নিশ্চয়ই আমরা এটা (পবিত্র কোরআনকে) মহিমান্বিত রজনীতে অবতীর্ণ করেছি । তুমি কি জান মহিমান্বিত রজনী কী? মহিমান্বিত রজনী সহস্র মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এতে ফেরেশতাগণ ও রুহুল কুদ্স (জিবরাঈল) তাদের প্রতিপালকের অনুজ্ঞাক্রমে প্রত্যেক বিষয়ের আদেশসহ অবতীর্ণ হয়,এতে (রজনীতে) ঊষার আবির্ভাব অবধি শান্তি (অবতীর্ণ হয়)।’ (সূরা ক্বাদর)
এই সূরায় মহান ও বরকতময় রাত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সমগ্র বিশ্ব এই রাতটি এক আনন্দময় ইবাদত-বন্দেগির মধ্য দিয়ে উদযাপন করে। এই রাত পৃথিবী এবং ঊর্ধ্বলোকের মধ্যে একটি যথার্থ সংযোগ স্থাপনের সুবর্ণ সুযোগ। এই রাতে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর ওপর পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হয়। মানব ইতিহাসে এ এক অনন্য ঘটনা। গোটা মানবজীবনের জন্য এ রাত অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ রাত। এ রাতের গুরুত্ব মানুষের ধারণারও অতীত।
‘আমি কদরের রাত্রিতে তা অবতীর্ণ করেছি’-পবিত্র কুরআনের এই বাণীটি যে মহান ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত তা আল্লাহ তাআলার সুস্পষ্ট ও উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা থেকে উৎসারিত। এখানে জমিন ও ঊর্ধ্বলোকের মধ্যে ফেরেশতা ও রূহের চলাচল সম্পর্কেও আলোকপাত করা হয়েছে। বলা হয়েছে,‘সে রাত্রে ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে।’এছাড়াও আলোচনা করা হয়েছে উষা বা প্রত্যুষকাল সম্পর্কে,যা সত্যিকারভাবে পবিত্র কুরআন,ফেরেশতা ও প্রশান্ত আত্মার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কুরআনের ভাষায়,‘শান্তিই শান্তি,সেই রজনী ঊষার আবির্ভাব পর্যন্ত’।
কদরের রাত সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের সূরা দুখানেও অনুরূপ কথা বলা হয়েছে : ‘আমি তো এটা অবতীর্ণ করেছি এক মুবারক রজনীতে,আমি তো সতর্ককারী। এই রজনীতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়;আমার আদেশক্রমে,আমি তো রাসূল প্রেরণ করে থাকি তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহস্বরূপ,তিনি তো সর্বশ্রোতা,সর্বজ্ঞ (আয়াত : ৩-৬)। আর একথাও স্বীকৃত যে,এই রাত পবিত্র রমজান মাসের রাত। এ প্রসঙ্গে সূরা বাকারায় বলা হয়েছে : ‘রমজান মাস,এতে মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে।’(আয়াত : ১৮৫)। এ আয়াতগুলো থেকে বুঝা যায় যে,কদরের রাত থেকেই মহানবী (সা.)-এর ওপর পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হতে শুরু করে এবং মানব সমাজের কাছে তা পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব তাঁর ওপর অর্পিত হয়।
কোনো কোনো হাদিসে রমজান মাসের শেষ দশদিনের একটি রাত,কোনো কোনো হাদিসে ২১ রমজানের রাতকে ‘লাইলাতুল কদর’বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কোনো কোনো হাদিসে শবে কদর রমজান মাসে,এর বেশি আর কিছু বলা হয়নি। এই রাত হাজার মাসের চেয়েও শ্রেয়।
মানবীয় বুদ্ধি-বিবেচনায় মহত্তম ও শ্রেষ্ঠত্বের যতটা ধারণা করা সম্ভব এই রাত হচ্ছে তার সারাংশ। কুরআন মজীদে বলা হয়েছে : ‘আর মহিমান্বিত রজনী সম্বন্ধে তুমি কী জান?’ এ রাত এক মহান রাত। কেননা,আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই রাতটিকে তাঁর কুরআন নাযিলের জন্য মনোনীত করেছেন। যাতে এর আলোকবর্তিকা সমগ্র বিশ্বচরাচরে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং মানুষের জীবন ও বিবেক-বিবেচনার ওপর খোদায়ী শান্তি বিস্তৃত হয়।
শবে কদরের এত অধিক গুরুত্ব এই কারণে যে,এ রাতে যে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে তা নিয়ে এসেছে এক মহা আদর্শ। যে আদর্শ হচ্ছে এক সার্বিক মূল্যবোধ ও গুণগত মানের ভিত্তি এবং এক ব্যাপকতর নৈতিক ও সামাজিক আচরণের বিধান। এই কুরআনই মানবাত্মা এবং সমগ্র বিশ্বের জন্য শান্তির উৎস। শবে কদরের আরো একটি তাৎপর্যময় দিক হচ্ছে এই রাতে ফেরেশতারা,বিশেষত জিবরাঈল (আ.) প্রথম অবতীর্ণ হন কুরআন নিয়ে। সে রাতে তাঁরা আসমান ও জমীনের মধ্যবর্তী সকল স্থানকে উৎসবমুখর করে তোলেন।
আজকে বহু প্রজন্ম অতিক্রান্ত হওয়ার পরও আমরা যখন পাশ্চাত্যের দিকে তাকিয়ে এই মহান ও বরকতময় রাতের দিকে দৃষ্টিপাত করি তখনও আমরা ঐ রাতে পৃথিবীতে অনুষ্ঠিত চমৎকার উৎসবটি অনুভব করতে পারি। এছাড়াও অনুভব করা যায় কুরআন নাযিলের তাৎপর্য,মানবজীবনে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব ও মূল্যবোধ। আর তাই এ রাতের এ মহান ঘটনার প্রশংসা করতেই হয়। আর এ থেকেই আমরা কিছুটা উপলব্ধি করতে পারি কুরআনের ঐ আয়াতটির অর্থ : ‘আর মহিমান্বিত রজনী সম্বন্ধে তুমি কী জান?’
ঐ রাতে প্রতিটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় স্পষ্ট ও পৃথক করা হয়,নবতর মূল্যবোধ ও গুণগত মান নির্ধারিত হয়,জাতিসমূহের ভাগ্য নির্ধারণ করা হয়।
মানুষ অজ্ঞতা ও দুর্ভাগ্যবশত কদরের এই গুরুত্বর্পূ ও তাৎপর্যপূর্ণ রাতকে উপেক্ষা করতে পারে। আর মানুষ যদি এই রাতকে উপেক্ষা করেই তাহলে সে এমন এক সুখকর ও সুন্দরতম সুযোগকে হারায়,যা আল্লাহ তাকে দিয়েছেন। অর্থাৎ এই উপেক্ষা হবে মানুষের জন্য ইসলাম প্রদত্ত বিবেক-বুদ্ধি,পরিবার ও সমাজের শান্তি থেকে বঞ্চিত থাকা। এই বঞ্চনার পরিমাণ এত বেশি যে,বস্তুগত সভ্যতা আমাদের যা দিয়েছে তা ঐ বঞ্চনার ক্ষতি পূরণের জন্য যথেষ্ট নয়। বস্তুগত সভ্যতার এই যুগে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উৎপাদনের মাত্রা সর্বোচ্চ হলেও এবং জীবন যাপনের উন্নত উপায়-উপকরণ থাকা সত্ত্বেও মানবতা চরম দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে নিপতিত। একদিন যে দীপ্ত আলো মানুষের আত্মাকে প্রজ্বলিত করেছিল তা নিভে গেছে। ঊর্ধ্বজগতের সাথে মানবতার যে স্বর্গীয় স্পর্শ লেগেছিল তা যেন লুপ্তপ্রায় এবং অন্তর ও মন থেকে শান্তির যে ধারা প্রবাহিত হতো তাও যেন অপসৃয়মাণ। কোনো কিছুই আত্মার সুখ,স্বর্গীয় দীপ্তি ও উন্নত মহিমার অভাব পূরণ করতে পারে না।
ঈমানদার মুসলমান হিসাবে আমরা শবে কদরকে অবজ্ঞা করতে পারি না। মহানবী (সা.) এ রাতটি সহজ ও উপভোগ্য করে উদযাপনের জন্য আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি প্রতি বছর এই রাতটিকে ইবাদত-বন্দেগির মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত করতে বলেছেন। তিনি বলেছেন,রমজানের শেষ দশ রাতে শবে কদর অনুসন্ধান কর। তিনি আরো বলেছেন,কদরের রাত যে ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে অতিবাহিত করে আল্লাহ তার গুনাহ মাফ করে দেন।
ইসলাম কেবল অনুষ্ঠানের সমষ্টি নয়। মহানবী (সা.) সুস্পষ্টভাবে বলেছেন,ঐ রাতের ইবাদত-বন্দেগি হতে হবে ঈমানের সাথে ও নিবেদিতচিত্তে । তাহলে একজন বান্দা ঐ রাতে সংঘটিত ঘটনার সুদূরপ্রসারী প্রভাব কী তা পূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে পারবে।
ইসলামের চরিত্র গঠন পদ্ধতি ব্যক্তির ঈমানভিত্তিক ইবাদত-বন্দেগি এবং তার অন্তর ও বিবেকে প্রতিষ্ঠিত সত্যের সাথে সম্পৃক্ত। এই পদ্ধতিতে ইবাদত মানুষের অন্তর,মন ও আত্মায় সত্যের পূর্ণ সচেতনতা বজায় রাখার,সুস্পষ্ট করার ও দৃঢ়তর করার উপায় হিসাবে বিবেচিত। আর এই পদ্ধতি সত্যকে পুনরুজ্জীবিত করার সর্বোত্তম মাধ্যম হিসাবে প্রমাণিতও হয়েছে। ইবাদত-বন্দেগির এই পদ্ধতি ব্যতিরেকে ব্যক্তি বা সমাজ জীবনে সত্য প্রতিষ্ঠা এবং তাতে প্রয়োজনীয় প্রাণ সঞ্চার সম্ভব নয়। তাই এই মহমিান্বিত রজনীর বার্ষিকী এবং ঈমান ও নিষ্ঠাপূর্ণ ইবাদাত-বন্দেগির সংযোগই হচ্ছে মানব জীবনের সার্বিক সাফল্য ও ইসলামকে সমুন্নত করার পদ্ধতি।