আবনা ডেস্ক: তাহিরপুরের শনির হাওরের আনোয়ারপুর গ্রামের কৃষক আবদুল খালিক। সুনামগঞ্জ-তাহিরপুর সড়কের আনোয়ারপুর বাজারের পাশে শনির হাওরপারে কথা হয় গতকাল মঙ্গলবার।
তাহিরপুরের শনির হাওরের আনোয়ারপুর গ্রামের কৃষক আবদুল খালিক। সুনামগঞ্জ-তাহিরপুর সড়কের আনোয়ারপুর বাজারের পাশে শনির হাওরপারে কথা হয় গতকাল মঙ্গলবার। ছবি: আনিস মাহমুদ
‘আমরা পথের ফকির অই (হয়ে) গেছি। আর মাইত্যা (কথা বলে) কিতা অইত। সব শেষ। অখন এখটাই চিন্তা, বাঁচতাম কিলা...(বাঁচব কেমন করে)।’ হাওর থেকে কেটে আনা ভেজা কাঁচা ধানের গোছা নাড়াচাড়া করতে করতে এমন দীর্ঘশ্বাস ফেলেন সত্তরোর্ধ্ব আবদুল খালিক।
এই দীর্ঘশ্বাস, এই কষ্ট এখন শুধু আবদুল খালিকের একার নয়, সুনামগঞ্জের হাওর এলাকার ফসলহারা সব কৃষকের বুকে। শ্রমে-ঘামে ফলানো ফসল হারিয়ে হাওরের কৃষকেরা এখন অসহায়, নিঃস্ব।
কৃষক আবদুল খালিকের বাড়ি জেলার তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওরের পশ্চিমপাড়ের আনোয়ারপুর গ্রামে। সুনামগঞ্জ-তাহিরপুর সড়কের আনোয়ারপুর বাজারের পাশে শনির হাওরপারে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। এই হাওরটি ডুবেছে গত রোববার। তাঁরা হাওরের উঁচু জায়গা থেকে কিছু কাঁচা ধান কাটতে পেরেছেন। কিন্তু জেলার অন্য হাওরগুলো যখন ডুবে, তখন ধানগাছ ছিল কাঁচা। তাই এই সুযোগও পাননি ওই সব হাওর এলাকার কৃষকেরা।
এসব কাঁচা ধানে কী হবে? এমন প্রশ্নে আবদুল খালিক বললেন, ‘যা পারছি আনছি। ধান না-ই পাইলাম, গরুর তো কিছু খেড় (খড়) অইব। চিন্তা তো খালি আমরার না, গরু পালতাম কিলা।’
দেখা গেল, সুনামগঞ্জ-তাহিরপুর সড়কের ওপর আরও অনেকে একইভাবে কাঁচা ধান কেটে এনে রেখেছেন। এখনো কাটছেন কেউ কেউ। একই গ্রামের মনরূপা বেগম (৫০) এক ছেলে ও দুই মেয়ের জামাইকে নিয়ে হাওর থেকে কিছু কাঁচা ধান এনে এক জায়গায় জড়ো করছিলেন। বিপদের সময় মেয়ের জামাইরা এসেছেন তাঁদের সাহায্য করতে। মনরূপা বেগমের দিকে তাকাতেই বলে ওঠেন, ‘ইশ্, আর একটা সাপ্তা সময় পাইতাম, তাইলেই অইগিছিল। মানুষ পাকনা ধান কাটত পারত।’
লোহাছড়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবদুল জলিলের (৭২) তিন একর জমি ছিল। সামান্য জমি উঁচুতে থাকায় কিছু কাঁচা ধান কাটতে পেরেছেন। মেয়ের রাশেদা বেগমকে নিয়ে সেই ধান হাওর থেকে তুলে এনে সড়কের ওপর স্তূপ করছেন। আবদুল জলিল বলেন, ‘ইবার এলাকায় আকাল দেখা দিব। মানুষ না খাইয়া মরব। আপনার সরকাররে ই কথা জানাইন যেন। বাঁচাইলে সরকারেই বাঁচাইত।’
শনির হাওরটি এলাকার মানুষের স্বেচ্ছাশ্রমে টিকে ছিল ২৩ দিন। যে কারণে ধান পাকতে শুরু করেছিল। যখন হাওরে পানি ঢুকতে থাকে, তখন হাওরে উঁচু অংশে থাকা সেই আধা পাকা কিছু ধান কাটার চেষ্টা করেছেন কৃষকেরা।
তাহিরপুর সদরের কাছাকাছি মধ্যতাহিরপুর গ্রামের পাশে কথা হয় নারায়ণ বর্মণের (৫৪) সঙ্গে। এলাকার মাটিয়ান হাওরে দুই একর এবং শনির হাওরে এক একর জমি ছিল তাঁর। মাটিয়ান হাওরে জমির ধান এপ্রিলের প্রথম দিকেই তলিয়ে গেছে। ভরসা ছিল শনির হাওর। সেটিও তলিয়ে যায় গত রোববার। নারায়ণ বর্মণ জানান, তাঁর দুই ছেলের মধ্যে একজন এবার এসএসসি দিয়েছে, অন্যজন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। ঘরে সব মিলিয়ে নয়জন মানুষ। নারায়ণ বলেন,‘এখন ছেলেদের লেখাপড়ার খরচ কই থেকে পাব। আর খাবইবা কী। সবই ভরসা ছিল এই ধানে।’
সুনামগঞ্জ থেকে তাহিরপুর যেতে পথে কথা হয় প্রায় ২০ জন নারী-পুরুষের সঙ্গে। তাঁরা জানালেন, সুনামগঞ্জের ধনী-গরিব সব কৃষকের অবস্থা এখন এক। সবাই ফসল হারিয়ে অসহায়। কারও ঘরে খাবার নেই। অনাহারে অর্ধাহারে দিন যাচ্ছে।
ধনী-গরিবের একই অবস্থা, এই কথাটি নিজেই পরিষ্কার করলেন উপজেলার বড়দল দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ। তাঁর তিন মেয়ের মধ্যে দুই মেয়ে সিলেটে থেকে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে লেখাপড়া করেন। এক মেয়ে এবার স্নাতক পাস করেছেন। তাকেও পড়াশোনার জন্য সিলেটে পাঠানোর চিন্তা ছিল। আবুল কালাম বলেন, ‘আমি এলাকার সচ্ছল গৃহস্থ। আমার আর অন্য কোনো পেশা নেই। ১০ একর জমির সব ধান তলিয়ে গেছে। এই ধানেই আমি রাজার হালে চলতাম। এখন কী করব ভেবে পাচ্ছি না। এখন বোঝেন সাধারণ কৃষকেরা কী অবস্থায় আছে।’
এবার সুনামগঞ্জের ১৪২টি ছোট-বড় হাওরের সব বোরো ধান তলিয়ে গেছে। জেলায় ২ লাখ ২৩ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছিল। ধানের (চালে) লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন। স্থানীয় কৃষকেরা বলছেন, আবাদ করা ধানের প্রায় ৯০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আনোয়ারপুরের মনরূপা বেগম বলছিলেন, জমিতে ধান লাগানো সময় দুটি বেসরকারি সংস্থা থেকে ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। প্রতি সপ্তাহে কিস্তি দিতে হয় ১ হাজার ২০০ টাকা। ধান না পাওয়ায় এখন এই কিস্তি চালিয়ে যাবেন কীভাবে, এ চিন্তায় দিশেহারা তিনি। একইভাবে ২৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন নারায়ণ বর্মণ। সপ্তাহে তাঁর কিস্তি ৬৭৫ টাকা। মধ্য তাহিরপুর গ্রামের অলক ধরের দুটি সংস্থায় ঋণ আছে ৩০ হাজার টাকা। তাঁর সপ্তাহে কিস্তি ৮০০ টাকা। অলক ধর জানান, অগ্রহায়ণ মাসে ঋণ নিয়েছিলেন। ফসল তুলে সব টাকা পরিশোধের চিন্তা ছিল। এখন ফসল গেছে, কিস্তি কীভাবে চালাবেন আর নিজে কীভাবে চলবেন—এই ভেবে কূল পাচ্ছেন না। অলক ধর বলেন, কিস্তির টাকার জন্য সোমবার রাত ১০টা পর্যন্ত বাড়িতে অপেক্ষা করে গেছেন একটি সংস্থার লোক। তিনি বলেছেন, দেওয়ার কোনো ক্ষমতা নেই। মঙ্গলবার সকালে আবার আসার কথা ছিল। কিন্তু তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে আসায় জানেন না ওই লোক এসেছেন কি না।
এনজিও ঋণ মওকুফের দাবি
হাওরে ফসল লাগানোর সময় বিভিন্ন এনজিওর কাছ থেকে নেওয়া ঋণের কিস্তি দেওয়া বন্ধ করে দিতে কৃষকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সুনামগঞ্জ-৪ আসনের (সদর ও বিশ্বম্ভরপুর) সাংসদ পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ। সাংসদ বলেছেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হাওরে ফসলহানির পর কৃষিঋণ আদায় বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। এখন উচ্চ সুদে এনজিওগুলোর কাছ থেকে নেওয়া ঋণের কিস্তির যন্ত্রণায় আছে ফসলহারা মানুষ। এনজিওগুলোর ঋণ মওকুফ করতে হবে।’
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল তাঁর দপ্তরে বসে প্রথম আলোকে জানান, তিনি এনজিও ঋণের কোনো কিস্তি না দিতে কৃষকদের বলে দিয়েছেন। এই ঋণ মওকুফ চান তিনিও। কামরুল বলেন,‘কৃষকদের ঋণের কিস্তি না দেওয়ার জন্য যেমন বলেছি, তেমনি এনজিও কর্মকর্তাদের পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছি, ফসলহারা মানুষদের ঋণের কিস্তির জন্য হয়রানি করলে পরিণাম ভালো হবে না।’