নীল সিয়া আসমান, লালে লাল দুনিয়া,
'আম্মা লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া!'
কাঁদে কোন্ ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে,
সে কাঁদনে আঁসু আনে সীমারেরও ছোরাতে!
.. ...
বেটাদের লোহু-রাঙা পিরাহান-হাতে, আহ্-
'আরশের' পায়া ধরে, কাঁদে মাতা ফাতেমা,
"এয়্ খোদা বদ্ লাতে বেটাদের রক্তের
মার্জ্জনা কর গোনা পাপী কম্ বখতের |"
ইসলাম নারী ও পুরুষের সম্মিলিত ইতিহাস। ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম ব্যক্তি ছিলেন একজন নারী তথা উম্মুল মুমিনিন হযরত খাদিজা (সালামুল্লাহি আলাইহা) এবং প্রায় একই সময়ে পুরুষদের মধ্যে প্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন হযরত আলী (আ.) মাত্র দশ বছর বয়সে। হযরত খাদিজা (সা.) ছিলেন আরবের শীর্ষস্থানীয় ধনী ও সম্পদশালী। কিন্তু রাসূল (সা.)'র স্ত্রী হওয়ার পর তিনি তাঁর প্রায় সব সম্পদ বিলিয়ে দিয়েছিলেন ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রাসূল (সা.) যখনই হযরত খাদিজা (সা.)'র নাম নিতেন তাঁর পবিত্র চোখ দুটি অশ্রুতে ভরে যেত। ইসলামের প্রথম শহীদও ছিলেন একজন নারী, হযরত সুমাইয়া (রা.)। কারবালার বীর শহীদানদের মধ্যে নারীও ছিলেন। হযরত খাদিজার কন্যা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নারী খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতিমাকে (সালামুল্লাহি আলাইহা) বলা হত উম্মে আবিহা বা পিতার মাতা। পিতা বিশ্বনবী (সা.)' জন্য অশেষ স্নেহ-ভালবাসা ও সেবার কারণেই এই উপাধি পেয়েছিলেন তিনি। এ ছাড়াও মুসলমানদের সচেতন করার জন্যও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য ও হাদীস প্রচার করে গেছেন এই মহীয়সী নারী। তাঁর প্রতি সম্মান জানিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় কবি বলেছেন:
বিশ্ব দুলালী নবী-নন্দিনী/ খাতুনে জান্নাত ফাতেমা জননী ।
হাসান হোসাইন তব উম্মত তরে মাগো,/ কারবালা প্রান্তরে দিলে বলিদান।
বদলাতে তার রোজ হাশরে,/ চাহিবে মা মোর মত পাপীদের ত্রাণ।
তাই এটা স্পষ্ট ইসলামের সেবায় সেই প্রাথমিক যুগেও নারী রেখেছিল এমন এক গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা যা গুরুত্বের দিক থেকে পুরুষের চেয়ে কম তো নয়ই বরং অনেক ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা ছিল অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, যুগান্তকারী, অনন্য ও ঐতিহাসিক। কারবালার মহাবিপ্লবও এর ব্যতিক্রম নয়। কারবালার অসম যুদ্ধে যারা ইমাম হুসাইনের পক্ষে তথা খাঁটি মুহাম্মদী ইসলামকে রক্ষার লড়াইয়ে অংশ নিয়ে শহীদ হয়েছেন তাদের অনেকেই এই মহান সংগ্রামে যোগ দেয়ার ও অবিচল থাকার প্রেরণা পেয়েছিলেন পুণ্যবতী জননী বা স্ত্রীর কাছ থেকে। নারীদের ওপর জিহাদ ওয়াজিব না হওয়া সত্ত্বেও দুজন মুমিন নারী শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধের জন্য লড়াইয়ের ময়দানে হাজির হয়েছিলেন। কিন্তু ইমাম হুসাইন (আ.) তাঁদের ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরিয়ে আনেন।
কারবালার বীরত্ব-গাঁথার অপরিহার্য অংশ হলেন হযরত যেইনাব (সা.)। তাঁকে ছাড়া কারবালার বিপ্লব হয়ে পড়ত অসম্পূর্ণ। তিনি ছিলেন হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)'র বোন ও নবী-নন্দিনী হযরত ফাতিমা (সা.)'র কন্যা। হযরত যেইনাব (সা.) যদি কারবালার ঘটনাগুলো তুলে না ধরতেন এবং কুফায় ও ইয়াজিদের দরবারে ভাষণ না দিতেন তাহলে হয়তো কারবালার প্রকৃত ঘটনা মানুষ কখনও জানতেই পারত না। আসলে তিনি ছিলেন এ বিপ্লবের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ের অন্যতম প্রধান পরিচালক।
হযরত যেইনুল আবেদীন (আ.) অসুস্থ ছিলেন বলে কারবালার জিহাদে অংশ নিতে পারেননি। আর অসুস্থ বলেই ইয়াজিদ সেনাদের কেউ কেউ ভেবেছিল, এ তো এমনিতে মরবে, ওকে আর মারার দরকার নেই। আশুরার দিন বিকেলে হযরত যেইনাব (সা.) বিশেষভাবে সমহিমায় সমুদ্ভাসিত হয়েছিলেন। ইমাম হুসাইনের শাহাদতের পর শিমার হযরত যেইনুল আবেদীন (আ.)-কে হত্যা করতে উদ্যত হলে যেইনাব (সা.) এসে তাঁর ওপর হাত বাড়িয়ে ধরায় ও ইবনে সাদ শিমারকে নিরস্ত করায় নবী বংশের শেষ চেরাগটি রক্ষা পান। কারবালার ঘটনার আগে ও পরে এই মহান ইমামের সেবা-শুশ্রূষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন ফুফু হযরত যেইনাব (সা.)।
কলিজা কাবাব সম ভুনে মরু-রোদ্দুর,
খাঁ-খাঁ করে কারবালা, নাই পানি খর্জ্জুর,
মা'র স্তনে দুধ নাই, বাচ্চারা তড়্ পায় !
জিভ চুষে' কচি জান থাকে কিরে ধড়্ টায় ?
দাউ দাউ জ্বলে শিরে কারবালা-ভাস্কর,
কাঁদে বানু----"পানি দাও, মরে যাদু আস্ গর !"
পেলো না তো পানি শিশু পিয়ে গেল কাঁচা খুন,
ডাকে মাতা, পানি দেবো ফিরে আয় বাছা শুন্ !
পুত্রহীনার আর বিধবার কাঁদনে
ছিঁড়ে আনে মর্ম্মের বত্রিশ বাঁধনে !
তাম্বুতে শয্যায় কাঁদে একা জয়নাল,
"দাদা ! তেরি ঘর্ কিয়া বরবাদ্ পয়মাল !"
হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) ইসলামকে রক্ষার জন্য নিজেকে কুরবানি করতে রাজি হয়েছিলেন মহান আল্লাহর নির্দেশে ও আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য। কিন্তু তিনি কেন এই মহাবিপজ্জনক সফরে নারীসহ পরিবার-পরিজনকেও সঙ্গে নিয়েছিলেন? এর উত্তরেও তিনি বলেছিলেন যে, নিশ্চয় আল্লাহ চান যে নবী পরিবারের নারীরাও বন্দিনী হবে। আসলে এরই মধ্যে ছিল আল্লাহর সন্তুষ্টি। মহান আল্লাহ ঈমানের পরীক্ষায় নারীদেরও উত্তীর্ণ হতে দেখতে চেয়েছেন।
হযরত যেইনাব (সা.) নিজের জীবনের চেয়েও ভালবাসতেন ভাই ইমাম হুসাইন (আ.) ও ভাতিজাদেরকে। ইমামের জন্য যেইনাব (সা.)'র দুই তরুণ বা শিশুপুত্র শহীদ হলেও তিনি মোটেও ব্যথিত হননি। কিন্তু যখন ভাইপো আলী আকবর (রা.) শহীদ হন তখন তিনি তাঁর লাশ জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন ও বিলাপ করেন। (এই আলী আকবর ছিলেন দেখতে অবিকল বিশ্বনবী-সা.'র মত, তাঁর আচরণও ছিল মহানবী (সা.)'র অনুরূপ এবং এমনকি তাঁর কণ্ঠস্বরও ছিল হুবহু রাসূল-সা.'র কণ্ঠের মত। এ কারণে সাহাবী ও নবী পরিবারের অনেকেরই প্রাণ যখন রাসূলেরসা. জন্য কাঁদত, তখন তারা এই তরুণকে দেখতে আসতেন!)
ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর প্রায় সব পুরুষ সঙ্গী এবং আপনজনদের নির্মমভাবে শহীদ করার পর হুসাইন-শিবিরে ইয়াজিদ সেনারা অগ্নিসংযোগ করেছিল ও লুণ্ঠন করেছিল মালপত্র। এ ছাড়াও নরপশু ইয়াজিদ সেনারা মস্তকবিহীন পবিত্র লাশগুলোর ওপর ঘোড়া ছুটিয়ে ছিন্ন-ভিন্ন করেছিল পবিত্র লাশগুলো। এরপর ১২ ই মহররম নবী পরিবারের নারী ও শিশুদের বন্দী অবস্থায় উটে চড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় দামেস্কের দিকে। ৭২ জন ইয়াজিদ সেনার বর্শার চূড়ায় বিদ্ধ ছিল নবী-দুলালদের কর্তিত মস্তক। আপনজনদের দলিত ও বিকৃত লাশগুলোর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হযরত যেইনাব যে ভাষায় বিলাপ করেছিলেন তা শত্রুদেরও অশ্রু-সজল করে। একজন ইয়াজিদি সেনা বলেছিল: আমি কখনও সে মর্মাহত বেদনা ভুলতে পারব না যখন হুসাইন (আ.)'র বোন যেইনাব (সা.) তাঁর ভাইয়ের ছিন্ন-ভিন্ন দেহ অতিক্রম করেছিলেন তখন তিনি কেঁদে কেঁদে বলছিলেন: "হে মুহাম্মাদ (সা.)! হে মুহাম্মাদ(সা.)! আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতারা তোমার ওপর দরুদ ও সালাম পাঠায়। আর এই তোমার আদরের হুসাইন, কী ভীষণভাবে লাঞ্ছিত, অবহেলিত, রক্তাপ্লুত খণ্ডিত লাশ হয়ে আছে!
হে মুহাম্মাদ (সা.)! তোমার কন্যারা আজ বন্দিনী, তোমার জবাই করা পরিবার আজ অপেক্ষা করছে পূবের হাওয়ার জন্য, কখন ধুলো এসে তাঁদের ঢেকে দেবে!"
উল্লেখ্য নবী-পরিবারের বন্দী নারীদের অনুরোধেই তাঁদেরকে ইমাম হুসাইন (আ.)'র শাহাদত-স্থলের ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে দামেস্কের পথে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় যেইনাব (সা.) ইমামের মস্তকবিহীন লাশের পাশে যেসব বিলাপ করেন তাতে শত্রু-বন্ধু নির্বিশেষে সবাই কাঁদতে বাধ্য হয়। কিন্তু এ সময়ও তিনি ইমাম যেইনুল আবেদীন (আ.)'র অসুস্থতার কথা ভুলেননি। পিতার ও প্রিয়জনদের লাশ দেখে তরুণ ও অসুস্থ ইমামের প্রাণ যেন দেহের খাঁচা ছেড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।
এ সময় যেইনাব (সা.) রাসূল (সা.) একটি হাদিস শুনিয়ে ভাতিজাকে সান্ত্বনা দেন এবং ওই হাদিসের বক্তব্য অনুযায়ী বলেন: 'এখন যেখানে হুসাইনের লাশ দেখতে পাচ্ছ, সেখানে কাফন ছাড়াই তাঁর লাশ দাফন করা হবে। এখানে হুসাইনের কবর যিয়ারতগাহে পরিণত হবে।'
অর্থাত এর পর থেকে ইসলাম হবে আরও প্রাণবন্ত, প্রোজ্জ্বল, আহলে বাইত হবে অমর।
রুদ্র মাতম্ ওঠে দুনিয়া-দামেশ্ কে-
"জয়নালে পরালো এ খুনিয়ারা বেশ কে ?"
' হায় হায় হোসেনা', ওঠে রোল ঝঞ্ঝায়,
তল্ ওয়ার কেঁপে ওঠে এজিদেরো পঞ্জায় !
উন্ মাদ 'দুল্ দুল্' ছুটে ফেরে মদিনায়,
আদি-জাদা হোসেনের দেখা হেথা যদি পায় !
মা ফতেমা আস্ মানে কাঁদে খুলি কেশপাশ,
বেটাদের লাশ নিয়ে বধূদের শ্বেতবাস !
রণে যায় কাসিম ঐ দু'ঘড়ির নওশা,
মেহেদীর রঙটুকু মুছে গেল সহসা !
'হায় হায়' কাঁদে বায় পূরবী ও দখিনা----
'কঙ্কণ পঁইচি খুলে ফেল সকীনা !'
কাঁদে কে রে কোলে ক'রে কাসিমের কাটা-শির ?
খান্ খান্ হয়ে ক্ষরে বুক-ফাটা নীর !
কেঁদে গেছে থামি' হেথা মৃত্যু ও রুদ্র,
বিশ্বের ব্যথা যেন বালিকা এ ক্ষুদ্র !
গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে কচি মেয়ে ফাতিমা,
"আম্মা গো পানি দাও ফেটে গেল ছাতি মা !"
নিয়ে তৃষা সাহারার, দুনিয়ার হাহাকার,
কারবালা-প্রান্তরে কাঁদে বাছা আহা কার !
দুই হাত কাটা তবু শের-নর আব্বাস,
পানি আনে মুখে, হাঁকে দুশ্ মনও 'সাব্বাস্' !
দ্রিম্ দ্রিম্ বাজে ঘন দুন্দুভি দামামা,
হাঁকে বীর "শির দেগা, নেহি দেগা আমামা !"
দুই
"আশুরা বিপ্লবে নারীর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা"-
'হাইদরী-হাঁক-হাঁকি দুলদুল-আসওয়ার/শম্ শের চম্ কায় দুষমনে ত্রাস্ বার |
খ'সে পড়ে হাত হ'তে শত্রুর তরবার,/ভাসে চোখে কিয়ামতে আল্লার দরবার !
নিঃশেষ দুষমন্ ; ও কে রণ-শ্রান্ত/ফোরাতের নীরে নেমে মুছে আঁখি-প্রান্ত ?
কোথা বাবা আস্ গর? শোকে বুক-ঝাঁঝরা/পানি দেখে হোসেনের ফেটে যায় পাঁজরা !
ধুঁকে ম'লো আহা তবু পানি এক কাৎরা/দেয় নি রে বাছাদের মুখে কম্ জাত্ রা !
অঞ্জলি হ'তে পানি প'ড়ে গেল ঝর্-ঝর্,/লুটে ভূমে মহাবাহু খঞ্জর-জর্জ্জর !
হল্ কুমে হানে তেগ ও কে ব'সে ছাতিতে ?--/আফ্ তাব ছেয়ে নিল আঁধিয়ারা রাতিতে |
'আস্ মান' ভ'রে গেল গোধূলিতে দুপুরে,/লাল নীল খুন ঝরে কুফরের উপরে !
বেটাদের লোহু-রাঙা পিরাহান-হাতে, আহ্-/'আরশের' পায়া ধরে, কাঁদে মাতা ফাতেমা,
" এয়্ খোদা বদ্ লাতে বেটাদের রক্তের/মার্জ্জনা কর গোনা পাপী কম্ বখতের |"
কত মোহর্ রম এলো, গেল চ'লে বহু কাল-/ভুলিনি গো আজো সেই শহীদের লোহু লাল !
কারবালায় আমরু বিন জুনাদেহ নামের এক যুবক ও তাঁর পিতা হুসাইনী সেনা হিসেবে শত্রুর বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণভাবে লড়াই করে শহীদ হন। পিতার শাহাদতের পর পুত্রও যখন লড়াই করতে চেয়েছিল ইমাম তাকে বাধা দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি জানান তাঁর মা বলেছেন, ইমামের জন্য যেন শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করে শহীদ হই। শেষ পর্যন্ত সে শহীদ হয়। ইয়াজিদ সেনারা তার কর্তিত মস্তক হুসাইন শিবিরের দিকে নিক্ষেপ করে। আমরুর মা ওই মস্তক চেপে ধরে বলেছিল,
'সাবাস আমার পুত্র সাবাস! তুমি আমার হৃদয়ের আনন্দ ও চোখের আলো!' এরপর ওই মা পুত্রের মস্তকটি শত্রু শিবিরের দিকে নিক্ষেপ করে বলেন: আমরা যা আল্লাহর পথে দান করি তা কখনও ফিরিয়ে নেই না। তারপরএই বীর নারী শত্রু সেনাদের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের দুজনকে হত্যা করেন! পরে ইমাম হুসাইন (আ.) নিজে গিয়ে তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে শিবিরে ফিরিয়ে আনেন।
মায়ের নির্দেশে একই ধরনের বীরত্ব দেখিয়ে শহীদ হয়েছিলেন আবদুল্লাহ বিন উমাইর বা ওয়াহাব বিন আবদুল্লাহ নামের এক যুবক। একদল শত্রু সেনাকে নাস্তানাবুদ করার পর সে শিবিরে ফিরে এলে তার মা তাকে জানায় যে, হুসাইন (আ.)'র পথে শহীদ না হওয়া পর্যন্ত তিনি পুত্রের ওপর সন্তুষ্ট হবেন না। পরে সে আবারও হামলা চালিয়ে ওমর সাদের ২৪ জন সাহসী সেনাকে হত্যা করে ও ১২ জন অশ্বারোহীকে আহত করে। ইয়াজিদের সেনাপতি ওমর সাদ ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে নির্মমভাবে শহীদ করে। তার স্ত্রী স্বামীর লাশের কাছে গিয়ে বলেছিল: বেহেশতে তুমি স্বাগতম! শিমারের নির্দেশে তার গোলাম এই বীর নারীর মাথায় মুগুর দিয়ে আঘাত হানলে তিনি শাহাদত বরণ করেন। আবদুল্লাহর স্ত্রীই ছিলেন কারবালার প্রথম মহিলা শহীদ।
শত্রুরা আবদুল্লাহর বিচ্ছিন্ন মাথাও নিক্ষেপ করেছিল তাঁর মায়ের দিকে। তাঁর মাও তা আবার শত্রুদের দিকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন এবং শত্রুদের ওপর হামলা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ইমাম হুসাইন (আ.) তাঁকে বোঝান যে জিহাদ নারীর জন্য ওয়াজিব নয়। তিনি এবং তাঁর পুত্র বেহেশতে রাসূল (সা.)'র সঙ্গে থাকার সৌভাগ্য অর্জন করবেন বলেও তিনি ওই বীর নারীকে সুসংবাদ দিয়েছিলেন।
কারবালার বীর নারীরা মুসলিম নারী সমাজকে শিখিয়ে গেছেন কিভাবে বীরত্ব দেখানোর পাশাপাশি সতীত্ব, হিজাব ও লজ্জাশীলতা বজায় রেখে সত্য ঘটনাকে ইসলামের স্বার্থে প্রচার করতে হয় এবং কিভাবে ধৈর্য বজায় রেখে শোক-প্রকাশ করতে হয়।
কুফায় ইবনে জিয়াদের দরবারসহ নানা স্থানে এবং দামেস্কে ইয়াজিদের দরবারে বন্দী অবস্থায় হযরত যেইনাব (সা.) যেসব সাহসী বক্তব্য রেখেছিলেন তা ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। কুফায় তাঁর ভাষণ শ্রবণকারী একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেছিল, আল্লাহর শপথ, "এমন আর কোনো লজ্জাশীলা নারীকে কখনও এমন ভাষণ দিতে শুনিনি।" তার ভাষণে ছিল পিতা হযরত আলী (আ.)'র বীরত্ব, বাগ্মিতা ও নারীসুলভ লজ্জাশীলতা। কুফা নগরীর প্রবেশ দ্বারের কাছে মাত্র দশ-বারোটি বাক্যে তিনি তাঁর ভাষণ শেষ করেছিলেন। কুফাবাসীরা তাদের প্রতি যেইনাব(সা.)'র যৌক্তিক ও মর্মস্পর্শী তিরস্কার শুনে অনুশোচনা ও বিবেকের দংশনের তীব্রতায় নিজেদের আঙুলগুলো মুখে ঢুকিয়ে কামড়াচ্ছিল। এখানে নারীসুলভ মর্যাদা বজায় রেখে সাহসী বীর নারী ইমাম হুসাইন (আ.)'র কন্যা ফাতিমা একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। সে সময়ও সবাই অশ্রু-সজল হয়ে পড়ে।
হযরত যেইনাব (সা.) কুফাবাসিকে তিরস্কার করে যেসব বক্তব্য রেখেছিলেন তার একাংশে বলেছিলেন, " তোমরা নিজেদের জন্য চিরন্তন অপরাধ ও লজ্জা রেখে এসেছ এবং চিরন্তন লাঞ্ছনা খরিদ করেছ। তোমরা কোনোদিনই এ লাঞ্ছনা দূর করতে সক্ষম হবে না। আর কোনো পানি দিয়েই তা ধুয়ে ফেলতে পারবে না। কারণ, তোমরা হত্যা করেছ হুসাইনকে যিনি হচ্ছেন খাতামুন্নাবিয়্যিনের(সা.)'র কলিজার টুকরা, বেহেশতে যুবকদের নেতা।"
যেইনাব (সালামুল্লাহি আলাইহা)সহ নবী পরিবারের বন্দীদেরকে কুফায় ইবনে জিয়াদের দরবারে নিয়ে আনা হলে জিয়াদ তাঁকে বিদ্রূপ করে বলেছিল: সকল প্রশংসা আল্লাহর যিনি তোমাদের লাঞ্ছিত করেছেন, তোমাদের পুরুষদের হত্যা করেছেন এবং তোমাদের বাগাড়ম্বরকে মিথ্যা প্রমাণ করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে যেইনাব (সা.) জবাব দিয়েছিলেন: "সব প্রশংসা আল্লাহর যিনি নবী মুহাম্মাদ(সা.)'র বদৌলতে আমাদেরকে সম্মানিত করেছেন এবং আমাদেরকে সব অপবিত্রতা থেকে মুক্ত করেছেন। অবশ্যই ফাসেক লাঞ্ছিত হবে এবং ফাজের বা পাপাচারী মিথ্যা বলছে, (যার বাগাড়ম্বরের কথা সে বলছে) সে ব্যক্তি আমরা ছাড়া অন্য কেউ। তাই সব প্রশংসা আল্লাহর।"
ইবনে জিয়াদ এবার বিদ্রূপ করে বলল: আল্লাহ তোমার ভাইয়ের সাথে যে আচরণ করলেন তা কেমন দেখলে? সে খলিফা ইয়াজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল ও প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, তাই আল্লাহ তাকে হতাশ করলেন এবং ইয়াজিদকে সাহায্য করলেন।
জবাবে যেইনাব (সা.) বলেছিলেন, " আমরা এতে উত্তম ছাড়া অন্য কিছু দেখিনি। আল্লাহ আমার ভাইকে শাহাদতের মর্যাদা দিয়ে সম্মানিত করেছেন, এটা তথা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হওয়া সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য।...আল্লাহ তোমাকে এবং তুমি যাদের হত্যা করেছ তাঁদের সবাইকে খুব শিগগিরই বিচারের জন্য নিজ দরবারে হাজির করবেন, সেদিনের জন্য প্রস্তুত হও তুমি, সেদিন কী জবাব দিবে তুমি, সেদিনের জন্য উদ্বিগ্ন হও। কে সেদিন বিজয়ী ও সফল হবে, হে যেনাকারিণীর পুত্র?"
এরপর নেকড়ের মত ক্ষিপ্ত হয়েও নির্লজ্জের মত জিয়াদ বলে, " আমি খুশি হয়েছি, কারণ, যা চেয়েছি তা পেয়েছি। "
জবাবে যেইনাব (সা.) বলেছিলেন,
" তুমি দুনিয়ার মাধ্যমে নেশাগ্রস্ত, প্রতারিত ও ফিতনাহগ্রস্ত। তুমি কি মনে করেছ হুসাইনের পরে তুমি আনন্দের সঙ্গে পৃথিবীতে চিরদিন টিকে থাকবে? স্বস্তিতে থাকবে? কখনও না, তুমি স্বস্তির মুখ দেখবে না। তুমি কখনও তোমার অভীষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হতে পারবে না। হে ইবনে জিয়াদ! তুমি নিজের হাতে নিজের ওপর যে কলঙ্ক লেপন করেছ তা অনন্তকাল পর্যন্ত থেকে যাবে।"
এতে দিশেহারা, অস্থির ও ক্ষিপ্ত হয়ে ইবনে জিয়াদ চিতকার করে বলে: " আমাকে এ নারীর হাত থেকে মুক্তি দাও; ওদেরকে কারাগারে নিয়ে যাও।"
মহাপাপিষ্ঠ ও নরাধম ইয়াজিদের দরবারে উপনীত হলে তার বেয়াদবিপূর্ণ নানা কথা ও বিদ্রূপের জবাবে হযরত যেইনাব (সা.) এক দীর্ঘ ও ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। সে ভাষণের একাংশে তিনি বলেছিলেন: "আমাদের শাসন-কর্তৃত্ব (তোমার হাতে পড়ায়) তুমি মহিমান্বিত আল্লাহর সেই বাণী ভুলে গিয়েছ: 'কাফেররা যেন মনে না করে যে আমরা তাদের যেঅবকাশ দান করি, তা নিজেদের জন্য কল্যাণকর। বরং আমরা তো তাদেরকে এ জন্যই অবকাশ দেই যাতে করে তাদের পাপগুলো বাড়তে থাকে এবং তাদের জন্য অপমানজনক শাস্তি অবধারিত।"
তিনি ইয়াজিদকে 'সে ব্যক্তির পুত্র যাকে বন্দী করার পর ছেড়ে দেয়া হয়েছিল' বলেও সম্বোধন করেন!(কারণ, আমির মুয়াবিয়া মক্কা বিজয়ের সময় বন্দী হয়েছিল মুসলিম বাহিনীর হাতে, ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেয়ায় তাকে মুক্তি দেয়া হয়)
হযরত যেইনাব (সা.) তাঁর ঐতিহাসিক সেই ভাষণে পবিত্র নবী বংশের, বিশেষ করে ইমাম হুসাইন (আ.)'র মর্যাদা তুলে ধরার পাশাপাশি ইয়াজিদ বাহিনীর জুলুম ও নৃশংসতাও তুলে ধরেছিলেন ।
তিনি ইমাম হুসাইন (আ.)'র সঙ্গে ইয়াজিদের নানা বেয়াদবী এবং নবী বংশের ওপর তার বাহিনীর নৃশংস জুলুম নির্যাতন চালানোসহ হত্যাযজ্ঞের জন্য তাকে খোদায়ী কঠোর শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে বলে উল্লেখ করেন। হযরত যেইনাব (সা.) এক পর্যায়ে ইয়াজিদের দরবারেই তাকে বলেন, "যদিও ঘটনাচক্রে আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে বাধ্য হয়েছি, কিন্তু আমি তোমাকে খুবই তুচ্ছ ও নীচ মনে করি এবং তোমাকে কঠোরভাবে তিরস্কার করছি ও অনেক বেশি নিন্দা করছি, কিন্তু (আমার ভাইয়ের হত্যার কারণে মুসলমানদের ) দৃষ্টিগুলো অশ্রুসজল আর হৃদয়গুলো কাবাবের মত দগ্ধীভূত।"
বিশ্বনবী (সা.)'র আহলে বাইতের প্রতি উম্মতের ভালবাসা ও তাঁদের স্মরণ যে ইয়াজিদ গোষ্ঠী কখনও বিলুপ্ত করতে পারবে না এবং আহলে বাইতের মর্যাদার ধারে কাছেও যে পৌঁছুতে পারবে না ইয়াজিদ গোষ্ঠী তিনি তাও ভবিষ্যদ্বাণী করেন। জালিমদের ওপর যে আল্লাহর লানত বর্ষিত হবে এবং ইহকালে তাদের পতন ও চরম লাঞ্ছনা এবং পরকালেও আরো কঠোর শাস্তি অপেক্ষা করছে হযরত যেইনাব (সা.) তাও উল্লেখ করেন ওই ভাষণে।
তাঁর সেইসব অবিস্মরণীয় ভাষণ ও বক্তব্যগুলো দিকে দিক প্রচারিত হয়ে দামেশক ও কুফাসহ মুসলিম বিশ্বের জনগণের মধ্যে বিক্ষোভের আগুন প্রজ্জ্বলিত করেছিল। গোটা আরব উপদ্বীপের চার লাখ মানুষ হুসাইন (আ.) হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য অভ্যুত্থান করে। ফলে খুব শিগগিরই কুফায় মুখতারের নেতৃত্বে নবী বংশের অবমানানকারী ও ঘাতকরা লাঞ্ছনার শিকার এবং নির্মূল হয়। আর এ জন্যই নবী(সা.) -নাতনী হযরত যেইনাব (সা.)-কে কারবালা বিপ্লবের অন্যতম সফল সংগঠক ও প্রধান পরিচালক বলা যায়।
উল্লেখ্য, কুফার জনগণ ইয়াজিদের প্রতি ইমাম হুসাইন (আ.)'র আনুগত্য প্রকাশ না করার কথা শুনে তাঁর প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল। এই শহরের জনগণ প্রকৃত ইসলামী খেলাফতের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য ও তাঁদেরকে মুক্ত করার জন্য ইমামের প্রতি আকুল আবেদন জানিয়ে অন্তত ১৮ হাজার চিঠি পাঠিয়েছিল। প্রতিটি চিঠিতে অন্তত ১০০ জনের স্বাক্ষর ছিল। কিন্তু তাঁরা প্রয়োজনের সময় ইমামের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। এমনকি কুফার প্রকৃত অবস্থা যাচাই করার জন্য যখন চাচাত ভাই মুসলিম ইবনে আকিল (রা.)-কে কুফায় পাঠান এই মহান ইমাম তখনও তারা ইমামের এই দূতকে সাহায্য করতে ব্যর্থ হয় এবং তিনি নৃশংসভাবে শহীদ হয়েছিলেন।
কিন্তু আকিল (রা.)'র শাহাদতের পরও ইমাম হুসাইন (আ.) যদি দোদুল-মনা কুফাবাসীদের আহ্বানে সাড়া না দিতেন , তাহলে ইতিহাসে এই ইমামকে কাপুরুষ বলে উল্লেখ করা হত এবং বলা হত লাখো মানুষের মুক্তির আহ্বানকে উপেক্ষা করে ইমাম হুসাইন (আ.) নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করেছিলেন।
কুফার পথে যাওয়ার সময় আকিল (রা.)'র শাহাদতের খবর শুনেকেঁদে ফেলেন ইমাম হুসাইন (আ.)। কিন্তু তবুও তিনি বিপ্লব চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেন। এ সময় ইমাম আবৃত্তি করেছিলেন পবিত্র কুরআনের একটি আয়াত যেখানে বলা হয়েছে:
"মুমিনদের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা পূর্ণ করেছে। তাদের কেউ কেউ মৃত্যুবরণ করেছে এবং কেউ কেউ(শাহাদতের জন্য) প্রতীক্ষা করছে। তারা তাদের সংকল্প মোটেই পরিবর্তন করেনি।"(সুরা আহজাব, ২৩)
মুস্ লিম ! তোরা আজ 'জয়নাল আবেদীন্' ,/'ওয়া হোসেনা-----ওয়া হোসেনা' কেঁদে তাই যাবে দিন !....
....উষ্ণীষ কোরানের, হাতে তেগ্ আরবীর,/দুনিয়াতে নত নয় মুস্ লিম কারো শির,-----
তবে শোন ঐ বাজে কোথা দামামা,/শম্ শের হাতে নাও, বাঁধো শিরে আমামা !
বেজেছে নাকাড়া, হাঁকে নকীবের তুর্য্য,/হুঁশিয়ার ইসলাম, ডুবে তব সূর্য্য !
জাগো ওঠ মুস্ লিম, হাঁকো হাইদরী হাঁক |/শহীদের খুনে সব লালে-লাল হ'য়ে যাক্ !
নওশার সাজ নাও খুন-খচা আস্তীন,/ময়দানে লুটাতে রে লাশ এই খাস্ দিন !
হাসানের মতো পি'ব পিয়ালা সে জহরের,/হোসেনের মতো নিব বুকে ছুরি কহরের ;
আস্ গর সম দিব বাচ্চারে কোর্ বান,/জালিমের দাদ নেবো, দেবো আজ গোর জান !
সকীনার শ্বেতবাস দেবো মাতা কন্যায়,/কাসিমের মত দেবো জান রুধি' অন্যায় !
মোহর্ রম্ ! কারবালা ! কাঁদো "হায় হোসেনা !"/দেখো মরু-সূর্য্যে এ খুন যেন শোষে না !(রেডিও তেহরান)