আবনা ডেস্ক: যুদ্ধাপরাধী ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের আলবদর কমান্ডার মীর কাসেম আলীর ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়েছে। শনিবার রাত ১০টা ৩০ মিনিটে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ এ তাকে রশিতে ঝুলিয়ে ফাঁসি কার্যকর করা হয়। কারাগারটির জেলসুপার প্রশান্ত কুমার বণিক তার হাত থেকে লাল রুমাল ফেলা মাত্রই ফাঁসির মঞ্চের লিভার (হাতল) ধরে টান দেন জল্লাদ। ২০ মিনিট তাকে (কাসেম) ঝুলিয়ে রেখে ফাঁসকূপ থেকে তোলা হয়। গাজীপুর জেলা সিভিল সার্জন ডা. আলী হায়দার লাশ পরীক্ষা করে কাসেমকে মৃত ঘোষণা করেন। যার মধ্য দিয়ে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দণ্ডিত ষষ্ঠ অপরাধীর ফাঁসি কার্যকর হল। চট্টগ্রামের ডালিম হোটেলে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে অপহরণের পর নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যার দায়ে তার ফাঁসি কার্যকর হয়। এটা ছিল কাশিমপুর কারাগারে কোনো যুদ্ধাপরাধীর প্রথম ফাঁসি।
এর আগে মানবতাবিরোধী অপরাধে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১১ মে জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী, গত বছরের ২২ নভেম্বর আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, একই বছর ১১ এপ্রিল জামায়াত নেতা মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়।
রাত ১০টা ৫০ মিনিটে কাশিপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ এর জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিক কারাগার থেকে বের হয়ে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডিত মীর কাসেম আলীর ফাঁসি শনিবার রাত ১০টা ৩০ মিনিটে কার্যকর করা হয়েছে। লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি ও ময়নাতদন্ত শেষে পুলিশি প্রহরায় তার (কাসেমের) লাশ গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হবে।’
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরার সদস্য ছিলেন মীর কাসেম। তিনি ইসলামী ব্যাংক ও ইবনেসিনা এবং জামায়াতে ইসলামীর বেশ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে ছিলেন। ৬৩ বছর বয়সী মীর কাসেম আলী ২০১২ সালের ১৭ জুন নয়া দিগন্ত কার্যালয় থেকে গ্রেফতার হন। এরপর থেকে তিনি কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছিলেন। ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মীর কাসেম আলীকে দুটি অভিযোগে ফাঁসি এবং আটটি অভিযোগে সব মিলিয়ে ৭২ বছরের কারাদণ্ড দেন। ফাঁসির দণ্ড দেয়ার পর তাকে কনডেম সেলে পাঠানো হয়। ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করেন মীর কাসেম। আপিলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ৮ মার্চ আপিল বিভাগ কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিন আহমেদকে খুনের দায়ে (১১ নম্বর অভিযোগ) ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন। মীর কাসেম ১৯ জুন ফাঁসির দণ্ড থেকে খালাস চেয়ে রিভিউ আবেদন দাখিল করেন। শুনানি শেষে ৩০ আগস্ট মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ রিভিউ আবেদন খারিজের রায় ঘোষণা করেন। বুধবার মীর কাসেমকে কারাগারে আনুষ্ঠানিকভাবে রায় পড়ে শোনানো হয় এবং তার কাছে জানতে চাওয়া হয় তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন কিনা। শুক্রবার কারা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে মীর কাসেম জানান, তিনি প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন না।
শনিবার বিকাল ৩টা ৪০ মিনিটে কয়েক শিশুসহ ৩৮ জন আত্মীয় কাশিমপুর কারাগারে কাসেমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাদের নিয়ে যাওয়া হয় কনডেম সেলে। তারা সাক্ষাৎ শেষে সন্ধ্যায় বেরিয়ে আসেন।
এর আগে দিনেই ফাঁসি কার্যকরের যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে কারা কর্তৃপক্ষ। শনিবার সকালে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ এ শামিয়ানা টানিয়ে এবং ফ্লাডলাইট জ্বালিয়ে প্রস্তুত করা হয় ফাঁসির মঞ্চ। এর আগে মোম মাখানো দড়িতে বালুর বস্তা ঝুলিয়ে ফাঁসির মহড়াও দেয়া হয়।
শুক্রবার সকাল থেকেই কারাগার এলাকায় গড়ে তোলা হয় ছয় স্তরের নিরাপত্তা বলয়। বৃহস্পতিবার বিকালেই কাশিমপুর কারাগারের মূল প্রবেশপথের দোকানপাট বন্ধ করে দেয়া হয়। কারাগারের মূল সড়ক থেকে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের সংযোগ পর্যন্ত অংশে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। কারাগারের চারপাশে মোতায়েন করা হয় কারারক্ষী, অতিরিক্ত পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের। রাজধানী ঢাকা ও গাজীপুর মহানগরীর বিভিন্ন স্থানেও জোরদার করা হয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এছাড়া জামায়াত অধ্যুষিত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মোতায়েন করা হয় বিজিবিসহ আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের। শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ ও কাশিমপুর কারা ফটকে মুক্তিযোদ্ধা ও উৎসুক জনতা অবস্থান নেন। ফাঁসি কার্যকরের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তারা উল্লাস প্রকাশ করেন।
কারা সূত্র জানায়, আদালতের রায় বাস্তবায়নের জন্য শনিবার সকালে জরুরি বৈঠকে বসেন কারা অধিদফতরের কর্মকর্তারা। সেখানে আইজি প্রিজন্স ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিনের সভাপতিত্বে কারা অধিদফতর ও কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে রায় কার্যকরের প্রস্তুতি বিষয়ে আলোচনা, রায় বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। বেলা দেড়টায় অতিরিক্ত আইজি প্রিজন্স কর্নেল ইকবাল হাসান ফাঁসি সংক্রান্ত নির্বাহী আদেশের কপি নিয়ে কাশিমপুর কারাগারে প্রবেশ করেন। এছাড়া নির্বাহী আদেশের আরেকটি কপি প্রায় একই সময়ে গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কাছে যায়। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ফাঁসির আদেশের কপি কাশিমপুর কারাগারে পৌঁছানো হয়। বিকাল পৌনে ৫টায় ডিআইজি প্রিজন্স গোলাম হায়দার কাশিমপুর কারাগারে প্রবেশ করেন। আর সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটে প্রবেশ করেন আইজি প্রিজন্স ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন। রাত পৌনে ৯টায় কারাগারে প্রবেশ করেন জেলা পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ। রাত ৯টা ৩৫ মিনিটে কারাগারে যান জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এসএম আলম, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রায়হানুল আলম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মাহমুদুল হাসান ও সিভিল সার্জন ডা. আলী হায়দার একসঙ্গে কারাগারে প্রবেশ করেন।
আরও জানা গেছে, ফাঁসির রায় কার্যকর করার সময় উপস্থিত ছিলেন- সিনিয়র জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিক, কারাধ্যক্ষ (জেলার) নাসির উদ্দিন আহমদ, জেলা সিভিল সার্জনের সহযোগী চিকিৎসক ডা. কাওসার ও ডা. মিজানুর রহমান।
রায় কার্যকর হওয়ার পর রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ধানমণ্ডির বাসায় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘কাশিমপুর কারাগারে রাত সাড়ে ১০টায় যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেমের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীর বিচার সুসম্পন্ন হওয়ায় মানুষ মনের আনন্দে মিছিল করছে। যারা লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে তাদের বিচার হয়েছে। বিচারের পর বাংলাদেশের পরিস্থিতি অত্যন্ত স্বাভাবিক আছে। ২০০৮ সালে দেশের মানুষ আমাদের ম্যান্ডেট দিয়েছে। দেশের মানুষ আমাদের সঙ্গে আছে। দেশে কোনো ধরনের বিশৃংখলা হবে না। নিরাপত্তা নিশ্চিতে আমাদের আইনশৃংখলা বাহিনী প্রস্তুত আছে। জনগণই নাশকতাকারীদের প্রতিহত করবে।’ মন্ত্রী বলেন, ‘শেখ হাসিনা কারও অগ্নিচক্ষুকে ভয় পান না। আমরা জনতার ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় এসেছি। জনতার ম্যান্ডেটেই বিচার হয়েছে। এ বিচার জনতার প্রাণের দাবি ছিল।’ আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘প্রশাসনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মানিকগঞ্জেই লাশ দাফন করা হয়েছে। তারও (কাসেম) এটা শেষ ইচ্ছা ছিল।’
ফাঁসির মঞ্চ
কারা সূত্রে জানা গেছে, মীর কাসেমের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয় কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ এর কনডেম সেল সংলগ্ন ফাঁসির মূলমঞ্চে। এ কারাগারের ৪০নং কনডেম সেলে বন্দি ছিলেন মীর কাসেম। শনিবার সকালে পুরো ফাঁসির মঞ্চে লাল ও সবুজ রঙের শামিয়ানা টানিয়ে দেয়া হয়। যাতে বাইরে থেকে ফাঁসির মঞ্চ দেখা না যায়। শামিয়ানার ভেতর বসানো হয় ফ্লাডলাইট। পাশাপাশি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে বসানো হয় সিসি ক্যামেরা। কাশিমপুর কারাগারের এ মঞ্চটির দৈর্ঘ্য ৮ ফুট এবং প্রস্থ সাড়ে ৪ ফুট। সেখানে আছে পাশাপাশি দুটি ফাঁসকূপ। একই লিভারে এই মঞ্চে দু’জন আসামির দণ্ড কার্যকর করা যায়। ফাঁসির মঞ্চটি ভূমি থেকে বেশ উঁচু। মঞ্চের ওপরে যে ফাঁসির কাষ্ঠ তার উচ্চতা ৮ ফুট। আর মঞ্চ থেকে নিচের দিকে ১২ ফুট গভীর গর্ত আছে। সেই গর্ত কাঠের পাটাতন দিয়ে ঢাকা। লিভারে চাপ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে পায়ের নিচ থেকে পাটাতন সরে যায় এবং গলায় ফাঁস পড়ে। ফাঁসি কার্যকরের সময় মঞ্চ সংলগ্ন স্থানে একটি লম্বা টেবিলে চেয়ার পাতা হয়। তাতে পাশাপাশি বসেন ১০ কর্মকর্তা। ২০ মিনিট ঝুলিয়ে রাখার পর ফাঁস কূপ থেকে কাসেমের লাশ তুলে ওই টেবিলে রাখা হয়। লাশ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন সিভিল সার্জন ডা. আলী হায়দার। বিধান অনুযায়ী মীর কাসেমের দুই পায়ের গোড়ালির রগ কেটে দেয়া হয়। কাসেমের মৃত্যু নিশ্চিত করে সিভিল সার্জন ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ তৈরি করেন। লাশ গোসল দিয়ে কাফনের কাপড় পরানো হয়। কফিনে ভরে লাশ তোলা হয় অ্যাম্বুলেন্সে।
স্বাস্থ্য পরীক্ষা
নিয়মানুযায়ী অসুস্থ কোনো ব্যক্তিকে ফাঁসি দেয়া হয় না। রায় কার্যকর করার আগে আসামি কাসেমের স্বাস্থ্য চূড়ান্তভাবে পরীক্ষা করেন জেলা সিভিল সার্জন ডা. আলী হায়দার। তার সঙ্গে ছিলেন ডা. কাওসার ও ডা. মিজান। তার (কাসেম) রক্তচাপসহ সবকিছু ঠিকঠাক থাকার পর তাকে সুস্থ বলে ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা।
তওবা পড়ানো
পরিবারের সদস্যরা সাক্ষাৎ করে বের হয়ে আসার পর আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে ফাঁসি কার্যকরের আগে মীর কাসেমকে গোসল করানো হয়। গোসল শেষে তওবা পড়ান কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা হেলাল উদ্দিন। রাত সাড়ে ৯টায় তাকে (হেলাল উদ্দিন) সঙ্গে নিয়ে জেল সুপার ও জেলার কনডেম সেলে কাসেমের কক্ষে যান। ওই সময় কারা অধিদফতরের ডিআইজি পদমর্র্যাদার এক কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। তার কাছে জানতে চাওয়া হয় তিনি কারও সঙ্গে দেখা করতে চান কিনা এবং কোনো কিছু খেতে ইচ্ছে করছে কিনা। তিনি বলেন, ‘না’। এরপর জেলার কাসেমকে বলেন, ‘এটাই আপনার শেষ রাত। এ রাতেই আপনার ফাঁসি কার্যকর করা হবে। এখন আপনাকে তওবা পড়তে হবে।’ কাসেম নিজেই তওবা পড়েন। এরপর তিনি দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করেন। এর কয়েক মিনিট পর প্রধান জল্লাদের নেতৃত্বে জল্লাদরা কনডেম সেলে যান।
জল্লাদ দল
কারাগারের জল্লাদ শাহজাহানের নেতৃত্বে চার জল্লাদকে শুক্রবার থেকে প্রস্তুত রাখা হয়। এ দলের অন্য সদস্যরা হলেন- দীন ইসলাম, রিপন ও শাহীন। দলনেতা শাহজাহানকে আগেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়। ফাঁসির মঞ্চে নেয়ার আগে কনডেম সেলেই কাশেমকে যমটুপি (মাথার ওপর থেকে গলা পর্যন্ত ঢেকে যায় কালো রঙের কাপড় দিয়ে তৈরি বিশেষ ধরনে টুপি) পরিয়ে দেন জল্লাদ দীন ইসলাম। এ সময় কাসেম ছিলেন নির্বিকার। তিনি যমটুপি পরতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এ সময় তিনি (কাসেম) কারা কর্মকর্তাদের বলেন, ‘আপনারা আপনাদের দায়িত্ব পালন করেন। যমটুপি পরাতে হবে না।’ এ সময় তাকে বলা হয় ‘এটা নিয়ম। তাই আপনাকে পরতেই হবে।’ পরে তাকে যমটুপি পরানো হয়। জল্লাদরা তাকে (কাসেম) দু’দিক থেকে বগলদাবা করে ধরে নিয়ে যায় ফাঁসির মঞ্চে।
কারা অধিদফতরের এক কর্মকর্তা জানান, ফাঁসি কার্যকরের জন্য প্রথমে জল্লাদ রাজুর নাম প্রস্তাব করা হয়। শারীরিক সামর্থ্য না থাকায় পরে তাকে জল্লাদ দল থেকে বাদ দেয়া হয়। কারাবিধি অনুযায়ী কোনো আসামির রায় কার্যকর করলে জল্লাদের এক মাসের সাজা মওকুফ হয়।
প্রাণভিক্ষার আবেদন করেননি
মঙ্গলবার রাতে ট্রাইব্যুনালের একজন ডেপুটি রেজিস্ট্রার রায়ের কপি নিয়ে কাশিমপুর কারাগারে যান। বুধবার সকালে মীর কাসেমকে রায় পড়ে শোনান জেলসুপার প্রশান্ত কুমার বণিক। তখন তার কাছে জানতে চাওয়া হয় তিনি প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন কিনা। কাসেম কোনো জবাব দেননি বরং চিন্তা-ভাবনার জন্য সময় চান। শুক্রবার তিনি সিদ্ধান্ত জানান যে প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন না।
শেষ সাক্ষাৎ
শনিবার বিকালে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে কাসেমের সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ করতে যান কয়েক শিশুসহ ৪৬ জন আত্মীয়। এদের মধ্যে পরিবারের সদস্য ছিলেন ১৫ জন। শুক্রবার সন্ধ্যায় ফোন করে সাক্ষাৎ প্রার্থীদের নামের তালিকা চায় কারা কর্তৃপক্ষ। শনিবার সকালে তাদের জানানো হয় বিকাল সাড়ে ৩টার মধ্যে সাক্ষাৎ করার জন্য। কারাগারের এক কর্মকর্তা জানান, কাসেমের দেয়া তালিকা অনুযায়ী পরিবারের সদস্যদের ডাকা হয়েছে। তবে সাক্ষাতে তার ছেলে ব্যারিস্টার আহমদ বিন কাসেম ওরফে আরমান উপস্থিত ছিলেন না। ৯ আগস্ট রাতে মিরপুরের বাসা থেকে সাদা পোশাকে কে বা কারা তাকে তুলে নিয়ে যায় বলে পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল। পরদিন ১০ আগস্ট আরমানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার পল্লবী থানায় জিডি করেন। ৯ আগস্ট থেকে নিখোঁজ আছেন আরমান। কাসেমের বড় ছেলে আগেই দেশ ছেড়ে চলে গেছেন বলে তার ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে।
ছয়টি গাড়িতে কাসেমের পরিবারের সদস্যরা কারা ফটকে যান। তাদের মধ্যে ৩৮ জন সাক্ষাতের অনুমতি পান। বিকাল পৌনে ৫টায় তারা কনডেম সেলে যান। তারা ১ ঘণ্টা ২৩ মিনিট সেলে অবস্থান করেন। সন্ধ্যা ৬টা ৮ মিনিটে বেরিয়ে এসে কারা ফটকের সামনে মীর কাসেমের স্ত্রী খন্দকার আয়েশা আক্তার অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার স্বামী শক্ত আছেন। তিনি মৃত্যু ভয়ে ভীত নন। তার অন্তিম ইচ্ছা পূরণ হয়নি। শেষবারের মতো তিনি ছেলের মুখ দেখতে পারেননি। তিনি পরিবারের সবাইকে ও দেশবাসীকে শান্ত থাকতে বলেছেন। পরিবারের সবাইকে মিলেমিশে থাকতে বলেছেন।’ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে মেয়ে সুমাইয়া রাবেয়া ও তাহেরা তাসমিন উপস্থিত ছিলেন।
কারাগার থেকে পরিবারের সদস্যরা বেরিয়ে যাওয়ার সময় কারাগারের বাইরে অপেক্ষমাণ বিপুলসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা ও উৎসুক জনতা ‘কাসেমের ফাঁসি চাই’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন। কাসেমের পরিবারের সদস্যদের বহনকারী গাড়িগুলো পুলিশি প্রহরায় দ্রুত এলাকা ত্যাগ করে।
যেভাবে লাশ বের করা হয়
রাত ৯টায় কারাগারের মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করে তিনটি অ্যাম্বুলেন্স। এর একটিতে ছিল কফিন। একটি অ্যাম্বুলেন্স নম্বর প্লেটযুক্ত এবং অপর দুটি নম্বর প্লেট ছাড়া। রাত ১২টা ৩২ মিনিটে ওই তিনটি অ্যাম্বুলেন্স কারাগারের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে। যার একটিতে ছিল মীর কাসেমের লাশ। অ্যাম্বুলেন্সের সামনে ও পেছনে পুলিশ এবং র্যাবের দুটি করে গাড়ি ছিল। ওই বহরে ছিলেন একজন ডেপুটি জেলার। তার নেতৃত্বে কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সটি মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের উদ্দেশে রওনা হয়। সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ লাশ বহনের সময় বাড়তি নিরাপত্তা দেয়।
কারাগারের পরিস্থিতি
ফাঁসি কার্যকর করা উপলক্ষে কশিমপুর কারাগারের ভেতরে আলো কমিয়ে দেয়া হয়। কারাগারের সেলগুলো সাদা ও কালো কাপড় দিয়ে ডেকে দেয়া হয়। বাইরে থেকে যাতে কোনোভাবেই ফাঁসির মঞ্চ দেখা না যায় সেটা নিশ্চিত করা হয়। বন্দিদের নিজ নিজ সেলে আটকে রাখা হয়। শুধু জল্লাদরা বাইরে ছিলেন। ফাঁসি কার্যকরের পর তারা নিজ নিজ সেলে ফিরে যান। কাসেমের স্বজনরা কারাগার থেকে বের হওয়ার পরই কারা ফটক ও আশপাশের এলাকা পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নেয় আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত কাশিমপুর কারাগার ও আশপাশের এলাকায় রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়। বাড়ানো হয় পুলিশি নিরাপত্তা। সেখানে মোতায়েন করা হয় চার প্লাটুন বিজিবি সদস্য। আর ঢাকায় মোতায়েন করা হয় আরও ৬ প্লাটুন বিজিবি সদস্য। এলাকাটি গার্মেন্ট অধ্যুষিত হওয়ায় বিষটি মাথায় রেখে বাড়তি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয় পুলিশ প্রশাসন।
রায় কার্যকরের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই উল্লাসে ফেটে পড়েন কারাগারের বাইরে উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধা ও উৎসুক জনতা। তারা একে-অপরকে জড়িয়ে ধরে উল্লাস প্রকাশ করেন। পাশাপাশি লাশবাহী গাড়ি লক্ষ্য করে জুতা নিক্ষেপ করেন।
১৮৯৮ দিন কারাবন্দি ছিলেন কাসেম : মীর কাসেম কারাবন্দি ছিলেন ৫ বছর ২ মাস ১৩ দিন বা ১৮৯৮ দিন। তাকে ২০১২ সালের ১৭ জুন ঢাকার মতিঝিলের দৈনিক নয়া দিগন্ত কার্যালয় থেকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর থেকে কাশিমপুর কারাগারেই বন্দি ছিলেন মীর কাসেম। তার ডাক নাম মিন্টু।
মীর কাসেম একাত্তরের কুখ্যাত গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান ছিলেন। তার নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনায় মুক্তিযুদ্ধকালে চট্টগ্রাম শহরের আন্দরকিল্লা এলাকার ডালিম হোটেলে স্থাপিত হয় আলবদর বাহিনীর ক্যাম্প ও নির্যাতন কেন্দ্র। একাত্তরে চট্টগ্রামে এই ডালিম হোটেলকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতো সব ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ, যার তত্ত্বাবধানে ছিলেন আলবদর নেতা মীর কাসেম আলী। মুক্তিযুদ্ধের সময় ডালিম হোটেল মানুষের কাছে পরিচিতি পায় হত্যাপুরী হিসেবে, আর নৃশংসতার জন্য মীর কাসেমের পরিচয় হয় ‘বাঙালি খান’।
মানিকগঞ্জে দাফন
মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, মীর কাসেমের লাশ দাফন করা হয় মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর থানার চালা গ্রামে। ওই গ্রামে মীর কাসেম আলীর প্রতিষ্ঠিত মসজিদসংলগ্ন লেবুবাগান ও বাঁশ ঝাড়ের পাশে কবর খোঁড়া হয় রাতেই। সন্ধ্যার আগেই হরিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুবিনা ফেরদৌস ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
এদিকে মীর কাসেমের দাফনকে কেন্দ্র করে হরিরামপুর ও মানিকগঞ্জের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। মানিকগঞ্জ শহর থেকে হরিরামপুরের চালা পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার সড়কে প্রতিটি মোড়ে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পুরো এলাকায় পুলিশের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে জনসাধারণের যাতায়াত সীমিত করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মীর কাসেমের লাশ দাফনের সময় তার দুই মেয়ে বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে মানকগঞ্জে মীর কাসেমের লাশ দাফন না করার দাবিতে বিক্ষোভ করেছে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম ও জেলা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। শনিবার রাত সাড়ে ৮টায় জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়।
source : abna24