সূরা ইউসুফ; আয়াত ১৯-২২
সূরা ইউসুফের ১৯ ও ২০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
وَجَاءَتْ سَيَّارَةٌ فَأَرْسَلُوا وَارِدَهُمْ فَأَدْلَى دَلْوَهُ قَالَ يَا بُشْرَى هَذَا غُلَامٌ وَأَسَرُّوهُ بِضَاعَةً وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِمَا يَعْمَلُونَ (19) وَشَرَوْهُ بِثَمَنٍ بَخْسٍ دَرَاهِمَ مَعْدُودَةٍ وَكَانُوا فِيهِ مِنَ الزَّاهِدِينَ
"এক যাত্রীদল এল, তারা তাদের পানি সংগ্রাহককে প্রেরণ করল, সে তার বালতি বা পানির ডোল নামিয়ে দিল, সে বলে উঠলো কি সুখবর! এ যে এক কিশোর। অতপর তারা তাকে পণ্যরূপে লুকিয়ে রাখল, তারা যা করছিল সে বিষয়ে আল্লাহ সবিশেষ জ্ঞাত ছিলেন।” (১২:১৯)
“এবং তারা তাকে স্বল্পমূল্যে মাত্র কয়েক দিরহামের বিনিময়ে বিক্রয় করল, তারা তার ব্যাপারে নিরাসক্ত ছিল।" (১২:২০)
হযরত ইউসুফ (আ.)কে কুয়ায় ফেলে দেয়ার পর তার ভাইয়েরা তার জামা-কাপড়ে প্রাণীর রক্ত মেখে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরলো এবং বাবাকে বলল- খেলার মাঠে হঠাৎ এক নেকড়ে বাঘ এসে ইউসুফকে খেয়ে ফেলেছে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা কি ছিল? এই দুই আয়াতে তারই বর্ণনা দেয়া হয়েছে।
"হযরত ইউসুফ(আ.) কিছু সময় অন্ধকার কূপে থাকার পর হঠাৎ একটি কাফেলা কূপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তারা পানি সংগ্রহের জন্য কূপে বালতি ফেলল, হযরত ইউসুফ বালতির দড়ি বেয়ে এবং কাফেলার লোকদের সাহায্যে উপরে আসতে সক্ষম হলেন। কাফেলার লোকজন সুদর্শন কিশোর ইউসুফকে দেখে তাকে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রির জন্য মনস্থ করল। কেউ যেন তার মালিকানা দাবি না করতে পারে এজন্য তারা তাদের পণ্য সামগ্রীর সঙ্গে তাকে লুকিয়ে রাখলো। এরপর বাজারে পৌঁছার পর তারা হযরত ইউসুফকে খুব অল্প দামে বিক্রি করে দিল। ইউসুফকে পাওয়ার জন্য যেহেতু তাদেরকে পরিশ্রম বা পুঁজি খরচ করতে হয়নি তাই অল্প দামে বিক্রির ব্যাপারে তারা সহজেই রাজী হয়ে গেল। অনেক সময় মানুষ তার আপনজনের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বিপদে পড়ে, কিন্তু আল্লাহর অনুগ্রহ হলে এমন কেউ বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য এগিয়ে আসে, যাকে সে আগে কখনো কল্পনাও করেনি।
এই সূরার ২১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
وَقَالَ الَّذِي اشْتَرَاهُ مِنْ مِصْرَ لِامْرَأَتِهِ أَكْرِمِي مَثْوَاهُ عَسَى أَنْ يَنْفَعَنَا أَوْ نَتَّخِذَهُ وَلَدًا وَكَذَلِكَ مَكَّنَّا لِيُوسُفَ فِي الْأَرْضِ وَلِنُعَلِّمَهُ مِنْ تَأْوِيلِ الْأَحَادِيثِ وَاللَّهُ غَالِبٌ عَلَى أَمْرِهِ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ
“মিশরের যে ব্যক্তি তাকে ক্রয় করেছিল সে তার স্ত্রীকে বলল, একে সসম্মানে রাখ। সম্ভবত: সে আমাদের উপকারে আসবে অথবা আমরা তাকে পুত্ররূপেও গ্রহণ করতে পারি। এবং এভাবে আমি ইউসুফকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিক্ষা দেবার জন্য সে দেশে প্রতিষ্ঠিত করলাম। আল্লাহ তার কার্য সম্পাদনে অপ্রতিহত। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না।” (১২:২১)
হযরত ইউসুফকে যখন বিক্রির জন্য বাজারে তোলা হলো,তখন মিশরের রাজদরবারের এক প্রতিনিধি তাকে ক্রয় করে রাজার কাছে নিয়ে গেল। সুদর্শন কিশোর ইউসুফকে দেখে রাজা তার স্ত্রীকে বলল,ওকে সসম্মানে লালন কর। একদিকে ঘরের কাজেকর্মে সে যেমন তোমাকে সাহায্য করতে পারবে তেমনি তোমার সন্তানের অভাবটাও তার দ্বারা পূর্ণ হতে পারে। এ কথা বলার কারণ হচ্ছে মিশরের রাজা ছিলেন নিঃসন্তান এবং সন্তানের অভাব রাজা-রাণীকে ভীষণ পীড়া দিত। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এখানে বলেছেন,মিশরের রাজ প্রাসাদে প্রবেশের মধ্য দিয়ে হযরত ইউসুফের জীবনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। বাল্যকালে দেখা তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথও সুগম হয়ে উঠলো। ভালোবাসা স্নেহ-মমতা এসবই সৃষ্টিকর্তার দান। আল্লাহ তালা মিশরের রাজার মনে হযরত ইউসুফের প্রতি এমন মায়া-মমতা দিয়েছিলেন যে রাজা তাকে নিজ সন্তানের মত স্নেহ করতে লাগলো।
এবার ২২ নম্বর এই আয়াতে বলা হয়েছে,
وَلَمَّا بَلَغَ أَشُدَّهُ آَتَيْنَاهُ حُكْمًا وَعِلْمًا وَكَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ
"যখন (হযরত ইউসুফ) পূর্ণ যৌবনে উপনীত হলো তখন আমি তাকে প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দান করলাম এবং এভাবেই আমি সৎ কর্মপরায়ণদের পুরস্কৃত করি।" (১২:২২)
এখানে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরত ইউসুফ (আ.) এর আধ্যাত্মিক মাহাত্ম বর্ণনা করেছেন। হযরত ইউসুফ অত্যন্ত সৎকর্মশীল ও ন্যায়বান ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু তার বয়স যখন পূর্ণতা পেল তখন আল্লাহতায়ালা তার প্রতি অনুগ্রহ দান করলেন এবং তাকে নবুয়্যত প্রদান করলেন। আল্লাহ এভাবেই সৎকর্মশীলদেরকে পুরস্কৃত করেন। আল্লাহতালা সমাজেরই একজনকে নবী হিসেবে নির্বাচিত করেন। এরপর নানা ঘটনার মাধ্যমে তাকে পরীক্ষা করেন এবং মানব সমাজে সত্যের আহ্বানকারী হওয়ার যোগ্যরূপে গড়ে তোলেন।