আবনা ডেস্কঃ সৌদি আরবের ডাকা সম্মেলনে ইরানকে রুখে দেওয়ার যে আহ্বান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প করেছিলেন, তা বৃথা যায়নি। মুসলিমবিদ্বেষী বক্তৃতা করা ট্রাম্প, মার্কিন দেশে মুসলমানদের সফর-নিষেধাজ্ঞা দানকারী ট্রাম্প সাহেবই এখন মুসলিম দুনিয়ার ‘নেতা’ হিসেবে হাজির হয়েছেন। তাঁর আহ্বানের পরপরই বাহরাইনের সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়াদের ওপর রাষ্ট্রীয় অভিযান চলে। গ্রেপ্তার ২৮৬ এবং নিহত হন ৫ জন। একটি দৈনিক পত্রিকা বন্ধ এবং বিরোধীরা নিষিদ্ধ হয়। এরই ধারাবাহিকতা ৫ জুন কাতারের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে প্রতিবেশী চারটি পূর্ণ এবং দুটি আধা দেশ (ইয়েমেন ও লিবিয়ার যে ‘সরকার’ এই মিছিলে শামিল, তাদের নিজেদেরই বৈধতা ও কর্তৃত্ব নেই)। তাদের অভিযোগ, কাতার মুসলিম সন্ত্রাসবাদীদের মদদ দিয়ে যাচ্ছে এবং প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। কাতারের আমিরকে উচ্ছেদের হুমকিও দিয়ে রেখেছেন সৌদি-আমেরিকান পাবলিক রিলেশন অ্যাফেয়ার্স কমিটির প্রেসিডেন্ট সালমান আল-আনসারি। এক টুইট বার্তায় বলেন, ‘কাতারের আমিরকে বলছি, আমি আপনাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি, মোহাম্মদ মুরসি আপনার মতোই করেছিল এবং তারপর তাকে উচ্ছেদ করে বন্দী করা হয়েছিল।’ এদিকে জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই আরব বিচ্ছেদকে মধ্যপ্রাচ্যের ট্রাম্পিকরণ বলে সংঘাত ও অস্ত্র প্রতিযোগিতায় উসকানির অভিযোগ তুলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে।
সিরিয়া ও ইয়েমেনে ইরানবিরোধী শক্তিকে কাতার মদদ দেয় ঠিকই, কিন্তু সেটা তো সৌদি আরবের মিত্র হিসেবেই। আর সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের বিষয়ে সৌদি আরবের তুলনায় কাতার নিতান্তই শিশু। গত সপ্তাহে যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম অভিযোগ তোলে, সরকারি তদন্ত প্রতিবেদনে সন্ত্রাসবাদ ছড়ানোয় সৌদি ভূমিকার প্রমাণ লুকাতে চাইছে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় এ সম্পর্কে বিস্তৃত প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সাময়িকী নিউজউইক শিরোনাম করেছে, ‘যুক্তরাজ্যের সৌদি আরববিষয়ক সন্ত্রাসবাদের প্রতিবেদন হয়তো গোপনই রাখা হবে (U.K. Terrorism Report on Saudi Arabia May Be Kept Secret)।’ গত ডিসেম্বরে জার্মানিতে ফাঁস হওয়া এক তদন্ত প্রতিবেদনেও একই অভিযোগ ছিল। সুতরাং নিজ দেশে মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তম মার্কিন বিমানঘাঁটি করতে দেওয়া কাতারের ‘অপরাধ’ অন্য।
মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের পর সবচেয়ে বড় তেল মজুতের মালিক কাতার। তাদের টাকা আছে, আধুনিকতা আছে আর আছে আল জাজিরার মতো বৈশ্বিক প্রভাবশালী গণমাধ্যম। মুসলিম ব্রাদারহুডের মাধ্যমে কাতার আরব জগতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে আসছিল। মিসরে সেই চেষ্টা গুঁড়িয়ে দেওয়া হলেও হামাস ও হিজবুল্লাহ টিকে আছে। মুসলিম ব্রাদারহুডের আধ্যাত্মিক নেতা কাতারের রাজপরিবারের খুবই ঘনিষ্ঠ। হামাসের প্রধান নেতা খালেদ মিশালও কাতারে নিরাপদেই আছেন। এর বাইরে সৌদি-আমেরিকান জোটের কাছে কাতারের বড় ‘অপরাধ’, ইরান বিষয়ে কাতারের নীতি দ্বিমুখী। ইরান বিষয়ে কাতারের মধ্যপন্থা এবং আরব বসন্তের দেশান্তরি পাখিদের বাসা হওয়ায়, মিসরের স্বৈরশাসক সিসি ও আরব রাজবংশগুলো নিশ্চিন্তে থাকতে পারছে না।
ইতিমধ্যে সৌদি নেতৃত্বে ইরানবিরোধী মুসলিম ন্যাটো জোট গঠিত হয়েছে। এর প্রধান সেনাপতি হলেন পাকিস্তানের সদ্য সাবেক সেনাপ্রধান রাহেল শরিফ। (যদিও পাকিস্তান সিনেটে রাহেল শরিফকে ফিরিয়ে আনার দাবি তুলেছেন কয়েকজন সিনেটর)। বাংলাদেশও এই সামরিক জোটের অংশ।
জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরব ঐক্যের ভাঙ্গনের জন্য দায়ি করেছেন ট্রাম্প প্রশাসনের চাপকে।গত ২১-২২ মে রিয়াদে ট্রাম্প তিনটি সম্মেলন ও একটি চুক্তি করেন : ১. যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি আরব সম্মেলন, ২. যুক্তরাষ্ট্র-জিসিসি (Gulf Cooperation Council) সম্মেলন এবং ৩. আরব ইসলামি আমেরিকান সম্মেলন—যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গী হন ৫৪টি মুসলিম দেশের রাষ্ট্রপ্রধান। ঘটনাটি ঐতিহাসিক, তার নগদ প্রমাণও পাওয়া যায়। সৌদি আরবের সঙ্গে মানবেতিহাসের সবচেয়ে বড় (৩৫০ বিলিয়ন ডলার) অস্ত্র বিক্রির চুক্তি করেন ট্রাম্প। এর প্রতীক হয়ে থাকে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও বাদশাহ সালমানের তলোয়ার নৃত্য। ঘটনাটা মনে করিয়ে দেয় ব্রিটিশ গোয়েন্দা ও কৌশলবিদ লরেন্স অব অ্যারাবিয়ার কথা। তুর্কি ওসমানিয়া শাসন উচ্ছেদ করে সৌদি শাসন প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভূমিকা কিংবদন্তিসম। যাহোক, প্রতিক্রিয়ায় ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সামরিক মুখপাত্র টুইট করে বলেন, ‘যা ঘটছে তা ওই তলোয়ার নৃত্যের প্রাথমিক ফলাফল।’
অনুরূপ একটি ঘটনা ঘটেছিল ৫০ বছর আগে। তা থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল ছয় দিনের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ। সেই যুদ্ধের ফল পুরো আরব জগতে ওলট-পালট ঘটিয়ে দিয়েছিল। নাসেরের জাতীয়তাবাদী মিসর লোহিত সাগরে ইসরায়েলের প্রবেশ ঠেকাতে তিরান প্রণালি বন্ধ করে দেয়। সেবার শত্রু ছিল ইসরায়েল, এবারে ইরান। কাতারের ওপর নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে সঙ্গেই ইরান তার তিনটি বন্দর দিয়ে জরুরি খাদ্য আমদানির প্রস্তাব দেয় কাতারকে। এতে আরও খেপে যান সৌদি ও বাহরাইনি শাসকেরা। কাতার নিয়ে দ্বন্দ্বের গভীরে চলছে ইরানবিরোধী আরব ঐক্য শাণিয়ে তোলার কাজ। ‘মুসলিম ন্যাটো’ নামে পরিচিত সামরিক জোট গঠন এবং বিপুল মার্কিন অস্ত্র, ট্যাংক, বিমান, মিসাইল ও যুদ্ধপ্রযুক্তি কেনার ঘটনা বলছে, ঈশান কোণে যুদ্ধের মেঘ জমছে। ঘটনা দেখে ইসরায়েল তার আনন্দ লুকাতে কার্পণ্য করেনি।
১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় (সৌদি আরব ছাড়া), ১৯৯১-২০০১ সালে ইরাকের বিরুদ্ধে এবং এবার ইরানের বিরুদ্ধে সৌদি নেতৃত্বে মুসলিম ন্যাটো গঠনের সময়। প্রথম ঐক্য পরাস্ত হয়, বিজয়ী হয় পশ্চিমা মদদপুষ্ট ইসরায়েল। আরবের ত্রাতা বলে খ্যাত মিসরের গামাল আবদেল নাসের ক্ষমতা ছাড়েন। আরবজুড়ে সামরিক ও রাজতান্ত্রিক স্বৈরশাসন আরও পোক্ত হয়। সেক্যুলার আরব জাতীয়তাবাদের জায়গায় ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান ঘটে। ইসরায়েল আরও আগ্রাসী হয়, দখল করে নেয় পূর্ব জেরুজালেমসহ সিরিয়া, মিসর ও জর্ডানের বিস্তৃত এলাকা।
দ্বিতীয় আরব ঐক্য গড়ে ওঠে সাদ্দামের বিরুদ্ধে। ফলাফল সবার জানা। ফিলিস্তিন, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন, লেবানন ও সুদানে যে অশান্তি চলছে, তা আসলে ইরানকে পরাস্ত করারই আয়োজন। নাসেরের পতনে যারা খুশি হয়েছিল, সাদ্দামের পতনে যারা উৎসব করেছিল, ইরানের পতনের জন্য তারাই আবার জোট বেঁধে মরিয়া হয়েছে।
ইতিহাস পুনরাবৃত্তিময়। প্রথমবার যে ঘটনা ট্র্যাজিক হয়, দ্বিতীয়বার তা নাকি পরিহাস হয়ে ওঠে। প্রথম আরব ঐক্যের পরাজয় ছিল ট্র্যাজিক। দ্বিতীয়বার ইরাক ধ্বংস আরব ও মুসলিম দুনিয়াকে পরিহাস করেছিল। এখন ইরান-সিরিয়া-ইয়েমেন-লেবনান ও ফিলিস্তিনের সারিতে কাতারের পড়ে যাওয়ায় অনেকেই অবাক! এবার সম্ভবত ট্র্যাজি-কমেডি দেখতে যাচ্ছে শান্তিকামী বিশ্ব। সাবেক কমেডিয়ান মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ইসলামি দুনিয়ার শীর্ষ বাদশাহের তলোয়ার নৃত্য ট্র্যাজি-কমেডিই বটে।
কাতার ইরানপন্থী দেশ নয়। তাহলেও সমুদ্রের গ্যাস ভাগাভাগির ব্যাপারে দুই দেশের যোগাযোগ রয়েছে। কাতারের আধুনিকতামুখী তরুণ আমির আশা করেছিলেন, ট্রাম্প কাতারে পা রেখে দোহাকে আধুনিক আরবের রাজধানীর স্বীকৃতি দেবেন। কিন্তু ট্রাম্প বেছে নিলেন পুরোনো মিত্র সৌদি আরবকে, তিরস্কার করলেন ইরানকে। কাতার সেই তিরস্কারে শামিল হলো না। সৌদি আরবের সঙ্গে কাতারের অতীতের ঘা আবার তাজা হয়ে উঠল। কাতারের আমিরের দাদা ছিলেন অকর্মণ্য এক শাসক। তাঁকে সরিয়ে ক্ষমতাসীন হন বর্তমান আমির তামিমের বাবা। ২০১৩ থেকে তামিম খুদে কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মাথাপিছু আয়ের এ দেশটির শাসক। সৌদি আরব তামিমের দাদার উৎখাত পছন্দ করেনি। ভয় ছিল, এ ধরনের ঘটনা অন্য রাজপরিবারেও বিদ্রোহ উসকে দেবে। অভিযোগ রয়েছে, বাহরাইনকে দিয়ে চেষ্টা হয়েছিল নতুন আমির ও তাঁর সঙ্গীদের হত্যা করার। সেই পুরোনো শত্রুতার সঙ্গে যোগ হয়েছে কাতারের ইরানমুখী তেল-রাজনীতি। হয়তো, ইরান-কাতার-রাশিয়া মিলে নতুন আরেকটা ওপেক গঠনের চেষ্টা অঙ্কুরেই গুঁড়িয়ে দিতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।
ঘটনা যা-ই ঘটুক, ইরাককে দিয়ে কুয়েত আক্রমণ করানো যেমন ফাঁদ ছিল, তেমনি সৌদি আরবের কাতার বা ইরান আক্রমণ হবে আরও মারাত্মক ফাঁদ।#