আবনা ডেস্ক: গুলশানের হলি আর্টিজান হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী নব্য জেএমবির শীর্ষ এক নেতা ও মেজর জাহিদুল ইসলাম ওরফে মুরাদের স্ত্রী জেবুন্নেছা শীলা ও জঙ্গি মুসাকে অনেক দিন ধরে খুঁজছিল কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটি)। তাদের খুঁজতে গিয়ে রাজধানীর পূর্ব আশকোনায় জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পায় আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এরপর দক্ষিণখান থানার হাজী ক্যাম্পের কাছের ওই আস্তানায় ১৭ ঘণ্টা অভিযান চালায় সিটি ইউনিট। শুক্রবার রাত ১২টা থেকে শুরু হওয়া এ অভিযান চলে শনিবার বিকাল ৫টা পর্যন্ত।
শুক্রবার রাত ১২টার দিকে সিটির অতিরিক্ত উপকমিশনার ছানোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে ৩০-৩৫ জনের একটি দল তিনটি গাড়িতে ঘটনাস্থলে যান। জঙ্গি আস্তানার বিষয়টি উত্তরা বিভাগের পুলিশকে জানানো হয়। পরে অর্ধশতাধিক পুলিশ সদস্যও সেখানে যান। ভোর ৫টার দিকে ঘটনাস্থলে যান পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। তিনি অভিযানে নেতৃত্বে দেন।
ভোর ৬টার দিকে জঙ্গিদের আত্মসমর্পণ না করলে অ্যাকশনে যাওয়ার কথা বলা হয়। ওই সময় বাড়ির ভেতরে থাকা জঙ্গিরা জানায়, তাদের সঙ্গে অনেক শিশু আছে। পরে ধীরে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেয় পুলিশ। এরপর সকাল সাড়ে ৬টার দিকে বাসার দরজার কাছে গিয়ে আত্মসমর্পণের কথা বললে, তখন ভেতর থেকে এক নারী জঙ্গি বলে- আমরা আত্মসমর্পণ করব না। আত্মসমর্পণ করলে রিমান্ডে নিয়ে মারধর করবেন।
নারী জঙ্গিরা মনিরুল ইসলামকে কয়েকটি হাদিস শুনিয়ে বলেন, দেশে ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠা করতে পারলে আপনাদের সঙ্গে কথা বলব। এ সময় কক্ষের ভেতর থেকে শিশুর কথার শব্দ শুনে তাকে বের হয়ে আসতে বলেন মনিরুল ইসলাম। উত্তরে শিশুটি বলে আমি মাকে ছাড়া বের হব না। কথোপকথনের সময় মনিরুল ইসলাম দেখতে পান পর্দা দিয়ে ঘেরা জানালার পাশে ৬টি গ্রেনেড। সকাল ৯টার দিকে জঙ্গিদের পুনরায় আত্মসমর্পণ করতে আহ্বান জানানো হয় হ্যান্ড মাইকে; সকাল সাড়ে ৯টার দিকে জঙ্গিনেতা জাহিদের স্ত্রী, মেয়েসহ চারজন পুলিশের হাতে ধরা দেন।
অভিযানের শুরুতে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ‘সূর্য ভিলা’ বাড়ির পাশের একটি বাড়িতে তল্লাশি চালান। এরপর তারা নিশ্চিত হন, ‘সূর্য ভিলা’ বাড়িতে ‘জঙ্গি আস্তানা’ আছে। এরপর রাত সাড়ে ১২টায় তারা ওই বাড়িটি ঘিরে ফেলেন। রাত ৪টার দিকে সোয়াত দল সেখানে যোগ দেয়।
ভোর ৫টার দিকে ঘটনাস্থলে যাওয়া পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম সেখানে সাংবাদিকদের বলেন, “বাড়িটিতে ‘নব্য জেএমবির শীর্ষ এক নেতা’ রয়েছে। এছাড়া নারীসহ একাধিক জঙ্গি রয়েছে। জঙ্গিদের কাছে শক্তিশালী গ্রেনেড রয়েছে। তাদের আÍসমর্পণ করতে বলা হচ্ছে। তবে তারা শরীরে গ্রেনেড বেঁধে প্রতিরোধের ঘোষণা দিচ্ছে।”
এরপর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে পুলিশের আহ্বানে সাড়া দিয়ে দুই শিশুকে নিয়ে দু’জন নারী আত্মসমর্পণ করেন। পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, প্রথম দফায় ওই বাড়ির নিচতলার বাসা থেকে চারজন আত্মসমর্পণ করেছে। এই চারজন হল মিরপুরের রূপনগরে পুলিশের অভিযানে নিহত জঙ্গি ও সাবেক মেজর জাহিদের স্ত্রী জেবুন্নাহার শীলা, তার মেয়ে এবং পলাতক জঙ্গি মুসার স্ত্রী তৃষ্ণা ও তার মেয়ে। তাদের মাইক্রোবাসে করে ঘটনাস্থল থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
বাড়ির মালিক কাতার প্রবাসী জামাল হোসেনের বড় মেয়ে জোনাকি রাসেল দুপুরে সাংবাদিকদের বলেন, ১ সেপ্টেম্বর মো. ইমতিয়াজ আহমেদ পরিচয় দিয়ে একজন নিচতলার বাসাটি দেখতে আসেন। তখন ওই ব্যক্তি নিজেকে অনলাইন ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দেন এবং বলেন- বাসায় তিনি, তার স্ত্রী ও এক বাচ্চা থাকবে। মাঝে মধ্যে স্ত্রীর বোন এসে থাকবেন। ১০ হাজার টাকায় তিনি বাসাটি ভাড়া নেন। ৩ সেপ্টেম্বর পরিবার নিয়ে তিনি সেখানে ওঠেন। বাসা ভাড়া দেয়ার পর তিনি বেশ কয়েকবার ওই বাসায় গেছেন। বাসায় ল্যাপটপ, খাট, ড্রেসিং টেবিল, ফ্রিজ দেখেছেন। তিনি বলেন, ‘উনারা কখনও বের হতেন না। বাসায় ওঠার সময় বাচ্চার বয়স ছিল ৪০ দিন। ‘মাঝে মধ্যে দু’জন নারী ওই বাসায় আসতেন। জিজ্ঞেস করলে বলতেন, মা ও এক আত্মীয়। গ্রামের বাড়ি থেকে এসেছেন।’
দুপুরে বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের প্রধান ও সিটির এডিসি ছানোয়ার হোসেন বলেন, ওই বাসায় আরও তিনজন ছিল। তাদের বের হওয়ার জন্য পুলিশ এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় দিয়েছিল। বারবার তাদের হ্যান্ড মাইকে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তারা তাতে সাড়া দেয়নি। দুপুর সাড়ে ১২টার একটু পরে নিচতলা বাসার দরজা খুলে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন এক নারী।
কীভাবে ওই ‘জঙ্গি’ নারী বিস্ফোরণটি ঘটিয়েছেন, উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, প্রথম দফায় ওই বাড়ির নিচতলার বাসা থেকে চারজন আত্মসমর্পণ করেন। আরও তিনজন ওই বাসায় ছিল। তিনি নিজে ওই বাড়ির গাড়ি পার্কিংয়ের পিলারের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন জানিয়ে বলেন, দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তিনি দেখতে পান, বোরকা পরা একজন নারী বাঁ হাতে একটি মেয়েশিশুকে ধরে বুকে হাত রেখে বাসার দরজা খুলে বাইরে এসেছেন। ওই দু’জন পার্কিংয়ের দিকে আসছিলেন। তখন তিনি তাদের দাঁড়াতে বলেন। বারবার বলেন হাত তুলতে। কিন্তু ওই নারী দাঁড়াননি। তিনি শিশুটিকে সঙ্গে নিয়ে সামনে দিকে হাঁটতে শুরু করেন।
এ সময় ভয় পেয়ে পিছু হটে অভিযানের দায়িত্বে থাকা সোয়াত টিম। একপর্যায়ে বাঁ হাতে শিশুটিকে ধরে রেখে ডান হাত উপরের দিকে তোলার মতো ভঙ্গি করেন। তবে তখন তিনি কোমরে রাখা বিস্ফোরকে চাপ দেন। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণ ঘটে। ওই নারীর মৃত্যু হয়। বিস্ফোরণে আহত এক শিশুকে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তখনও বাড়ির ভেতরে আজিমপুরে পুলিশের অভিযানে নিহত জঙ্গি তানভীর কাদেরির ছেলে ছিল বলে ধারণা করা হয়।
পরে ছানোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, নারীটি জঙ্গি সুমনের স্ত্রী। শিশুটি জঙ্গি ইকবালের মেয়ে। তবে এ দুই জঙ্গি সম্পর্কে তিনি বিস্তারিত কিছু জানাননি।
বেলা ৩টার দিকে এক সংবাদ সম্মেলনে মনিরুল ইসলাম বলেন, গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানো জঙ্গি নারী মারা গেছেন। ভেতরে থাকা আরেক ‘জঙ্গি’ বিস্ফোরক ও গুলি ছুড়েছে। আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীও পাল্টা গুলি করেছে। এরপর ভেতর থেকে আর কোনো শব্দ আসেনি। ভেতরে থাকা ‘জঙ্গি’ জীবিত না মৃত, তা নিশ্চিত নয় পুলিশ।
অভিযান চালানো বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল এক কিশোর সবজি বিক্রেতার। ওই কিশোর জানায়, এ বাড়ির আনুমানিক ১৩-১৪ বছর বয়সের এক কিশোরের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। তার নাম শহীদ বলে জানায় সবজি বিক্রেতা জনি। শহীদ বিভিন্ন সময় তাকে অস্ত্র দেখাত। তাকে জিহাদে অংশে নেয়ার আহ্বান জানিয়ে শহীদ (শহীদ কাদেরী ওরফে আদর) বলত, ‘তোমারও বোমা বানানো শেখা উচিত, অস্ত্র চালাতে পারা উচিত। আমি এসব পারি।’ পরে জনিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিবিতে নিয়ে যাওয়া হয়।