আবনা ডেস্ক: যে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত প্রতিরোধ রচনা করে ভাষার অধিকার ছিনিয়ে নিতে হয়েছিল বাংলা ভাষাভাষী মানুষকে, বিশ্বের অন্যান্য স্থানের মতো সেই পাকিস্তানেও লেগেছে একুশে ফেব্রুয়ারির উত্তাপ। যথাযথ মর্যাদায় সেখানে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। মাতৃভাষার গুরুত্ব তুলে ধরতে সেখানে অনুষ্ঠিত হয়েছে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এবং সাহিত্য উৎসব। ভাষা কমিশন সৃষ্টির মধ্য দিয়ে প্রাদেশিক বিভিন্ন ভাষা সংরক্ষণের দাবি উঠেছে সংসদে। পাশাপাশি সব প্রধান প্রধান প্রাদেশিক ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করবার দাবি তুলেছেন সে দেশের লেকক-বুদ্ধিজীবী-শিল্পীরা। পাকিস্তানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডন নিউজ, এক্সপ্রেস ট্রিবিউন এবং দ্য নিউজ.কম-এর খবর থেকে এসব কথা জানা গেছে।
উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালের নভেম্বরে ইউনেস্কোর সাধারণ সভায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে প্রতিবছর ভাষাবিদ্যা, ভাষার বহুত্ব এবং সাংস্কৃতিক বহুমুখিতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পালন করা হচ্ছে। ডন নিউজের খবরে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের ভাষাগত বৈচিত্র্য এবং ভিন্ন ভাষায় পাঠের প্রণোদনা তৈরি করতে সেখানে ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি দুইদিনের সাহিত্য উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। সিন্ধ সরকারের সংস্কৃতি বিভাগের প্রেরণায় ইন্ডাজ কালচারাল ফোরাম ওই সাহিত্য উৎসবের আয়োজন করে।
দ্য নিউজ.কম তাদের খবরে জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে পাকিস্তানের লাহোরে কলেজ ফর উইমেন ইউনিভার্সিটির পাঞ্জাবি বিভাগের উদ্যোগে এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। পাশাপাশি একটি সচেতনতামূলক র্যালিও অনুষ্ঠিত হয়েছে ওই বিভাগের উদ্যোগে।
এক্সপ্রেস ট্রিবিউনের খবর অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ওই সেমিনারে উইমেন ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ড. রোকসানা কাওসার মাতৃভাষায় শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘সুশিক্ষার ভিত্তি গড়ে দেয় মাতৃভাষা। এটি নারী-পুরুষ এবং তাদের সমাজের ক্ষমতায়নের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে’।
এদিকে ডন নিউজের এক খবরে জানানো হয়েছে, পাকিস্তান অ্যাকাডেমি অব লেটারস (পাল) নামের এক সংগঠনের উদ্যোগে দেশটিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে দুই দিনের সিম্পোজিয়াম।
পাঞ্জাবের সুবিখ্যাত লেখক মুশতাক সুফী ৫২’র একুশে ফেব্রুয়ারিকে ইঙ্গিত করে সেই সেমিনারে বলেন, ‘ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, একক রাষ্ট্রভাষা একটি রাষ্ট্রের অখণ্ডতা নিশ্চিত করে না।’ তিনি মন্তব্য করেন: নীতিনির্ধারকদের এটা বুঝতে হবে যে একাধিক রাষ্ট্রীয় ভাষা রাষ্ট্রীয়-নিরাপত্তার জন্য হুমকি নয়। তিনি বলেন, উর্দু চাপিয়ে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ)কে প্রতিরোধের পথে এগিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
পাকিস্তানের লেখক-বুদ্ধিজীবী এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা মঙ্গলবারের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে সামনে রেখে সোমবার জাতিগত ঐক্য আর সম্মিলনের ডাক দিয়েছেন। ডন নিউজের খবরে বলা হয়েছে, সব প্রধান প্রধান প্রাদেশিক ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার জোর দাবি তুলেছেন তারা।
ডন-এর অপর এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, সব প্রধান প্রধান প্রাদেশিক ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতির প্রশ্নে পাকিস্তানের সংসদে দুইটি প্রস্তাব আনা হয়েছে। সেই দুই প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের আইন ও বিচার বিভাগের সিনেট স্যান্ডিং কমিটি এক শুনানির আয়োজন করে। শুনানিতে অংশগ্রহণকারীরা একটি জাতীয় ভাষা কমিশন গঠনের প্রস্তাব দেন। ওই কমিশনের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন ভাষার সংরক্ষণ এবং প্রধান প্রধান ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা ঘোষণার তাগিদ দেন তারা।
২০০৭ সালের ১৬ মে তারিখে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় এ/আরইএস/৬১/২৬৬ নম্বর নথি অনুসারে, সকল সদস্য দেশের উদ্দেশে বলা হয়, ‘বিশ্বের সকল ভাষার সংরক্ষণ এবং সুরক্ষার বিষয়টি’ প্রচার করতে বলা হয়। একই নথিতে ভাষাসমূহের মধ্যে বহুভাষা এবং বহুসংস্কৃতির মধ্যে বহুমুখিতার ঐক্যবদ্ধতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে, ২০০৮ সালকে ‘ভাষাসমূহের আন্তর্জাতিক বছর’ বলে ঘোষণা করা হয়।
এবারের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হলো ‘বহুভাষায় শিক্ষার মাধ্যমে টেকসই ভবিষ্যৎ’। ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে ইউনাইটেড ন্যাশনস এডুকেশনাল, সায়েন্টিফিক অ্যান্ড কালচারাল অর্গানাইজেশন (ইউনেস্কো)-এর মহাপরিচালক ইরিনা বকোভা বলেছেন, ‘সর্বত্র বহুভাষায় শিক্ষার গ্রহণযোগ্যতা দিতে হবে।’