বাঙ্গালী
Tuesday 26th of November 2024
0
نفر 0

দর্শনের যে কথা জানা হয়নি

দর্শনের যে কথা জানা হয়নি



[শহীদ আয়াতুল্লাহ্ মোর্তাজা মোতাহ্হারীর রচনা অবলম্বনে]

মানবের সকল পবিত্র বিষয়ের মধ্যে ‘জ্ঞান’ হল একমাত্র ও অদ্বিতীয়,যা বংশ,গোত্র,মত ও পথ নির্বিশেষে সকলে পবিত্র বলে গণ্য করে থাকে,আর এর মহিমা,পবিত্রতাও শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে থাকে। এমনকি মূর্খতম লোকটিও জ্ঞানকে তুচ্ছ গণ্য করেনা।

জ্ঞানের এ সর্বজনপ্রিয়তা ও মর্যাদা কেবল এ কারণে নয় যে,এটা জীবনের সর্বোৎকৃষ্ট হাতিয়ার এবং জীবন সংগ্রামে মানুষকে শক্তি যোগায়,সক্ষমতা বয়ে আনে এবং প্রকৃতির ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে। যদি কথা এটাই হত,তাহলে মানুষের উচিত ছিল অন্যান্য জীবনোপকরণকে যে দৃষ্টি থেকে দেখা হয়,জ্ঞানকেও সে দৃষ্টিতে দেখা। জ্ঞান-বিজ্ঞানের ইতিহাস সেসব কষ্ট-ক্লেশ,বঞ্চনা আর দুঃখে ভরা,যা পণ্ডিত ও বিজ্ঞানীরা জ্ঞান অর্জনের পথে বরণ করেছেন এবং বস্তুগত জীবনকে নিজেদের জন্য তিক্ত করে ফেলেছেন। আর যদি জ্ঞানের প্রতি মানুষের আগ্রহ ও আকর্ষণ শুধু একারণে হয়ে থাকে যে,তা জীবনের বস্তুগত চাহিদা মেটাবার হাতিয়ার,তাহলে জ্ঞানের পথে এতসব ত্যাগ ও জীবনের সুখ-শান্তি বর্জন করার কী অর্থ থাকে?

আসলে মানবাত্মার সাথে জ্ঞানের সম্পর্কের বন্ধন এসব নীচ ও হীন বন্ধনের অনেক ঊর্ধ্বে,যেগুলো প্রাথমিকভাবে কল্পনা করা হয়ে থাকে। জ্ঞান যত বেশি নিশ্চিত এবং সংশয়,সন্দেহ ও অজ্ঞতা বিদূরণকারী হবে,যত বেশি সর্বব্যাপী এবং বৃহৎ থেকে বৃহত্তর পর্দা উন্মোচনকারী হবে,তত বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও কাঙ্ক্ষিত হবে।

মানুষের অজানার বিশাল জগতের মধ্যে কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলো জানার আগ্রহ তুলনামূলকভাবে বেশি। গুরত্বের দিক দিয়েও সেগুলোর স্থান তালিকার শীর্ষে। এ বিষয়গুলো হল জগৎ সম্পর্কিত সামগ্রিক বিষয়ের রহস্য উদ্ঘাটন। মানুষ সফল হোক আর না হোক,এ বিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি,সৃষ্টির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য,আদি-অনাদি,একত্ব-বহুত্ব,সসীম-অসীম,কার্যকারণ,স্রষ্টা-সৃষ্টি ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে অনুসন্ধান ও চিন্তা-অনুধ্যান না করে পারে না। আর মানুষের এ সহজাত স্পৃহাই ‘দর্শন’-কে মানুষের জন্য উপহার হিসাবে এনেছে। দর্শন,জগতের আপাদমস্তক মানুষের চিন্তার অঙ্গনে হাজির করে,মানুষের বুদ্ধি ও চিন্তাকে নিজ ডানার ওপর বসিয়ে মানুষের আকাঙ্ক্ষার শেষ সীমানায় ভ্রমণ করায়,এমন সব জগতে যেখানে পরিভ্রমণ করা মানুষের পরম লক্ষ্য।

দর্শনের ইতিহাস মানুষের চিন্তার ইতিহাসের সাথে একসূত্রে গাঁথা। তাই দর্শনের উৎপত্তি কোন্ যুগে হয়েছে কিম্বা কোন্ ভূখণ্ডে এর সূচনা সে ব্যাপারে নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। মানব তার সহজাত আকাঙ্ক্ষার বশে যখনই এবং যেখানেই চিন্তার অবকাশ লাভ করেছে,সেখানেই জগতের সামগ্রিক বিষয় নিয়ে মতামত প্রকাশে কুণ্ঠা করেনি। ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুযায়ী বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত,যেমন মিশর,ইরান,ভারত,চীন ও গ্রীসে বিখ্যাত দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের আবির্ভাব ঘটেছে,যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক মতাদর্শসমূহ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁদের সেসব রচনার অনেকাংশই এখনও অবশিষ্ট রয়েছে। এসব প্রাচীন রচনার মধ্যে গ্রীক বিজ্ঞান ও দর্শনের সংখ্যাই বেশি,যা আজ থেকে প্রায় দু’হাজার ছয়শ’ বছর আগে সেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক মহা বিপ্লবের মতই আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।

চিন্তা ও দর্শনের এই যে বিপ্লব এশিয়া মাইনরের গা ঘেঁষে এবং গ্রীসে সূচিত হয়েছিল,তা আলেকজান্দ্রিয়ায় অব্যাহত থাকে। অতঃপর যখন আলেকজান্দ্রিয়া ও এথেন্সের জ্ঞানকেন্দ্র ধ্বংস ও পুরোপুরি বিলীন হয়ে যাবার উপক্রম হয় এবং পূর্ব রোমান সম্রাট জাস্টিনিন ৫২৯ খ্রিস্টাব্দে এথেন্স ও আলেকজান্দ্রিয়ার বিদ্যাপিঠসমূহে তালা লাগিয়ে দেবার নির্দেশ জারী করেন,আর ভীত-সন্ত্রস্ত পণ্ডিতবর্গ আত্মগোপন করেন ও জ্ঞান কেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে যায়,তখন পৃথিবীর আরেক প্রান্তে ইসলামের আলোকোজ্জ্বল সূর্যের উদয়ের মাধ্যমে আরেকটি বিপ্লবের সূচনা ঘটে এবং নবতর ও গভীরতর আরেকটি সভ্যতার দিগন্ত উন্মোচিত হয়। ইসলামের মহান নবী (সা.) ও মহান আউলিয়াবৃন্দের পক্ষ থেকে যেভাবে জ্ঞানের মর্যাদা এবং জ্ঞান অন্বেষণকারীদের প্রশংসা ও উৎসাহ যোগানো হয়েছে,তাতে জ্ঞান অন্বেষার অদম্য আকাঙ্ক্ষা পুনর্বার অন্তরে অন্তরে প্রজ্বলিত হয়ে ওঠে। এভাবে বিশাল ইসলামী সভ্যতা আত্মপ্রকাশ করে,জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার ওপর মৌলিক গ্রন্থাবলি রচিত ও লিপিবদ্ধ হয়। বিভিন্ন ভাষা,বিশেষ করে গ্রীক ভাষার গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাবলি অনূদিত হয়,বৃহত্তর বিদ্যাপিঠ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ প্রতিষ্ঠা করা হয়,অসংখ্য গ্রন্থাগার গড়ে ওঠে,ইসলামী ভূখণ্ডের বৃহৎ নগরীসমূহ জ্ঞানচর্চার লালনভূমিতে পরিণত হয় এবং সেসব স্থান আজকের ইউরোপসহ দেশি-বিদেশি অগণিত জ্ঞান-পিপাসুর পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে। এভাবে কয়েক শতাব্দী অতিবাহিত হওয়ার পর ইউরোপে নতুন এক বিপ্লবের উন্মেষ ঘটে। ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের রাজ্যে সাধিত হয় এক অভূতপূর্ব বিবর্তন।

তবে যে বিষয়টি ইতিহাসের দৃষ্টিতে একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য বিষয়,তা হল প্রাচীন গ্রীসও জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূল উৎসসমূহ প্রাচ্য থেকেই পেয়েছিল। গ্রীসের বিখ্যাত পণ্ডিতগণ অনেকবার প্রাচ্য ভ্রমণ করেন এবং প্রাচ্যের পণ্ডিতদের সাধনালব্ধ জ্ঞান-ভাণ্ডার থেকে অবলীলায় গ্রহণ করেন। অতঃপর স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে উক্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান ছড়িয়ে দেন। সে যুগে গ্রীকরা প্রাচ্যের জ্ঞান-ভাণ্ডার থেকে কতটুকু গ্রহণ করেছিলেন কিম্বা বিগত এক হাজার বছর পূর্বে আজকের ইউরোপ ইসলামী সভ্যতার বিজ্ঞান ও দর্শনের ভাণ্ডার থেকে কতটুকু উপকৃত হয়েছিল কিম্বা মুসলমানরা গ্রীক দর্শনকে কীভাবে গ্রহণ করে এবং তাতে কতটা সংযোজন করে ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে স্বতন্ত্র গবেষণার দাবি রাখে। তবে এখানে শুধু বিগত সাড়ে তিনশ’ বছরের ইসলামী দর্শনের একটি ইতিহাস সংক্ষেপে আলোচনা করা হল,যে কথা অনেকেরই জানা হয়নি। অন্য কথায়,যে বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও দুঃখজনক ভাবে খুব কমই আলোচনা করা হয়। বিশ্বে,বিশেষ করে শিক্ষিত মুসলিম যুব শ্রেণী,যারা ইউরোপীয় সূত্রাবলি হতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের তথ্যাবলি লাভ করে থাকে,তাদের কাছে এ ইতিহাস যথাযথভাবে উপস্থাপিত হয়নি।

ইসলামী এ দর্শন যা ‘হিকমাতে মুতাআলিয়া’ (উচ্চতর বুদ্ধিবৃত্তিক প্রজ্ঞা) নামে প্রসিদ্ধ,তা সাদরুল মুতাআল্লেহীন শিরাজী ওরফে মোল্লা সাদরার মাধ্যমে হিজরি একাদশ শতকে (খ্রিস্টিয় অষ্টাদশ শতকে) প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পরবর্তীকালে পারস্যের দর্শনচর্চা এ দর্শন শিক্ষাকে কেন্দ্র করেই অগ্রসর হয়,যার মূল ভিত রচিত হয়েছিল হিকমাতে মুতাআলিয়া দর্শনে।

মোল্লা সাদরার গবেষণা বেশিরভাগই ‘উচ্চতর দর্শন’ ও ‘ঐশ্বরিক প্রজ্ঞা’ সম্পর্কিত। এ ক্ষেত্রে মোল্লা সাদরা প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকবৃন্দ,বিশেষ করে প্লেটো ও অ্যারিস্টটল থেকে যা কিছু পাওয়া গিয়েছিল এবং ফারাবী,ইবনে সিনা,শেখ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ মুসলিম হাকিমগণ এ মর্মে যে ব্যাখ্যা ও পর্যালোচনা উপস্থাপন কিম্বা সংযোজন করেছিলেন,আর অধ্যাত্মবাদী মরমী সাধকবৃন্দ স্ব স্ব সাধনায় যে সিদ্ধি লাভ করেছিলেন সে সমস্তই উত্তমভাবে আয়ত্ত করেছিলেন এবং নতুনভাবে একটি দার্শনিক ভিত্তির গোড়াপত্তন করেছিলেন এবং একে অকাট্ট ও অখণ্ডনীয় মৌলনীতিমালা দ্বারা সুরক্ষিত করেছিলেন। তিনি যুক্তি-প্রমাণের দিক থেকে দর্শনের সমস্যাবলিকে গাণিতিক সূত্রের ওপর দাঁড় করান,যেগুলোর একটি অপরটি থেকে নিঃসৃত ও প্রমাণিত হয়। এভাবে তিনি দর্শনকে প্রমাণ ও প্রতিষ্ঠার পন্থাগুলোকে বিক্ষিপ্ত অবস্থা থেকে বের করে আনেন।

অ্যারিস্টটল,যিনি স্বীয় দর্শনের গুরু প্লেটোর মতবাদসমূহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন,তাঁর সময় থেকেই দর্শনের দু’টি ধারা সর্বদা একে অপরের সামন্তরালে এগিয়ে চলে,যে ধারা দু’টির প্রতিনিধিত্ব করে এসেছেন স্বয়ং প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল। প্রতিটি যুগেই এ দু’টি দার্শনিক ধারার অনুসারী ছিল। মুসলমানদের মধ্যেও এ দু’টি ধারা ‘ইশরাকী’ এবং ‘মাশশায়ী’ নামে প্রসিদ্ধ। বিগত দু’হাজার বছর ধরে গ্রীস ও আলেকজান্দ্রিয়ায় যেমনভাবে,তেমনি মুসলমানদের মাঝে এবং মধ্যযুগে ইউরোপে এ ধারাদ্বয়ের মধ্যে দার্শনিক বিতর্ক অব্যাহত থাকে। কিন্তু সাদরুল মুতাআল্লেহীন যে নতুনভাবে একটি বুনিয়াদ গড়ে তোলেন,তাতে দু’হাজার বছর ধরে চলমান এ বিবাদের অবসান ঘটে। তিনি বিষয়টিকে এমনভাবে উপস্থাপন করেন যার ফলে তাঁর পরবর্তীকালে ইশরাকী ও মাশশায়ী ধারাদ্বয়ের একে অপরের মোকাবেলার কোন অর্থ হয় না। আর যাঁরা তাঁর উত্তরকালে আবির্ভূত হয়েছেন ও তাঁর এ দর্শনের সাথে পরিচয় লাভ করেছেন,তাঁরা এ ধারাদ্বয়ের মধ্যে চলে আসা দু’হাজার বছরের বিতর্ক মীমাংসিত অবস্থায় দেখতে পেয়েছেন।

সাদরুল মুতাআল্লেহীনের দর্শন কোন কোন দিক থেকে যেমন অভিনব,অপর দিকে তেমনি তা ছিল মহান গবেষকদের সুদীর্ঘ আটশ’ বছরের চেষ্টা-সাধনার ফসল,যাঁরা প্রত্যেকেই দর্শনের ঝাণ্ডাকে এগিয়ে নিতে অবদান রেখেছেন। কিন্তু এত কিছুর পরও প্রাচ্যবিদদের সাক্ষ্য অনুযায়ী দুঃখজনকভাবে আজ চারশ’ বছরের অধিক কাল পেরিয়ে গেলেও এখনও পর্যন্ত ইউরোপে এ দর্শন সম্পর্কে এমনকি প্রাথমিক পরিচিতিটুকুও তুলে ধরা হয়নি। Prof. Edward Brawn একজন বিখ্যাত ইংরেজ প্রাচ্যবিদ (মৃত্যু ১৯২৫)। তিনি আজীবন পারস্য ও পারসিক ইতিহাস বিষয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি History of Iranian Literature গ্রন্থের ৪র্থ খণ্ডে বলেন : ‘ইরানে মোল্লা সাদরার দর্শনের প্রসিদ্ধি ও প্রচলন থাকা সত্ত্বেও আমি তাঁর দর্শনের কেবল দু’টি সাধারণ ও অসম্পূর্ণ সংকলন ইউরোপীয় ভাষায় দেখেছি।’ Cont Gobino মোল্লা সাদরার দর্শন-চিন্তা সম্পর্কে কয়েক পৃষ্ঠা লিখেছেন। কিন্তু দৃশ্যত তাঁর সবটুকুই তিনি সংগ্রহ করেছেন ইরানে তাঁর শিক্ষকবৃন্দের মৌখিক ভাষ্যাবলি থেকে। উপরন্তু,খোদ শিক্ষকবৃন্দেরই মোল্লা সাদরার দর্শন চিন্তা সম্পর্কে সম্যক অবগতি ছিল না বলে প্রতীয়মান হয়। Gobino মোল্লা সাদরা সম্বন্ধে যে বিবরণ লিখেছেন তার উপসংহারে বলেন : ‘মোল্লা সাদরার দর্শন পন্থা হুবহু ইবনে সিনা থেকে গৃহীত।’ অথচ রওযাতুল জান্নাত গ্রন্থের লেখক মোল্লা সাদরা সম্পর্কে লিখেছেন : ‘মোল্লা সাদরা ছিলেন ইশরাকী দর্শনের চরম সমালোচনাকারী। আর মাশশায়ী দর্শনের দোষত্রুটির দরজা উন্মোচনকারী।’ মোল্লা সাদরা সম্পর্কে সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত,কিন্তু সত্যিকার ও সঠিকতম মূল্যায়ন করেছেন আল্লামা ইকবাল।

Prof. Edward Brawn তাঁর বইয়ে আরও লিখেছেন,‘মোল্লা সাদরার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হল ‘আসফারে আরবাআ ও শাওয়াহিদুর রুবুবিয়্যাহ।’ অতঃপর পাদটীকায় Cont Gobino ‘আসফার’ কথাটির ভুল অর্থ করেছেন। আসফার কথাটি ‘সিফর’ এর বহুবচন,যার অর্থ হল ‘কিতাব’। কিন্তু তিনি এর অর্থ করেছেন ‘সফর’ এর বহুবচন ধরে। এ কারণে তিনি তাঁর ‘মধ্য এশিয়ার মাযহাবসমূহও দর্শন’ শীর্ষক বইয়ের ৮১ পৃষ্ঠায় লিখেছেন : ‘মোল্লা সাদরা সফর বা ভ্রমণ বিষয়ক আরও কিছু বই লিখেছেন!’

আল্লামা ইকবাল লাহোরী ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করার সময় ‘ইসলামে হিকমাত (দর্শন)-এর বিকাশ’ শিরোনামে যে বইটি প্রকাশ করেন তা হস্তগত করা যায়নি। কিন্তু এটুকু নিশ্চিত যে,সেটা ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত। এ দু’জন (Prof. Edward Brawn I Cont Gobino) ছিলেন প্রাচ্যবিদদের অন্যতম। মরহুম শেখ মুহাম্মাদ খান কাযভীনি,যিনি দীর্ঘ প্রায় ত্রিশ বছর ধরে ইউরোপের বিভিন্ন গ্রন্থাগারে অধ্যয়ন ও গবেষণা চালিয়েছেন এবং সেখানকার অনেক প্রাচ্যবিদের সাথে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন,তিনি একবার বার্লিন থেকে প্রকাশিত ‘ইরানশাহর’ নামক পত্রিকায় Edward Brawn এর মৃত্য উপলক্ষে একটি নিবন্ধে তাঁকে ইউরোপ ও আমেরিকার প্রাচ্যবিদদের মধ্যে ইরানের সাহিত্য,দর্শন ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান-ভাণ্ডারের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি আন্তরিক ও কঠোর অধ্যবসায়ী বলে উল্লেখ করেছেন। ঐ একই নিবন্ধে তিনি Cont Gobino সম্পর্কে লেখেন যে,তিনি ফ্রান্সের অত্যন্ত খ্যাতিমান একজন লেখক এবং দর্শন,সমাজ,ধর্ম,ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ে বহু গ্রন্থের প্রণেতা। Philosophy of History সম্পর্কে তিনি Gobinism খ্যাত বিশেষ এক মতবাদের প্রবর্তন করেন,যার অনেক অনুসারী জার্মানীতে রয়েছে।

মোটকথা,এত কিছুর পরও এ দু’জন প্রাচ্যবিদের একজন সাদরুল মুতাআল্লেহীনকে মাশশায়ী পন্থী,আর অন্যজন তাঁর বক্তব্য খণ্ডন করে ‘রওযাতুল জান্নাত’ গ্রন্থের (যা ছিল মূলত একটি ইতিহাস ও জীবনীমূলক গ্রন্থ) লেখনীকে সাক্ষ্য হিসাবে উপস্থাপন করেছেন। একজনের মতে,আসফার হল সফরনামা। আরেকজনের মতে,আসফারহল সিফর বা কিতাব এর বহুবচন। অথচ এ দু’জনই যদি আসফার গ্রন্থের প্রথম কয়েকটি পৃষ্ঠা পড়তেন তাহলে দেখতে পেতেন যে,আসফার ‘সিফর’ এর বহুবচনও নয়,কোন সফরনামাও নয়। আর Edward Brawn যে শিক্ষকের মৌখিক ভাষ্যের কথা বলেছেন যিনি ইরানে Gobino কে মোল্লা সাদরার দর্শন শিক্ষা দিতেন,তিনি ছিলেন একজন ইয়াহুদী,মোল্লা লালেযার নাম্মী। এ শিক্ষকেরই সহযোগিতায় তিনি ডেকার্টের ভাষ্যনামাকে ফারসি ভাষায় অনুবাদ করেন।

Gobino তাঁর ঐ গ্রন্থে সাদরুল মুতাআল্লেহীনের জীবনচরিত বর্ণনা প্রসঙ্গে দর্শনের মহামতি মীর মুহাম্মাদ বাকের দামাদকে একজন Dialectician (দ্বান্দ্বিক মতবাদী) বলে উল্লেখ করেছেন। সেখানে তিনি মীর দামাদের ক্লাসে মোল্লা সাদরার অংশগ্রহণ শেখ বাহায়ীর ইশারায় হয়েছিল বলে উল্লেখ করার পর মীর দামাদের নিকট মোল্লা সাদরার শিক্ষাগ্রহণের ফলাফলকে এভাবে তুলে ধরেছেন : ‘এবং কয়েক বছর পরে তাঁর ভাষার যে বিশুদ্ধতা ও আলঙ্কারিক দক্ষতার কথা আমরা জানি,তা অর্জন করেন।’

এখানে প্রাচ্যবিদদের নীতির সমালোচনা করা উদ্দেশ্য নয়। কারণ,এটা অমূলক যে,বিজাতীয় লোকদের নিকট থেকে আমরা আশা করব যাতে তাঁরা এসে আমাদের দর্শন,বিজ্ঞান,ধর্ম,ইতিহাস কিম্বা সাহিত্য সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেবেন ও বিশ্বের সামনে এ সবের পরিচয় তুলে ধরবেন! আরবি ভাষায় একটি প্রবাদ রয়েছে যে,‘তোমার আঙ্গুলের নখের মত আর কিছুই তোমার পিঠ চুলকে দেয় না।’ যদি কোন জনগোষ্ঠী বিশ্ববাসীর সামনে নিজেকে ও নিজের ইতিহাস,সাহিত্য,ধর্ম,কিম্বা দর্শনকে পরিচিত করাতে চায়,তাহলে তার একমাত্র উপায় হল এ কাজ তাদের নিজেদের দ্বারাই সম্পন্ন হওয়া। বিজাতীয়রা যদি সম্পূর্ণ আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথেও তা করতে যায় তবুও শেষ পর্যন্ত তাদের নিজেদেরই সম্পূর্ণ পরিচিতি না থাকার কারণে বৃহত্তর ভ্রান্তির কবলে পড়তে পারেন। যেখানে ইতিহাস ও কৃষ্টি-কালচারের মত সামান্য ব্যাপারেই এরূপ অনেক ঘটনা ঘটেছে,সেখানে দর্শনের ক্ষেত্রে তো বলার অপেক্ষাই রাখে না,যা অনুধাবন করা বিশেষজ্ঞদের কাজ। শুধু ভাষা জানা কিম্বা কতেক বই-কিতাব সংগ্রহ করাই যথেষ্ট নয়। খোদ ইরান যেখানে ইবনে সিনা ও সাদরুল মুতাআল্লেহীনের মত মহান দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের প্রতিপালন ভূমি ছিল,সেখানেই প্রতি যুগে যেসব জ্ঞানপ্রেমী তাঁদের সেসব উচ্চতর চিন্তা-দর্শনের সাথে পূর্ণাঙ্গভাবে পরিচিত হতে চাইতেন তাঁরা জীবনের অনেকগুলো বছর এ কাজে ব্যয় করতেন। অবশেষে এরূপ হাজারও জ্ঞানতাপসের মধ্য থেকে হাতেগোনা কয়েকজন মাত্র একাজে সফল হতে পারতেন। কাজেই আমরা কীভাবে নিশ্চিত হতে পারি যে,দশ শতাব্দীকাল পূর্বে ইসলামী দর্শন,উদাহরণস্বরূপ ইবনে সিনার চিন্তাসমূহ যেভাবে তাঁর শিষ্যদের বোধগম্য হত,তাঁদের অনুবাদকর্মেও ঠিক সেরূপ প্রতিফলিত হয়েছে।

যে সময়ে সাদরুল মুতাআল্লেহীন ইরানে দর্শনকে ঢেলে সাজানো এবং নতুন এক দার্শনিক কাঠামো গড়ে তোলার কাজে ব্যস্ত ছিলেন (খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতক),ঠিক সে সময়ে ইউরোপেও বিজ্ঞান ও দর্শনে এক মহা আলোড়ন সূচিত হয়,যার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল আরও কয়েশ’ বছর আগে থেকে। সাদরুল মুতাআল্লেহীন নির্জন গৃহকোণে বসে চিন্তা ও গণিত চর্চায় নিমগ্ন হন এবং কিছুকালের জন্য কোম নগরীর পর্বতদেশকে এ কাজের জন্য বেছে নেন যাতে স্বীয় সুবিস্তৃত চিন্তার ফসলকে উত্তমরূপে কাগজে লিপিবদ্ধ করতে সক্ষম হন। আর ইউরোপে ডেকার্ট সে সময়নতুন এক মুক্তির ডাক দেন এবং প্রাচীনদের অনুসরণের শিকল খুলে ফেলেন। রচিত হয় নতুন এক পথ চলা। তিনিও হল্যান্ডের এক প্রান্তে কয়েক বছরের জন্য নির্জনবাস বেছে নেন এবং দৈনন্দিন জীবনের ঝামেলামুক্ত হয়ে স্বীয় অবসরকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের পেছনে উৎসর্গ করেন। ডেকার্টের পর থেকে ইউরোপ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের পথে অবিশ্বাস্য গতিতে অগ্রসর হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখায় গবেষণার পদ্ধতি বদলে যায় এবং নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভব হয়। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানও গণিতশাস্ত্রে যেমন অগণিত বিজ্ঞানী ও পণ্ডিতের আবির্ভাব ঘটে,তদ্রুপ একাদিক্রমে বড় বড় দার্শনিকও আবির্ভূত হন এবং দর্শন একটি নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করে।

মধ্যযুগীয় দর্শনে যেসব বিষয়ে বেশি মনোযোগ দেওয়া হত,ইউরোপের আধুনিক দর্শনে সেগুলোর প্রতি কমই দৃষ্টি দেওয়া হয়। তৎপরিবর্তে এক শ্রেণীর নতুন বিষয় যেগুলোর প্রতি প্রাচীন দার্শনিকরা কম মনোযোগ দিতেন সেগুলো বেশি বেশি উল্লিখিত হয়।

ইউরোপে ডেকার্টের সময় থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত বিভিন্ন দার্শনিক মতবাদের উদ্ভব হয়েছে। প্রত্যেক দলই একটি বিশেষ মতবাদের অনুসারী হয়েছেন,কেউ বুদ্ধিবৃত্তিক দর্শনে মত্ত হয়েছেন,কেউ আবার ব্যবহারিক বিজ্ঞানের (অভিজ্ঞতাবাদী) চোখ দিয়ে দর্শনকে দেখেছেন। আবার কেউ কেউ উচ্চতর দর্শন তথা ঈশ্বরতত্ত্বকে আলোচনা ও গবেষণার যোগ্য বলে মনে করেছেন এবং এ সম্পর্কে স্ব স্ব মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গী প্রকাশ করেছেন। আর কেউ কেউ দাবি করেছেন যে,মূলগতভাবে মানুষ এসব বিষয় উপলব্ধি করতে অপারগ এবং এ পর্যন্ত এ ব্যাপারে পক্ষে-বিপক্ষে যা কিছুই বলা হয়েছে তার সবই বিনা প্রমাণে বলা হয়েছে। তবু বিশ্বাসের ক্ষেত্রে একদল ঈশ্বরবাদী হয়েছেন,আরেকদল হয়েছেন বস্তুবাদী। মোটকথা,যে শাস্ত্র প্রাচীনকাল থেকে real philosophy তথা উচ্চতর বিদ্যা বলে পরিচিত হয়ে এসেছে (অর্থাৎ জগতের সামগ্রিক ব্যবস্থা এবং বিশ্বের আপাদমস্তক ব্যাখ্যা করার জন্য গবেষণা করা হয় যে বিদ্যায়) তা ইউরোপে মধ্যযুগে যেমন,আধুনিক যুগেও তেমনি উল্লেখযোগ্য কোন উন্নতি লাভ করেনি এবং দর্শনকে বিক্ষিপ্ততা ও বিভক্তি থেকে রক্ষা করতে পারে- এমন কোন শক্তিশালী ও সন্তোষজনক সিস্টেম দাঁড় করাতে সক্ষম হয়নি। এর ফলে ইউরোপে দর্শনের মধ্যে সাংঘর্ষিক মতবাদ সৃষ্টির কারণ হয়েছে। আর ইউরোপের গবেষণার যেটুকু উল্লেখযোগ্য ও প্রশংসনীয় এবং যা দার্শনিক বিষয়াবলি নামে প্রসিদ্ধ,তা আসলে দর্শনের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়;বরং গণিত,পদার্থবিজ্ঞান কিম্বা মনোবিজ্ঞানের সাথে সংশ্লিষ্ট।

আর ন্যায়ত বলতে হয় যে,মুসলিম দার্শনিকরা এ বিদ্যার গবেষণায় যেভাবে আত্মনিয়োগ করেছেন,তাতে তাঁরা সফলভাবেই অগ্রসর হয়েছেন এবং আধা সমাপ্ত গ্রীক দর্শনকে যথেষ্ট এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছেন। যদিও মুসলমানদের মধ্যে প্রবেশের সময় গ্রীক দর্শনে সর্বসাকুল্যে দু’শটির বেশি বিষয় ছিল না। কিন্তু মুসলিম দর্শনে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাতশ’রও বেশি। তাছাড়া যুক্তি-প্রমাণের (principles) তথা মৌলনীতি ও প্রেক্ষিত-পদ্ধতিসমূহ,এমনকি গ্রীসের প্রাথমিক বিষয়াবলির ক্ষেত্রেও পরিপূর্ণরূপে বদলে গেছে এবং দার্শনিক বিষয়াবলি প্রায় গাণিতিক বৈশিষ্ট্য ধারণ করেছে। এ বৈশিষ্ট্য মোল্লা সাদরার দর্শনে পুরোপুরিভাবে প্রকাশমান। এদিক থেকে তিনি মুসলিম পণ্ডিতদের মধ্যে অগ্রবর্তী।

এ মন্তব্যগুলো যে নিছক দাবি নয়;বরং এটাই বাস্তব,তা স্পষ্ট করার জন্য আমাদের আরও গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে।

যে সময়কালে ইউরোপীয় দর্শনের ঢেউ ইরানে এসে পৌঁছায় সে সময় স্বল্প-বিস্তর দার্শনিক রচনা ইউরোপীয় ভাষাসমূহ থেকে ফারসিতে অনূদিত হয়। সম্ভবত ফারসি ভাষায় আধুনিক দর্শনের সর্বপথম প্রকাশনা হল Verses of Descartes এর অনুবাদ,যা এক শতাধিক কাল পূর্বে কতিপয় সহযোগীর সহযোগিতা নিয়ে Cont Gobino এর মাধ্যমে অনূদিত হয়। অবশ্য পরবর্তীকালে পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান যতই তোপধ্বনি তোলে,ততই পশ্চিমা দার্শনিক ও পণ্ডিতদের নাম মুখে মুখে ফিরতে থাকে এবং ক্রমে ক্রমে আরও বেশি গ্রন্থ ফারসি ভাষায় প্রকাশিত হয়।১ আর যদিও কিছুকাল ধরে বিদগ্ধ অনেকের মনোযোগ এ দিকটির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে যে,আধুনিক দর্শনের মতবাদ ও বিশ্বাসসমূহ প্রাচীন দর্শনে অনুপ্রবেশ করুক এবং আধুনিক মতবাদসমূহের ও মুসলিম দার্শনিকবৃন্দের মতামতসমূহের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা হোক,কিন্তু দুঃখের বিষয় হল,অদ্যাবধি এ আকাঙ্ক্ষা বাস্তবে রূপ করেনি। আর সে সময় থেকে আজ পর্যন্ত যত দার্শনিক রচনা প্রকাশিত হয়েছে সেগুলো হয় নেহায়েত প্রাচীনদের পন্থায় রচিত (কখনও কখনও প্রকৃতি ও মহাকাশ সম্পর্কিত বিষয়াদির ওপরেও ছিল,আধুনিক মতবাদসমূহ যার ঘোর বিরোধী। উপরন্তু সেগুলোতে যেসব নীতি-পন্থা অনুসরণ করা হয়েছিল,তাও ছিল প্রাচীন ধারার),নচেৎ শুধু মতবাদসমূহের অনুবাদ ও বিবরণসর্বস্ব। অপরদিকে আধুনিক দার্শনিকদের গবেষণায় প্রবেশ ও বের হওয়ার পদ্ধতি প্রাচীন দার্শনিকদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন হওয়া ছাড়াও যেসব বিষয় প্রাচীন দর্শনে বিশেষ করে সাদরুল মুতাআল্লেহীনের দর্শনে প্রধান ভূমিকা রাখত,সেগুলো আধুনিক দর্শনে তাচ্ছিল্যের শিকার হওয়া কিম্বা আদৌ সেগুলোর দিকে ভ্রুক্ষেপ না করার ফলে এ দু’ধারার বই-পৃস্তক পাঠ করে জ্ঞানপিপাসুদের যে লক্ষ্য অর্জিত হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি। তাই আমরা যখন মুসলিম দর্শনের হাজার বছরের গবেষণা অধ্যয়ন করব তখন পাশ্চাত্যের আধুনিক দর্শনের দিকপালদের গবেষণা-কর্মের প্রতিও পুরোপুরি লক্ষ্য রাখব। কিন্তু আমাদের উচিত হবে দর্শনের সীমানাকে সুরক্ষিত রাখা,যেন বিভিন্ন বিজ্ঞানের সাথে এর সংমিশ্রণ না ঘটে। দর্শনের সাথে বিজ্ঞানের সম্পর্ক আছে বটে। কিন্তু প্রকৃত দর্শনে প্রকৃতিবিজ্ঞান ও মহাকাশীয় বিজ্ঞানের সম্পর্ক ছিন্ন করা আবশ্যক। প্রয়োজন হলে আধুনিক বিজ্ঞানের বৈজ্ঞানিক অর্জন থেকে উপকৃত হওয়া বাঞ্ছনীয়।

প্রসঙ্গত,সমসাময়িক কালের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক মরহুম আল্লামা তাবাতাবায়ী (রহ.)-এর অনবদ্য অবদান এবং তাঁর রচিত পাঁচ খণ্ডের দর্শন গ্রন্থ ‘Principles of Philosophy and Method of Realism’ সম্পর্কে আলোকপাত করা প্রয়োজন। আল্লামা তাবাতাবায়ী জীবনের সুদীর্ঘ সময় ধরে দর্শনের ওপর অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা করেন এবং ফারাবী,ইবনে সিনা,শেখ সোহরাওয়ার্দী,সাদরুল মুতাআল্লেহীন প্রমুখের ন্যায় বড় বড় মুসলিম দার্শনিকের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গী ও মতামতসমূহ বিচক্ষণতার সাথে আত্মস্থ করেন। পাশাপাশি ইউরোপের গবেষক দার্শনিকদের চিন্তাধারাকেও ভালভাবে রপ্ত করেন। ইরানের জ্ঞান-নগরী কোমে তিনি ফেকাহ,তাফসীর ইত্যাদি বিষয়ে অধ্যাপনা করা ছাড়াও দর্শন (হিকমত) শাস্ত্রের একক ও অনন্য শিক্ষাগুরুতে পরিণত হন। দর্শনের ওপর এরূপ পাণ্ডিত্য অর্জনের পর তিনি প্রত্যয় গ্রহণ করেন যে,বৃহত্তর কলেবরে একটি দর্শনের গ্রন্থ রচনা করবেন যা একদিকে মুসলিম দর্শনের হাজার বছরের মূল্যবান গবেষণাকে লিপিবদ্ধ করবে,অপরদিকে এতে আধুনিক দর্শনের সকল মতবাদ ও দৃষ্টিভঙ্গীর বিশ্লেষণ থাকবে;আর প্রাথমিক দৃষ্টিতে প্রাচীন আধুনিক দর্শনের মতবাদসমূহের মধ্যে যে বিস্তর পার্থক্য চোখে পড়ে এবং এ দু’টিকে আলাদা ও সম্পর্কহীন শাস্ত্র হিসাবে প্রতিপন্ন করা হয়,তা যেন বিদূরিত হয়ে যায়। পরিশেষে দর্শনের এমন এক রূপ প্রকাশ পায় যা এ যুগের চিন্তাগত চাহিদার সাথে উত্তমভাবে খাপ খায়। বিশেষ করে ঈশ্বরবাদী দর্শনের মূল্য (যার অগ্রপথিকরা ছিলেন মুসলিম পণ্ডিতবর্গ এবং বস্তুবাদী দর্শনের প্রোপাগাণ্ডার ডামাডোলের আড়ালে যে দর্শনের যুগ শেষ হয়ে গেছে বলে প্রচারণা রয়েছে) যেন স্বমহিমায় ফুটে ওঠে।

একদিকে ইউরোপীয় দার্শনিকদের দর্শন-চিন্তা ও মতবাদগুলো ব্যাপকভাবে অনূদিত হয়ে কিম্বা হুবহু মূল রচনাবলি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রকাশিত হওয়া এবং বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষিত যুবকদের সেদিকে ঝুঁকে পড়া (যা প্রকৃতপক্ষে তাদের কৌতুহলী মনোবৃত্তিরই পরিচয় বহন করে),অপরদিকে আধুনিক বস্তুবাদী দর্শনের (Dialectic Materialism) সুসংগঠিত ও বেপরোয়া রাজনৈতিক ও দলীয় প্রচারণা আল্লামাকে স্বীয় প্রত্যয়ে আরও দৃঢ় করে তোলে। প্রথম পদক্ষেপে তিনি সহকর্মী ও নির্বাচিত শিষ্যবৃন্দের সমন্বয়ে একটি ‘Council of Philosophy’ গড়ে তোলেন। আল্লামার নেতৃত্বে এ কাউন্সিল দর্শন চর্চায় যে অভাবনীয় অবদান রাখে তা দর্শনকে ইরানে নতুন এক যুগে প্রবেশ করায়। ইতিপূর্বে দর্শন চর্চাকারীদের জ্ঞানের পরিধি সীমাবদ্ধ ছিল কেবল সাধারণ বই-কিতাবে লিপিবদ্ধ বিষয়াবলির মধ্যে। কিন্তু আল্লামা তাবাতাবায়ীর এ সৃজনশীল উদ্যোগের সুবাদে অচিরেই দর্শন চর্চাকারীদের জ্ঞানের পরিধি সীমানা অতিক্রম করে ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। এখন তাঁরা বস্তুবাদী দর্শনের তত্ত্বগুলো সম্পর্কে অনেক বেশি পরিচিত এবং সেগুলোর দোষত্রুটি সম্পর্কে সম্যক অবগত।

‘Principles of Philosophy and Method of Realism’ গ্রন্থে আল্লামা তাবাতাবায়ী প্রাচীন ও আধুনিক যুগের ঈশ্বরবাদী ও জড়বাদী নির্বিশেষে বহু সংখ্যক দার্শনিকের মতামত ও মতবাদ পর্যালোচনা এবং বিশ্লেষণ করেছেন। তাছাড়া বিশেষ এক কারণেতিনি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের প্রতি কিছু বেশি মনোযোগী হয়েছেন এবং এ মতবাদের সকল ত্রুটি-বিচ্যুতি স্পষ্ট করে দিয়েছেন। প্রাচীনকাল থেকেই ‘আদি কারণ’ কিম্বা সৃষ্টির উদ্দেশ্য থাকা নাকচ করা অথবা আত্মার অমরত্ব ও অজড়ত্বকে নাকচ করা সংক্রান্ত বস্তুবাদী মতবাদ ও ধ্যান-ধারণাসমূহ দর্শনের বই-পুস্তকে উত্থাপিত হয়। কিন্তু যে বিষয়টি সর্বসম্মত,তা হল প্রাচীনদের মধ্যে কখনও অধিবিদ্যাকে সামগ্রিকভাবে অস্বীকার করবে এবং অস্তিত্বকে বলতেই জড়বস্তু অর্থাৎ অস্তিত্ব = জড়বস্তু বলে মনে করবে এহেন কোন বস্তুবাদী মতবাদের উৎপত্তি ঘটেনি। সে সুদূর অতীত,যখন দার্শনিক আলোচনার চর্চা হত,তখন থেকেই অধিবিদ্যা ও প্রাকৃতিক জগতের ঊর্ধ্বে এক পরাপ্রকৃতি জগতের আলোচনা ছিল। তবে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে,এসব আলোচনা প্রথম দিকে খুবই সরল ও সাধারণ স্তরের ছিল। পরবর্তীকালে তা ক্রমান্বয়ে যুক্তি-প্রমাণের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা পায় এবং অধিকতর বিস্তার লাভ করে। প্রাচীন দার্শনিকদের থেকে বর্ণিত ভাষ্য অনুযায়ী দেখা যায়,সর্বপ্রথম যে দার্শনিক আলোচনাগুলো একটি দার্শনিক মতবাদের রূপ লাভ করে তা Hermes কর্তৃক গোড়াপত্তন কৃত। Balinas এর The wise on the causes বই থেকে পাওয়া যায় যে,সে সময়ে দর্শন ‘বস্তুসমূহের কারণ’ নামে আ্যখায়িত হত। এ মতবাদের অনুসারীরা প্রাকৃতিক জগতের অতিবর্তী আরেকটি জগতের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন।

এ সময়ের পরে দর্শনে মাইলেসীয়দের যুগ শুরু হয়। এ যুগে বিভিন্ন রকমের দার্শনিক মতবাদ আত্মপ্রকাশ করে। মূলত এ অধ্যায়কে দর্শনের ‘দ্বিতীয় অধ্যায়’ বলা যায়। প্রাচীন ও আধুনিক ইতিহাসের বর্ণনামতে এবং তাদের মতামত ও বিশ্বাস সম্বলিত দর্শনের বই-পৃস্তক থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী দেখা যায় যে,এ যুগেও প্রকৃতি জগতের অতিবর্তী পরাপ্রাকৃতিক জগতের আলোচনা ছিল। তদ্রুপ,মাইলেসীয়দের সমসাময়িক কিম্বা তারও পরবর্তী যুগের গ্রীকগণ সক্রেটিসের সময় পর্যন্ত এ চর্চা অব্যাহত রাখেন। এ দিকে মাইলেসীয়দের (খ্রিস্টপূর্ব ৬ শতক) সমসাময়িক ভারতীয়ও চীনা দার্শনিকদের থেকে যেসব বর্ণনা পাওয়া যায়,সেটাও প্রায় এরূপই। মোটকথা,প্রাচীনদের মধ্যে এমন কোন নির্দিষ্ট দার্শনিক মতবাদ পাওয়া যাবে না যা পরাপ্রকৃতিকে সামগ্রিকভাবে নাকচ করে থাকবে। আর বেশিরভাগ যুগে বস্তুবাদী তথা প্রকৃতিবাদী হিসাবে যে কতিপয় ব্যক্তির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়,তারা আসলে সংশয়গ্রস্ত ও দিশেহারা লোকজন। তারা দাবি করত যে,ঈশ্বরবাদীদের যুক্তি-প্রমাণতাদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি।

সুতরাং বস্তুবাদী দর্শনের জন্য কোন ইতিহাস দাঁড় করানো যায় না। কেবল অষ্টাদশও ঊনবিংশ শতকে ইউরোপে কতিপয় কারণে একটি শোরগোল পরিদৃষ্ট হয় যা নিজেকে একটি দার্শনিক রূপ দেয় এবং অপরাপর দার্শনিক মতবাদের বিপরীতে অতিকায় দেহাবয়ব নিয়ে জাহির হয়,আর শক্তির প্রকাশ ঘটায়। কিন্তু অচিরেই বিংশ শতাব্দীতে তা পরাভূত হয় এবং স্বীয় জৌলুস ও দাপট হারিয়ে ফেলে। কাজেই,বস্তুবাদী দর্শনের প্রকৃত ইতিহাস শুরু হয় অষ্টাদশ শতক থেকে।

কিন্তু বস্তুবাদীরা প্রাণান্তকর চেষ্টা চালায় তাদের মতবাদকে একটি ঐতিহ্যপূর্ণ ও ইতিহাসসমৃদ্ধ মতবাদ বলে প্রতিষ্ঠা করতে এবং বিশ্বের বড় বড় দার্শনিকদের তাদের মতই বস্তুবাদী ঘরানার বলে প্রতিপন্ন করতে। সর্বোপরি বস্তুগত জ্ঞান-বিজ্ঞানের ঝাণ্ডাবাহী হিসাবে বস্তুবাদী দার্শনিকদেরই অগ্রসারিতে প্রতিষ্ঠিত করতে। এমনকি অ্যারিস্টটল সম্পর্কেও তারা বলতে দ্বিধা করেনি যে,তিনি বস্তুবাদ ও ভাববাদের মধ্যে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। আর কোন কোন লেখনিতে তারা ইবনে সিনাকেও বস্তুবাদী বলে আখ্যায়িত করে থাকে। বস্তুবাদীরা তাদের রচনাবলিতে মাইলেসীয় থেলিস (Thales)থেকে সক্রেটিস পর্যন্ত সকল দার্শনিককে বস্তুবাদী আখ্যা দেয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত জার্মান বস্তুবাদী Buckner ডারউইনের মতবাদের ওপরে যে ব্যাখ্যা লিখেছেন,তার পঞ্চম প্রবন্ধে অ্যানাক্সিম্যান্ডার (Anaximander),অ্যানাক্সিমিনিস (Anaximienes),জেনোফ্যানিস (Xanophanes),হিরাক্লিটাস (Heraclitus),অ্যাম্পিডক্লিস (Empedocles) ও ডেমোক্রিটাস (Democritus) প্রমুখ দার্শনিককে বস্তুবাদী বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হল এ সকল অবিস্মরণীয় দার্শনিক ব্যক্তিত্বের মধ্যে কাউকে পরাপ্রকৃতি অস্বীকারকারী অর্থে যে বস্তুবাদ,সেরূপ বস্তুবাদী বলা যায় না। যদিও এ সকল ব্যক্তিকে দর্শনের ইতিহাসের পরিভাষায় প্রকৃতিবাদী তথা বস্তুবাদী বলে আখ্যায়িত করা হয় (পিথাগোরীয় গণিতবাদীদের বিপরীতে,যাঁরা জগতের মৌলিক দ্রব্য ‘সংখ্যা’ থেকে বলে উদ্ভূত বলে বিশ্বাস করতেন এবং সোফিস্টদের বিপরীতে,যাঁরা external world তথা বহির্জগৎ এর অস্তিত্ব অস্বীকার করতেন) এ হিসাবে যে,তাঁরা প্রকৃতির মৌলিক দ্রব্য একটি ‘পদার্থ’ বলে মনে করতেন। যেমন থেলিস মনে করতেন,জগতের সমুদয় বস্তু পানি থেকে সৃষ্ট। আবার অ্যানাক্সিম্যান্ডারের মতে,পৃথিবীর সমুদয় বস্তু একটি মাত্র মৌলিক দ্রব্য থেকে সৃষ্টি হয়েছে। তবে এ মৌলিক দ্রব্য থেলিসের ‘পানি’ নয়। এ মৌলিক দ্রব্য আমাদের জ্ঞাত অন্য কোন দ্রব্যও নয়। তাঁর মতে,এ মৌলিক দ্রব্য শাশ্বত ও সীমাহীন নয় এবং এ মৌলিক দ্রব্য পৃথিবীর যাবতীয় দ্রব্যের মূলে বিদ্যমান। আর অ্যানাক্সিমিনিসের মতে,মৌলিক দ্রব্য হচ্ছে বায়ু। হিরাক্লিটাসের মতে,আগুন;আর ডেমোক্রিটাসের মতে পরমাণু। এ দার্শনিকবৃন্দ সকলেই প্রকৃতির ঘটনা প্রবাহকে প্রাকৃতিক কারণাবলি দ্বারা ব্যাখ্যা করতেন ঠিকই,কিন্তু এমন কোন প্রমাণ নেই যে, তাঁরা পরাপ্রকৃতিকে অস্বীকার করতেন। প্লেটে ও অ্যারিস্টটল স্ব স্ব লেখনীতে এ সকল ব্যক্তির নাম অনেকবার উল্লেখ করেছেন,কিন্তু কোথাও তাঁদেরকে পরাপ্রকৃতি অস্বীকারকারী বলে আখ্যায়িত করেননি।

বস্তুবাদীরা ও অন্যান্য কতিপয় লেখক যে বিষয়কে তাদের প্রমাণ হিসাবে ব্যবহার করে (যা ইতিপূর্বে উল্লিখিত হয়েছে),তার সাথে পরাপ্রকৃতিকে নাকচ করার কোন সম্পর্ক নেই। আর যদি কথা এমনই হয় যে,যাঁরাই মৌলিক দ্রব্যের কথা বলবেন এবং প্রকৃতির ঘটনাবলিকে প্রাকৃতিক কারণ দ্বারা ব্যাখ্যা করবেন,তাঁদেরকেই বস্তুবাদী বলা হবে,তাহলে সকল ঈশ্বরবাদীকেও বস্তুবাদী বলতে হয় যাঁদের মধ্যে সক্রেটিস,প্লেটে,অ্যারিস্টটল,ফারাবী,ইবনে সিনা,সাদরুল মুতাআল্লেহীন ও ডেকার্টও রয়েছেন। শুধু তা-ই না,নবী-রাসূল ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্বরাও বাদ থাকেন না। অথচ দার্শনিকদের বই-পুস্তকে প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকদের পরাপ্রকৃতি সম্পর্কিত মতামত উল্লিখিত হয়েছে,যা থেকে প্রতীয়মান হয় যে,তাঁরা আনুষ্ঠানিক ভাবে ঈশ্বরবাদী ছিলেন। যেমন ঈশ্বরের ‘জ্ঞান’ বিষয়ক থেলিস ও অ্যানাক্সিমিনিসের বিশ্বাস।

আশ্চর্যের বিষয় হল স্বয়ং Buckner এমন কিছু বর্ণনা করেন যা তাঁর নিজ দাবির পরিপন্থী। যেমন হিরাক্লিটাস সম্পর্কে তিনি বলেন : ‘হিরাক্লিটাসের বিশ্বাস অনুযায়ী মানব আত্মা হল আগুনের শিখা,যা ঐশ্বরিক নিত্যতা থেকে উৎসারিত হয়েছে।’

আর অ্যাম্পিডক্লিস যাঁকে ডারউইনী মতবাদের জনক বলেন এবং স্বীকার করেন যে,তিনিই সর্বপ্রথম evolution and natural selection তত্ত্বকে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা দেন,তাঁর সম্পর্কে বলেন : ‘তিনি আত্মার বিচ্ছিন্নতায় বিশ্বাস করতেন এবং একে একটি আধ্যাত্মিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যজনিত বলে মনে করতেন,যে লক্ষ্যে আত্মা আরাম,আসক্তি ও প্রেমের প্রাথমিক অবস্থায় প্রত্যাবর্তন করে।’

তবে এখানে যে কথাটি বলা যেতে পারে সেটা হল এই যে,সক্রেটিসের আগের দার্শনিকরা অধিকাংশই পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ঈশ্বর সম্পর্কে এক ধরনের অংশীবাদী বিশ্বাস পোষণ করতেন। Buckner হিরাক্লিটাস সম্পর্কে এক বর্ণনায় বলেন: ‘জগতের মূল হল আগুন,যা কখনও শিখাময় হয়,আবার কখনও নিভু নিভু হয়ে আসে। আর এটা হল একটি খেলা মাত্র,যা Jupiter সর্বদা নিজে নিজে খেলে থাকেন।’ অবশ্য এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে,এ সকল দার্শনিকের কথা রহস্য ও সংকেতমুক্ত নয়। তাই এটাই তাঁর আসল উদ্দেশ্য বলে ধরা যায় না। সাদরুল মুতাআল্লেহীন তাঁর আসফার গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে থেলিস,অ্যানাক্সিমিনিস,অ্যানাক্সগোরাস,অ্যাম্পিডক্লিস,প্লেটো,ডেমোক্রিটাস,অ্যাপিকিওর প্রমুখের নিকট থেকে বর্ণনা উল্লেখ করেছেন এবং দাবি করেছেন যে,পূর্ববর্তী দার্শনিকদের এসব কথা রহস্যপূর্ণ ও সংকেতময় ছিল,কিন্তু বর্ণনাকারীরা তাঁদের সে আসল উদ্দেশ্য উপলব্ধি করতে পারেননি। অতঃপর সাদরুল মুতাআল্লেহীন তাঁদের সেসব বক্তব্যকে স্বীয় দাবি অনুযায়ী ‘substancial motion’ ও ‘জগতের সৃষ্টি’ অর্থে ব্যাখ্যা করেছেন।

প্রাচীন ও তৎপরবর্তী যুগের কোন কোন দার্শনিককে বস্তুবাদী প্রতিপন্ন করার স্বপক্ষে যেসব যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপন করা হয় সেগুলো এমন সব বিষয়,যা এ বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত নয়। যেমন মৌলিক দ্রব্য ও মূল উপাদানে বিশ্বাস করা,প্রকৃতির ঘটনাবলিকে প্রাকৃতিক কারণ দ্বারা ব্যাখ্যা করা,জাগতিক নিয়মকে একটি অপরিহার্যও অবশ্যম্ভাবী নিয়ম মনে করা,অনস্তিত্ব থেকে কোন কিছু অস্তিত্ব লাভ করতে পারেনা বলে মনে করা,কিম্বা প্রকৃতির বিষয়াবলি অনুসন্ধানে প্রায়োগিক যুক্তিবিদ্যার প্রতি গুরত্বারোপ ইত্যাদি।

ঐশ্বরিক বিষয়াদিতে গভীরতা না থাকার কারণে বস্তুবাদীরা মনে করে থাকে যে,উপরিউক্ত বিষয়গুলো প্রকৃতি জগতের অতিবর্তী এক পরাপ্রকৃতির প্রতি বিশ্বাসের পরিপন্থী। আর এ কারণে যে কেউ এ বিষয়গুলোর কোন একটির প্রবক্তা ও বিশ্বাসী হয়েছেন,তাঁকেই বস্তুবাদী বলে চিহ্নিত করেছে। যদিও উক্ত ব্যক্তি স্বয়ং এর বিপরীতে তাঁর অবস্থান স্পষ্টভাবে ঘোষণা করছেন,তদুপরি বস্তুবাদীরা তাঁকে ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। অবশ্য বস্তুবাদী নন এমন কিছু সংখ্যক দর্শনের ইতিহাস লেখক এবং encyclopedia-র লেখকও একই ভুল করেছেন।

কেবল যে জিনিসটি সর্বসম্মত তা হল,প্রাচীনদের মধ্যে কেউ কেউ আত্মার অশরীরত্ব ও মৃত্যুর পরে আত্মার অমরত্বকে অস্বীকার করেছেন। ডেমোক্রিটাস,অ্যাপিকিওর এবং তাঁদের অনুসারীরা এ বিশ্বাসে বিশ্বাসী বলে মনে করা হয়। খ্রিস্টিয় ষোড়শ শতক থেকে ইউরোপেও ‘মৃত্যুর পরে আত্মার অমর না থাকা’ মতবাদের কিছু সংখ্যক অনুসারী পাওয়া যায়। বলা হয় যে,প্রথমবার ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দে অ্যারিস্টটলের মতবাদকে খণ্ডন করে Petros Bombonatius ‘আত্মার অশরীরত্ব’ বিষয়ে একটি বই লেখেন। ক্রমান্বয়ে এ মত প্রচারিত হয় এবং কিছু সংখ্যক অনুসারী গড়ে ওঠে। এ বিষয়ে কিছু লেখালেখিও প্রকাশিত হয়। আর Buckner তাঁর গ্রন্থের ষষ্ঠ প্রবন্ধে যা লিখেছেন,সে অনুযায়ী Bombonatius নিজেই খ্রিস্টিয় শিক্ষার কট্টর অনুসারী ছিলেন এবং তা সমর্থন করতেন। তিনি বলেন,সতের শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সকলেই এরূপ ছিলেন। আর তাঁদের অন্তরের গভীরে নিহিত বিশ্বাসই হয়ত এর কারণ ছিল।

Buckner এর বর্ণনা অনুযায়ী কেবল আঠারো শতকেই কতিপয় দার্শনিক আনুষ্ঠানিকভাবে ঈশ্বরকে অস্বীকার করেন। Baron d’Holbach ১৭৭০ সালে The system of Nature গ্রন্থটি লেখেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও ধর্মকে অস্বীকার করেন। আঠারো দশকে একদল লেখক একটি encyclopedia রচনায় লিপ্তহন। এদের মধ্যে বড় বড় কয়েকজন,যেমন Holbach, Didero এবং Dalamber প্রমুখ বস্তুবাদী ছিলেন। তবে Dalamber এর অবস্থানটা ছিল অধিকতর দ্বিধাগ্রস্ত ও দিশেহারার মত। Buckner বলেন : ‘Dalamber একাধিকবার স্পষ্টভাবে বলেছেন যে,পরাপ্রকৃতি সম্পর্কিত বিষয়াবলিতে ‘জানি না’ উত্তরটাই উৎকৃষ্ট উপায়।’ Didero থেকেও বর্ণিত আছে যে,শেষাবধি তিনিও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যেই ছিলেন।

উনিশ শতকে বস্তুবাদী দর্শন আরও বেশি সমর্থক খুঁজে পায়। আর এর শেষার্ধ্বে(১৮৫৯ খ্রি.) ডারউইনী বিবর্তনবাদ প্রচারিত হয়। বস্তুবাদীরা এ বিবর্তনবাদকে তাদের বস্তুবাদী দর্শনের প্রসারের জন্য মোক্ষম হাতিয়ার হিসাবে লুফে নেয়। ডারউইন বস্তুবাদী ছিলেন না। তিনি কেবল Biological দৃষ্টিকোণ থেকেই তাঁর মত উপস্থাপন করেন। কিন্তু তাঁর সময়ের বস্তুবাদীরা এ মতবাদকে তাদের বস্তুবাদী দর্শনের স্বার্থে ব্যবহার করে। ড. শিবলী শুমাইল একজন বিখ্যাত Materialist,তিনিই প্রথম ডারউইনের মতবাদকে আরবি ভাষায় অনুবাদ করেন। অতঃপর এর সাথে আরও কিছু অধ্যায় যোগ করে ‘ফালসাফাতুল নুশু ওয়াল ইরতিকা’ (উৎপত্তি ও বিবর্তনের দর্শন) শিরোনামে মূদ্রণ ও প্রকাশ করেন। বইয়ের ভূমিকায় তিনি স্বীকার করেন যে,ডারউইন কেবল বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে (দার্শনিক নয়) বিবর্তন মতবাদকে (যা শুধু প্রাণীকুলের জন্য স্বতন্ত্র) ব্যাখ্যা করেন। অতঃপর একদল বস্তুবাদী দার্শনিক,যেমন Haksil, Buckner প্রমুখ একে জড়বাদী ও বস্তুবাদী দর্শনের সনদ হিসাবে গ্রহণ করেন। এ বইয়ের ১৬ পৃষ্ঠায় তিনি বলেন : ‘এর চেয়েও আশ্চর্যজনক হল যে,ডারউইন এ মতবাদের মূল প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন,কিন্তু এর থেকে যত ফলাফল গ্রহণ করা উচিত ছিল তিনি তা করেননি।’

Buckner এর ব্যাখ্যার প্রথম নিবন্ধে (আরবি অনুবাদ) স্বয়ং ডারউইনের এ উক্তিটি উল্লেখ করা হয়েছে : ‘এ পর্যন্ত যা কিছু আমার কাছে উদ্ঘাটিত হয়েছে সে অনুযায়ী পৃথিবী পৃষ্ঠে যত প্রাণীই সৃষ্টি হয়েছে তা সবই একটি মূল থেকে উৎসারিত। আর পৃথিবী পৃষ্ঠে সর্বপ্রথম যে জীবিত প্রাণী সৃষ্টি হয়,স্রষ্টা তার মধ্যে প্রাণ (আত্মা) ফুঁকে দেন।’

ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধ্বে ডারউইনবাদের ধারা দর্শনের বাজার সরগরম করে তুলেছিল। এছাড়াও আরেকটি বিশেষ ধারা উৎপত্তি লাভ করে বস্তুবাদকে নতুন একরূপ দান করে। ফলে নতুন এক মতবাদের জন্ম হয় যা Dialectic Materialism বা‘দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ’ নামে পরিচিত। এ মতবাদের দু’জন বিখ্যাত প্রবক্তা কার্ল মার্কস(১৮১৮-১৮৮৩) ও ফ্রেডরিক অ্যাঙ্গেলস (১৮২০-১৮৯৫),যাঁরা অন্যসব কিছুর চাইতে বেশি বিপ্লবী চিন্তা-চেতনা ও উগ্র সামাজিক ভাবাবেগের অধিকারী ছিলেন। এ মতবাদের একটি পরিচয় হল এই যে,এটি বিশেষ Dialectical logoc অনুসরণ করে থাকে। এ মতবাদের আসল প্রতিষ্ঠাতা কার্ল মার্কস অল্প কিছুদিনের জন্য বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক হেগেল-এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং তাঁর কাছ থেকেই দ্বান্দ্বিক যুক্তিবিদ্যা শিক্ষা নেন। হেগেল দার্শনিক চিন্তায় বস্তুবাদী ছিলেন না। কিন্তু কার্লমার্কস বস্তুবাদী দর্শনকেই পছন্দ করলেন এবং সেটা তাঁর শিক্ষকের কাছ থেকে শেখা Dialectical logoc এর ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। আর এ থেকেই Dialectic Materialism বা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ জন্ম নেয়।

এ মতবাদের আরেকটি পরিচয় হল এ পর্যন্ত বিশ্বে আবির্ভূত হওয়া অপরাপর দার্শনিক স্টিস্টেমগুলোর বিপরীতে এর জন্ম,লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য দার্শনিক বিষয়াবলির গবেষণা নয়;বরং মূল লক্ষ্য হল সামাজিক,রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশেষ মতাদর্শ ও চিন্তাধারাসমূহের ভিত্তিমূল ও প্রেক্ষিতসমূহ খুঁজে বের করা। এ মতবাদের ঝাণ্ডাধারীরা অন্যান্য দার্শনিক ও চিন্তাবিদের ন্যায় স্বীয় আয়ুষ্কালকে বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক গুঢ় রহস্যাবলি ভেদ করার লক্ষ্যে গবেষণা ও অনুসন্ধানে নিয়োগ করার পরিবর্তে রাজনৈতিক দল গঠন ও রাজনৈতিক সংগ্রাম করে কাটিয়েছেন।

১৯৪৬ সালে ইরানে প্রকাশিত এ মতবাদের পত্রিকা Internationalist এ লেখা হয়যে,কার্ল মার্কস ২৪ বছর বয়সে যখন তাঁর পিএইচডি’র থিসিস সমাপ্ত করেন,তখন রাজনৈতিক সংগ্রামে অবতীর্ণ হন এবং ৩১ বছর বয়সে প্যারিস থেকে নির্বাসিত হয়ে লণ্ডনে পাড়ি জমান। তিনি অনবরত সংগ্রাম,টানাপড়েন ও বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হন এবং নির্বাসিত জীবন কাটান। কখনও জার্মানীতে,কখনও ব্রুকসেল-এ অবস্থান করেন। আর এসব টানাপড়েনের মধ্যে কম্যুনিস্ট সংঘের পক্ষ থেকে ব্রুকসেল-একম্যুনিস্ট পার্টির মেনুফেস্টো প্রণয়ন করার দায়িত্ব লাভ করেন। এ সূত্রে তিনি Menifesto পুস্তকটি রচনা করেন। লেনিনের ভাষায় যা ছিল Historical materialism ও Dialectical materialism এর প্রকাশ এবং মার্কসীয় মতবাদের শ্রেণীগত সংগ্রাম তত্ত্ব,আর সামাজিক ও অর্থনৈতিক শিক্ষাসমূহের সনদ।

মার্কস ১৮৫১ সাল থেকে লণ্ডনে সামাজিক সংগ্রামে ব্যস্ত থাকার পাশাপাশি নিজের অবসরকে Capital পুস্তকটি রচনায় ব্যাপৃত করেন,যা ছিল political economy এর ওপরে একটি মার্কসীয় তত্ত্ব আর উক্ত পত্রিকার লেখনী অনুযায়ী অ্যাঙ্গেলস ১৮ বছর বয়সে স্কুল ত্যাগ করেন এবং ২১ বছর বয়সে বার্লিনে পাড়ি জমান। সেখানে তিনি সেনাবাহিনীতে নাম লেখান এবং সরকারী কর্তব্য পালনের পাশাপাশি বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের কনফারেন্সসমূহে অংশগ্রহণ করেন। তিনি উকাত শহরে হেগেলীয় মতবাদের বামপন্থীদের সাথে যোগাযোগ করেন এবং ২৪ বছর বয়সে প্রথমবারের মত মার্কসের সাথে তাঁর দেখা হয়। সেখান থেকেই তাঁদের জোটবদ্ধ সংগ্রাম শুরু হয়।

এ ঘটনার পর বস্তুবাদী দর্শনের প্রসার রাজনৈতিক দলের অভিলাষ পূরণের অনুবর্তী হয়ে পড়ে। আর কম্যুনিস্ট পার্টি যে পরিসরে বিশ্বে বিস্তার লাভ Dialectical materialism নামের এ নতুন মতবাদকে সেই পরিসরে সাথে করে নিয়ে যায়। এ কারণে বিগত বছরগুলোতে যেসব দেশে কম্যুনিজমের পদচারণা রয়েছে,সেসব দেশে Dialectical materialism শিরোনামে অনেক প্রবন্ধ ও রচনা প্রকাশিত হয়েছে। এসব প্রকাশনা রাজনৈতিক দলের সাথে সংযুক্ত হওয়ার কারণে একটি দলীয় মুখপাত্র হিসাবে প্রচার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে,কোন বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক প্রকাশনা হিসাবে নয়। দলীয় পত্রিকায় মূল লক্ষ্য থাকে রাজনৈতিক পথকে নিষ্কণ্টক করা এবং সকল প্রতিবন্ধক অপসারণ করা,আর তা করতে যে কোন উপকরণ বা মাধ্যম ব্যবহার করাকে বৈধ গণ্য করে থাকে (কেননা,দলীয় মূলনীতি অনুসারে ‘লক্ষ্য মাধ্যমকে বৈধ করে দেয়’)। দলীয় মূলনীতি কখনও সত্যকে ‘ঠিক যেভাবে বিদ্যমান’ সেভাবেই প্রতিফলিত করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ নয়;বরং এ ব্যাপারে অঙ্গীকারাবদ্ধ যে,সত্যকে সেভাবেই প্রতিফলিত করতে হবে যাতে লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়। কিন্তু বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক রচনাবলিতে যেহেতু সাধারণত মূল উদ্দেশ্য থাকে সত্য অনুসন্ধানের সহজাত প্রবৃত্তি বা আকাঙ্ক্ষাকে পরিতুষ্ট করা,কাজেই উপরিউক্ত পন্থা পরিহার করা হয়।

নতুন শতাব্দীর বস্তুবাদীদের সামগ্রিকভাবে এ প্রতীতি জন্মেছে যে,ব্যবহারিক ও ফলিত বিজ্ঞান বস্তুবাদের অনুকূলেই এগিয়ে চলেছে। কিন্তু Dialectical materialism এর পক্ষাবলম্বীরা এমন বাড়াবাড়ির পথ বেছে নেয় যে,বস্তুবাদকে বিজ্ঞানের প্রত্যক্ষ জাতক এবং অপরিহার্য ও অবশ্যম্ভাবী ফল বলে মনে করে। এমনকি যে সকল বৈজ্ঞানিক এসব বিজ্ঞানের জনক ছিলেন তাঁরা কেন বস্তুবাদী ছিলেন না- এ নিয়ে তারা বিস্ময় প্রকাশ করে।

এ মতবাদের পক্ষাবলম্বনকারীরা স্পষ্টতই দাবি করে যে,হয় ঐশ্বরিক প্রজ্ঞার অনুসারী হতে হবে,ঈশ্বরের অস্তিত্বকে মানতে হবে এবং সকল বিজ্ঞান,শিল্প ও আবিষ্কারকে অস্বীকার করতে হবে,নয়ত এগুলোকে গ্রহণ করতে হবে- ঐশ্বরিক প্রজ্ঞার ওপর পদাঘাত করতে হবে!

ন্যূনতম যে উপকার একজন পাঠকের জন্য এ প্রবন্ধ পড়ে অর্জন হতে পারে তা হল,তিনি খুব ভালভাবে অনুধাবন করতে পারবেন যে,দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের সমর্থকদের দাবির পরও বিজ্ঞানের সাথে বস্তুবাদের কোন সম্পর্ক নেই এবং এর সবগুলো মূলনীতিই (principles) হল এক ধরনের বিকৃতি ও ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত যা কিছুসংখ্যক লোক নিজস্ব রুচি থেকে গ্রহণ করেছে। এ সকল লোক তাদের প্রপাগাণ্ডায় যেসব প্রমাণ উপস্থাপন করে,সেগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণটি হল এই যে,নতুন শতাব্দীতে ব্যবহারিক ও ইন্দ্রিয়নির্ভর বিজ্ঞানের উৎপত্তির সাথে সাথে ইউরোপের বস্তুবাদী দর্শনও জমে ওঠে। কিন্তু আসল ব্যাপার হচ্ছে,সাম্প্রতিক কালে ইউরোপে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটেছে চিন্তা-চেতনার ওপরে যে কঠিন ধাক্কা দেওয়া হয়েছে এবং মহাজগৎ ও প্রকৃতি সম্পর্কিত মানুষের হাজার বছরের প্রতিষ্ঠিত ধ্যান-ধারণাগুলোকে বাতিল করে দিয়ে চিন্তার মধ্যে যে বিস্ময়কর আতঙ্ক,উৎকণ্ঠা আর বিভেদ সৃষ্টি করা হয়েছে তার প্রভাবে। যদিও এসব উত্থান-পতন সংঘটিত হয় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কিম্বা অনুমাননির্ভর বিষয়াবলির ক্ষেত্রে,কিন্তু অনিবার্যভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক ও তাত্ত্বিক বিষয়াবলি এবং একইভাবে ধর্মীয় বিষয়াবলিকেও সংশয় ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সম্মুখীন করে। আর এরই ফলে ইউরোপে জন্ম নেয় ভিন্ন ভিন্ন ও পরস্পর বিরোধী দার্শনিক মতবাদ। প্রতিটি মতবাদই এক একটি পথ অবলম্বন করে। যেমন একদল বস্তুবাদী হয়েছে,তদ্রুপ সোফিজমও দীর্ঘ দু’হাজার বছর ধরে নিষ্প্রভ থাকার পর পুনরায় দ্বিগুণ বেগে প্রচলন লাভ করেছে। তাই আধুনিক বিজ্ঞানের অভ্যুদয়ের সময়কালে উৎপত্তি হওয়া মতবাদগুলোকেও যদি এ বিজ্ঞানের সাথে সাথে সঠিক ও যৌক্তিক সংযোগের প্রমাণ বলে ধরা হয়,তাহলে সোফিজম ও ভাববাদকে ও আধুনিকবিজ্ঞানের সরাসরি ফল ও তারই অবিচ্ছেদ্য গুণ বলতে হবে।

তবে ইউরোপে বিভিন্ন মতবাদ জন্ম নেওয়ার পেছনে আরেকটি কারণ রয়েছে। সেটাহল একটি শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ বুদ্ধিবৃত্তিক দর্শন বিদ্যমান না থাকা,যা বিজ্ঞানের সাথে সঙ্গতিশীল হতে পারে। বিশেষ করে ‘ঐশ্বরিক প্রজ্ঞা’ (হেকমতে এলাহী)-এর নামে তৎকালীন ইউরোপে বিদ্যমান একশ্রেণীর ফালতু আকীদা-বিশ্বাসই অন্য সবকিছুর চেয়ে বেশি বস্তুবাদীদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। আমরা যদি বই-পুস্তক খুলে দেখি তাহলে লক্ষ্য করব যে,এরা কোন্ শ্রেণীর বিশ্বাসকে কঠিন আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে থাকে। এমনকি ইউরোপের একদল আধুনিক বিজ্ঞানী যাঁরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন,তাঁরাও উক্ত ঐশ্বরিক প্রজ্ঞার বিষয়বস্তু নিয়ে অনুযোগ করেছেন।

বিখ্যাত ঈশ্বরবাদী জ্যোতির্বিদ Flammarion তাঁর God in Nature বইতে লিখেছেন:‘সূক্ষ্মবিচারী ও সত্যদর্শী আজ মানবের চিন্তাশীল সমাজে দু’টি ভিন্ন ধরনের প্রবণতা অবলোকন করতে পারে যারা প্রত্যেকেই একদল লোককে নিজেদের প্রতি আকৃষ্ট করেছে এবং তাদের ওপরে জেঁকে বসেছে। একদিক থেকে রসায়ন বিদ্যার বিজ্ঞানীরা তাঁদের পরীক্ষাগারে রাসায়নিক উপাদানসমূহের ক্রিয়া-বিক্রিয়া ও আধুনিক বিজ্ঞানের জড় অংশ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন এবং পদার্থের যৌগ গঠনকারী উপাদানসমূহকে উদ্ঘাটন করে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন যে,রাসায়নিক বিক্রিয়া থেকে উদ্ঘাটিত এসব যৌগে কখনই ঈশ্বরের উপস্থিতি বা অস্তিত্ব প্রত্যক্ষণ ও ইন্দ্রিয়ানুভব করা যায়না। অপরদিকে,ঈশ্বরবাদী হাকিম তথা দার্শনিকরা ধুলোর আস্তরণে ঢাকা পড়া পুরাতন গ্রন্থ ও পাণ্ডুলিপির স্তুপের মধ্যে বসে কৌতুহল ও আগ্রহ সহকারে সেসব গ্রন্থের বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা,গবেষণা,অনুবাদ,কপি সংগ্রহ এবং এক শ্রেণীর ধর্মীয় আয়াত ও ভিন্ন ভিন্ন হাদীসের বিশ্লেষণ ও বর্ণনায় মত্ত থেকেছেন। আর স্বীয় বিশ্বাস অনুযায়ী রাফাঈল ফেরেশতার কণ্ঠের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে ঘোষণা দিয়েছেন যে,চিরন্তন জনকের ডান চোখের মণি থেকে বাম চোখের মণির মাঝে ব্যবধান ছয় হাজার ফারসাখ।’

টমাস অ্যাকুনাস-এর Summa Contra Gentiles গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে,এর কিছু অংশে ‘কয়েকজন ফেরেশতা কি সূঁচের অগ্রভাগে একত্রে অবস্থান করতে পারে?’ শিরোনামে আলোচনা রয়েছে।২

ডক্টর শিবলী শুমাইল ‘মাজমুআতু ফালাসাফাতুন নুশু ওয়াল ইরতিকা’ নামক গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে ‘আল-কুরআন ওয়াল ইমরান’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধের মধ্যে লিখেছেন : ‘দর্শন মুসলমানদের মাঝে তার প্রথম আন্দোলনেই উচ্চতর মাত্রায় উৎকর্ষ লাভ করে। কিন্তু খ্রিস্টানদের মাঝে প্রথম সাক্ষাতেই ধ্বংস ও বিলীন হয়ে যায় এবং তার গোটা আলোচ্য বিষয় নিষিদ্ধ হয়ে যায়।’৩

আধুনিক যুগে ডেকার্ট ও তাঁর অনুসারীদের মত কতিপয় বড় বড় ঈশ্বরবাদী দার্শনিকের আবির্ভাব ঘটেছে,কিন্তু এ সকল দার্শনিকও একটি শক্তিশালী ও সন্তোষজনক ঈশ্বরবাদী দর্শন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হননি।

নিঃসন্দেহে ঈশ্বরবাদী দর্শন যদি মুসলমানদের মাঝে যেভাবে উৎকর্ষ লাভ করেছে,ইউরোপেও সেভাবে উৎকর্ষ লাভ করত,তাহলে এতসব বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন দর্শনের উৎপত্তি ঘটত না। তদ্রুপ সংশয়বাদীদের (sceptic) জন্য অলীক কল্পনার জাল বোনা কিম্বা বস্তুবাদীদের এত অহঙ্কারী আত্মপ্রচারেরও সুযোগ মিলত না। সর্বোপরি,না ভাববাদের জন্ম হত,আর না বস্তুবাদের।

তথ্যসূত্র :

১. বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

২. সেন্ট টমাস অ্যাকুনাস ছিলেন মধ্যযুগীয় ইউরোপের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক এবং স্কলাস্টিক দর্শনের পুরোধা। তাঁর গ্রন্থাবলি প্রায় চারশ’ বছর যাবৎ ইউরোপের বিজ্ঞান ও ধর্মীয় শিক্ষা কেন্দ্রসমূহে আনুষ্ঠানিক দর্শনের পাঠ্য ছিল।

৩. কেবল Christian divinity এর অধ্যায় বাদে।

 

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

কোরআন বিকৃতি মুক্ত
আদাবুস সুলূক (আধ্যাত্মিক পথ ...
মুহাম্মাদের (সা.) সঙ্গে মুবাহিলা ...
একটি শিক্ষণীয় গল্প :হালুয়ার মূল্য
মহানবী (সাঃ)-এর আহলে বাইতকে ...
বেহেশতের নারীদের নেত্রী- সব যুগের ...
তাওহীদের মর্মবাণী-১ম কিস্তি
হাসনাইন (ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন) ...
খেলাফত তথা রাসূল (সা.)-এর ...
নবী (সা.) কিভাবে উম্মী ছিলেন বা কেন ...

 
user comment