ইমাম হোসাইনের বীরত্বের প্রভারশ্মি সবচেয়ে বেশি যার উপর প্রতিফলিত হয়েছিল তিনি হলেন তার সুযোগ্য বোন হযরত যয়নাব। হযরত যয়নাব বিশ্বজননী হযরত ফাতেমার কোলে বড় হন। প্রথম থেকেই তিনি একজন মহতী নারী ছিলেন। তারপরও কারবালার পরের যয়নাবের সাথে কারবালার আগের যয়নাবের ঢের তফাত পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ কারবালার পর হযরত যয়নাব (আঃ) আরও বেশী ব্যক্তিত্বসম্পন্নও মহতী হয়ে ওঠেন।
আশুরার রাতের দুর্বিষহ অবস্থা দেখে হযরত যয়নাব দু’ একবার কেঁদেও ফেলেন। একবার ইমাম হোসাইনের (আঃ) কোলে মাথা রেখে তিনি এতোই কাঁদলেন যে,বেহুশ প্রায় হয়ে পড়েন। ইমাম হোসাইনের (আঃ) বিভিন্ন ভাবে তাকে শান্ত করেন। তারপর বলেন,
‘‘বোন আমার! শয়তান যেন তোমার ধৈর্যচ্যুতি না ঘটায়।’’ (এ’ লামুল ওরাঃ ২৩৬, ইরশাদে মুফীদঃ ২৩২ বিহারুল আনওয়ারঃ ৪৫/২)
তিনি হযরত যয়নাবকে (আঃ) বলেনঃ আমাদের নানাইতো এপথ দেখিয়ে গেছেন। বাবা-মা-ভাই সবাইতো এপথে শাহাদাত বরণ করেছেন। এতে তো গৌরব ছাড়া কাঁদার কিছুই নেই।
হযরত যয়নাব (আঃ) নিজেকে কিছুটা সংযত করে বলেনঃ‘ আমি কোনো কষ্টের জন্যে কাঁদছি না। আমার দুঃখ হলো এ কারণে যে,নানাকে হারিয়েছি,বাবাকে হারিয়েছি,মাকে হারিয়েছি,বড় ভাই হাসানকে (আঃ) হারিয়েছি। তারপরও এতদিন আপনার দিকে চেয়ে আমি সব দুঃখ ভুলেছিলাম। কিন্তু আজ আপনাকেও হারাতে হবে তাই আমার কষ্ট হচ্ছে ।
অথচ কারবালার ঘটনার পরমুহূর্ত থেকে হযরত যয়নাব আর আগের যয়নাব রইলেন না। ইমাম হোসাইনের শৌয-বীর্য এবং ধৈর্য দেখে তিনি এমন মানসিকতা অর্জন করলেন যে,যতবড় ব্যক্তিত্বই হোক না কেন,যয়নাবের (আঃ) সামনে সে তুচ্ছ । ইমাম যয়নুল আবেদীন (আঃ) বলেনঃ আমরা বারজন ছিলাম। সবাইকে এক শিকলে বেঁধে শিকলের একমাথা আমার বাহুতে এবং অন্য মাথা আমার ফুফুর বাহুতে বেঁধে দেয়া হয়।
বলা হয় যে,নবী পরিবারকে ২রা সফর তারিখে বন্দী অবস্থায় সিরিয়ায় নিয়ে আসা হয়। এ হিসাব অনুযায়ী কারবালার ঘটনা থেকে যখন বাইশদিন অতিক্রান্ত হয়ে গেছে তখন বন্দীদেরকে ইয়াযিদের সবুজ প্রাসাদে নেয়া হল। সবুজ প্রাসাদ মুয়াবিয়ার তৈরী।
এই প্রাসাদ ঝলমলে,রাজকীয় সাজে সজ্জিত,আয়া-খানসামাদের ভিড় প্রভৃতিতে ভরা ছিল এবং কেউ এর মধ্যে ঢ়ুকলে হতবাক হয়ে পড়তো। বলা হয় যে,সাত সাতটা বড় বড় হল ঘর পার হলে তারপর ইয়াযিদের মনিমাণিক্য খচিত দরবারে আসা যেত। সেখানে ইয়াযিদ দাস-দাসী,উযির -নাযির সবাইকে নিয়ে বসে আছে। এমনি অবস্থায় বন্দী নবী পরিবারকে দরবারে আনা হল। কিন্তু হযরত যয়নাব (আঃ) এত দুঃখ-কষ্ট সহ্য করার পরও ইয়াযিদের দরবারে এমন সাহসী ভূমিকা নিলেন যে,সমস্ত দরবার কেঁপে উঠলো এবং উপস্থিত সভাসদরা হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো। এমন কি বাকপটু ইয়াযিদও সম্পূর্ণ নিশ্চুপ হয়ে গেল। ইয়াযিদ প্রথমে গর্বভরে তার বিজয় উল্লাস করছিল। সাথে সাথে হযরত যয়নাব (আঃ) বাঘের মতো গর্জে উঠে বললেনঃ
‘হে ইয়াযিদ খুব যে ফুর্তি করছো! আমাদেরকে এই হালে ফেলে ও নিজের হাতের মুঠোয় পেয়ে বোধ হয় মনে করছো যে,পৃথিবীর সব কিছু থেকে আমাদের বঞ্চিত করে আল্লাহর পক্ষ থেকে এক নেয়ামত লাভ করেছ। আল্লাহর শপথ করে বলছি যে,আমার দৃষ্টিতে তোমার মতো কাপুরুষ আর কেউ নেই। আমার দৃষ্টিতে তোমার এক কানাকিড়ও মূল্য নেই।’ (আল লুহুফঃ ৭৬, মাকতালুল মোকাররামঃ ৪৬২ বিহারুল আনওয়ারঃ ৪৫/১৩৩)
একবার লক্ষ্য করুন যে,কেবল ঈমান ও ব্যক্তিত্ব ছাড়া সবকিছু হারিয়েছেন এবং বর্তমানে বন্দী অবস্থায় সবচেয়ে জঘন্য লোকের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন-এরকম একজন মহিলার কাছ থেকে কী আশা করা যেতে পারে? কিন্তু দেখুন হযরত যয়নাব (আঃ) এমন ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন যে,অতি শীঘ্রই শামে বিপ্লবের ঘনঘটা শুরু হয়।
ঐ দরবারে বসেই ইয়াযিদ তার কৌশল বদলাতে বাধ্য হয়। বন্দীদেরকে সসম্মানে মদীনায় পাঠানোর ব্যবস্থা করে। তারপর নিজে অনুতাপ প্রকাশ করে ও ইবনে যিয়াদকে অভিসম্পাত করে বলে আমি ওকে এ কাজ করতে আদেশ দেইনি। সে নিজেই একাজ করেছে। এই বিপ্লব কে ঘটালেন? ইসলামের মহীয়সী নারী হযরত যয়নাবই (আঃ) এরকম বিপ্লবের ভিত্তি রচনা করে যান। তারপর তার বক্তব্যের শেষাংশে যে ইয়াজিদকে হাজার হাজার মানুষ জাঁহাপনা বলে ডাকতো সেই ইয়াজিদকে ব্যঙ্গ করে হযরত যয়নাব বললেনঃ
‘‘হে ইয়াযিদ! তোমাদের যে জল্পনা-কল্পনা আর ষড়যন্ত্র আছে সবই করো। তবে জেনে রেখো যে আমাদের স্মরণকে মানুষের অন্তর থেকে কোনিদন মুছে ফলেতে পারবে না। আমাদের এ বাণী চিরন্তন। আর যারা নিশ্চিহ্ন হবে সে হলো তুমি এবং তোমার চাটুকাররা’’ (আল লুহুফঃ ৭৭, বিহারুল আনওয়ারঃ ৪৫/২৩৫)
একথা শুনে ইয়াজিদ প্রথম চুপ রইলো তারপর পাপিষ্ট ইয়াযিদ ভিতরে জ্বলে উঠলো এবং হযরত যয়নাবকে (আঃ) আরও কষ্ট দেয়ার জন্যে তার হাতের লাঠি দিয়ে ইমাম হোসাইনের (আঃ) ছিন্ন মস্তকে খোঁচা মারলো।
লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লাবিল্লাহিল আলিয়িল আযিম।