সূরা আল আনফাল; আয়াত ৭৩-৭৫
সূরা আনফালের ৭৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَالَّذِينَ كَفَرُوا بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ إِلَّا تَفْعَلُوهُ تَكُنْ فِتْنَةٌ فِي الْأَرْضِ وَفَسَادٌ كَبِيرٌ
"যারা অবিশ্বাস ও কুফরি করেছে তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু। যদি তোমরা তা না কর অর্থাত কাফেরদের সাথে সম্পর্কের বিষয়ে আল্লাহর আদেশ মেনে না চল তাহলে দেশে অধর্ম ও মহাবিপর্যয় দেখা দেবে।" (৮:৭৩)
পবিত্র কুরআন মানবজাতির প্রত্যেকটি বিষয়ের প্রতি দিক নির্দেশনা দিয়েছে। মুসলমানদের পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত। অবিশ্বাসী কাফেরদের সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে মুসলমানরা কি নীতিমালা গ্রহণ করবে-তার সবই পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে। আগের কয়েকটি পর্বে আমরা এ দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করেছি। এই আয়াতে বলা হচ্ছে, এ ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশ যদি তোমরা মেনে না চল তাহলে তোমাদেরকে বড় ধরনের সহিংসতা ও বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হবে। কারণ অবিশ্বাসী কাফেররা ঐক্যবদ্ধ এবং তারা একে অপরের সহযোগী। আগের কয়েকটি আয়াতে বলা হয়েছে, মুসলমানরা যেন কাফেরদের সাথে সম্পর্ক জোরদার করাকে প্রাধান্য না দিয়ে নিজেদের মধ্যকার সহযোগিতা ও সুসম্পর্ক শক্তিশালী করার ওপর বেশি জোর দেয়।
এ আয়াত থেকে তাহলে আমরা এটা বুঝে নিতে পারি যে, কাফেরদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তারা ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে এক এবং ঐক্যবদ্ধ। তাই মুসলমানরা নিজেরা যদি ঐক্যবদ্ধ না হয় তাহলে তাদেরকে মহা বিপর্যয় ও ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। এ ছাড়া মুসলমানদেরকে সব সময়ই এমনভাবে কাজ করতে হবে যাতে কাফেররা মুসলিম দেশ বা জাতির ওপর হামলা করার কোনো অজুহাত খুঁজে না পায়।
এই সূরার ৭৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَالَّذِينَ آَمَنُوا وَهَاجَرُوا وَجَاهَدُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالَّذِينَ آَوَوْا وَنَصَرُوا أُولَئِكَ هُمُ الْمُؤْمِنُونَ حَقًّا لَهُمْ مَغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيمٌ
"যারা ঈমান এনেছে বা বিশ্বাস করেছে, ধর্মের জন্য হিজরত করেছে, আল্লাহর পথে সংগ্রাম করেছে এবং যারা আশ্রয় দান করেছে তারাই প্রকৃত বিশ্বাসী, তাদের জন্য ক্ষমা ও মহান জীবিকা রয়েছে।" (৮:৭৪)
এই আয়াতটিতে একজন মুমিনের বৈশিষ্ট্যগুলো পুণরায় উল্লেখ করে বলা হয়েছে, একজন মুমিন ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করতে এবং প্রয়োজন হলে ঘরবাড়ি ত্যাগ করতে সবসময়ই প্রস্তুত থাকে। আর তা না হলে তারা যেন অন্তত মুহাজিরদেরকে আশ্রয় দেয় এবং আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রামরত মুজাহিদদেরকে সহায়তা করে। তবে এখানে এটা বলে রাখা দরকার যে, হিজরত এবং জিহাদ শুধু শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ বা সংগ্রাম করা নয়। ইসলাম ধর্ম জ্ঞান অর্জন বা জ্ঞান শিক্ষা দেয়ার জন্য প্রয়োজন হলে হিজরত করতে উতসাহ দিয়েছে। বঞ্চিত ও দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের সাহায্যের জন্য হিজরত করাও জিহাদের অংশ। এসবই ঈমানের নিদর্শন বহন করে। তবে এটা অনস্বীকার্য যে, জিহাদ বা হিজরত করার শক্তি-সামর্থ সব মুসলমানের সমান নয়। কিন্তু মুহাজির ও মুজাহিদদেরকে অর্থ দিয়ে বা অন্যভাবে সাহায্য সহযোগিতা করা প্রত্যেকের সমান দায়িত্ব।
এ ছাড়া, ইসলামের প্রচার ও প্রসারের দায়িত্ব সকল মুসলমানের ওপরই সমানভাবে ন্যস্ত। সামাজিকভাবে এসব দায়িত্ব সঠিকভাবে পালিত হলে সেই সমাজে আল্লাহর বিশেষ রহমত নেমে আসে।
এই আয়াত থেকে আমরা এই শিক্ষা নিতে পারি যে, যে কোনো ভালো কাজই হতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। তা না হলে সে ভালো কাজের কোনো মূল্য নেই।
এই সূরার ৭৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَالَّذِينَ آَمَنُوا مِنْ بَعْدُ وَهَاجَرُوا وَجَاهَدُوا مَعَكُمْ فَأُولَئِكَ مِنْكُمْ وَأُولُو الْأَرْحَامِ بَعْضُهُمْ أَوْلَى بِبَعْضٍ فِي كِتَابِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ
"যারা পরে ঈমান এনেছে, ধর্মের জন্য গৃহত্যাগ করেছে ও তোমাদের সঙ্গে থেকে সংগ্রাম করেছে তারাও তোমাদের অন্তর্ভূক্ত এবং আত্মীয়গণ আল্লাহর বিধানে একে অন্য অপেক্ষা অধিক হকদার। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ব বিষয়ে সম্যক অবহিত।" (৮:৭৫)
আগের আয়াতে জিহাদ, হিজরত এবং মুহাজির ও মুজাহিদদেরকে সাহায্য সহযোগিতার তাতপর্য ও গুরুত্ব বর্ণনার পর এই আয়াতে বলা হচ্ছে, এটা মনে করার অবকাশ নেই যে, এই নির্দেশ এবং মূল্যবোধ শুধুমাত্র ইসলামের প্রাথমিক যুগের জন্য প্রযোজ্য। বরং ইসলামের এই বিধান ও মূল্যবোধ চিরন্তন এবং তা সব সময়ের জন্যই। যখনই কেউ ইসলামের ডাকে সাড়া দিয়ে সত্য দ্বীনকে গ্রহণ করবে তখনই সে ইসলামের ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যাবে।
ইসলামের প্রথম যুগের মুজাহিদরা মুসলমানদের কাছে এবং আল্লাহর কাছে বিশেষভাবে সম্মানিত ও মর্যাদাবান। কারণ আল্লাহর নবী যখন ইসলাম প্রচার শুরু করেন তখন নানা বাধা-বিপত্তির মধ্যেও এই মুজাহিদরাই তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তারপরও মর্যাদার বিষয়টিকে ইসলাম কারো জন্য সীমাবদ্ধ করে রাখেনি। তাই কাফের বা মুশরিক অবস্থা থেকে কেউ ইসলাম গ্রহণ করার সাথে সাথেই সে অন্যান্য মুসলমানের সমান মর্যাদায় ভূষিত হবেন।