কোন জাতির মাঝে ঈদের উৎপত্তি লাভের মৌলিক উপাদান হচ্ছে- এমন কোন ঘটনা যা সেই জাতির জন্য আনন্দদায়ক ও সৌভাগ্যপূর্ণ, যা নির্দিষ্ট কোন এক সময়ে সংঘটিত হয়ে থাকে এবং সেটি আগে ও পরের ঘটনাবলী হতে স্বতন্ত্র ও বিশিষ্ট হয়ে থাকে আর তখন থেকেই মানুষ ঐ দিনটিকে ঈদের দিন হিসেবে নামকরণ করে থাকে এবং যুগ যুগ ধরে ঐ দিনকে নিজেদের সংস্কৃতি ও সভ্যতার অংশ হিসেবে সম্মান করে।
ইসলামী সংস্কৃতিতে এই ধরনের মৌলিক উপাদানকে নেয়ামত নামকরণ করা হয়ে থাকে ও প্রত্যেকটি জ্ঞানবান ব্যক্তিই নিজেকে কর্তব্যপরায়ণ বলে মনে করে যে, এই নেয়ামত দাতার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে হবে। আর এ সকল কারণেই দ্বীন-ইসলামের নিয়মাবলীর মধ্যে একটি হচ্ছে- এই ধরনের অনুষ্ঠানাদিতে বিশেষ ইবাদত-বন্দেগী করা যা মানুষকে অধিকতর আল্লাহর (নেয়ামত দাতার) নিকটবর্তী করে।
ঈদে গাদীরের দিনেও ঠিক অন্যান্য ঈদের দিনের মতই বিভিন্ন ইবাদত বন্দেগী ও বিশেষ আনুষ্ঠানিকতার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এই মহান ঈদের ক্ষেত্রে দু’টি বিশেষ নিয়মাবলীর কথা উল্লিখিত আছেঃ
১. এই দিনের আদব বা নিয়মাবলী সংখ্যাগত ও গুণগত দিক থেকে ইসলামের অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানের চেয়ে অধিক গুরুত্বের অধিকারী। এমন কি বলা যেতে পারে: ঈদে গাদীরের আমল সম্পর্কে যা বর্ণিত হয়েছে তা হচ্ছে, সকল কল্যাণকর কাজের সমষ্টি, একটি গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন ব্যবস্থার সামগ্রিক রূপ।
২. পবিত্র ও নিষ্পাপ ইমামগণ (আ.) থেকে যে সমস্ত হাদীস আমাদের নিকট পৌছেছে সে অনুযায়ী গাদীরের প্রত্যেকটি আমল বা কর্মেরই বিশেষ উচ্চ মর্যাদা ও মূল্য রয়েছে। আর সে জন্যই এর পুরস্কারও হবে সর্বোচ্চ ধরনের।
সুতরাং গাদীর দিবস, এমন এক মূল্যবান ধর্মীয় অনুষ্ঠান যার মর্যাদা রক্ষা করা একান্ত জরুরী। আর এই দিনের সম্মান বা মর্যাদা রক্ষার একমাত্র উপায় হচ্ছে- এই দিনের আদব ও নিয়ম-কানুনগুলি ঠিক সেভাবে মেনে চলা যেভাবে আহলে বাইত (আ.) নির্দিষ্ট করেছেন এবং মেনে চলতেন।
কল্যাণকর কাজ
যদিও এই দিবসের সমস্তকর্মই কল্যাণময় কিন্তু তারপরেও একটি সার্বজনীন নির্দেশ ও ভূমিকা স্বরূপ কিছু নিয়ম-কানুন হাদীসে বর্ণিত হয়েছেঃ এই দিনের একটি সৎকর্ম ৮০ মাসের (আশি মাসের) সৎকর্মের সমপরিমাণ।(ইকবালুল আ’মাল, পৃষ্ঠা-৪৬৫, লাইন নং-সর্বশেষ।)
ইবাদত
ইমাম রেযা (আ.) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেনঃ গাদীর দিবস এমনই একটি দিন যে দিনে যদি কেউ ইবাদত বন্দেগী করে তাহলে আল্লাহ তায়ালা তাকে সম্পদে সমৃদ্ধ করে দেন।(ইকবালুল আ’মাল, পৃষ্ঠা-৪৬৪, লাইন নং-১৮।)
রোজা
ইবনে হোরায়রা হতে বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি ১৮ই জিলহিজ্জায় রোজা রাখবে আল্লাহ তায়ালা তার জন্য ৬০ বছরের রোজা লিখে রাখবেন।(ফারায়েদুস সিমতাঈন, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭৭, অধ্যায়-১৩, হাদীস-৪৪ ও মানাকেবে ইবনে মাগাজেলী, পৃষ্ঠা-১৯, হাদীস-২৪।)
ইমাম সাদিক (আ.) এক হাদীসে তার শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে এই রোজা সম্পর্কে বলেছেনঃ এই দিনের একটি রোজা অন্য সময়ের ৬০ মাসের (ষাট মাসের) রোজার সমতুল্য।(ইকবালুল আ’মাল, পৃষ্ঠা-৪৬৫)
অন্য এক হাদীসে বলেছেনঃ ঈদে গাদীরে খুমের একদিনের রোজা, আল্লাহর নিকট একশ’টি গহণযোগ্য হজ্জ ও ওমরার সমতুল্য।(আল-গাদীর, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৮৫।)
অনুরূপভাবে বর্ণনা করেছেনঃ গাদীরে খুমের রোজা পৃথিবীর আয়ুর (জীবনের) সমস্ত রোজার সমান, যদি কেউ এ ধরনের বয়সের অধিকারী হয় এবং সে যদি সারা জীবন রোজা রাখে।(ইকবালুল আ’মাল, পৃষ্ঠা-৪৬৩)
নামাজ
ঈদে গাদীরের কিছু নামাজ আছে যা বিশেষ পদ্ধতিতে পড়াতে হয়।
যদি কেউ তাদের মত হতে চায় যারা সেদিন রাসূল (সা.)-এর সাথে ছিলেন ও সে সকল সত্যবাদী যারা আল্লাহ ও তার রাসূল (সা.)-এর সাথে আমিরুল মু’মিনীন আলী (আ.)-এর বন্ধুত্ব কে সত্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন তাদের সম মর্যাদার অধিকারী হতে চায় এবং ঐ সকল ব্যক্তির মত হতে চায় যারা রাসূল (সা.), আমিরুল মু’মিনীন আলী (আ.), ইমাম হাসান (আ.) ও ইমাম হোসাঈন (আ.)-এর পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে শহীদ হয়েছেন এবং তাদের মত যারা হযরত ইমাম মাহদীর (আ.) পতাকাতলে ও তার তাবুর ছায়াতলে আছেন এবং মহান ও মহৎ ব্যক্তিগণের অন্তর্ভুক্ত হতে চায়, তাহলে সে যেন যোহরের প্রারম্ভে অর্থাৎ ঠিক সেই সময়ে- যে সময়ে রাসূল (সা.) ও তার সাহাবীগণ গাদীরে খুমের নিকটবর্তী হয়েছিলেন- দু’রাকাত নামাজ আদায় করে এবং নামাজের পরে শুকরানা সিজদায় (নামাজ শেষ করার পর শুকরিয়া আদায়ের জন্য একটি সিজদা) গিয়ে যেন একশ’বার বলে- শুকরান লিল্লাহ ।(ইকবালুল আ’মাল, পৃষ্ঠা-৪৬৩)
জিয়ারত
ইমাম রেযা (আ.) এক হাদীসে বলেছেনঃ যেখানেই থাক না কেন, চেষ্টা করবে গাদীর দিবসে আমিরুল মু’মিনীন আলী (আ.)-এর মাজারের নিকটবর্তী হওয়ার। কারণ, এই দিনে আল্লাহ তায়ালা ঈমানদারদের ষাট বছরের পাপসমূহকে ক্ষমা করে দেন এবং রমজান মাসের, শবে কদরের ও ঈদুল ফিতরের রাতের চেয়েও দ্বিগুণ সংখ্যক ব্যক্তিকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি প্রদান করেন।(ইকবালুল আ’মাল, পৃষ্ঠা-৪৬৩)
তার পবিত্র মাজারের নিকটবর্তী হওয়া যদি কারো পক্ষে অসম্ভব হয় তাহলে সে দূর হতেও জিয়ারত করতে পারে।
পবিত্র ইমামগণ থেকে গাদীর দিবসকে কেন্দ্র করে তিন’টি জিয়ারতের কথা বর্ণিত হয়েছে, যার প্রতিটিই দূর হতে ও নিকট থেকে পাঠ করা যেতে পারে। ঐগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হচ্ছে- জিয়ারতে “আমিনাল্লাহ” যা আকারে ছোট ও সনদ বা সূত্রের দিক থেকে অকাট্য ও নির্ভরযোগ্য। এই জিয়ারতে আমিরুল মু’মিনীন আলীকে (আ.) উদ্দেশ্য করে পাঠ করে থাকিঃ
“সালাম (শান্তি) বর্ষিত হোক আপনার উপর হে বিশ্বজগতে আল্লাহর নিদর্শন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি হে আমিরুল মু’মিনীন! আল্লাহর পথে আপনি যথোচিতভাবে চেষ্টা-প্রচেষ্টা করেছেন, তার কিতাব কোরআনের উপর আমল করেছেন ও তার রাসূল (সা.)-এর সুন্নাতের অনুসরণ করেছেন, যখন আপনার জন্যে আল্লাহ সর্বোত্তম পুরস্কারের কথা ভাবলেন তখন তিনি আপনাকে নিজের কাছে ডেকে নিলেন ও আপনার উন্নত আত্মাকে স্বীয় সান্নিধ্যে স্থান দিলেন। যদিও আপনি সমস্ত সৃষ্টির মাঝে উপযুক্ত প্রমাণ হিসেবে ছিলেন, তবুও আল্লাহ আপনার শাহাদাতের মাধ্যমে আপনার শত্রুদের উপর হুজ্জাত বা প্রমাণ সমাপ্ত করেছেন।” .
“হে আল্লাহ! বিনয় ও নম্রতার অন্তরসমূহ তোমারই প্রেমে দিশেহারা; তোমার প্রেমিকদের জন্য তোমার দরজা সদা-সর্বদা খোলা, যারা তোমার প্রতি প্রত্যাবর্তনের আশা পোষণ করেন তারা সুস্পষ্ট প্রমাণের অধিকারী। যারা তোমার কাছে প্রত্যাবর্তন করতে চায় তাদের অন্তরে কেবল তুমিই বিদ্যমান। যারা তোমাকে ডাকে তাদের আওয়াজই কেবল তোমার নিকট পৌছায় ও তাদের প্রার্থনা মঞ্জুরের দরজাসমূহ সব সময় খোলা। আর যারা গোপনে তোমার ইবাদত করে তাদের দোয়া অতি তাড়াতাড়ি কবুল কর। তাদের তওবা কবুল হয় যারা তোমার দিকে প্রত্যাবর্তন করে, যে তোমার ভয়ে ক্রন্দন করে তার প্রতিটি অশ্রু ফোটাকে তোমার রহমতে রূপান্তর কর, যে তোমার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করে তুমি তার সাহায্যে এগিয়ে আস, যে তোমার নিকট সহযোগিতা কামনা করে তুমি তাকে সহযোগিতা কর, তুমি যেসব অঙ্গীকার তোমার বান্দাদেরকে দিয়েছো তার বাস্তবায়ন কর এবং যে তোমার নিকট ক্ষমা চায় তুমি তার ত্রুটিগুলোকে উপেক্ষা ও মার্জনা কর।”(ইকবালুল আ’মাল, পৃষ্ঠা-৪৬৩)
দয়া ও অনুগ্রহ
ঈদে গাদীরের নিয়মাবলীর মধ্যে একটি হচ্ছে-ঈমানদারদের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ করা। এ বিষয়ে পবিত্র ঈমামগণ বিশেষ সুপারিশ করেছেন। এই দিনে দয়া ও অনুগ্রহের গুরুত্বের নিদর্শন হচ্ছে-
প্রথমতঃ হাদীস ও বর্ণনাসমূহে বিভিন্ন শিরোনামে এ দায়িত্ব পালনের বিশেষ তাগিদ দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে হাদীসসমূহে দয়া ও অনুগ্রহের নিদর্শন হিসেবে নমুনা দান, পরস্পরকে সহযোগিতা, উপহার প্রদান, আতিথেয়তা, খাদ্য বিতরণ, ইফতার করানো, দয়া পরবশ হওয়া, ঈমানদার ভাইয়ের মনবাসনা পূর্ণ করার কথা বলা হয়েছে।
দ্বিতীয়তঃ উপদেশ দেওয়া হয়েছে, এই দিনে যার দান করার মত যথেষ্ট পরিমাণ ধন-সম্পদ নাই সে যেন ঋণ গ্রহণ করে। ইমাম আলী (আ.) নিজে বর্ণনা করেছেনঃ যদি কেউ এই কারণে ঋণ নেয় যে, সে মু’মিন ভাইদেরকে সাহায্য করবে, তাহলে আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে নিশ্চয়তা প্রদান করবো, যদি তাকে জীবিত রাখে, সে যেন তার ঋণ পরিশোধ করতে পারে; আর যদি জীবিত না রাখে তাহলে ঐ ঋণ তার থেকে নেওয়া হবে না।(আল-মোরাকেবাত, পৃষ্ঠা-৪৬৪) অথচ আমরা অবগত যে, শরীয়তের দৃষ্টিতে ঋণ গ্রহণ কাজটি শোভনীয় নয় এবং ইসলাম মানুষের অধিকারকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে থাকে ।
আমিরুল মু’মিনীন হযরত আলী (আ.) গাদীর দিবস উপলক্ষে জুমআ’র এক খুতবায় বলেছেনঃ
আল্লাহ আপনাদের রহমত দান করুক! আপনারা যখন অনুষ্ঠান শেষে একে অপর হতে পৃথক হয়ে যাবেন, তখন স্বীয় পরিবারের জন্য উম্মুক্ত হস্তে খরচ করুন, আপন ভাইয়ের প্রতি দয়া-অনুগ্রহ করুন এবং আল্লাহ তায়ালা যে নেয়ামত দান করেছেন তার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করুন... এই দিনে সৎকাজ সম্পাদন করলে সম্পদ বৃদ্ধি পায় ও আয়ু বাড়ে। পরস্পরের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ প্রদর্শন বান্দার প্রতি আল্লাহর রহমত বৃদ্ধি ও সহানুভূতিকে জাগ্রত করে। অতএব, যা কিছু আল্লাহ তায়ালা আপনাদেরকে দান করেছেন তা থেকে উদারতার সাথে দান করুন।
আনন্দ ও প্রফুল্লতার সাথে পরস্পরের সাথে সাক্ষাত করুন এবং আল্লাহ আপনাদেরকে যে নেয়ামত দান করেছেন তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন! যারা আপনাদের প্রতি আশাবাদী হয়ে আছে তাদের প্রতি বেশী বেশী অনুগ্রহ করুন! যতটা সম্ভব হয় নিজেদের ও দুর্বলদের এবং যারা আপনাদের অধীনে আছে তাদের মধ্যে সমতা বজায় রাখুন!।
এই দিনে এক দিরহাম দান করা অন্য দিনে দুইশ’ দিরহাম দান করার সমান ও আল্লাহ যদি চান তাহলে এর চেয়েও বেশী দিতে পারেন।
যে ব্যক্তি প্রথমে তার ভাইয়ের প্রতি অনুগ্রহ করবে ও আগ্রহ সহকারে দয়া দেখাবে, সে ঐ ব্যক্তির পুরস্কার লাভ করবে, যে ব্যক্তি এই দিনে রোযা রেখেছে।(ইকবালুল আ’মাল, পৃষ্ঠা-৪৬৩)
আনন্দোৎসব
এটা পছন্দণীয় যে, একজন মু’মিন ব্যক্তি এই দিনে প্রচলিত রীতির মধ্যে থেকে এবং শরীয়তের বিধি-নিষেধ মেনে চলে আনন্দ ও উৎসব করবে এবং স্বীয় জীবনকে অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু ভিন্নভাবে সাজাবে। বিশেষ করে যে সকল আনন্দ-উৎসব বিভিন্ন হাদীসে বিশেষ গুরুত্বের সাথে বর্ণিত হয়েছে সে সব করা উত্তম। যেমন- গোসল করা, আতর বা খোশবু লাগানো, সাজ-গোছ করা, নিজেকে পরিপাটি করে রাখা, নতুন পোশাক পরিধান করা, পাক-পবিত্র থাকা, দেখা-সাক্ষাত করা, স্বাগত জানানো এবং করমর্দন করা, মুক্ত হস্তে খরচ করা ইতাদি।
ঈদে গাদীর দিবসে আনন্দোৎসবের বিষয়টি আহলে বাইতের প্রতি ভালবাসা ও সহমর্মিতার দৃষ্টান্ত হওয়া ছাড়াও স্বয়ং উৎসব পালনের দিকটিও বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছে।
ইমাম সাদিক (আ.) এক বর্ণনায় গাদীর দিবসের অনুষ্ঠানাদি উৎযাপন করার পর এই ঈদের কিছু নিয়ম-কানুন পালনের সময় বললেনঃ এই দিনে খাও, পান কর আর যারা এই দিনে দুঃখ প্রকাশ করে আল্লাহ তাদের দুঃখকে আরো কয়েক গুণ বৃদ্ধি করে দেন তাই এই দিনে আনন্দ-ফুর্তি কর।(ইকবালুল আ’মাল, পৃষ্ঠা-৪৬৩)
ইমাম রেযা (আ.) বলেছেনঃ
এই দিনটি সাজ-গোছ করার দিন। যদি কেউ এই দিনের সম্মানার্থে নিজেকে সাজায় তাহলে আল্লাহ তার সমস্ত ছোট ও বড় পাপসমূহ মোচন করে দেন এবং একজন ফেরেশতাকে নির্ধারণ করে দেন যেন সে আগামী বছর পর্যন্ত তার জন্য উত্তম কিছু লিখতে থাকে ও তার অবস্থানকে যেন আরো উর্ধ্বে পৌছে দেয়। আর যদি এ অবস্থায় মৃত্যু বরণ করে তাহলে সে শহীদের মর্যাদা পাবে, আর যদি জীবিত থাকে তাহলে সে সৌভাগ্যশীল হবে।(ইকবালুল আ’মাল, পৃষ্ঠা-৪৬৩)
অনুরূপ উত্তম কাজ হচ্ছে, মু’মিন ভাইদের সাথে আনন্দের সাথে সাক্ষাৎ করা এবং এমন ধরনের কাজ করা যাতে সকলেই বুঝতে পারে সে আনন্দিত।
ইমাম রেযা (আ.) বলেছেনঃ
এই দিনটি হচ্ছে- ঈমানদার ভাইদের জন্যে হাসি-খুশির দিন। যদি কেউ এই দিনে কোন ঈমানদার ভাইয়ের সাথে হাস্যোজ্জল মুখে সাক্ষাৎ করে তাহলে আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন তার প্রতি রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন ও তার হাজার’টি আশা পূর্ণ করবেন এবং তার জন্য বেহেশতে সাদা মুক্তার এক প্রসাদ নির্মান করবেন ও তার চেহারাকে উজ্জল করে দিবেন।(ইকবালুল আ’মাল, পৃষ্ঠা-৪৬৩)
দোয়া
ইসলামের পবিত্র শরীয়তে বর্ণিত শ্রেষ্ঠ ইবাদতসমূহের অন্যতম হল দোয়া। দোয়া হচ্ছে এমন একটি ইবাদত যে সম্পর্কে কোরআনে বলা হয়েছেঃ “যে কেউ অহংকারের বশে আমার ইবাদতকে প্রতাখ্যান করবে, সে অপমান ও লাঞ্চনার সাথে দোযখে প্রবেশ করবে।”(সূরা-গাফির, আয়াত-৬০।)
দোয়া হচ্ছে- কথা বলা সেই উপাস্যের সাথে যিনি এক ও অদ্বিতীয় এবং এই বিশ্বজগতসহ তার মধ্যে যা কিছু আছে তার স্রষ্টা এবং এর কারণে বান্দার প্রতি আল্লাহ তায়ালার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছেঃ
)قُلْ مَا يَعْبَأُ بِكُمْ رَبِّي لَوْلَا دُعَاؤُكُمْ(
অর্থাৎ বল যদি দোয়া না করতে (না ডাকতে) তাহলে আমার প্রভূ তোমাদের প্রতি ফিরেও তাকাতেন না (আদৌ মূল্য দিতেন না)।(সূরা-ফকোন, আয়াত-৭৭।)
গাদীর দিবসটি দোয়া করার জন্য একটি বিশেষ দিন বা সময়।
ইমাম রেযা (আ.) বলেছেনঃ গাদীর দিবসটি এমনই এক দিন যে দিনে দোয়াসমূহ কবুল হয়।(ইকবালুল আমাল, পৃষ্ঠা-৪৬৪)
আর সে কারণেই যে সকল দোয়া মুস্তাহাব নামাযসমূহের পরে ও বিভিন্ন সময়ে পড়ার নির্দেশ এসেছে সেগুলি ব্যতীত, পৃথক কিছু দোয়া স্বতন্ত্র ভাবে এই দিনের জন্য বর্ণিত হয়েছে।
গাদীর দিবসের দোয়াসমূহের কেন্দ্রস্থল
গাদীর দিবসের দোয়াসমূহের মূল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে- বেলায়াতের (শাসনকর্তৃত্বের) নেয়ামত বা অনুগ্রহ। দোয়াকারী এই দিনে তাদের বিভিন্ন দোয়াতে বা প্রার্থনাতে এই মহা অনুগ্রহ সম্পর্কে স্বীয় প্রভূর সাথে কথোপকথন করে থাকে ।
কখনো কখনো এই শ্রেষ্ঠ প্রশংসাসূচক কথাটি উল্লেখ করে বলে থাকে, হে আল্লাহ! তার জন্য তোমাকে জানাই কৃতজ্ঞতা। কখনো আবার আল্লাহর নিকট অনুরোধ করে যেন এই অনুগ্রহটি তার কাছ থেকে ছিনিয়ে না নেয়া হয় অথবা আজীবন ধরে যেন তার উপর দৃঢ় ও অবিচল থাকতে পারে। কখনো আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে, যেমন করে এই মর্যাদাটি তাকে দিয়েছে ও তাকে বেলায়াত (কর্তৃত্ব) গ্রহণের যোগ্যতা দান করেছে, ঠিক তেমনভাবে যেন তার পাপসমূহকে আড়াল করে ও ত্রুটিসসমূহকে ক্ষমা করে দেয়।
কখনো চায় আল্লাহ তাকে যেন এ তৌফিক দান করে যে বেলায়াতের আবশ্যকীয় বিষয়সমূহকে অনুসরণ ও পালন করতে পারে, যেমন ওলীর (অভিভাবকের) শর্তহীন অনুসরণ যা বেলায়াতের মূল শর্ত তা মেনে চলা যেন তার জন্য সহজ হয় ও তাকে যেন তৌফিক দান করে যাতে ইমামগণের শত্রুর সাথে শত্রুতা পোষণ করতে পারে এবং তাদের বন্ধুর সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে পারে।
“সজ্জিত হওয়ার সময়” নামক একটি প্রসিদ্ধ দোয়া যা গাদীর দিবসে সকালে পাঠ করা হয়ে থাকে, তাতে এভাবে বর্ণনা করা হচ্ছে-
আমরা আলী (আ.)-এর বন্ধু ও তার বন্ধুদের বন্ধু; যেমনভাবে তুমি নির্দেশ দিয়েছ তার সাথে বন্ধুত্ব করার ও তার শত্রুদের সাথে শত্রুতা করার। যারা তার প্রতি অসন্তুষ্ট আমরাও তার প্রতি অসন্তুষ্ট, যাদের অন্তুরে তার প্রতি হিংসার আগুন জ্বলে আমরাও তাদের প্রতি আমাদের অন্তরে হিংসার আগুন জ্বালিয়ে রাখব, যারা তাঁর প্রতি ভালবাসাপোষণ করে আমরাও তাদের প্রতি ভালবাসাপোষণ করব।(ইকবালুল আমাল, পৃষ্ঠা-৪৬৪)
কখনো কখনো আবার ইমামগণের মান-মর্যাদার কথা স্মরণ করা হয় ও তাদেরকে স্মরণের মাধ্যমে স্বীয় অন্তরকে কলুষমুক্ত করে থাকে এবং দ্বীনের অভিভাবকদের মর্যাদার শীর্ষকে অবলোকন করে আর একের পর এক দরূদের মাধ্যমে নিজেদের আত্মাকে তাদের পাক-পবিত্র আত্মার সাথে মিলিয়ে দেয় ও মানুষের মর্যাদার সীমাহীন সমূদ্রে সাতার কাটতে থাকে গাদীর দিবসের অপর একটি দোয়া হচ্ছেঃ
اللهم صل علی محمد و آل محمد الائمه القاده والدعاه الساده و النجوم الزاهره و الاعلام الباهره و ساسه العباد و ارکان البلاد و الناقه المرسله و السفینه الناجیه الجاریه فی الغامره
অর্থাৎ হে আল্লাহ! শান্তি বর্ষণ করুন রাসূল (সা.) ও তার পরিবারবর্গের উপর, নেতৃত্বদানকারী নেতার উপর, আহবানকারী সর্দারের উপর, উজ্জল নক্ষত্র ও স্পষ্ট নিদর্শনের উপর এবং যারা তোমার বান্দাদের বিভিন্ন বিষয়াদির ব্যবস্থাপনা করে থাকে ও যারা বসবাসযোগ্য ভূমিসমূহের স্তম্ভ তাদের উপর, যারা এমনই এক মো’জেজা বা অলৌকিক শক্তির অধিকারী যা দ্বারা তুমি মানুষের পরীক্ষা নিয়ে থাক এবং তাদের উপর দরুদ যারা এমনই নাজাতের তরী যা গভীর ঘূর্ণাবর্তের মাঝেও গতিশীল।(ইকবালুল আমাল, পৃষ্ঠা-৪৬৪)
হে আল্লাহ! শান্তি বর্ষণ করুন মুহাম্মাদ ও তার বংশধরের প্রতি যারা তোমার জ্ঞান ভাণ্ডারের সংরক্ষক, একত্ববাদের ও এক আল্লাহর ইবাদতকারীদের দৃঢ় ভিত্তি, দ্বীন ও মহত্ত্বের খনির স্তম্ভসমূহ। শান্তি বর্ষণ করুন তাদের উপর যাদেরকে তোমার বান্দাদের মধ্য থেকে বেছে নিয়েছ। শান্তি বর্ষণ করুন তাদের উপর যারা পবিত্র, পরহেজগার, মহৎ ও কল্যাণময়; তারা এমনই দরজা যেখানে মানুষ পরীক্ষার সম্মুখীন হয়, যারা এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করে তারা মুক্তিলাভ করে আর যারা প্রবেশ করা থেকে বিরত থাকে তারা ধ্বংস হয়।
হে আল্লাহ! শান্তি বর্ষণ করুন মুহাম্মাদ ও তার পরিবারবর্গের উপর যাদেরকে “আহলে জিকর বা অবগত” বলে অভিহিত করে বলেছ যে, তাদের নিকট জিজ্ঞাসা কর, (নবীর) নিকটাত্মীয় বলে যাদের প্রতি ভালবাসার নির্দেশ দিয়েছ, তাদের প্রতি ভালবাসাকে আবশ্যক করে দিয়েছ ও বেহেশত তাদেরই অধীনে দিয়েছ যারা তাদের আনুগত্য করবে।
হে আল্লাহ! শান্তি বর্ষণ করুন মুহাম্মাদ ও তাঁর পরিবারবর্গের উপর; কারণ, তারা তোমার আনুগত্য করার নির্দেশ দিতেন ও পাপ থেকে বিরত থাকতে বলতেন এবং তোমার বান্দাদেরকে তোমারই একত্ববাদের দিকে আহবান করতেন।
(মুহাম্মদ রেজা জাব্বারান প্রণীত ও মুহাদ্দিস এম, এ, রহমান কর্তৃক অনূদীত আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে গাদীর গ্রন্থ থেকে সংকলিত)