মানুষের অপরিহার্য প্রকৃতি পরকালীন জীবনের প্রমাণ
ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখতে পাব যে,মানুষের চৈন্তিক বিকাশের প্রতিটি স্তরেই তথা প্রাগৈতিহাসিক যুগের অস্পষ্ট অধ্যায়ে যেমন,তেমনি পরিবর্তনশীল বিশ্বের লিখিত ইতিহাসের ব্যাপক অঙ্গনে,মানুষ সব সময়ই মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের অস্তিত্বে বিশ্বাস পোষণ করে আসছে।
প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে প্রাগৈতিহাসিক মানুষের যে সব বস্তুগত নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে তা থেকে আমরা জানতে পারি যে,তাদের সকলেই এ পার্থিব জীবনের পরবর্তী আরেকটি জীবনে বিশ্বাসী ছিল। তারা তাদের মৃতদেহের সাথে বিভিন্ন জিনিসপত্র ও হাতিয়ার কবর দিত,যা থেকে মৃত্যুর দরজার ওপারে আরেকটি জীবনের অস্তিত্বের ব্যাপারে তাদের বিশেষ বিশ্বাসেরই প্রমাণ পাওয়া যায়। তারা জানত যে,মৃত্যুতেই জীবনের চূড়ান্ত সমাপ্তি নয়। তারা মৃত্যুপরবর্তী জীবনে অকাট্য বিশ্বাস পোষণ করত,তবে সে সাথে এ ভ্রান্ত বিশ্বাসও পোষণ করতে যে,একজন মানুষ তার মৃত্যুর পরে এ পৃথিবীর জীবনের অনুরূপ জীবনের অধিকারী হবে এবং এ কারণে সেখানে তার জন্য এ পার্থিব জগতের উপায়-উপকরণ ও হাতিয়ারের প্রয়োজন হবে,তাই তার সাথে এসব উপকরণ ও হাতিয়ার কবর দেয়া হলে পরবর্তী জীবনে সে তা ব্যবহার করতে সক্ষম হবে।
স্থান-কাল নির্বিশেষে যে কোনো মানুষের মনেই এমন এক ধরনের সচেতন বা অবচেতন ধারণা বা সহজাত প্রেরণা বিদ্যমান যা তাকে আজকের পর আগামী কালের প্রত্যাশা করতে উদ্বুদ্ধ করে। এ সত্যকে অনেক একদেশদর্শী সমাজতাত্ত্বিক যথার্থ যুক্তিভিত্তিক ব্যাখ্যাসহ আত্মস্থ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এ কারণে তাঁরা এ বিষয়ে পুরোপুরি সামাজিক ও অর্থনৈতিক উপাদানসমূহের দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করেছেন। তাঁরা কতক ধর্মের উদ্ভট ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন দিকের প্রতি তাঁদের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছেন এবং পরকালীন জীবনে বিশ্বাসের ইতিবাচক দিকগুলো উপেক্ষা করেছেন।
এ ব্যাপক বিশ্বাসকে কেবলই আত্মবাধ্যকরণ বা অভ্যাসের ফল বলে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। কারণ,কালের প্রবাহ এবং তা মানব সমাজে যে পরিবর্তন আনে,অভ্যাস ও প্রথা তাকে প্রতিহত করে টিকে থাকতে পারে না।
যদিও গোষ্ঠীগত ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন জাতি ও জনগোষ্ঠীর জাতীয় ও সামাজিক রীতি-নীতিতে অনেক পার্থক্য দেখা যায় এবং এ কারণে প্রতিটি জনগোষ্ঠীরই নিজস্ব রীতি-নীতি ও চৈন্তিক অভ্যাস রয়েছে,কিন্তু তা সত্ত্বেও সকল মানুষের মধ্যেই কতকগুলো সুনির্দিষ্ট অভিন্ন প্রবণতা ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
মানুষ যে দেশে বা মহাদেশেই বসবাস করুক না কেনো,সকল মানুষ,এমনকি অর্ধ-অসভ্য,পশ্চাদপদ ও প্রাগৈতিহাসিক লোকদের মধ্যেও কতকগুলো অভিন্ন মূল্যবোধ লক্ষ্য করা যায়। যেমন- সকলেই ন্যায়বিচার,সমতা ও বিশ্বস্ততাকে ইতিবাচকভাবে মূল্যায়ন ও পছন্দ করে এবং এর বিপরীতে বিশ্বাসঘাতকতা,নিষ্ঠুরতা ও স্বৈরাচারী আচরণকে ঘৃণা সহকারে পরিহার করে।
এ কারণেই,যদিও বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক পরিবর্তন ও বিপ্লবের কারণে কোনো সুনির্দিষ্ট সমাজে শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী প্রচলিত অনেক অভ্যাস ও রীতি প্রভাবহীন ও বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে এবং এ কারণে এখন সে সব রীতিনীতি ও অভ্যাসের সামান্যতম চিহ্নও অবশিষ্ট না-ও থাকতে পারে,কিন্তু অতীতের মানুষ যে সব সদ্গুণাবলীকে লালন করত,যেমন- ন্যায়পরায়ণতা,ন্যায়বিচার,বদান্যতা ও বিশ্বস্ততা ইত্যাদি এখনকার মানব সমাজেও উত্তম বলে পরিগণিত হচ্ছে ও টিকে আছে;বরং বলা যেতে পারে যে,এ সব ধারণার প্রতি মানুষের আকর্ষণ ও ভালবাসা আজকের দিনে অতীতের তুলনায় অধিকতর প্রোজ্জ্বলভাবে পরিদৃষ্ট হচ্ছে এবং এসবের সাথে মানুষের সংশ্লিষ্টতা পূর্বাপেক্ষা গভীরতর হয়েছে।
নিরেট সামাজিক রীতি-নীতি ও ধ্যান-ধারণা হচ্ছে এমন বিষয় যেগুলো মানুষের বিচারবুদ্ধির বিকাশ শুরু হওয়ার পর থেকেই তাদেরকে শিক্ষা করতে হয়। আর এর বিপরীতে সহজাত ও প্রকৃতিগত প্রবণতাগুলো কোনোরূপ শিক্ষা-প্রশিক্ষণ এবং কোনো শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা ব্যতীতই একটি শিশুর অভ্যন্তরীণ সত্তা থেকে জাগ্রত হয়।
এক চিরন্তন ও অবিনশ্বর সত্যে বিশ্বাস এবং সৃষ্টি ও পরকালীন জীবনের ব্যাপারে সচেতনতা ও ধারণা মানুষের প্রকৃতিতে সহজাত ও দৃঢ়মূলভাবে প্রোথিত রয়েছে। আর গোটা ইতিহাসে মানব সমাজের ওপর দিয়ে অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়া সকল প্রকার পরিবর্তনের হাত থেকেই তা নিরাপদ রয়ে গেছে। অতএব,বলা যেতে পারে যে,তা স্থায়ী ও স্থিতিশীল।
যারা তাদের কল্পনার বালুরাশির মধ্যে মুখ গুঁজে আছে কেবল তারাই মানুষের মধ্যকার এসব সুগভীর ধারণা ও বিশ্বাসকে তাদের ভিত্তিহীন ও ক্ষেত্রবিশেষে দুর্বোধ্য কাল্পনিক তত্ত্ব দ্বারা চাপা দেয়ার চেষ্টা করছে।
প্রাচীন বিশ্বের রোমান,মিশরীয়,গ্রীক,বেবিলনীয়. চাল্দীয় ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোনো না কোনো ধরনের পরকাল বিশ্বাস প্রচলিত ছিল,যদিও তাদের সে বিশ্বাস ছিল ভাসাভাসা,কুসংস্কারের সাথে মিশ্রিত এবং একজন একক সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসের যৌক্তিক দাবী থেকে অনেক দূরে। অনেক আদিম জনগোষ্ঠীর বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও এটি সত্য। উদাহরণস্বরূপ,কঙ্গোর কতক উপজাতির মধ্যে এই নিয়ম ছিল যে,তাদের রাজার মৃত্যু হলে বারো জন কুমারী তার কবরে এসে নিজেদেরকে পেশ করতো এবং মৃত রাজার সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য তারা পরস্পর তর্কবিতর্ক ও লড়াই করত,আর অনেক সময় এর ফল হতো খুবই লোমহর্ষক। অন্যদিকে ফিজি দ্বীপের লোকদের বিশ্বাস ছিল,মৃত ব্যক্তিরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ,সন্তান উৎপাদন,জমিচাষ করা ইত্যাদি জীবিতদের অনুরূপ সমস্ত কাজই সম্পাদন করে থাকে।
একজন মনীষী লিখেছেন : “ফিজির লোকদের মধ্যে প্রচলিত অন্যতম রীতি হচ্ছে,তাদের পিতা-মাতারা যখন চল্লিশ বছর বয়সে উপনীত হয় তখন তারা তাদেরকে কবরস্থ করে। কবরস্থ করার জন্য এ বয়সটিকে বেছে নেয়ার কারণ এই যে,মোটামুটি এটিই হচ্ছে একজন মানুষের মধ্য বয়স এবং সর্বাধিক কাম্য বয়সসমূহের অন্যতম। অতএব,এ সময় কবরস্থ করলে সে যখন পুনরুত্থিত হবে তখন সে নিজেকে চল্লিশ বছর বয়সী শারীরিক শক্তিসম্পন্ন লোক হিসাবে পাবে।”১
বিখ্যাত সমাজতত্ত্ববিদ স্যামুয়েল কিং বলেন : “বর্তমানে ধর্ম যে সারা বিশ্বে টিকে আছে শুধু তা-ই নয়,বরং সতর্ক গবেষণা থেকে এটিই জানা যায় যে,অত্যন্ত আদিম স্তরের উপজাতিসমূহের মধ্যেও ধর্মের অস্তিত্ব রয়েছে। বর্তমান মানব প্রজাতির পূর্বপুরুষ নিয়ান্ডারথাল মানুষের মধ্যেও স্পষ্টতঃই কতক ধরনের ধর্মের প্রচলন ছিল। কারণ,আমরা জানি যে,তারা তাদের মৃতদেরকে বিশেষ নিয়মে কবর দিত এবং তখন তাদের ব্যবহৃত হাতিয়ারপত্র ও কারিগরি যন্ত্রপাতিকে তাদের পাশে স্থাপন করত,আর এভাবেই তারা তাদের ভবিষ্যৎ সংক্রান্ত বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটাতো।”২
মেক্সিকোর লোকেরা তাদের রাজার মৃতদেহের সাথে রাজ দরবারের ভাঁড়কেও কবর দিত যাতে সে উদ্ভট গল্প বলে ও রসিকতা করে রাজার মনের দুঃখ-কষ্ট দূর করতে পারে।
এখন থেকে তিন হাজার বছর পূর্বে গ্রীকরা বিশ্বাস করতো যে,মানুষ যখন মৃত্যুবরণ করে তখন সে হারিয়ে যায় না;বরং এ পৃথিবীর লোকদের মতোই এবং তাদের মতো অভিন্ন প্রয়োজন সহকারেই তার জীবন অব্যাহত থাকে। এ কারণেই তারা মৃত ব্যক্তিদের কবরের কাছে খাদ্যদ্রব্য রাখত।৩
যদিও তৎকালীন ঐ সব সমাজের মানুষের পরকালীন জীবনের প্রকৃতি সম্পর্কিত বিশ্বাসে কুসংস্কার সংমিশ্রিত ছিল বা অন্য কথায়,সত্য ও মিথ্যার এক ধরনের মিশ্রণ তৈরি হয়েছিল,কিন্তু তা সত্ত্বেও সকল যুগেই পরকালীন জীবনের ওপর বিশ্বাসের প্রচলন থেকে এটাই অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে,এ বিশ্বাসের একটি অভ্যন্তরীণ উৎস আছে,তা হচ্ছে তার সহজাত প্রবৃত্তি। এ বিশ্বাস সহজাত প্রেরণা ও অন্তর্জাত ধারণা দ্বারা লালিত হয়ে মানব সত্তার কাঠামোতে স্থাপিত হয়।
এটাও অনস্বীকার্য যে,মানুষের জ্ঞান কতকগুলো স্বতঃসিদ্ধ বিষয়ের ওপর ভিত্তিশীল। এ বিষয়গুলো যদি সন্দেহের আবর্তে নিপতিত হয় তা হলে মানুষের সকল জ্ঞানের সত্যাসত্য নিশ্চিত করার মূল মানদণ্ডই নড়বড়ে হয়ে পড়তে বাধ্য,ফলে কোনো জ্ঞানের ওপরই আর নির্ভর করা যাবে না। মানুষের অন্তরের অন্তঃস্তল ও আদি প্রকৃতি যে সাক্ষ্য প্রদান করে প্রকৃতপক্ষে তা হচ্ছে সর্বোচ্চ মানের সাক্ষ্য,তাই কোনো যুক্তি দ্বারাই তাকে অস্বীকার করা চলে না।
কোনোরূপ যৌক্তিক উপসংহারের আশ্রয় গ্রহণ ও সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়াই কেবল আমাদের
অভ্যন্তর থেকে উৎসারিত জ্ঞানের সাহায্যেই আমরা বুঝতে পারি যে,অস্তিত্বলোকের শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থাপনা ন্যায়ানুগতা ও জবাবদিহিতার ওপর ভিত্তিশীল। আমাদের সত্তার মূল থেকে যা কিছু উত্থিত হয় তা আমাদের সত্তারই অংশবিশেষ এবং এ সৃষ্টিলোকের শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থাপনারও অংশবিশেষ-যে শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থাপনায় কোনো রকম ভুলের অবকাশ নেই। বস্তুত মানুষের সত্তার অভ্যন্তরে নিহিত প্রকৃতিই তার জন্য সত্যে উপনীত হওয়া সম্ভব করে দেয়।
আমাদের সহজাত সচেতনতা ও আমাদের প্রকৃতি আমাদের মধ্যে এ মর্মে জ্ঞান সঞ্চারিত করে যে,এ বিশ্বজগতে জবাবদিহিতা ও আইন নিহিত রয়েছে। আমাদের মধ্যে শুরু থেকে নিহিত আদিম জ্ঞান যখন এ মর্মে রায় প্রদান করে,তখন প্রকৃতপক্ষে আমরা এমন এক অকাট্য প্রমাণ লাভ করি যা পরীক্ষালব্ধ নিশ্চয়তার তুলনায় শ্রেয়তর। কারণ,আমরা যখন আমাদের অভ্যন্তরীণ প্রকৃতির দ্বারা তা বুঝতে পারি তখন আমরা পরিপূর্ণ সুস্পষ্টতা সহকারে তার নিশ্চিত ও সন্দেহাতীত হওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারি।
আমরা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে অনুভব করতে পারি যে,এ বস্তুগত জগতে জবাবদিহিতা ছাড়া কোনো জিনিসেরই ভিত্তি নেই। অতি সূক্ষ্ম পরমাণু থেকে শুরু করে বিশালায়তন নক্ষত্রমণ্ডলী পর্যন্ত অস্তিত্ব লোকের সব কিছুই নিখুঁত আইনের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। নক্ষত্রসমূহের জন্ম ও মৃত্যু,সূর্যের বস্তুগত উপাদানের আলোকোজ্জ্বল শক্তিতে পরিণত হওয়া ইত্যাদি সব কিছুই সূক্ষ্ম হিসাব-নিকাশের ভিত্তিতে সম্পাদিত হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের বস্তুগত উপাদানের প্রতিটিই কতকগুলো সুনির্দিষ্ট নিয়মের অধীনে অগ্রসর হচ্ছে এবং কোনোটিই,এমনকি একটি সূক্ষ্ম পরমাণু পর্যন্ত অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে না। মোদ্দা কথা,গোটা সৃষ্টিলোকের শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থাপনাই একটি অপরিবর্তনীয় নিয়মানুবর্তিতা মেনে চলছে যা খুবই সুদৃঢ় ও অনমনীয় আইনের অধীন।
তা হলে মানুষের আচরণ কেনো সমগ্র সৃষ্টিলোকের আবর্তন কেন্দ্র সেই আদর্শ অক্ষ থেকে বিচ্যুত হবে? মানুষের আচরণ কেনো ন্যায়পরায়ণতা ও নিয়মানুবর্তিতার ওপর ভিত্তিশীল হবে না এবং কেনো সে অন্যায়,অনাচার,অবিচার ও বিশৃঙ্খলার আশ্রয় নেবে? কেনো সে মানবিক জগতে আত্মসংযমবিহীন ও লাগামছাড়া হবে?
এর জবাব অত্যন্ত স্পষ্ট। তা হচ্ছে,আমাদেরকে সচেতনতা ও স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি প্রদান করা হয়েছে এবং এ কারণে আমরা অন্য সকল সৃষ্টি থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।
আমাদের কর্মতৎপরতার সুযোগ ও ক্ষেত্র অত্যন্ত ব্যাপক-বিস্তৃত। আল্লাহ্ তাআলা যদি চাইতেন তা হলে তিনি আমাদেরকে সকল প্রাকৃতিক বিধান মেনে চলতে বাধ্য করতে পারতেন। কিন্তু তাঁর সুদূরপ্রসারী জ্ঞানের কারণে তিনি আমাদেরকে ধরণীর বুকে তাঁর প্রতিনিধি বানিয়েছেন এবং আমাদেরকে স্বাধীনতা দিয়েছেন। অতএব,অন্যায় আচরণ করা বা দায়িত্বহীনতার পরিচয় দেয়ার মানে হচ্ছে আমাদেরকে দেয়া এ স্বাধীনতার অপব্যবহার ও অত্যন্ত অযৌক্তিকভাবে এর বিকৃতি সাধন।
যেহেতু এ জগৎ হচ্ছে একটি পরীক্ষার জায়গা যা আমাদেরকে আমাদের অস্তিত্বের আরেকটি পর্যায়ে পৌঁছতে সহায়তা করবে যে পর্যায়টি আমাদের জন্য অপেক্ষমাণ,সেহেতু এটা মনে করা চলে না যে,নিষ্ঠুরতা,জুলুম-নির্যাতন ও অধিকার লঙ্ঘন জীবনের সমগ্রতার প্রতিনিধিত্ব করতে সক্ষম। প্রকৃতপক্ষে আমাদের এ পার্থিব জীবন হচ্ছে অনন্তের পানে এগিয়ে চলা এক সুদীর্ঘ কাহিনীর একটি অধ্যায় মাত্র।
আমাদের সহজাত অনুভূতি আমাদেরকে জানিয়ে দেয় যে,যে জালেম ও নিপীড়ক পার্থিব বিচারের হাত থেকে বেঁচে যাচ্ছে,যে আক্রমণকারী লোকদের অধিকার পদদলিত করছে অথচ আইনের হাতে ধরা পড়ছে না,যে অপরাধী নিশ্চিত যে,তার ব্যাপারে ন্যায়বিচার কার্যকর হবে না,এ ধরনের সব লোকই শেষ পর্যন্ত সমগ্র বিশ্বজগতে প্রতিষ্ঠিত ন্যায়বিচারের নীতিমালার অধীনে বিচারের সম্মুখীন হতে বাধ্য।
গোটা সৃষ্টিলোকে বিরাজমান শৃঙ্খলা ও পরিচালনা ব্যবস্থার অনিবার্য দাবী মানুষকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করে যে,এমন একটি দিন অবশ্যই আসবে যখন নিখুঁত হিসাব-নিকাশের ভিত্তিতে পুরোপুরি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে।
সত্যিকারের ন্যায়বিচারের যদি অস্তিত্ব না থেকে থাকে এবং তা যদি কোনো কাল্পনিক আদর্শ হয়ে থাকে,আমাদের অন্তঃকরণ যা বিশ্বাস করে তা যদি অবাস্তব বিষয় হয়ে থাকে,তা হলে,কেনো আমরা সহজাতভাবে নিজেদের ও অন্যদের জন্য ন্যায়বিচার কামনা করি? তা হলে কেনো আমরা অধিকার লঙ্ঘিত হতে দেখে ক্রোধান্বিত হই,এমনকি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেদের অস্তিত্বকে পর্যন্ত বিসর্জন দিতে প্রস্তুত হই? কেনো আমাদের হৃদয়ে ন্যায়বিচারের প্রতি ভালবাসা এরূপ দৃঢ়মূল এবং কেনো আমরা এমন কিছু কামনা করি যার আদৌ অস্তিত্ব নেই? ন্যায়বিচারের জন্য আমাদের এ পিপাসা নিজেই কি এটা প্রমাণ করে না যে,কোথাও না কোথাও ন্যায়বিচারের অস্তিত্ব রয়েছে ঠিক যেভাবে আমাদের মধ্যে পিপাসার অস্তিত্ব প্রমাণ করে যে,কোথাও না কোথাও পানির অস্তিত্ব রয়েছে?
অমরত্বের আকাঙ্ক্ষা
অমরত্বের আকাঙ্ক্ষা মানব অস্তিত্বের আরেকটি মৌলিক দিক যা তার সত্তায় অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশে আছে। অমরত্বের ধারণা কোনো আকস্মিকভাবে সৃষ্ট বা প্রশিক্ষণজাত ধারণা নয়;বরং তা মানুষের সত্তার গভীরে নিহিত একটি সহজাত আকাঙ্ক্ষা যা প্রমাণ করে যে,তার মধ্যে চিরন্তন জীবনের উপযুক্ততা নিহিত রয়েছে এবং সে এরূপ জীবনের জন্য মানসিকভাবে পুরোপুরি প্রস্তুত। মানুষের মধ্যে নিহিত প্রতিটি সহজাত প্রয়োজন বা কামনা-বাসনা পূরণের জন্যই প্রকৃতিতে যথাযথ ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু এর বিপরীতে এ অস্থায়ী জগতে চিরস্থায়ী জীবনের আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে একটি প্রকৃতি-উর্ধ্ব আকাঙ্ক্ষা,তাই এ জগতে তা পূর্ণ হওয়া সম্ভব নয়।
যেহেতু মানুষের পক্ষে তার ভিতরগত প্রকৃতির অগ্নিশিখাকে নির্বাপিত করা সম্ভব নয় এবং তার অস্তিত্বের উৎসের প্রতি তার ঝোঁক ও আকর্ষণকে তার পক্ষে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়,সেহেতু সে যখনই জীবনের দুর্বহ বোঝা ও দুঃখকষ্টের ভারে মানুষ ন্যুব্জ হয়ে পড়ে তখনই তার মন সহজাতভাবেই সেই এক ও অদ্বিতীয় মূলের দিকে মুখ ফিরায়। তাই দেখা যায়,যারা পরকালীন জীবনের অস্তিত্ব অস্বীকার করে তারাও যখন তাদের জীবনের চলার পথে অন্ধ গলিতে গিয়ে ঠেকে যায় তখন তারা অবচেতনভাবেই চিরন্তন জীবনের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে।
মানুষ যখনই তার বস্তুগত জীবনের ঝড়ঝঞ্ঝা থেকে সামান্য অবকাশ পায় এবং চিন্তা করার ও তার ভিতরের দিকে দৃষ্টিপাত করার মতো সময়-সুযোগ লাভ করে তখনই সে পরকালীন জীবন সম্পর্কে চিন্তা করতে শুরু করে এবং এ অস্থায়ী ও অপসৃয়মান জগতের শূন্যতা তীব্রভাবে অনুভব করে।
অন্যান্য প্রাণী যখন তাদের বস্তুগত প্রয়োজনসমূহ পূরণে সক্ষম হয়,তখন তারা বিশ্রাম গ্রহণ করে। কিন্তু এর বিপরীতে,মানুষ যখন তার বস্তুগত প্রয়োজন পূরণ এবং শারীরিক ভোগ ও আনন্দ চরিতার্থ করতে সক্ষম হয়,তার পর অচিরেই সে নিজের মধ্যে অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করে। একটি রহস্যজনক ব্যথা তার আত্মাকে কষ্ট দিতে থাকে। যারা নিজেদেরকে এরূপ অবস্থার মুখোমুখী দেখতে পায় তাদের মধ্যে অনেকেই অভ্যন্তরস্থ এ অশান্ত অবস্থা থেকে পালিয়ে বাঁচার এবং তাদের মধ্যে ভবিষ্যৎ চিন্তা থেকে উদ্ভূত ব্যথা থেকে সাময়িকভাবে হলেও মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যে উন্মত্ততা এবং ভোগ-বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দেয়। এমনকি তাদের মধ্যে অনেকে এ অসহনীয় যন্ত্রণা থেকে পলায়নের জন্য আত্মহত্যাকেই একমাত্র পথ হিসাবে দেখতে পায় ও তারই আশ্রয় নেয়।
মানব জাতির ইতিহাসে মহামানব ও বড় বড় চিন্তাবিদগণ সব সময়ই এ পার্থিব জীবনকে আনন্দ এবং দুঃখ-বেদনার সংমিশ্রণ হিসাবে উল্লেখ করেছেন। আমরা নবী-রাসূল,ওয়ালি-দরবেশ ও বড় বড় ধর্মীয় ব্যক্তিগণের মধ্যে এমন একজনকেও পাব না যিনি এ জগতকে মানুষের বসবাসের জন্য আদর্শ স্থান বলে গণ্য করেছেন।
এমন অনেক লোক আছে যারা মুখে পরকালীন জীবন ও শেষ বিচারের দিনকে অস্বীকার করে,কিন্তু একই সাথে তারা তাদের মৃত্যুর পূর্বে নিজেদের জন্য সুনাম-সুখ্যাতি রেখে যাওয়ার চেষ্টা করে। প্রশ্ন হচ্ছে,যে ব্যক্তি মৃত্যুতেই সব কিছুর শেষ বলে মনে করে,কেনো সে সুনাম,সুকৃতি ও দানকর্ম রেখে যাওয়ার চেষ্টা করে যা তাকে মানুষের মনে বাঁচিয়ে রাখবে?
বস্তুত যার কোনো প্রকৃত অস্তিত্ব নেই তার জন্য এভাবে চেষ্ট-সাধনা করার তো কোনোই অর্থ হয় না। যে ব্যক্তি মৃত্যুর পরবর্তী যে কোনো ধরনের জীবনের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে সে ব্যক্তির বৈজ্ঞানিক অবদান,দান ও কল্যাণকর কার্য,শিল্পকর্ম ইত্যাদি কীভাবে তাকে মৃত্যুর পরে উপকৃত করবে?
এ ধরনের লোক প্রকৃতপক্ষে তার ভিতরগত কামনা-বাসনা অনুযায়ী কাজ করছে। প্রকৃতপক্ষে সে এটাই তুলে ধরছে যে,সে অমরত্বে¡ বিশ্বাস করে।
মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও কামনা-বাসনার আওতা সীমাহীন। তাই সে যদি কখনো গোটা বিশ্বের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়,তার পরেও সে তৃপ্ত হবে না;বরং সে অন্যান্য গ্রহকে জয় করার চিন্তা করতে থাকবে। আমরা কল্পনা করছি যে,সে তার এ লক্ষ্যও অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে,এর পরেও এক ধরনের রহস্যজনক অভ্যন্তরীণ অনুভূতি তার মনের শান্তি ও স্থিতিশীলতা হরণ করে নেবে।
এমনকি মানুষের জ্ঞানার্জনের স্পৃহারও কোন সীমারেখা নেই। প্রকৃতপক্ষে সে তার জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য যতই পদক্ষেপ গ্রহণ করে ততই তার জ্ঞানার্জনের স্পৃহা বেড়ে যায় এবং সে তার নিকট অজানা দিগন্তসমূহকে উন্মোচন করার জন্য আরো বেশি উদগ্রীব হয়ে ওঠে।
বস্তুত গোটা বিশ্বলোকও মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পুরোপুরি পরিতৃপ্ত করার জন্য যথেষ্ট নয়;যদিও দৃশ্যত এ বিশ্বলোকের কোনো সীমা আছে বলে মনে হয় না। কারণ,মানুষের আত্মার সীমাহীনতার অনুভূতি তার চেয়েও বেশি,তাই সমগ্র আসমান ও যমীনের পক্ষেও তার পিপাসা নিবৃত্ত করা সম্ভব নয়। যেহেতু মানুষের মধ্যে রয়েছে অমরত্বের আকাঙ্ক্ষা,সেহেতু তার এ প্রকৃত চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা কোনো কিছুতেই পরিতৃপ্ত হওয়া সম্ভব নয়।
মাওলানা জালালুদ্দীন রূমীর সাথে নিজেকে সম্পৃক্তকারী একজন জ্ঞানী কবি বলেছেন :
“আমার প্রাণ বন্ধুর আরশের সর্বোচ্চ চূড়ায় অধিষ্ঠিত ছিল
রূমী ও বাল্খী আমার ত্বকের দুই স্তর সম ছিল
যদিও এ দেহ খোরাসান থেকে রোমের পানে অভিযাত্রা করল
কোন ভূখণ্ডই আমার প্রাণকে ধারণ করতে সক্ষম হলো না
আমাকে মনে করো না মৃত্তিকার কীট সমতুল্য
মর্তলোকের নহি আমি নভঃলোকের বাসিন্দা।”
মানুষের প্রকৃতির ভিতরে এই যে অনুভূতি,আশা-আকাঙ্ক্ষা ও কামনা-বাসনা রয়েছে,তার পরিতৃপ্তির জন্য অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা থাকতে হবে। এটা একটা যৌক্তিক উপসংহার। কারণ,এ বিশ্বের বুকে যদি পানির অস্তিত্ব না থাকত,তা হলে পানির জন্য পিপাসার অস্তিত্ব থাকা কি সম্ভব ছিল?
মানুষের অভ্যন্তরে একটি আদর্শ অনন্ত জীবনের জন্য যে সুগভীর ও অদম্য অনুভূতি ও আকাঙ্ক্ষা বিদ্যমান তার পরিপূরণের জন্য অবশ্যই এক ধরনের আয়োজন থেকে থাকবে। প্রতিটি মানুষের মধ্যেই যে অভ্যন্তরীণ ঝোঁক-প্রবণতা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা দৃঢ়মূল হয়ে বিদ্যমান তাকে পরিতৃপ্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় আয়োজন ও ব্যবস্থাপনা যদি না থাকে,তা হলে মানুষকে হতাশা ও বিভ্রান্তির শিকার হতে হবে। তা হলে তার সকল আশা ও আকাঙ্ক্ষা হবে মায়া-মরীচিকা। কিন্তু আমরা এ বিশ্বলোকের সুশৃঙ্খল ও সুপরিচালিত ব্যবস্থাপনায় দেখতে পাচ্ছি যে,এখানে নিয়ম বহির্ভূত বা অযথার্থতার ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি প্রপঞ্চেরও অস্তিত্ব নেই।
তাই আমরা জোর দিয়ে বলতে পারি যে,মানুষের অনিবার্য প্রকৃতিতে নিহিত দৃঢ়মূল কোনো ঝোঁক-প্রবণতা বা কোনো আশা-আকাঙ্ক্ষাই অর্থহীন বা উদ্দেশ্যবিহীন নয়। আর এর অনিবার্য যৌক্তিক দাবী হচ্ছে,মৃত্যুর দরজা পার হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে মানুষের মূল সত্তা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় না;বরং পরকালীন জীবনের মাধ্যমেই তার অবিনশ্বর জীবনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হওয়া সম্ভব হবে।
ইউরোপীয় (?) মনীষী নরম্যান ভিন্সেন্ট বলেন : “অবিনশ্বর জীবনের ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ বা সংশয় নেই;আমি এতে বিশ্বাস করি এবং একে অখণ্ডনীয় বলে মনে করি।”
“অবিনশ্বর জীবনের ব্যাপারে মানুষের অভ্যন্তরীণ অনুভূতি হচ্ছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিবাচক প্রমাণসমূহের অন্যতম যা আমাদেরকে এ সত্য গ্রহণের দিকে এগিয়ে দেয়। সর্বশক্তিমান ঈশ্বর যখন মানুষকে কোনো বিশেষ সত্যের দিকে পথপ্রদর্শন করেন,তখন তিনি সর্বপ্রথমে মানুষের অভ্যন্তরীণ চেতনার মাঝে তার বীজ বপন করে দেন। অনন্ত জীবনের প্রতি মানুষের পিপাসা এমনই সর্বজনীন যে,এটা অপূর্ণ থাকবে-এমন কথা মেনে নেয়া যায় না।”
“মানুষ কখনো গাণিতিক প্রমাণাদির সাহায্যের ওপর নির্ভর করে আধ্যাত্মিক সত্যসমূহকে গ্রহণ করে না;বরং বিশ্বাস ও অভ্যন্তরীণ প্রেরণাই তাকে এ সব সত্য গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। প্রকৃতপক্ষে অভ্যন্তরীণ প্রেরণা এমনকি বৈজ্ঞানিক সত্যসমূহের অঙ্গনেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।”৪
মানুষের পরকাল বিশ্বাস সম্বন্ধে অনুসন্ধান করার পর একদল পণ্ডিত নিম্নোক্ত উপসংহারে উপনীত হন : “এ বিষয়ে সত্য হলো এই যে,মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ও অভ্যন্তরীণ অনুভূতি পরকালীন জীবনের সত্যতার সপক্ষে সর্বাধিক শক্তিশালী প্রমাণ।”
“সৃষ্টিকর্তা যখন মানুষের আত্মাকে কোনো বিষয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত করতে চান,তখন তিনি তার সহজাত অনুভুতির মধ্যে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশ্বাসের কারণ ও উপাদানসমূহ নিহিত রেখে দেন। সৃষ্টিকর্তার এ প্রাজ্ঞ কর্মের কারণেই প্রত্যেকেই তার আত্মার গভীরে চিরন্তন সত্তা ও অবিনশ্বর জীবনের অস্তিত্ব অনুভব করে। যেহেতু মানুষের বর্তমান অস্তিত্বের অবস্থায় চিরস্থায়ী জীবন সম্ভব নয়,সেহেতু এ আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য একটি ভিন্ন ধরনের পরিস্থিতি অপরিহার্য। অমরত্বের এ সর্বজনীন চেতনা এমনই সুগভীর ও দৃঢ়মূল যে,এর বাস্তবতা ও মানব জীবনের ওপরে এর প্রভাবকে কিছুতেই উপেক্ষা করা যায় না। সুপ্রাচীন কাল থেকে শুরু করে বর্তমান কাল পর্যন্ত এটি (অমরত্বের এ সর্বজনীন চেতনা) মানুষের মনে পুনরুত্থানের বিশ্বাসকে বাঁচিয়ে রেখেছে ও অত্যন্ত শক্তিশালীরূপে টিকিয়ে রেখেছে।”৫
প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মের ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়েই অবিনশ্বর জীবনের প্রতি শক্তিশালী বিশ্বাস লক্ষ্য করা যায়। পরকাল বিশ্বাস প্রতিটি ঐশী ধর্মেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। নবী-রাসূলগণের মিশনে এ বিষয়টি এতই গুরুত্বপূর্ণ স্থানের অধিকারী ছিল যে,কখনোই এমন কোনো নবী বা রাসূলের আবির্ভাব ঘটে নি যিনি তাঁর অনুসারীদেরকে তাদের কাজকর্মের জন্য পুরস্কার বা শাস্তি দেয়া হবে-এমন একটি ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য প্রস্তুত করেন নি।
বিশ্বলোকের সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা ও সকল সৃষ্টির প্রেরণাদাতা আল্লাহ্ তাআলা-যিনি তাঁর বান্দাদের প্রতি সীমাহীন দয়া ও অনুগ্রহ সহকারে দৃষ্টি রাখেন,তিনি তাঁর এ দয়া ও অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে মানুষের মধ্যে শুধু অভ্যন্তরীণ পথপ্রদর্শক ও আলোকায়নের ব্যবস্থা নিহিত রেখেই তাকে ছেড়ে দেন নি;বরং তিনি গ্রন্থ ও অকাট্য প্রমাণাদিসহ নবী-রাসূলগণকে প্রেরণ করেছেন-যাঁদের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব ছিল মানুষকে মৃত্যু-পরবর্তী আরেকটি জগতে তাদেরকে পুনর্জীবিতকরণ সংক্রান্ত ধারণাকে আত্মস্থকরণের দিকে পথপ্রদর্শন করা। এ কারণে এর প্রয়োজন ছিল যে,প্রবৃত্তির লালসা,খেয়ালী মন-মেজাজ এবং বস্তুগত ঝোঁক মানুষের সহজাত প্রকৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাই মানুষের নিজের সত্তায় নিহিত পথপ্রদর্শক তার জন্য সমুন্নত মর্যাদা প্রকৃত মানবতার স্তরে উন্নীত হওয়ার বিষয়কে নিশ্চিত করতে এবং তার জন্য এ পথে সৃষ্ট বাধাসমূহ অপসারণে সক্ষম থাকে না।
কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে :
فَلَا تَحْسَبَنَّ اللَّـهَ مُخْلِفَ وَعْدِهِ رُسُلَهُ ۗ إِنَّ اللَّـهَ عَزِيزٌ ذُو انتِقَامٍ ﴿٤٧﴾ يَوْمَ تُبَدَّلُ الْأَرْضُ غَيْرَ الْأَرْضِ وَالسَّمَاوَاتُ ۖ وَبَرَزُوا لِلَّـهِ الْوَاحِدِ الْقَهَّارِ ﴿٤٨﴾ وَتَرَى الْمُجْرِمِينَ يَوْمَئِذٍ مُّقَرَّنِينَ فِي الْأَصْفَادِ ﴿٤٩﴾ سَرَابِيلُهُم مِّن قَطِرَانٍ وَتَغْشَىٰ وُجُوهَهُمُ النَّارُ ﴿٥٠﴾ لِيَجْزِيَ اللَّـهُ كُلَّ نَفْسٍ مَّا كَسَبَتْ ۚ إِنَّ اللَّـهَ سَرِيعُ الْحِسَابِ ﴿٥١﴾ هَـٰذَا بَلَاغٌ لِّلنَّاسِ وَلِيُنذَرُوا بِهِ وَلِيَعْلَمُوا أَنَّمَا هُوَ إِلَـٰهٌ وَاحِدٌ وَلِيَذَّكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ
“অতএব,আল্লাহ্ সম্বন্ধে এরূপ ধারণা পোষণ করো না যে,তিনি তাঁর রাসূলগণকে প্রদত্ত ওয়াদা ভঙ্গ করবেন;নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ মহাপরাক্রমশালী ও প্রতিশোধগ্রহণকারী। যেদিন এ পৃথিবী অন্য এক পৃথিবীতে রূপান্তরিত হবে এবং আসমানসমূহও (রূপান্তরিত হবে),আর তারা (লোকেরা) এক ও অদ্বিতীয় মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর সামনে সমুপস্থিত হবে। (হে নবী!) আপনি সেদিন অপরাধীদেরকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ দেখতে পাবেন;তাদের পোশাক হবে আলকাতরার এবং আগুন তাদের চেহারাকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে। এটা এজন্য যাতে আল্লাহ্ প্রত্যেককে তার কৃতকর্মের প্রতিদান প্রদান করেন। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ দ্রূত হিসাব সম্পাদনকারী। এটা হচ্ছে সমগ্র মানবমণ্ডলীর জন্য একটি ঘোষণা যাতে তারা এর ভিত্তিতে সতর্ক হয় এবং জেনে নেয় যে,তিনিই একমাত্র উপাস্য,আর যাতে বুদ্ধিমান লোকেরা উপদেশ গ্রহণ করে।” (সূরা ইবরাহীম : ৪৭-৫২)
পুনরুত্থানের বৈজ্ঞানিক প্রমাণ
ফলিত বিজ্ঞানের অনবরত অগ্রগতি থেকে প্রাপ্ত সুফলসমূহের অন্যতম হচ্ছে,এ বিজ্ঞান জীবনের পুনঃপ্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা প্রমাণ করেছে। মানবিক জ্ঞানের অগ্রগতি প্রকৃতপক্ষে এ ব্যাপারে আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের একটি চমকপ্রদ ক্ষেত্র খুলে দিয়েছে এবং বিষয়টিকে এক নতুন আলোর সামনে উপস্থাপন করেছে ও প্রথমবারের মতো এ বিষয়টি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোকে সম্ভব করেছে। এ সাফল্য এ বিষয়কে অধিকতর উত্তমরূপে অনুধাবনের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। বস্তুত প্রতীয়মান হচ্ছে যে,এ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান আরো উন্নততর তত্ত্বের উদ্ভব হওয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বিজ্ঞানের আওতা যতই সম্প্রসারিত হচ্ছে ততই এ ব্যাপারে অস্পষ্টতা,দুর্বোধ্যতা ও সন্দেহের মাত্রা হ্রাস পাচ্ছে।
প্রাথমিক যুগের বস্তুবাদীরা যখন পুনরুত্থানের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করত তখন তারা জীবনের পুনঃপ্রত্যাবর্তনকে অসম্ভব বলে গণ্য করত। তাই তারা পুনরুত্থানকে বৈজ্ঞানিক আলোচনার উপযোগী একটি বিষয় হিসাবে গণ্য করতে ব্যর্থ হয়।
এ ব্যাপারে অব্যাহত বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের ফলাফল হিসাবে সর্বপ্রথম যে পরিবর্তনটি সাধিত হয় তার নায়ক হলেন বিখ্যাত ফরাসী বৈজ্ঞানিক আধুনিক রসায়নশাস্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা ল্যাভয়েসিয়ার। তিনি পূর্ববর্তী তত্ত্বসমূহ খণ্ডন করেন এবং ঐ সব তত্ত্বের আধিপত্যের অবসান ঘটান। কারণ,তিনি তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময় জুড়ে যে বিষয় নিয়ে গবেষণায় নিবেদিত ছিলেন সে ব্যাপারে তিনি এ উপসংহারে উপনীত হন যে,এ বিশ্বজগতে বিদ্যমান পদার্থের মোট পরিমাণ অপরিবর্তনীয়;না তা হ্রাস পায়,না তা বৃদ্ধি পায়। এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় যে অগ্রগতি সাধিত হয় তা হচ্ছে তেজস্ক্রিয়া ও পদার্থের শক্তিতে রূপান্তরিত হওয়া। এ আবিষ্কারের ফলে ল্যাভয়েসিয়ারের তত্ত্বকে সংশোধন করতে হয়। তবে পদার্থ ও শক্তির স্থায়িত্বের কারণে তাঁর তত্ত্বের গ্রহণযোগ্যতা টিকে থাকে।
যে পদার্থের দ্বারা এ বিশ্বজগত গঠিত তাতে রাসায়নিক ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া সংগঠিত হওয়ার কারণে এ বিশ্বজগতের আকার ও আকৃতিতে পরিবর্তন সংঘটিত হলেও কোনো পদার্থই বিলুপ্তির কবরে সমাধিস্থ হয়ে যাচ্ছে না। আমরা যা লক্ষ্য করছি বা যে সব সম্পর্কে ধারণা করতে পারছি তা আসলে গুণাবলী পরিবর্তনীয় বিভিন্ন ধরনের অস্তিত্বের সমষ্টি মাত্র। তাই অস্তিত্বের ধ্বংসমুক্ততা পূর্ববর্তী তত্ত্বের স্থান দখল করে নেয় এবং বস্তুতে যত রকমের পরিবর্তন ও রূপান্তর সংঘটিত হয় তার ব্যাখ্যা প্রদান করে।
পানির যে ফোঁটাটি মাটির বুকে পতিত হচ্ছে ও মাটি যাকে শুষে নিচ্ছে,সিগারেটের যে ধোঁয়া বাতাসে মিশে যাচ্ছে,শিল্প-কারখানার যে যন্ত্রপাতি বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি আত্মস্থ করে ফেলছে,যে শুকনা কাঠ পুড়ে অগ্নিশিখার সৃষ্টি হচ্ছে,যে মোমবাতিটি পুড়ে গিয়ে তার অণুগুলো বাতাসে মিশে যাচ্ছে-এ সবের কোনোটিই চূড়ান্তভাবে হারিয়ে বা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে না। আমাদের হাতে যদি এর যে কোনোটির গঠনের সকল উপাদান বা অংশকে পুনরায় একত্রিত ও সংযোজিত করার উপায় থাকত,তা হলে আমরা সামান্যতম হ্রাসপ্রাপ্তি ব্যতীতই পুনরায় মূল বস্তুটি ফিরে পেতে পারতাম। প্রকৃতপক্ষে আমরা আমাদের ভাসাভাসা ও অগভীর দর্শন ক্ষমতা এবং সীমিত ও অপর্যাপ্ত চিন্তাশক্তির কারণেই এ সব জিনিস হারিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছি।
মানুষের শরীর মাটির তৈরি এবং তার ওপর দিয়ে পরিবর্তন ও রূপান্তরের চাকা অতিক্রম করে যাওয়ার পরিণতিতে সে পুনরায় মাটিতে পরিণত হয় অর্থাৎ সে তার মূল রূপ ফিরে পায়। এর কারণ হচ্ছে,শরীরের অভ্যন্তরে পরিবর্তন গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে,কিন্তু তার বাহ্যিক উপাদানের মধ্যে পরিবর্তনের ফলে অনস্তিত্বে পর্যবসিত হওয়ার বৈশিষ্ট্য নিহিত নেই। বস্তুত এ বস্তুগত উপাদানসমূহ অন্যান্য বস্তুগত জিনিসেরই মতো কেবল তার বিশেষ বিন্যাস হারাচ্ছে মাত্র;তার মূল বস্তু থেকে কিছুই হারিয়ে যাচ্ছে না।
একইভাবে মানুষের মৃত ও প্রাণহীন দেহ তার ভিতরগত ও বাইরের বিভিন্ন উপাদানের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার পরিণতিতে মাটিতে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে এবং বিভিন্ন পন্থায় তা প্রতিনয়ত নতুন নতুন রূপ ধারণ করে চলেছে। উদাহরণস্বরূপ,কালের প্রবাহে এমন জায়গার মাটি থেকে একটি গাছের চারা গজাতে পারে যেখানে একজন মানুষকে কবর দেয়া হয়েছে এবং কোনো পশু সে চারাগাছটি খেয়ে ফেলতে পারে যা তার শরীরের বৃদ্ধিতে ভূমিকা পালন করতে পারে। এভাবে মানুষের শরীর যে উপাদানে গঠিত তা বিভিন্ন ধরনের রূপান্তরের সম্মুখীন হতে পারে,কিন্তু তার শরীরের সে বস্তু কোনো না কোনো অবস্থায় এবং কোথাও না কোথাও টিকে থাকেই এবং তার ওপর দিয়ে যতই পরিবর্তন সংঘটিত হয়ে যাক না কেনো সে ধ্বংসের উর্ধ্বে থেকে যায়।
একইভাবে আমাদের শক্তি যে বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে অর্থাৎ ভাল ও মন্দ কাজে পর্যবসিত হয়,তাও অপরিবর্তনীয় থেকে যায়। এ বিশ্বজগতের সংগ্রহশালায় তা সংগৃহীত থেকে যায় যা আমাদের চূড়ান্ত ভাগ্য নির্ধারণে ভূমিকা পালন করবে-আমাদের সে ভাগ্য ভাল বা মন্দ,অনন্ত সুখ-শান্তি বা চিরস্থায়ী দুঃখ-কষ্ট যা-ই হোক না কেনো। গবেষকগণ অতীতের মানুষের কথাবার্তা উদ্ধারের জন্য যে চেষ্টা চালাচ্ছেন তাতে তাঁরা বহুলাংশে সাফল্য অর্জন করেছেন। বিশেষ ধরনের যন্ত্রপাতির সাহায্যে তাঁরা বিভিন্ন ধরনের হাতিয়ার ও সাজসরঞ্জামের নির্মাতাদের কৃত শব্দকে সীমিত মাত্রায় হলেও উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন। ঐ সব হাতিয়ারপত্রের নির্মাতারা যখন সেগুলো নির্মাণ করেছিল তখন তাদের হাত থেকে ঐ সব হাতিয়ারপত্রে যে তেজস্ক্রিয়া সঞ্চারিত হয় তা থেকেই তাদের শব্দ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এ সব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার স্বয়ং পুনরুত্থানের সত্যতারই আভাস দিচ্ছে। এ সব আবিষ্কার আমাদেরকে এমন কতক চৈন্তিক খোরাক সরবরাহ করছে যা আমাদেরকে পুনরুত্থানকে অনুধাবন করতে এবং বৈজ্ঞানিকভাবে তা প্রমাণ করতে সাহায্য করে।
উপরিউক্ত আলোচনায় যা বলা হলো তার চেয়েও বড় কথা,যে মানুষ মাটির বিক্ষিপ্ত অণু থেকে অস্তিত্ব লাভ করেছে এবং পুনরায় মাটিতে পরিণত হয়েছে আল্লাহ্ তাআলা কেনো তাকে পুনরায় অস্তিত্ব দান করতে সক্ষম হবেন না?
কোরআন মজীদে বারবারই এ কথার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। আল্লাহ্ তাআলা এরশাদ করেন :
مِنْهَا خَلَقْنَاكُمْ وَفِيهَا نُعِيدُكُمْ وَمِنْهَا نُخْرِجُكُمْ تَارَةً أُخْرَىٰ
“আমরা তোমাদেরকে এ (মাটি) থেকেই সৃষ্টি করেছি এবং এতেই প্রত্যাবর্তিত করব,আর পুনর্বার এ থেকেই তোমাদেরকে বহির্গত করব।” (সূরা ত্বা-হা : ৫৫)
এ আয়াতে সৃষ্টিকর্তার ক্ষমতার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। যদিও এ আয়াতে এ পার্থিব জীবনে মানুষের অতীত ও ভবিষ্যৎ এবং পরকালীন জীবনের কথা একটিমাত্র দৃশ্যে তুলে ধরা হয়েছে,কিন্তু মানুষের অশান্ত ও সন্দেহপ্রবণ মনকে সান্ত্বনা ও নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। মৃত্যুতেই মানুষের সত্তার পরিসমাপ্তি বলে মানুষের মধ্যে যে ধারণা গড়ে ওঠে এখানে তাকে অযৌক্তিক বলে তুলে ধরা হয়েছে এবং পরিবর্তন ও রূপান্তরের কথা বলা হয়েছে। এভাবে মানুষের অস্তিত্ব ও জীবনকে উদ্দেশ্যহীন ও অর্থহীন গণ্য করার ধারণার অসারতা ও অসম্ভাব্যতাও জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
মানুষের জন্য এ পৃথিবীর সংকীর্ণ অঙ্গনের জীবন তার সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্যের বাস্তবায়নের জন্য খুবই সামান্য। আমরা যদি মানুষের সৃষ্টির পুরো দৃশ্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করি,তা হলে আমরা দেখতে পাব যে,এ বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষেত্রটি তার সমুন্নত উৎসারণ ক্ষেত্রের বিচারে খুবই অনুপযোগী।
যে সব অবিশ্বাসী লোক মনে করে যে,যেহেতু রাসায়নিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কারণে মানুষের শরীর বিক্ষিপ্ত ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়,অতএব,তাকে আর পুনরায় জীবিত করা সম্ভব হবে না,তাদেরকে সম্বোধন করে কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে :
لْ عَجِبُوا أَن جَاءَهُم مُّنذِرٌ مِّنْهُمْ فَقَالَ الْكَافِرُونَ هَـٰذَا شَيْءٌ عَجِيبٌ ﴿٢﴾ أَإِذَا مِتْنَا وَكُنَّا تُرَابًا ۖ ذَٰلِكَ رَجْعٌ بَعِيدٌ ﴿٣﴾ قَدْ عَلِمْنَا مَا تَنقُصُ الْأَرْضُ مِنْهُمْ ۖ وَعِندَنَا كِتَابٌ حَفِيظٌ
“বরং তারা তাদের মধ্য থেকেই একজন সতর্ককারী আগমন করায় বিস্মিত হয়েছে,তাই কাফেররা বলেছে : এ তো বড়ই অদ্ভুত ব্যাপার! আমরা যখন মৃত্যুবরণ করব ও মাটি হয়ে যাব তার পরেও কি (আমরা প্রত্যাবর্তিত হবো)? এ প্রত্যাবর্তন তো অসম্ভব ব্যাপার। বস্তুত মাটি তাদের (শরীরের উপাদান) থেকে যা নিয়ে নেয় সে সম্বন্ধে আমি ভালভাবেই অবগত আছি,আর আমার নিকট রয়েছে সদাসংরক্ষিত মহাগ্রন্থ।” (সূরা কাফ : ২-৪)
এ আয়াতসমূহে এমন একদল অবিশ্বাসীর কথা বলা হয়েছে যারা মৃতদের পুনরুত্থানকে অস্বীকার করে। এ আয়াত স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে,তাদের মৃত্যু ও শরীরের উপাদানসমূহ বিক্ষিপ্ত হয়ে যাওয়ার পূর্বে তাদের শরীরে যে সব উপাদান ছিল তা কোথায় আছে এবং প্রকৃতির সংরক্ষণাগারে কোথায় সংরক্ষিত রয়েছে আল্লাহ্ তাআলা তা ভালভাবেই অবগত আছেন। তিনি তাদের শরীরের সেসব বিক্ষিপ্ত উপাদানকে একত্রিত ও সংযোজিত করে তাদেরকে পুনরুত্থানের বিশাল ময়দানে উত্থিত করবেন। এভাবেই তিনি এমন এক পন্থায় তাদের শরীরকে পুনরায় গঠন করবেন যাকে তারা অসম্ভব মনে করছে। শরীরের এ পুনর্গঠন তার পরিপূর্ণ কাঠামো ও উপাদানসমূহ সহকারে সম্পাদিত হবে এবং পূর্বে সে যেমন ছিল ঠিক তদ্রূপই তাকে গঠন করা হবে।
কোরআন মজীদের যুক্তি
রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মদ (সা.) যখন আরবের কাফেরদের সামনে কিয়ামতের মৃত্যুর পরে আবার জীবিত করার বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রচার করতে লাগলেন তখন উবাই ইবনে খালাফ নামে জনৈক বেদুঈন এ ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে একটি পুরনো ক্ষয় শুরু হওয়া হাড় যোগাড় করে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য মদীনায় চলে আসে। সে যেন একটি অত্যন্ত মূল্যবান প্রমাণ নিয়ে হাযির হয়েছে এমনভাবে সে হাড়টিকে রাসূলুল্লাহর সামনে তুলে ধরল। এরপর সে কোরআন মজীদের পরকালীন জীবন সংক্রান্ত তথ্য খণ্ডন করার লক্ষ্যে হাড়টিকে গুঁড়ো করে ফেলল এবং গুঁড়োগুলো বাতাসে ছড়িয়ে দিল। তারপর উপস্থিত লোকদেরকে সম্বোধন করে সে তার অজ্ঞতাজাত যুক্তি উপস্থাপন করল : “এই পচাগলা ও বিক্ষিপ্ত হাড়তে কে প্রাণের সঞ্চার করবে?”
তার ধারণা ছিল যে,সে এভাবে মৃতদের পুনরুত্থান ও পরকালীন জীবন সম্পর্কে রাসূলের যুক্তি এবং অন্য লোকদের বিশ্বাসকে খণ্ডন করতে সক্ষম হবে। সৃষ্টিপ্রক্রিয়া সম্পর্কে অজ্ঞতাজনিত কারণে সে পচাগলা ও বিক্ষিপ্ত হাড়ে প্রাণের সঞ্চারকে অসম্ভব মনে করেছিল। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ্ তাআলা কোরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল করে অকাট্য যুক্তি উপস্থাপন করেন :
قُلْ يُحْيِيهَا الَّذِي أَنشَأَهَا أَوَّلَ مَرَّةٍ ۖ وَهُوَ بِكُلِّ خَلْقٍ عَلِيمٌ ﴿٧٩﴾ الَّذِي جَعَلَ لَكُم مِّنَ الشَّجَرِ الْأَخْضَرِ نَارًا فَإِذَا أَنتُم مِّنْهُ تُوقِدُونَ ﴿٨٠﴾ أَوَلَيْسَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ بِقَادِرٍ عَلَىٰ أَن يَخْلُقَ مِثْلَهُم ۚ بَلَىٰ وَهُوَ الْخَلَّاقُ الْعَلِيمُ
“(হে রাসূল!) বলে দিন,এটিকে তিনিই জীবিত করবেন যিনি প্রথম বারের মতো সৃষ্টির সূচনা করেছিলেন;আর তিনি প্রতিটি সৃষ্টি সম্পর্কেই পুরোপুরি ওয়াকিবহাল। (তিনি হলেন সেই সত্তা) যিনি সবুজ বৃক্ষ থেকে তোমাদের জন্য আগুন তৈরি করেছেন,তাই তোমরা তা থেকে আগুন প্রজ্বলিত করতে সক্ষম হচ্ছ। যিনি আসমানসমূহ ও ধরণীকে সৃষ্টি করেছেন তিনি কি অনুরূপ সৃষ্টি করতে সক্ষম নন? অবশ্যই;আর তিনি হলেন সর্বজ্ঞ পুনঃ পুনঃ সৃষ্টিকারী।” (সূরা ইয়াসীন : ৭৯-৮০)
আল্লাহ্ তাআলা মানুষকে বিচারবুদ্ধি ও জ্ঞান দিয়েছেন যার সাহায্যে তার পক্ষে গোটা বিশ্বলোকে বিরাজমান নীতিমালা সম্পর্কে অবগত হওয়া সম্ভব। তাই আল্লাহ্ গোটা বিশ্বলোকের সৃষ্টিকাঠামো এবং এর আওতাধীন সকল প্রপঞ্চ ও নিখুঁত শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। আর এ চিন্তা-গবেষণা তাকে মৃত্যুর পরে পুনর্জীবিতকরণের সত্যতায় উপনীত হতে সক্ষম করবে। সে বুঝতে পারবে যে,বিভিন্ন ধরনের উপাদান থেকে প্রথম বারের মতো কোনো কিছু সৃষ্টি করা যার পক্ষে সম্ভব হয়েছে তাঁর পক্ষে তা পুনরায় সৃষ্টি করা অপেক্ষাকৃত সহজতর।
বস্তুত চিন্তা ও গবেষণা থেকে সঠিক ধারণায় উপনীত হওয়া সম্ভব। মানুষ যে বিশ্বে বসবাস করছে সে সম্পর্কে যৌক্তিক পদ্ধতিতে সঠিক ও অকাট্য ধারণা অর্জন করা তার জন্য অপরিহার্য।
কোরআন মজীদে মৃত্যু-পরবর্তী পুনরুত্থান সম্পর্কে যুক্তি উপস্থাপন করে আরো বলা হয়েছে :
أَفَعَيِينَا بِالْخَلْقِ الْأَوَّلِ ۚ بَلْ هُمْ فِي لَبْسٍ مِّنْ خَلْقٍ جَدِيدٍ
“আমরা কি প্রথমবার সৃষ্টির পরেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি? বস্তুত তারা নতুন সৃষ্টি সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণায় নিপতিত হয়ে আছে।” (সূরা কাফ : ১৫)
কোরআন মজীদ মানুষকে এ সত্য উপলব্ধি করার জন্য উদ্বুদ্ধ করছে যে,যদিও মৃতকে পুনর্জীবিতকরণের বিষয়টি মানবিক শক্তি ও ক্ষমতার বিচারে অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে,কিন্তু যে সৃষ্টিকর্তা নি®প্রাণ বস্তু থেকে প্রথমবারের মতো প্রাণশীল মানুষ সৃষ্টি করেছেন তাঁর জন্য এটা খুবই সহজ একটি কাজ।
অবশ্য মানুষের মনে পুনর্জীবনের প্রক্রিয়া সম্বন্ধে জানার আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক। সে জিজ্ঞাসা করতে পারে যে,মানুষের শরীরের অণুগুলো যখন বিক্ষিপ্ত হয়ে মাটির সাথে মিশে যাবে,অতঃপর তাতে কীভাবে প্রাণ সঞ্চার করা হবে এবং এসব প্রাণহীন বস্তুকে কীভাবে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা হবে? তবে তাদের জেনে রাখা প্রয়োজন যে,শরীরের উপাদানসমূহ বিক্ষিপ্ত হয়ে যাওয়ার মানে এ নয় যে,এগুলো পুরোপুরি সম্পর্কহীন হয়ে যাচ্ছে। মানুষের বিচারবুদ্ধি এটা খুব সহজেই বুঝতে পারে যে,আল্লাহ্ তাআলার চিরন্তন ও অসীম ক্ষমতার কাছে কোনো কিছূই অসম্ভব নয়,অতএব,তাঁর জন্য বিক্ষিপ্ত বস্তুকণাকে একত্রকরণ ও পুনর্জীবিতকরণ মোটেই কঠিন কাজ নয়।
কোরআন মজীদ মানুষকে আল্লাহ্ তাআলার সীমাহীন ক্ষমতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলে যে,তিনি মানুষের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সে সবের সূক্ষ্মতম বৈশিষ্ট্যসমূহ সহকারে পুনর্গঠিত করতে সক্ষম। তিনি এরশাদ করেন :
أَيَحْسَبُ الْإِنسَانُ أَلَّن نَّجْمَعَ عِظَامَهُ ﴿٣﴾ بَلَىٰ قَادِرِينَ عَلَىٰ أَن نُّسَوِّيَ بَنَانَهُ
“মানুষ কি ধারণা করেছে যে,আমরা তার অস্থিসমূহ একত্রিত (ও পুনর্গঠিত) করতে পারব না? অবশ্যই পারব;আমরা তার আঙ্গুলগুলো পর্যন্ত যথাযথভাবে পুনর্গঠিত করতে সক্ষম।” (সূরা কিয়ামাহ্ : ৩-৪)
এ আয়াতে এ বিষয়ের ওপরই জোর দেয়া হয়েছে যে,সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ তাআলা শুধু যে পচে-গলে মাটির সাথে মিশে যাওয়া অস্থিসমূহকে একত্রিত করে পুনর্জীবন দানে সক্ষম,শুধু তা-ই নয়;বরং তাঁর অতুলনীয় ও সীমাহীন ক্ষমতা এমন যে,তিনি শরীরের পচে-গলে তরল হয়ে মাটিতে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে যাওয়া অণুগুলোকেও একত্রিত করে পূর্বাবস্থায় নিয়ে আসতে ও প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে হুবহু মৃত্যু-পূর্ববর্তী অবস্থার মতো পুনর্গঠিত করতে সক্ষম।
আল্লাহ্ তাআলা যখন সৃষ্টিকুলের সৃষ্টি-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মানুষকে পুনর্জীবন দান করতে চাইবেন তখন এমনকি মানুষের শারীরিক বৈশিষ্ট্য পূর্ণ মাত্রায় ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রেও তাঁর অসীম ক্ষমতা কোনোই বাধা বা অসুবিধার সম্মুখীন হবে না। তিনি প্রথমবার যেভাবে অনায়াসে প্রাণহীন বস্তুর মধ্যে প্রাণের সঞ্চার করেন ঠিক সেভাবেই তিনি তাঁর অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে মানুষকে পুনর্জীবন দান করবেন।
ওপরে আমরা যে আয়াত উদ্ধৃত করেছি তাতে আল্লাহ্ তাআলা পরিপূর্ণ বৈশিষ্ট্য সহকারে মানুষকে পুনর্জীবন দানের কথা বলতে গিয়ে উদাহরণস্বরূপ তার আঙ্গুলকে পুনর্গঠিত করার কথা বলেছেন;এর মধ্যে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য বিষয় রয়েছে। তা হচ্ছে,বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে যথেষ্ট মিল থাকতে পারে এবং দৃশ্যত দু’জন মানুষের একই অঙ্গ হুবহু একই রকম হতে পারে। কিন্তু মানুষের আঙ্গুলের রেখাগুলোর বৈশিষ্ট্য এমনই বিস্ময়কর যে,এ বিশ্বে কোনো দু’জন মানুষের আঙ্গুলের রেখা হুবহু অভিন্ন পাওয়া যাবে না।
বিশেষ পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে,সারা জীবনে আমাদের শরীরে যতই পরিবর্তন সাধিত হোক না কেনো,এমনকি নির্দিষ্ট মেয়াদে একটি শরীরের সমগ্র বস্তুগত উপাদান পরিবর্তিত হয়ে যাওয়া এবং তার পরিমাণেও পরিবর্তন সাধিত হওয়া সত্ত্বেও আমাদের আঙ্গুলের রেখাগুলো অপরিবর্তিতই থেকে যায়। এটা আমাদের গোটা শরীরের সামগ্রিক পরিবর্তনের নিয়মের সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তাই দেখা যায় যে,কোনো দুর্ঘটনাজনিত কারণে যদি আমাদের হাতের চামড়া তুলে ফেলতে হয় এবং পরবর্তীতে সেখানে নতুন চামড়া গজায় সে ক্ষেত্রে সে চামড়ার বৈশিষ্ট্যসমূহ হয় হুবহু মূল চামড়ার বৈশিষ্ট্যসমূহের অনুরূপ। যাঁরা এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ তাঁরা জানেন যে,কোনো মানুষকে শনাক্ত করার জন্য তার আঙ্গুলের ছাপ হচ্ছে সর্বোত্তম মাধ্যম। তাই বিশ্বের সব দেশেই পুলিশ বিভাগ অপরাধীদেরকে নিশ্চিতভাবে শনাক্ত করার জন্য আঙ্গুলের ছাপকে মানদণ্ড হিসাবে গ্রহণ করে থাকে। আঙ্গুলের এ বিশেষ বৈশিষ্ট্যের প্রতি সর্বপ্রথম কোরআন মজীদেই ইঙ্গিত করা হয়েছে,অতঃপর ১৮৮৪ সালে বৃটেনের কয়েক জন বিজ্ঞানী আঙ্গুলের রেখার এ বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করেন।
যে কোনো সত্যান্বেষী ব্যক্তির পক্ষেই কোনোরূপ দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছাড়াই এটা বুঝতে পারা সম্ভব যে,এ বিশ্বজগতের বিস্ময়কর বিচিত্র সৃষ্টিনিচয়ের পেছনে এক পরম জ্ঞানী অসীম শক্তির অধিকারী সৃষ্টিকর্তার ভূমিকা কার্যকর রয়েছে। বিচারবুদ্ধির অধিকারী কোনো মানুষের পক্ষেই এটা মনে করা সম্ভব নয় যে,বস্তুজগতের অন্ধ যান্ত্রিক শক্তির পক্ষে মানুষের মতো এহেন জটিল ও অত্যুন্নত অলৌকিক ধরনের বিস্ময়কর প্রপঞ্চকে সৃষ্টি করা সম্ভবপর।
পাদটীকা
১.মুশাহাদায়ে ইল্মী,পৃ. ৯৮।
২.জমেশেনাসী,পৃ. ১৯২।
৩.মেলালে শারক ওয়া ইউনান,পৃ. ১৬৭।
৪.দনেস্তনিহয়ে জাহানে এল্মী,পৃ. ২০৪-২০৫।
৫.রূহুদ্দীনিল ইসলামী,পৃ. ৯৬।
(জ্যোতি, ৫ম বর্ষ, ১ম সংখ্যা)