সূরা আত তাওবা; আয়াত ৭০-৭৩
সূরা তাওবার ৭০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
أَلَمْ يَأْتِهِمْ نَبَأُ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ قَوْمِ نُوحٍ وَعَادٍ وَثَمُودَ وَقَوْمِ إِبْرَاهِيمَ وَأَصْحَابِ مَدْيَنَ وَالْمُؤْتَفِكَاتِ أَتَتْهُمْ رُسُلُهُمْ بِالْبَيِّنَاتِ فَمَا كَانَ اللَّهُ لِيَظْلِمَهُمْ وَلَكِنْ كَانُوا أَنْفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ
“তাদের পূর্ববর্তী সম্প্রদায়গুলোর ঘটনা। নূহ, আদ ও সামুদের সম্প্রদায়, ইব্রাহীমের সম্প্রদায় এবং মাদ্য়ান ও বিধ্বস্ত নগরের অধিবাসীদের সংবাদ কি তাদের নিকট আসে নাই? তাদের কাছে তাদের রাসূলগণ এসেছিল স্পষ্ট নিদর্শন সহকারে। (কিন্তু অবাধ্য হওয়ার কারণে তারা ধ্বংস হয়েছে) অতএব আল্লাহ তাদের ওপর জুলুম করেন নাই, কিন্তু তারা নিজেরাই নিজেদের ওপর জুলুম করেছে।” (৯:৭০)
আগের আয়াতে এমন কিছু সম্প্রদায়ের কথা বলা হয়েছে, যারা ঊশৃঙ্খল জীবন এবং অবাধ্যতার কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে। এই আয়াতে ধ্বংসপ্রাপ্ত ওই সম্প্রদায়গুলোর কোনো কোনোটার নাম বর্ণনা করে বলা হয়েছে তাদের অবাঞ্চিত আচরণের কারণেই ধ্বংস তাদের জন্য অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। হযরত নুহ (আ.)এর সম্প্রদায় প্রচণ্ড প্লাবনে নিমজ্জিত হয়েছিল। হযরত হুদ (আ.)এর সময় আদ্ জাতি সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়ে এবং হযরত সালেহ (আ.)এর সময় সামুদ জাতি প্রচণ্ড ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। তেমনিভাবে মাদায়েন জাতির জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন হযরত শুয়ায়েব(আ.)। কিন্তু তারা তাদের অপকর্মের জন্য প্রচণ্ড জলঝড়ে নাস্তানাবুদ হয়েছিল। হযরত লুত (আ.)এর কওম এমনভাবে ধ্বংস হয়েছিল যে গোটা অঞ্চলটিই বিধ্বস্ত নগরে পরিণত হয়েছিল।
এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, পাপ এবং অপকর্মের শাস্তি শুধু পরকালের জন্যেই নির্দিষ্ট নয়। ইহকালেও অনেক পাপের শাস্তি নেমে আসে। পবিত্র কুরআন অতীতকালের এসব ঘটনা এজন্যই তুলে ধরেছে যাতে মানুষ এখন তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।
সূরা তাওবার ৭১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,
وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَيُطِيعُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ أُولَئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ
“মুমিন নর-নারী একে অপরের সহায়ক, তারা সৎকাজের নির্দেশ দেয় এবং অসৎকাজ থেকে বিরত রাখে। নামাজ কায়েম করে এবং যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করে, খুব শীঘ্রই আল্লাহ তাদের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ করবেন এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” (৯:৭১)
আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে এই সূরার ৬৭ নম্বর আয়াতে কপট মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে বলা হয়েছে, তারা মানুষকে মন্দ কাজের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করে এবং সৎকাজের ব্যাপারে নিরুতসাহিত করে বা তাতে বাধা দেয়। এই আয়াতে বলা হয়েছে, মুমিন মুসলমানদের চরিত্র এবং কার্যকলাপ সম্পূর্ণ এর বিপরীত। তারা একে অপরকে সৎকাজের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করে এবং অন্যায় অসৎকাজ থেকে একে অপরকে বিরত রাখে। মূলত ‘আমর্ বিল মা’রুফ ওয়া নাহী আনিল মুনকার’ অর্থাত সৎকাজে উদ্বুদ্ধ করা এবং অসৎকাজে বিরত রাখা ইসলাম ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। এই বিধানের কারণে ব্যক্তিগত পর্যায়ের বাইরেও সামাজিক আচার অনুষ্ঠানের প্রতি দৃষ্টি রাখা প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য। কারণ কুসংস্কৃতি, অপসংস্কৃতি এবং কুরুচি বা অশালীনতার ব্যাপারে একজন দ্বীনদার মুসলমান নীরব-নির্লিপ্ত থাকতে পারে না। কারণ সমাজ হচ্ছে একটি নৌকার মত। নৌকার এক প্রান্তে ফুটো হলে অন্য প্রান্তের আরোহীদের জন্য সমান বিপদ বয়ে আনবে। কাজেই ইসলাম সামাজিক আচার অনুষ্ঠান রীতি-নীতির প্রতি দৃষ্টি রাখার নির্দেশ দেয়। সমাজ নামক নৌকাটি যেন পাপ পংকিলতায় নিমজ্জিত হয়ে না পড়ে সে দিকে সচেতন দৃষ্টি রাখার জন্য মুমিন মুসলমানদের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আসলে সমাজ সংশোধনের ক্ষেত্রে নারী-পু্রুষ উভয়ের ভূমিকা থাকতে হবে। কুরআনের নির্দেশ সৎকাজের আদেশ, অসৎকাজের নিষেধ শুধু পুরুষদের জন্যই প্রযোজ্য নয়। বরং এই নির্দেশ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল মুমিন মুসলমানদের জন্য প্রযোজ্য। কাজেই এই আয়াত থেকে বোঝা যায় এই পবিত্র দায়িত্ব পালন, নামাজ কায়েম করা, যাকাত দেয়া আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রদর্শিত পথে চলা ঈমানদারদের বৈশিষ্ট্য।
সূরা তাওবার ৭২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَعَدَ اللَّهُ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِي جَنَّاتِ عَدْنٍ وَرِضْوَانٌ مِنَ اللَّهِ أَكْبَرُ ذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
“আল্লাহ ঈমানদার নর-নারীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বেহেশতি উদ্যানের। যার নিম্নদেশে নদী প্রবাহিত, তারা সেখানে চিরস্থায়ী হবে এবং সেসব উদ্যানে থাকবে পরিচ্ছন্ন থাকার ঘর। বস্তুত এগুলোর মাঝে সবচেয়ে বড় ও সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি। এটিই হলো মহান কৃতজ্ঞতা।” (৯:৭২)
আগের আয়াতগুলোতে মুনাফিকদের কঠিন পরিণতি এবং নরকের শাস্তির বর্ণনা দেয়ার পর এই আয়াতে বেহেশতের সুন্দর মনোরম পরিবেশ ও সেখানে বিদ্যমান নির্মল প্রশান্তির বিবরণ দেয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে আল্লাহতালা কেবল মুমিনদেরকেই বেহেশতের কুঞ্জ-কাননের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। জান্নাত বা বেহেশত একটি চিরন্তন আবাসন এবং সেখানে যারা থাকবে তারাও চিরস্থায়ী হবে। মুমিন মুসলমানরা পৃথিবীতে যা কিছু করে তার উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লার সন্তুষ্টি অর্জন। কাজেই বেহেশতের কুঞ্জ-কাননে তারা আল্লাহর সন্তুষ্টির নিদর্শন উপভোগ করবেন এবং তারা সেখানে গর্বিত হবেন। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এমন একটি উচ্চ অবস্থান যা অর্জনের মাধ্যমে মানুষের পক্ষে প্রকৃত প্রশান্তি লাভ করা সম্ভব।
সূরা তাওবার ৭৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ جَاهِدِ الْكُفَّارَ وَالْمُنَافِقِينَ وَاغْلُظْ عَلَيْهِمْ وَمَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ وَبِئْسَ الْمَصِيرُ
“হে নবী! কাফের ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করুন এবং তাদের সাথে কঠোরতা অবলম্বন করুন, তাদের ঠিকানা হলো দোযখ। তা হলো নিকৃষ্ট ঠিকানা।” (৯:৭৩)
এর আগে বেশ কয়েকটি আয়াতে মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য, তাদের স্বভাব ও আচার-আচরণের বিবরণ দেয়ার পর এই আয়াতে আল্লাহর রাসূল ও মুমিনদেরকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, মুনাফিকদের যারা কাফেরদের পর্যায়ে উপনীত হয়েছে, যারা প্রকাশ্যে অবাধ্য হয়েছে এবং অনায়াসে ধর্মকে তিরস্কার করে, তাদের সাথে কঠোরতা অবলম্বন করুন। কারণ তারা আপনার বা মুমিনদের নম্র আচরণের অপব্যবহার করতে পারে। তাদের সঙ্গে এমন আচরণ করতে হবে যাতে তারা মুসলমানদেরকে দুর্বল না ভাবে।
এই আয়াত থেকে আমরা এই শিক্ষা নিতে পারি যে, কাফের-মুনাফিকরা যদি প্রকাশ্যে মুসলমানদের সাথে শত্রুতা করে তাহলে মুসলমানদের কর্তব্য হচ্ছে তাদেরকে প্রতিহত করা বা তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা। তবে এই জিহাদের বিভিন্ন পর্যায় আছে। যেমন কখনো মৌখিকভাবে তা হতে পারে। আবার প্রয়োজনে তা যুদ্ধও হতে পারে।