বাঙ্গালী
Sunday 24th of November 2024
0
نفر 0

ইসলামের অন্যতম কাণ্ডারি মজলুম ইমাম কাযিম (আ.)

ইসলামের অন্যতম কাণ্ডারি মজলুম ইমাম কাযিম (আ.)

আজ আমরা এমন একজন ব্যক্তিকে স্মরণ করব শোকার্ত ও সশ্রদ্ধ চিত্তে যিনি ছিলেন আল্লাহর শীর্ষস্থানীয় বন্ধু, মানবজাতির জন্য খোদায়ী ধর্ম ও সত্যের প্রকাশ, বিশ্বজুড়ে অজ্ঞতা ও নৈরাজ্যের  কালো আঁধারে আল্লাহর নূরের প্রতিফলন এবং মানবজাতিকে সুপথ দেখানোর মিশনে ছিলেন ত্রুটি-বিহীন ও নিবেদিত-প্রাণ। তিনি আল্লাহর পথে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা,ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সংগ্রাম উপহার দিয়েছেন এবং এই পথে অসংখ্য বাধা-বিঘ্ন আর জুলুমের শিকার হয়ে শাহাদত বরণ করেছেন। আমাদের এই আলোচ্য মহাপুরুষ হলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইত (আ.) ও নিষ্পাপ ইমামকুলের সদস্য, সতকর্মশীলদের অন্যতম নেতা, নবী-রাসূলদের উত্তরসূরি ও পরিপূর্ণ মহামানব হযরত ইমাম মুসা কাযিম (আ.)।
 
হযরত ইমাম মুসা কাযিম (আ.)'র শাহাদত বার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর মহান আত্মার প্রতি জানাচ্ছি সশ্রদ্ধ সালাম এবং সবাইকে জানাচ্ছি গভীর শোক ও সমবেদনা।  
ইমাম মুসা ইবনে জাফর আল কাযিম (আ.)'র জন্ম হয়েছিল ১১৯ হিজরিতে। তাঁর পিতা ছিলেন বিশ্ববিশ্রুত ইমাম হযরত জাফর সাদিক (আ.); আর মায়ের নাম ছিল হামিদাহ (সালামাতুল্লাহ আলাইহা) । ক্রোধ বা রাগ সংবরণে এবং ধৈর্য ধারণের ক্ষেত্রে ইমাম মুসা কাযিম (আ.)'র অশেষ ক্ষমতা দেখে স্তম্ভিত হত ততকালীন জালেম শাসকগোষ্ঠী। অশেষ ধৈর্যের জন্যই এই মহান ইমামকে বল হত কাযিম। তিনি ছিলেন পিতা ইমাম জাফর সাদিক (আ.)'র মতই নির্ভীক ও ন্যায়পরায়ণ এবং জুলুমের বিরুদ্ধে সোচ্চার। পিতার মহত গুণগুলোর সবই অর্জন করেছিলেন ইমাম মুসা কাযিম (আ.)। তাঁর ৩৫ বছরের ইমামতির জীবনের প্রায় পুরোটাই কেটেছে কারাগারে ও নির্বাসনে।
 
ইমাম মুসা কাযিম (আ.) আব্বাসীয় শাসকদের শত অত্যাচার ও নিপীড়ন এবং কারাদণ্ড ও নির্বাসন সত্ত্বেও ইসলামের সঠিক শিক্ষা প্রচারের আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। এ আন্দোলনের যে বিশেষ ধারা  তাঁর মহান পিতা ইমাম জাফর সাদিক (আ.) শুরু করেছিলেন তা আরও বিকশিত হয়েছিল পুত্রের প্রজ্ঞা, কৌশল ও ত্যাগ-তিতিক্ষাপূর্ণ অধ্যবসায়ের সুবাদে। বিশেষ করে পবিত্র কুরআনের প্রকৃত তাফসির ও হাদীস বর্ণনা তাঁর মাধ্যমে আরও বিকশিত হয়। ইমাম তাঁর অনুসারীদেরকে জ্ঞান অর্জনের জন্য অশেষ অনুপ্রেরণা যোগাতেন। তিনি বলতেন, জ্ঞান মৃত আত্মাকে জীবিত করে যেমনটি বৃষ্টি জীবিত করে মৃত ভূমিকে। ইমাম মুসা কাযিম (আ.) বিভ্রান্ত ব্যক্তিদের সঙ্গ ত্যাগ করতে নিজ অনুসারীদের তাগিদ দিতেন। মানুষ কখনও বিভ্রান্ত ব্যক্তির কুপ্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারে না এবং যখন মন্দ ব্যক্তির ওপর আল্লাহর শাস্তি নাজেল হয় তখন তার সঙ্গে থাকা সত ব্যক্তিও সেই শাস্তি এড়াতে পারে না বলে এই মহান ইমাম উল্লেখ করেছেন।
 
আব্বাসীয় শাসকদের বিভ্রান্ত ও দুর্নীতিগ্রস্ত চাল-চলন যে ইসলামের সম্পূর্ণ বিপরীত ধারা  পিতার মতই তা তুলে ধরেছিলেন ইমাম মুসা কাযিম (আ.) ।  তাই আব্বাসিয় শাসকরা চাইতেন না জনগণের সঙ্গে ইমামের যোগাযোগ বৃদ্ধি পাক। তারা জনগণের ওপর নবী বংশের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকানোর জন্য যে কোনো ধরনের প্রতারণ, প্রচারণা, বর্বরতা ও নৃশংসতার আশ্রয় নিতে দ্বিধা বোধ করত না। এমনকি বিশ্বনবী (সা.)'র আহলে বাইত এবং তাঁদের অনুসারীদের ওপর জুলুম ও নৃশংস আচরণের ক্ষেত্রে আব্বাসীয়রা উমাইয়াদের চেয়েও বেশি অগ্রসর হয়েছিল, যদিও তাদের নেতৃত্বে সংঘটিত উমাইয়া বিরোধী আন্দোলন জন-সমর্থন পেয়েছিল এই প্রতিশ্রুতির কারণে যে ইসলামী খেলাফতে সমাসীন করা হবে বিশ্বনবী (সা.)'র আহলে বাইতকে। আব্বাসীয়রা ইমাম জাফর সাদিক ও ইমাম মুসা কাযিম (আ.) সহ নবী বংশের বেশ কয়েকজন ইমামকে শহীদ করেছিল।
 
হযরত ইমাম মুসা কাযিম (আ.) তাঁর বন্দী অবস্থার নিকৃষ্টতম সময়েও বিচক্ষণতা, বীরত্ব এবং সংগ্রামী ও আপোষহীন মনোভাব ত্যাগ করেননি। ইমাম এক চিঠিতে হারুনের কাছে লিখেছিলেন: এমন কোনো দিন নেই যে আমি কষ্টে কাটাইনি অথচ এমন কোনো দিন নেই যে তুমি সুখ-স্বচ্ছন্দে কাটাওনি। কিন্তু, ওই দিন পর্যন্ত আরাম আয়েশে লিপ্ত থাক যেদিন আমরা উভয়ই এমন এক জগতে পদার্পণ করব যার কোনো শেষ নেই এবং ওই দিন অত্যাচারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
 
ইমামের এ ধরনের জ্বালাময়ী  বক্তব্য ও দৃঢ় মনোবল  ছিল হারুনের কাছে অসহনীয়। হারুন কেবল ইমামের আধ্যাত্মিক খ্যাতির জন্যই ইর্ষান্বিত হয়ে তাঁকে কারাগারে বন্দী করেনি।  ইমাম মুসা ইবনে জাফর (আ.)’র অনুসারীদের সঙ্গে তাঁর সার্বক্ষণিক যোগাযোগের কথাও হারুন তার গোয়েন্দা বাহিনীর মাধ্যমে জানতে পেরেছিল। হারুন এটাও বুঝতে পেরেছিল যে ইমাম যখনই উপযুক্ত সুযোগ পাবেন তখনই স্বয়ং বিপ্লব করবেন কিংবা তাঁর সঙ্গীদেরকে আন্দোলনের নির্দেশ দেবেন, ফলে তার হুকুমতের পতন হবে অনিবার্য। তাই আপোষহীন এই ইমামের প্রাণনাশের সিদ্ধান্ত নেয়।
 
হারুন খেলাফতকে রাজতন্ত্রে পরিণত করা ও জনগণের সম্পদ লুটের জন্য লজ্জিত ছিল না। উপরন্তু সে জনগণকে ধোঁকা দেয়ার জন্য বিশ্বনবী (সা.)’র রওজায় গিয়ে রাসূল (সা.)-কে উদ্দেশ করে বলে: হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনার সন্তান মুসা ইবনে জাফরের ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেজন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। আমি আন্তরিকভাবে তাঁকে বন্দী করতে চাইনি। বরং আপনার উম্মতের মধ্যে যুদ্ধ ও বিরোধ সৃষ্টি হবে এ ভয়েই আমি এ কাজ করেছি।
 
ইমাম মুসা ইবনে জাফর (আ.)-কে বসরায় ঈসা ইবনে জাফর নামক এক জল্লাদের কারাগারে এক বছর বন্দী রাখা হয়। সেখানে ইমামের উত্তম চরিত্র জাফরের ওপর এমন প্রভাব রাখে যে ওই জল্লাদ হারুনের কাছে এক লিখিত বার্তায় জানিয়ে দেয় যে: তাঁকে আমার কাছ থেকে ফিরিয়ে নাও, নতুবা আমি তাঁকে মুক্ত করে দেব। এরপর হারুনের নির্দেশে ইমাম মুসা ইবনে জাফর (আ.)-কে বাগদাদে ফাযল ইবনে রাবির কাছে কারারুদ্ধ করা হয়। এর কিছু দিন পর ফাযল ইবনে ইয়াহিয়ার কাছে হস্তান্তর করা হয় এই মহান ইমামকে। কয়েক দিন পর সেখান থেকেও তাঁকে পাঠানো হয় কুখ্যাত জল্লাদ সানদি ইবনে শাহাকের কারাগারে।
 
ইমাম কাযিম (আ.)-কে এক কারাগার থেকে বার বার অন্য কারাগারে স্থানান্তরের কারণ ছিল এটাই যে হারুন প্রতিবারই কারা প্রহরীকে নির্দেশ দিত ইমামকে গোপনে হত্যা করার। কিন্তু তাদের কেউই রাজি হয়নি এ কাজ করতে। অবশেষে সানদি ইমামকে বিষ প্রয়োগ করতে রাজি হয়। বিষ প্রয়োগের তিন দিন পর ১৮৩ হিজরির এমন দিনে  তিনি শাহাদত বরণ করেন। এ সময় ইমামের বয়স হয়েছিল ৫৫ বছর।      
 
হারুন ইমামকে শহীদ করার আগে একদল গণ্যমান্য ব্যক্তিকে কারাগারে উপস্থিত করেছিল যাতে তারা সাক্ষ্য দেয় যে ইমাম কাযিম (আ.) স্বাভাবিকভাবেই মারা গেছেন। এভাবে সে আব্বাসীয় শাসনযন্ত্রকে ইমাম (আ.)কে হত্যার দায়িত্বভার থেকে মুক্ত রাখতে ও ইমামের অনুসারীদের সম্ভাব্য আন্দোলন প্রতিরোধ করতে চেয়েছিল। কিন্তু  ইমামের প্রজ্ঞা সেই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেয়। কারণ, ওই সাক্ষীরা যখন ইমামের দিকে তাকিয়েছিল তখন তিনি বিষের তীব্রতা ও বিপন্ন অবস্থা সত্ত্বেও তাদেরকে বললেন: আমাকে নয়টি বিষযুক্ত খুরমা দিয়ে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে,আগামীকাল আমার শরীর সবুজ হয়ে যাবে এবং তার পরদিন আমি ইহজগত থেকে বিদায় নেব।
 
ইমাম মুসা কাযিম (আ.)’র মহানুভবতা, নম্রতা, সহিষ্ণুতা ও দানশীলতা ছিল শত্রুদের কাছেও সুবিদিত। তত্ত্বীয় ও জ্ঞানগর্ভ বিতর্কে ইমামের ঐশী জ্ঞান, বিস্তৃত চিন্তাশক্তি ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর পরিপূর্ণ দখল ফুটে উঠত। তিনি যে কোনো প্রশ্নের সঠিক,পরিপূর্ণ এবং প্রশ্নকারীর বোধগম্যতার আলোকে জবাব দিতেন। তাঁর প্রেমময় ইবাদত ছিল সাধকদের জন্য আদর্শ।
 
মদীনার অধিবাসীরা ইমাম মুসা কাযিম (আ.)-কে যাইনুল মুতাহাজ্জেদীন অর্থাত রাত্রি জাগরণকারীদের সৌন্দর্য উপাধিতে ভূষিত করেছিল।  এই মহান ইমাম এত সুন্দর ও সুললিত কণ্ঠে কুরআন তিলাওয়াত করতেন যে, যে কেউ তা শুনে কেঁদে ফেলত।
 
এই মহান ইমামের প্রতি অজস্র সালাম ও দরুদ পাঠিয়ে এবং সবাইকে গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়ে শেষ করব আজকের এই আলোচনা। তবে তাঁর আগে শুনুন ইমাম মুসা কাযিম (আ.)’র বরকতময় কয়েকটি বাণী:
 
১. খোদা পরিচিতির পরই আল্লাহর নৈকট্য লাভের সর্বোত্তম পন্থা হল নামাজ, বাবা মায়ের প্রতি সদাচরণ এবং হিংসা,স্বেচ্ছাচার,অহংকার ও দাম্ভিকতা পরিহার করা।
২.বিনয়ের অর্থ হল,মানুষের সঙ্গে সেরকম আচরণ কর যেরূপ তুমি মানুষের কাছে আশা কর।
৩. যদি কেউ পার্থিব জীবনের প্রতি আকৃষ্ট হয়,তবে তার হৃদয় থেকে আখেরাতের ভয় বিদায় নেয়।

(রেডিও তেহরান)

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

পরকালের জন্য প্রস্তুতি এবং ...
ইমাম হাসান (আ.) মুয়াবিয়াকে কখনও ...
নেয়ামতের হাত ছড়া হওয়ার কারন
হযরত মুসা (আ.)'র মু'জিজার কাছে ...
মহানবী (স.) হতে বর্ণিত ৪০টি হাদীস (২)
গাদিরে খুম
কুরআনের দৃষ্টিতে নবী-রাসূলগণ
আল কুরআনের দৃষ্টিতে মানব জীবনের ...
রমজানে দোয়া ও মোনাজাত
পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে ...

 
user comment