস্তবায়নে বাধা প্রদানপূর্বক ঐধরণের কথা বলার মাধ্যমে কথা কাটা-কাটি বা বির্তক সৃষ্টিই ছিল মূল উদ্দেশ্য, যাতে করে এর ফলে মহানবী (সা.) তাঁর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন থেকে বিরত হতে বাধ্য হন। সুতরাং অসুস্থতাজনিত প্রলাপ বকার কারণে তাঁর নির্দেশ বাস্তবায়নে বাধা দেয়াই তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল না। কারণ,
প্রথমতঃ আল্লাহ্র রাসুল (সা.)-এর পবিত্র মুখ থেকে অসুস্থকালীন সময়ে অসংলগ্ন একটি কথাও শোনা যায়নি। আর এযাবৎ এ ধরণের কোন ঘটনাও (অসংলগ্ন কথাবার্তা) কেউই বর্ণনা করেনি। ইসলাম নির্ধারিত নীতিমালা অনুযায়ী কোন মুসলমানই মহানবী (সা.)-এর প্রতি প্রলাপ বকার (?) মত অপবাদ আরোপ করতে পারে না। কারণ, আল্লাহ্র রাসুল (সা.) ছিলেন ঐশী ‘ইসমাত’ বা নিষ্পাপ হওয়ার গুণে গুণান্নিত।
দ্বিতীয়তঃ যদি তাদের কথা (প্রলাপ বকার মিথ্যা অভিযোগ সত্যই হত, তাহলে এর পরের কথাটি (কুরআনই আমাদের জন্যে যথেষ্ট) বলার কোন প্রয়োজন হত না। কারণঃ তাদের পরবর্তী কথার অর্থ হচ্ছে, কুরআনই তাদের জন্যে যথেষ্ট, এরপর রাসুল (সা.)-এর বক্তব্যের কোন প্রয়োজন নেই। কিন্তু রাসুল (সা.)-এর সাহাবীরা ভাল করেই জানতেন যে, পবিত্র কুরআনই মহানবী (সা.)-এর অনুসরণকে সবার জন্যে ফরজ হিসেবে ঘোষণা করেছে। রাসুল (সা.)-এর বাণীকে আল্লাহ্র বাণীরই মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনের সুস্পষ্ট দলিল অনুসারে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর নির্দেশের মোকাবিলায় মানুষের ইচ্ছার কোন স্বাধীনতা বা অধিকার নেই।
তৃতীয়তঃ প্রথম খলিফার মৃত্যুর সময় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল। তখন প্রথম খলিফা তার পরবর্তী খলিফা হিসেবে দ্বিতীয় খলিফার নামে খেলাফতের ওসিয়ত (উইল) লিখে যান। তৃতীয় খলিফা ওসমান যখন প্রথম খলিফার নির্দেশে উক্ত ‘ওসিয়ত’ (উইল) লিখছিলেন, তখন প্রথম খলিফা সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু, তখন বার দ্বিতীয় খলিফা প্রথম খলিফার ব্যাপারে মোটেই প্রতিবাদ করেননি, যে প্রতিবাদটি তিনি আল্লাহ্র রাসুল (সা.)-এর ব্যাপারে করেছিলেন। [আল্ কামিল ফিত্ তারীখ (ইবনে আসির), ২য় খন্ড, ২৯২ নং পৃষ্ঠা। শারহু ইবনি আবিল হাদিদ, ১ম খন্ড, ৪৫ নং পৃষ্ঠা।]
এ ছাড়া হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণিত হাদীসে [শারহু ইবনি আবিল হাদিদ, ১ম খন্ড, ১৩৪ নং পৃষ্ঠা।] দ্বিতীয় খলিফার যে স্বীকারোক্তি উল্লিখিত হয়েছে, তাতে তিনি বলেছেনঃ “আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আল্লাহ্র রাসুল (সা.) আলীর খেলাফতের বিষয়টি লিখে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে তা আমি হতে দেইনি”। তিনি আরও বলেন যে ‘আলীই ছিল খেলাফতের অধিকারী। [তারীখে ইয়াকুবী, ২য় খন্ড, ১৩৭ নং পৃষ্ঠা।]কিন্তু সে যদি খেলাফতের আসনে বসত্, তাহলে জনগণকে সত্যপথে চলার জন্যে উদ্বুদ্ধ করত। কিন্তু কুরাইশরা তার আনুগত্য করত না। তাই আমি তাকে খেলাফতের পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছি’ !!!
ইসলামের নীতি অনুযায়ী সত্য প্রত্যাখানকারীদের জন্যে সত্যবাদীদেরকে পরিত্যাগ না করে বরং সত্য প্রত্যাখানকারীদেরকে সত্য গ্রহণে বাধ্য করা উচিত। যখন প্রথম খলিফার কাছে সংবাদ পৌঁছলো যে মুসলমানদের একটি গোত্র যাকাত প্রদানে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে, তৎক্ষণাত তিনি তাদের সাথে যুদ্ধের নির্দেশ দিলেন এবং বললেনঃ “আল্লাহ রাসুল (সা.) কে মাথার রূমাল বাধার যে দড়ি দেয়া হত, তা যদি আমাকে না দেয়া হয়, তাহলেও তাদের সাথে আমি যুদ্ধে অবর্তীণ হব।” [আল্ বিদায়াহ্ ওয়ান্ নিহায়াহ্, ৬ম খন্ড, ৩১১ নং পৃষ্ঠা।]অবশ্য এ বক্তব্যের উদ্দেশ্য হচ্ছে, যেকোন মূল্যের বিনিময়েই হোক না কেন, সত্যকে পুনরুজীবিত করতে হবে। অথচ, সত্য ভিত্তিক খেলাফতের বিষয়টি মাথার রূমাল বাঁধার দড়ির চেয়ে অবশ্যই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান ছিল।
ইসলামে ইমামত
নবী পরিচিতি অধ্যায়ে ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে যে, গণভাবে পথ নির্দেশনার (হেদায়াত) অপরিহার্য ও ধ্রুব আইন অনুসারে সৃষ্টি জগতের প্রতিটি সৃষ্টিই প্রাকৃতিক ভাবে স্বীয় শ্রেষ্ঠত্ব, পূর্ণত্ব ও মহত্ব প্রাপ্তির পথে পরিচালিত ও সদা ধাবমান। মানুষও জগতের অন্যান্য সৃষ্টির মতই একটি সৃষ্টি। তাই মানুষও উক্ত আইনের ব্যতিক্রম নয়। সুতরাং মানুষও তার বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গী ও সামাজিক চিন্তা-চেতনা দিয়ে তার নিজ জীবনে একটি বিশেষ পদ্ধতিতে পরিচালিত হবে, যার মাধ্যমে সে ইহ ও পরকালে দু’জীবনেই সাফল্য ও সৌভাগ্য লাভ করতে পারে। এক কথায় এমন এক শ্রেণীর বিশ্বাস ও বাস্তব দায়িত্বের ভিত্তিতে মানব জীবন পরিচালিত হওয়া উচিত, যার মাধ্যমে মানুষ, জীবনের সাফল্য ও মানবীয় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়। মানব জীবন পরিচালনার ঐ কর্মসূচী ও জীবন দর্শনের নামই দ্বীন। এই দ্বীন মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমে অর্জিত নয়। বরং তা ঐশীবাণী (ওহী) ও নবুয়তের মাধ্যমে প্রাপ্ত, যা মানব জাতির কিছু সংখ্যক বিশিষ্ট ও পবিত্র আত্মাসম্পন্ন ব্যক্তিদের (নবীগণ) মাধ্যমে অর্জিত হয়। আল্লাহ্র নবীরাই ‘ওহী’ বা ঐশীবাণীর মাধ্যমে মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে মানব জাতির কাছে প্রয়োজনীয় দায়িত্ব সমূহ পৌঁছে দেন। যাতে করে ঐসব দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে মানব জীবন সাফল্য মন্ডিত হয়। এটা খুবই স্পষ্ট যে, উক্ত যুক্তির ভিত্তিতে এ ধরণের একটি জীবন বিধানের প্রয়োজনীয়তা মানব জাতির জন্যে প্রমাণিত হয়। একইভাবে এর পাশাপাশি মানব জাতির ঐ মূল্যবান জীবন বিধান সম্পূর্ণ অবিকৃতরূপে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তাও প্রমাণিত হয়। মহান আল্লাহ্র অনুগ্রহের মাধ্যমে সেই ঐশী জীবন বিধান মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্যে যেমন বিশিষ্ট কিছু ব্যক্তির প্রয়োজন, তেমনি ঐ জীবন বিধান সংরক্ষণের জন্যেও বিশিষ্ট কিছু ব্যক্তির প্রয়োজন। যাতে করে ঐ জীবন বিধান চিরদিন অবিকৃতরূপে সংরক্ষিত থাকে এবং প্রয়োজনে তা মানুষের কাছে উপস্থাপন ও শিক্ষা দেয়া যেতে পারে। অর্থাৎ, সর্বদাই একের পর এক এমন কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি থাকা প্রয়োজন, যারা আল্লাহ্র প্রদত্ত ঐ দ্বীনকে সর্বদাই অবিকৃতরূপে সংরক্ষণ ও প্রয়োজনে তা প্রচার করবেন। যে বিশিষ্ট বিশ্বাস ঐ ঐশী দ্বীনকে অবিকৃতভাবে সংরক্ষণের জন্যে মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে নিয়োজিত, তাঁকেই ‘ইমাম’ নামে অভিহিত করা হয়। একইভাবে মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে ‘ওহী’ বা ঐশীবাণী ও বিধান গ্রহণের যোগ্যতাসম্পন্ন আত্মার অধিকারী ব্যক্তিকে ‘নবী’ হিসেবে অবিহিত করা হয়। নবুয়তও ইমামতের সমাহার একই ব্যক্তির মধ্যেও পাওয়া যেতে পারে, আবার পৃথক পৃথকও হতে পারে। পূর্বোক্ত দলিল প্রমাণের ভিত্তিতে নবী রাসুলগণের জন্যে ‘ইমামত’ বা নিষ্পাপ হওয়ার গুণে গুণান্নিত হওয়ার অপরিহার্যতা যেমন প্রমাণিত হয়, তেমনি ইমামের জন্যে ‘ইসমাত’ বা নিষ্পাপ হওয়ার গুণে গুণান্নিত হওয়ার অপরিহার্যতাও প্রমাণিত হয়। কেননা, দ্বীনকে কেয়ামত পর্যন্ত মানব জাতির মাঝে সম্পূর্ণ অবিকৃত ও প্রচারের যোগ্যতাসম্পন্ন অবস্থায় সংরক্ষণ করা আল্লাহ্র দায়িত্ব। আর এ উদ্দেশ্য ঐশী ‘ইসমাত’ (নিষ্পাপ হওয়ার গুণ) ও ঐশী নিরাপত্তা বিধান ছাড়া বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
নবী ও ইমামের পার্থক্য
পূর্বোক্ত আলোচনায় আনীত যুক্তি প্রমাণের মাধ্যমে মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে ‘ওহী’ বা ঐশীবাণী প্রাপ্তির মাধ্যমে নবী রাসুলগণের ঐশী বিধান লাভের বিষয়টিই শুধুমাত্র প্রমাণিত হয়। কিন্তু ঐ ঐশী বিধানের অব্যাহতভাবে টিকে থাকা ও অবিকৃতভাবে চিরদিন তা সংরক্ষিত থাকার বিষয়টি সর্বসম্মত একটি বিষয় হলেও উপরোক্ত যুক্তির মাধ্যমে তা প্রমাণিত হয় না। তবে ঐশী বিধানের ঐ অমরত্বের কারণেই পুনঃ পুনঃ নবী আগমনের প্রয়োজনহীনতাও প্রমাণিত হয় না। বরং ঐশী বিধানকে মানব জাতির মাঝে সম্পূর্ণ অবিকৃতরূপে চিরদিন সংরক্ষণের জন্যে মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত ইমামের উপসি'তির অপরিহার্যতা এখানে প্রমাণিত হয়। এমনকি সমাজের লোকেরা ঐ ঐশী ইমামতকে চিনতে পারুক অথবা নাই পারুক, মানব সমাজ কখনোই ঐশী ইমামের অস্তিত্ব থেকে মুক্ত থাকবে না।
মহান আল্লাহ বলেনঃ “এরা যদি আমাদের হেদায়েতকে অস্বীকার করে তবে এর জন্যে এমন সমপ্রদায় নির্দিষ্ট করেছি, (তারা) তার অবিশ্বাসী হবে না।” (সুরা আল্ আনআম, ৮৯ নং আয়াত।)
পূর্বে যেমনটি বলা হয়েছে যে, নবুয়ত ও ইমামত এ দু’টো পদের সমাহার অনেক সময় একই ব্যক্তির মধ্যে পাওয়া যেতে পারে। আবার এ দু’টো পদের অস্তিত্ব পৃথক পৃথক ভাবেও বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে পরিলক্ষিত হতে পারে। তাই নবীহীন যুগে কোন মূহুর্তই ইমামের অস্তিত্ব বিহীন অবস্থায় কাটবে না। আর স্বাভাবিক ভাবেই নবীদের সংখ্যা সীমিত এবং সবসময় তাদের অস্তিত্ব ছিল না।
মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে তাঁর কিছু সংখ্যক নবীকে ইমাম হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। যেমনঃ মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে হযরত ইব্রাহীম (আ.) সম্পর্কে বলেনঃ “যখন ইব্রাহীমকে তাঁর পালনকর্তা কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর তিনি তা পূর্ণ করে দিলেন, তখন পালনকর্তা বললেনঃ নিশ্চয় আমি তোমাকে মানব জাতির নেতা করব। তিনি বললেনঃ আমার বংশধর থেকেও ? তিনি (প্রভু) বললেনঃ আমার প্রতিশ্রুতিতে অত্যাচারীরা শামিল হবে না।” (সুরা আল্ বাকারা, ১২৪ নং আয়াত।)
তিনি আরও বলেনঃ “আমি তাদেরকে নেতা মনোনীত করলাম। তারা আমার নির্দেশ অনুসারে পথপ্রর্দশন করত......”। (সুরা আম্বিয়া, ৭৩ নং আয়াত।)
কাজের অন্তরালে ইমামত
‘ইমাম’ যেমন মানুষের বাহ্যিক কাজকর্মের ব্যাপারে নেতা ও পথ প্রর্দশক স্বরূপ, তেমনি তিনি মানুষের অন্তরেরও ইমাম বা পথ প্রর্দশক। তিনিই প্রকৃতপক্ষে মানবজাতি ও যে কাফেলা আধ্যাত্মপথে মহান আল্লাহ্র প্রতি ধাবমান তাদের কর্ণধার স্বরূপ। উক্ত বিষয়টি আরও স্পষ্টভাবে বোঝার জন্যে নিম্ন লিখিত ভুমিকাটির প্রতি লক্ষ্য করুন।
প্রথমতঃ এতে কোন সন্দেহ নেই যে, ইসলাম সহ পৃথিবীর একত্ববাদী সকল ঐশী ধর্মের দৃষ্টিতে মানব জীবনের চিরন্তন ও প্রকৃত সাফল্য ও দূর্ভাগ্য তার কৃত সৎ ও অসৎ কর্মের উপর নির্ভরশীল। এটাই সকল ঐশী ধর্মের মূলশিক্ষা। মানুষ তার আপন সত্তায় নিহিত খোদাপ্রদত্ত স্বভাব দিয়ে ঐসব সৎ ও অসৎকর্মের পার্থক্য উপলব্ধি করতে পারে। মহান আল্লাহ ওহী ও নবুয়তের মাধ্যমে ঐ সব কাজকর্ম কে মানব জাতির চিন্তাশক্তি ও বোধশক্তির উপযোগী সামাজিক ভাষায় আদেশ ও নিষেধ এবং প্রশংসা ও তিরস্কারের আকারে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ নির্দেশিত ঐসব আদেশ নিষেধ আনুগত্যকারীদের জন্যে পরকালে এক সুমধুর ও অনন্ত জীবনের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। যেখানে মানবতার শ্রেষ্ঠত্ব ও পূর্ণত্বের সকল কামনা-বাসনা বাস্তবায়িত হবে। আর তার অবাধ্যকারী অসৎলোকদের জন্যে সর্ব প্রকার ব্যর্থতা ও দুর্ভাগ্যপূর্ণ এক তিক্ত ও অনন্ত জীবনের সংবাদ দেয়া হয়েছে। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, সর্বস্রষ্টা আল্লাহ সকল দিক থেকেই আমাদের কল্পনা শক্তির উর্ধ্বে। তিনি আমাদের মত সামাজিক চিন্তাধারার অধিকারী নন। কারণ, প্রভুত্ব, দাসত্ব, নেতৃত্ব, আনুগত্য, আদেশ, নিষেধ, পারিশ্রমিক এবং পুরুস্কার প্রথা আমাদের সমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এই বস্থাজগতের বাইরে এ সবের কোন অস্তিত্ব নেই। এ সৃষ্টিজগতের সাথে সর্বস্রষ্টা আল্লাহ্র সম্পর্ক বাস্তব ও সত্য নির্ভর। যেমনটি পবিত্র কুরআন [উদাহরণ স্বরূপ পবিত্র কুরআনের এ আয়াতটি উল্লেখযোগ্যঃ “শপথ এই সুস্পষ্ট কিতাবের। আমরা কুরআনকে আরবী ভাষায় (বর্ণনা) করেছি, যাতে তোমারা চিন্তা কর। নিশ্চয়ই এই কুরআন আমার কাছে সমুন্নত ও অটল রয়েছে ‘লওহে-মাহ্ফুজে’। (-সুরা যুখরূফ, ২-৪ নং আয়াত। )] ও মহানবীর হাদীস সমূহে যেভাবে ইঙ্গিত করা হয়েছে। সে অনুযায়ী দ্বীন এমন কিছু নিগূঢ় সত্য ও উচ্চতর জ্ঞানমালার সমষ্টি, যা সাধারণ বোধশক্তির ঊর্ধ্বে। মহান আল্লাহ ঐসব জটিল ও উচ্চতর বিষয় সমূহকে সাধারণ মানুষের চিন্তা ও বোধশক্তির মাত্রার উপযোগী করে অত্যন্ত সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় মানব জাতির জন্যে অবর্তীণ করেছেন। উক্ত বর্ণনা থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, সৎ ও অসৎকাজ এবং পরকালের অনন্ত জীবন ও তার বৈশিষ্ট্যের মধ্যে এক বাস্তব সম্পর্ক বিদ্যমান। ভবিষ্যত জীবনের (পরকাল) সৌভাগ্য ও দূর্ভাগ্য আল্লাহ্র ইচ্ছায় মানুষের ঐসব সৎ ও অসৎকাজের সৃষ্ট ফলস্বরূপ। আরো সহজ ভাষায় বলতে গেলে, সৎ ও অসৎ কাজগুলো মানুষের আত্মায় এমন এক প্রতিচ্ছবির সৃষ্টি করে, যার উপর তার পরকালীন জীবনের সুখ-দুঃখ নির্ভরশীল। মানুষ প্রকৃতপক্ষে শিশুর মতই। লালন-পালনকালীন সময়ে একটি শিশু তার অভিভাবকের কাছ থেকে ‘এটা কর’ ‘ওটা কর না’ এমনই সব আদেশ নিষেধই প্রতিনিয়ত শুনতে অভ্যস্ত। কিন্তু ঐ অবস্থায় ঐ শিশু ঐসব কাজ করা বা না করার মূলমর্ম আদৌ উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় না। ঐ শিশু যদি শৈশবে লালিত হওয়াকালীন সময়ে তার প্রশিক্ষক বা অভিভাবকের আদেশ নিষেধের ঠিকমত আনুগত্য করে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই সে ভবিষ্যতে মানুষের মত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে এবং ভবিষ্যত সামাজিক জীবনে সে সুখী হবে। কিন্তু কোন শিশু যদি শৈশবে তার অভিভাবক বা প্রশিক্ষকের অবাধ্যতা করে, তাহলে সে মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে না এবং এর ফলে ভবিষ্যত জীবনে সে হতভাগ্য হবে। ঐসব আদেশ নিষেধের নিগূঢ়তত্ত্ব ঐ শিশু বুঝুক অথবা নাই বুঝুক, ঐসবের আনুগত্যেই তার মঙ্গল নিহিত।
একইভাবে মানবজাতিও সর্বস্রষ্টা আল্লাহ্র কাছে শিশুর মত। আল্লাহ্র আদেশ নিষেধের মর্ম সে উপলব্ধি করুক অথবা নাই করুক, তা মানা বা না মানার উপরই তার পরকালীন জীবনের সুখ দুঃখ নির্ভরশীল। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট ঔষধ-পথ্য গ্রহণ ও ব্যয়াম করার দায়িত্ব পালনই রোগীর একমাত্র দায়িত্ব। এভাবে ডাক্তারের নির্দেশ মেনে চলার মাধ্যমেই রোগীর দেহে শৃংখলা নেমে আসে এবং রোগী ক্রমেই রোগমুক্ত হয়ে সুস্থা হয়ে ওঠে এবং এটাই তখন তার সুখের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মোটকথা, মানুষ তার এই বাহ্যিক জীবনের পাশাপাশি একটি আধ্যাত্মিক জীবনেরও অধিকারী। মানুষের ঐ আধ্যাত্মিক জীবনের প্রকৃতি তার কৃতকর্মের ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে এবং বিকাশ লাভ করে। আর তার পরকালীন জীবনের সকল সুখ ও দুঃখ সম্পূর্ণরূপে তার জীবনের ঐসব কৃতকর্মের উপরই নির্ভরশীল। পবিত্র কুরআনও উক্ত বুদ্ধিবৃত্তিগত যুক্তিকে সমর্থন করে। এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে অসংখ্য আয়াত রয়েছে।
কুরআনের ঐসব আয়াতে সৎলোক ও আল্লাহতে বিশ্বাসীদের জন্যে এ পৃথিবীর জীবন ও বর্তমান আত্মার চেয়েও অনেক উন্নত ও উচ্চতর জীবন এবং উন্নত ও জ্যোতির্ময় আত্মার অধিকারী হওয়ার সুসংবাদ দেয়া হয়েছে।
পবিত্র কুরআন মানব জীবনের কৃতকর্ম সমূহের অদৃশ্য ফলাফলকে মানুষের নিত্যসঙ্গী হিসেবে বিশ্বাস করে। মহানবী (সা.)-এর হাদীসগুলোতেও এই অর্থই অসংখ্য বার উচ্চারিত হয়েছে। [উদাহরণ স্বরূপ নিমোক্ত হাদীসটি উল্লেখযোগ্য। মহান আল্লাহ্ ‘মে’রাজ’ সংক্রান্ত হাদীসে মহানবী (সা.) কে বলেনঃ “যে ব্যক্তি তার কার্য ক্ষেত্রে আমার (আল্লাহর) সন্তুষ্টি চায়। তাকে তিনটা বৈশিষ্ট্যে বিশিষ্ট্যমন্ডিত হতে হবে।
১. অজ্ঞতামূলক ভাবে প্রভুর প্রসংশা না করা।
২. অন্যমনষ্ক অবস্থায় প্রভুকে স্মরণ না করা।
৩. প্রভুর ভালবাসায় যেন অন্যবস্থার প্রেম কোন প্রভাব বিস্তার না করে।]
দ্বিতীয়তঃ প্রায়ই এমনটি ঘটতে দেখা যায় যে, অনেকেই হয়ত অন্যদেরকে কোন সৎ বা অসৎকাজের নির্দেশ দেয়, অথচ সে নিজে ঐসব কাজ করে না, কিন্তু আল্লাহ্র নবী, রাসুল বা ইমামগণের ক্ষেত্রে এমনটি কখনোই পরিলক্ষিত হবে না। কারণ, তাঁরা সরাসরি আল্লাহ্র দ্বারা নির্দেশিত ও পরিচালিত। তাঁরা মানুষকে যে দ্বীনের পথে পরিচালিত করেন এবং তার পথনির্দেশনা দেন, তাঁরা নিজেরাও তা মেনে চলেন। তাঁরা মানুষকে যে আধ্যাত্মিক জীবনের পথে পরিচালিত করেন, তাঁরা নিজেরাও ঐ আধ্যাত্মিক জীবনের অধিকারী। কারণ, মহান আল্লাহ যতক্ষণ পর্যন্ত স্বয়ং কাউকে হেদায়েত না করেন বা সৎপথে পরিচালিত না করবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত অন্যদের সৎপথে পরিচালিত করার দায়িত্ব ভার তার উপর অর্পণ করেন না। আল্লাহ্র ‘বিশেষ হেদায়াত’ কখনই ব্যর্থ হতে পারে না। উপরের আলোচনা থেকে আমরা নিম্নোক্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি।
১. বিশ্বের প্রতিটি জাতির মধ্যেই তাদের জন্যে প্রেরিত নবী-রাসুল বা ইমাম পূর্ণাঙ্গ দ্বীনি ও আধ্যাত্মিক জীবনের অধিকারী, যে জীবনাদর্শ অনুসরণের প্রতি তাঁরা জনগণকে আহ্বান জানায়। আর ঐ আর্দশের কার্যক্ষেত্রে (আমলের ব্যাপারে) তাঁরা অন্য সবার চেয়ে অগ্রগামী। কারণঃ নিজেদের প্রচারিত আর্দশকে অবশ্যই ব্যক্তি জীবনেও বাস্তবায়িত করতে হবে এবং আধ্যাত্মিক জীবনের অধিকারী হতে হবে।
২. যেহেতু তাঁরা অন্যদের তুলনায় অগ্রগামী এবং জনগণের পথ প্রদর্শক ও নেতা, তাই তাঁরা অন্য সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও মহত্বের অধিকারী।
৩. যিনি মহান আল্লাহ্র নির্দেশে ‘উম্মত’ বা জাতির নেতৃত্বের দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন, তিনি মানুষের বাহ্যিক কাজকর্মের বিষয়ে যেমন নেতা ও পথপ্রদর্শক, তেমনি মানুষের আধ্যাত্মিক জীবন ও আধ্যাত্মিক বিষয়াদিরও নেতা ও পথ প্রদর্শক। [মহান আল্লাহ্ বলেনঃ “আমি তাদেরকে নেতা মনোনীত করলাম। তারা আমার নির্দেশ অনুসারে পথ প্রর্দশন করত। আমি তাদের প্রতি সৎকাজ করার ওহী নাযিল করলাম ......” (-সুরা আল্ আম্বিয়া, ৭৩ নং আয়াত।)
আল্লাহ্ অন্যত্র বলেনঃ “তারা ধৈর্য্য অবলম্বন করতো বিধায় আমি তাদের মধ্য থেকে নেতা মনোনীত করেছিলাম, যারা আমার আদেশে পথপ্রদর্শন করত।” (-সুরা সিজদাহ্, ২৪ নং আয়াত।)
উপরোক্ত আয়াতসমূহ থেকে বোঝা যায় যে, ইমামগণ জনগণকে উপদেশ প্রদান ও বাহ্যিকভাবে সৎপথে পরিচালিত করা ছাড়াও একধরণের বিশেষ হেদায়াত ও আধ্যাত্মিক নেতৃত্বের অধিকারী ছিলেন, যা সাধারণ জড়জগতের উর্ধ্বে। তাঁরা তাঁদের অন্তরের আধ্যাত্মিক জ্যোতি দিয়ে গণমানুষের অন্তরের অন্তঃস্থালে প্রভাব বিস্তার করেন। আর এভাবে তাঁরা বিশেষ ক্ষমতা বলে অন্যদেরকে আত্মিক উন্নতি ও শ্রেষ্ঠত্বের সিঁড়িতে আরোহণে সাহায্য করেন।]
ইমাম ও ইসলামের নেতৃবৃন্দ
পূর্বোক্ত আলোচনা সমূহের ভিত্তিতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, বিশ্ব নবী (সা.)-এর তিরোধাণের পর ইসলামী উম্মতের মাঝে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে মনোনীত ইমামের (নেতা) অস্তিত্ব ছিল এবং থাকবে। এ ব্যাপারে বিশ্বনবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে অসংখ্য হাদীস [। উদাহরণ স্বরূপ কিছু হাদীসঃ “যাবের বিন সামরাতেন বলেনঃ রাসুল (সা.) কে বলতে শুনেছি যে, বারজন প্রতিনিধি আর্বিভাবের পূর্বে এই অতীব সম্মানীত ধর্মের সমাপণ ঘটবে না। যাবের বললেনঃ জনগণ তাকবির ধ্বনিতে গগন মুখরিত করে তুললো। অতঃপর রাসুল (সা.) আস্তে কিছু কথা বললেন। আমি আমার বাবাকে বললামঃ কি বললেন? বাবা বললেনঃ রাসুল (সা.) বললেনঃ তারা সবাই কুরাইশ বংশের হবেন। (-সহীহ্ আবু দাউদ, ২য় খন্ড ২০৭ নং পৃষ্ঠ। মুসনাদে আহ্মাদ, ৫ম খন্ড, ৯২ নং পৃষ্ঠা। )
একই অর্থে বর্ণিত আরও অসংখ্য হাদীস রয়েছে। স্থানাভাবে এখানে সেগুলো উল্লেখ করা হচ্ছে না। অন্য একটি হাদীসঃ “সালমান ফারসী (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেনঃ এমতাবস্থায় রাসুল (সা.) এর নিকট উপস্থিত হলাম যে যখন হোসাইন তাঁর ঊরুর উপর ছিল এবং তিনি তার চোখ ও ওষ্ঠতে চুম্বন দিচ্ছেন আর বলছেন যে, তুমি সাইয়্যেদের সন্তান সাইয়্যেদ এবং তুমি ইমামের সন্তান ইমাম, তুমি ঐশী প্রতিনিধির সন্তান ঐশী প্রতিনিধি। আর তুমি নয় জন ঐশী প্রতিনিধির বাবা, যাদের নবম ব্যক্তি হলেন কায়েম (ইমাম মাহ্দী)।” [-ইয়ানাবী-উল্-মুয়াদ্দাহ্, (সুলাইমান বিন ইব্রাহীম কান্দুযি) ৭ম মুদ্রণ, ৩০৮ নং পৃষ্ঠা।)]
নিম্নলিখিত গ্রন্থগুলো দ্রষ্টব্যঃ
১. ‘আল্-গাদীর’-আল্লামা আমিনী।
২. ‘গায়াতুল মারাম’-সাইয়েদ হাশেম বাহ্রানী।
৩. ‘ইসবাতুল হুদাহ্’-মুহাম্মদ বিন হাসান আল্ হুর আল্ আমিলী।
৪. ‘যাখাইরূল উকবা’ মুহিবুদ্দিন আহমাদ বিন আবদিল্লাহ্ আত্ তাবারী।
৫. ‘মানাকিব’-খারাযমি।
৬. ‘তাযকিরাতুল খাওয়াস্’-সিবতু ইবনি জাউযি।
৭. ‘ইয়া নাবী উল্ মুয়াদ্দাহ্, সুলাইমান বিন ইব্রাহীম কান্দুযি হানাফী।
৮. ‘ফুসুলুল মুহিম্মাহ্’-ইবনু সাব্বাগ।
৯. ‘দালাইলুল ইমামাহ্’-মুহাম্মদ বিন জারির তাবারী।
১০. ‘আন্ নাস্ ওয়াল ইজতিহাদ’ আল্লামা শারাফুদ্দীন আল্ মুসাভী।
১১. উসুলুল ক্বাফী, ১ম খন্ড -মুহাম্মদ বিন ইয়াকুব আল্ কুলাইনী।
১২. ‘কিতাবুল ইরশাদ্’ -শেইখ মুফিদ।]বর্ণিত হয়েছে। ঐসব হাদীসে ইমামদের বৈশিষ্ট, পরিচিতি, সংখ্যা, ইত্যাদি বর্ণিত হয়েছে। এমনকি ইমামরা যে, সবাই কুরাইশ বংশীয় এবং মহানবী (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইতের সদশ্য হবেন তাও বলা হয়েছে। সেখানে আরও বলা হয়েছে যে, প্রতীক্ষিত ইমাম হযরত মাহ্দী (আ.)-ই হবেন ইমামদের মধ্যে সর্বশেষ ইমাম। একইভাবে হযরত আলী (আ.)-এর প্রথম ইমাম হওয়ার ব্যাপারেও মহানবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে যথেষ্ট পরিমাণ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। দ্বিতীয় ইমামের ইমামতের সমর্থনেও মহানবী (সা.) ও হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর পক্ষ থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত অসংখ্য হাদীস রয়েছে। একইভাবে প্রত্যেক ইমাম তাঁর পরবর্তী ইমামের ইমামতের সর্মথনে অকাট্য প্রামাণ্য দলিল রেখে গেছেন।
উপরোক্ত হাদীসসমূহের দলিলের ভিত্তিতে ইমামদের মোট সংখ্যা বারজন। তাঁদের পবিত্র নামগুলো নিম্নরূপঃ
১. হযরত ইমাম আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)
২. হযরত ইমাম হাসান বিন আলী (আ.)
৩. হযরত ইমাম হুসাইন বিন আলী (আ.)
৪. হযরত ইমাম আলী বিন হুসাইন (আ.) [যয়নুল আবেদীন]
৫. হযরত ইমাম মুহাম্মদ বিন আলী (আ.) [বাকের]
৬. হযরত ইমাম জাফর বিন মুহাম্মদ (আ.) [জাফর সাদিক]
৭. হযরত ইমাম মুসা বিন জাফর (আ.) [মুসা কাযিম]
৮. হযরত ইমাম আলী বিন মুসা (আ.) [রেজা]
৯. হযরত ইমাম মুহাম্মদ বিন আলী (আ.) [ত্বাকী]
১০. হযরত ইমাম আলী বিন মুহাম্মদ (আ.) [নাক্বী]
১১. হযরত ইমাম হাসান বিন আলী (আ.) [আসকারী]
১২. হযরত ইমাম মাহদী (আ.)
source : alhassanain