আবনা ডেস্কঃ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ৩০টি পুলিশ ফাঁড়িতে ‘রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের’ হামলার ঘটনায় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যসহ অন্তত ৮৯ জন নিহত হয়েছেন। এক রাতের মধ্যে এসব পুলিশ ফাঁড়ি ও একটি সেনা ছাউনিতে বিদ্রোহীদের হামলায় নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ জন সদস্য এবং রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের ৭৭ জন নিহত হয়েছেন।
শুক্রবার সকাল থেকে সংঘর্ষ ও সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১টার দিকে এ হামলার ঘটনা ঘটে বলে শুক্রবার সকালে এক বিবৃতিতে জানায় দেশটির স্টেট কাউন্সেলর অং সান সুচির কার্যালয়।
রাখাইনে হামলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন রোহিঙ্গা ইস্যুতে গঠিত কমিশনের প্রধান ও জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান। খবর আল জাজিরার।
রাখাইনের পরিস্থিতি নিয়ে গঠিত কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বড় ধরনের এই সমন্বিত হামলার ঘটনায় সংকট নতুন মাত্রা পেল। ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠল রাখাইন রাজ্য। শুক্রবার ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ)’ নামে একটি গ্রুপ হামলার দায় স্বীকার করেছে।
একসময়ে ‘হারাকা আল-ইয়াকিন’ নামে পরিচিত এ গ্রুপটিই গত বছরের অক্টোবরে পুলিশ ক্যাম্পে হামলা চালিয়েছিল। মিয়ানমার সরকারের বিবৃতিতে বলা হয়, রোহিঙ্গা গেরিলাদের সঙ্গে স্থানীয় গ্রামবাসী ধারালো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পুলিশ পোস্ট ঘিরে ফেলে এ হামলা চালায়। রাত ৩টার দিকে প্রায় দেড়শ হামলাকারী খামারা এলাকায় একটি সেনা ক্যাম্পে ঢোকার চেষ্টা করলেও প্রতিরোধের মুখে পিছিয়ে যায় বলে জানানো হয়েছে সরকারের বিবৃতিতে।
গত অক্টোবরে প্রায় একই ধরনের হামলায় ৯ পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার পর বড় ধরনের দমন অভিযানে নামে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। ওই অভিযানে বেসামরিক রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে হত্যা, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া এবং ধর্ষণের মতো অভিযোগ ওঠে। সেনাবাহিনীর ওই দমন অভিযানের মুখে ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান রাখাইন থেকে পালিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সে সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত হয় বলেও জাতিসংঘের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়।
চলতি মাসে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী রাখাইনের দুর্গম পাহাড়ি এলাকাগুলোয় নতুন করে দমন অভিযান শুরুর পর থেকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। বৃহস্পতিবার রাতে এ হামলা শুরুর পর কিছু কিছু এলাকায় সেনা ও বিদ্রোহীদের মাঝে এখনও সংঘর্ষ চলছে। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
তবে এবার হামলাকারীর সংখ্যা গত অক্টোবরের হামলাকারীদের থেকে অন্তত পাঁচ গুণ বেশি বলে জানিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। অন্তত ৫০টি গ্রামের এক হাজার বিদ্রোহী হামলায় অংশ নেয় বলে সেনা সদস্যরা মনে করছেন।
এদিকে ঘটনার পর এক বিবৃতিতে হামলাকারীদের ‘বাঙালি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে অং সান সুচির কার্যালয়ের সংবাদ বিভাগ। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের মংডু এলাকার একটি পুলিশ স্টেশনে হাতে তৈরি বোমা নিয়ে চরমপন্থী বাঙালি বিদ্রোহীরা আক্রমণ করে।
রাত ১টার দিকে আরও কয়েকটি পুলিশ পোস্টে তারা সমন্বিত হামলা চালায়।’ বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ১৫০ জন রোহিঙ্গা আক্রমণকারী একটি সেনা ক্যাম্প ভাঙার চেষ্টা চালিয়েছিল। সেনাবাহিনী পাল্টা হামলা চালিয়ে তা ভেস্তে দিয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বরাত দিয়ে রয়টার্স জানায়, রাখাইনে ২০১২ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর সৌদি আরবে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গারা তৈরি করে এআরএসএ গ্রুপ, যারা ইতিমধ্যে হামলার দায় স্বীকার করেছে। গ্রুপটির নেতা আতা উল্লাহ বলেন, শত শত তরুণ রোহিঙ্গা তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। মানবাধিকার রক্ষায় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ন্যায্য প্রতিরোধ তারা চালিয়ে যাবে বলে জানিয়েছে গ্রুপটি। এআরএসএর নামে করা একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে এক পোস্টে হামলার দায় স্বীকার করে বলা হয়, ‘বার্মিজ নির্যাতনকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে ২৫টির বেশি জায়গায় আমরা প্রতিরোধ কার্যক্রম চালিয়েছি। শিগগির আরও আসছে।’
এ হামলার নিন্দা জানিয়েছেন কফি আনান। তিনি বলেন, ‘তদন্ত কমিশনের প্রধান হিসেবে আমি এ ঘটনার ব্যাপারে গভীরভাবে অবগত রয়েছি। রাখাইনে সেনাসদস্য নিহত হওয়ার ঘটনায় আমি অত্যন্ত ব্যথিত হয়েছি।’
বৃহস্পতিবারের হামলার কয়েক ঘণ্টা আগে কফি আনান রাখাইনের পরিস্থিতি নিয়ে তাদের তদন্ত প্রতিবেদন মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচির কাছে হস্তান্তর করেন। পরে ইয়াংগুনে সংবাদ সম্মেলনে কফি আনান বলেন, ‘নাগরিকত্ব না পাওয়ায় এবং নিদারুণ বৈষম্যের কারণে মুসলমান রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছে। তাদের ওপর বলপ্রয়োগের পথ ছেড়ে মিয়ানমার সরকারকে যৌক্তিক সমাধানের পথে আসতে হবে এবং তাদেরকে নাগরিকত্ব দিতে হবে।’