সূরা ইউসুফ; আয়াত ৫০-৫২ (পর্ব-১৫)
সূরা ইউসুফের ৫০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
وَقَالَ الْمَلِكُ ائْتُونِي بِهِ فَلَمَّا جَاءَهُ الرَّسُولُ قَالَ ارْجِعْ إِلَى رَبِّكَ فَاسْأَلْهُ مَا بَالُ النِّسْوَةِ اللَّاتِي قَطَّعْنَ أَيْدِيَهُنَّ إِنَّ رَبِّي بِكَيْدِهِنَّ عَلِيمٌ
“রাজা বলল তোমরা ইউসুফকে আমার নিকট নিয়ে আস, যখন দূত তার নিকট উপস্থিত হল তখন সে বলল, তুমি তোমার মনিবের নিকট ফিরে যাও এবং তাকে জিজ্ঞেস কর যে, নারীরা হাত কেটে ফেলেছিল তাদের অবস্থা কি? নিশ্চয়ই আমার প্রতিপালক তাদের ছলনা সবই জানেন।" (১২:৫০)
আগের পর্বে আলোচনা হয়েছে যে, হযরত ইউসুফ (আ.)কে যখন রাজার স্বপ্নের তাতপর্য ব্যাখ্যা করার অনুরোধ জানানো হলো তখন তিনি কোনো শর্ত ছাড়াই তা বর্ণনা করলেন। এমনকি দুর্ভিক্ষের সময় কী করা উচিত তারও দিক নির্দেশনা দিলেন। কিন্তু স্বপ্নের ব্যাখ্যা শোনার পর রাজা যখন হযরত ইউসুফকে ডেকে পাঠালেন তখন তিনি তা সরাসরি মেনে নিলেন না বরং তিনি তার কারাদণ্ডের কারণ স্পষ্ট করার দাবি জানালেন। দরবারের নারীরা তার সম্পর্কে যা রটনা করেছে তার সত্যতা প্রমাণ করার জন্য বললেন।
হযরত ইউসুফের এই পদক্ষেপের কারণ সম্পর্কে মুফাসসিরগণ মনে করেন, রাজার দয়া ও অনুকম্পায় মুক্তি পেয়েছেন এ ধরনের দাবির নীচে তিনি যেতে চাননি বরং তিনি চেয়েছেন যে, রাজা এটা বুঝুক যে তার রাজ্যে কত নীরিহ নির্দোষ মানুষের ওপর অত্যাচার ও অবিচার চলছে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, আমি হযরত ইউসুফ (আ.)এর ধৈর্য ও সহিষ্ণুতায় বিস্মিত। মিশরের রাজা যখন তার কাছে স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে চাইলো তখন তিনি এটা বললেন না যে, কারাগার থেকে মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত তা বলবো না। কিন্তু রাজা যখন তাকে মুক্তি দেয়ার নির্দেশ দিল তখন তিনি বললেন, আমি যে নির্দোষ তা প্রমাণ না করা পর্যন্ত কারাগার থেকে বের হব না। এই আয়াত থেকে আমরা এই শিক্ষা পেলাম যে, মুক্তি লাভের চেয়ে মান-সম্মান রক্ষা করা এবং নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করা গুরুত্বপূর্ণ। যেনতেন উপায়ে মুক্তি পাওয়ার মূল্য নেই।
এই সূরার ৫১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
قَالَ مَا خَطْبُكُنَّ إِذْ رَاوَدْتُنَّ يُوسُفَ عَنْ نَفْسِهِ قُلْنَ حَاشَ لِلَّهِ مَا عَلِمْنَا عَلَيْهِ مِنْ سُوءٍ قَالَتِ امْرَأَةُ الْعَزِيزِ الْآَنَ حَصْحَصَ الْحَقُّ أَنَا رَاوَدْتُهُ عَنْ نَفْسِهِ وَإِنَّهُ لَمِنَ الصَّادِقِينَ
"রাজা নারীদের বলল, তোমরা যখন ইউসুফকে তোমাদের কাছে ডেকেছিলে তখন তোমাদের উদ্দেশ্য কি ছিল? তারা বলল, অদ্ভুত আল্লাহর মাহাত্ম্য। আমরা তার মধ্যে কোনো দোষ দেখিনি। রাজার স্ত্রী বলল, এখন সত্য কথা প্রকাশ হয়ে গেছে, আমি নিজেই তার কাছে অসৎকর্ম কামনা করেছিলাম। নিশ্চয়ই সে সত্যবাদী।" (১২:৫১)
এটাই ঐশী বিধান। তাকওয়া এবং সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য লাভের মাধ্যমে এভাবেই সৎ লোকেরা বিপদ থেকে উদ্ধার পান। মিশরের রাজার স্ত্রী এক সময় হযরত ইউসুফ (আ.) কে অপবাদ দিয়েছিল এবং তার অপবাদ ও মিথ্যা বক্তব্যের কারণেই হযরত ইউসুফকে কারাগারে আটক করা হয়েছিল কিন্তু কিছু সময়ের ব্যবধানে রাজার স্ত্রী নিজেই হযরত ইউসুফকে সত্যবাদী ও সৎ ব্যক্তি হিসেবে সাক্ষী দিল এবং হযরত ইউসুফ স্বসম্মানে জেল থেকে বেরিয়ে আসলেন। আল্লাহর ইচ্ছায় সত্য এভাবেই প্রকাশিত হয়। এ জন্য ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সঙ্গে আল্লাহর ওপর নির্ভর করা উচিত।
এই আয়াতে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় হচ্ছে, অন্যায় ও অসত্য চিরস্থায়ী হয় না তেমনি সত্যও চির দিন ঢাকা থাকে না। এই ঘটনায় আরেকটি দিক ফুটে উঠেছে, তাকওয়া ও পবিত্রতার পক্ষে সবাই কথা বলতে বাধ্য। সমাজের মন্দ লোকেরাও ভালো ও পবিত্র ব্যক্তিদের সততা ও পবিত্রতার স্বীকৃতি দিয়ে থাকে।
এই সূরার ৫২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
ذَلِكَ لِيَعْلَمَ أَنِّي لَمْ أَخُنْهُ بِالْغَيْبِ وَأَنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي كَيْدَ الْخَائِنِينَ
“ইউসুফ বলল, এ কথা আমি এজন্য বলেছি যাতে রাজা বুঝতে পারে যে, আমি গোপনে তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করিনি এবং আল্লাহ বিশ্বাসঘাতকদের ছলনা সফল করেন না।” (১২:৫২)
এই আয়াতের ব্যাপারে মুফাসসিরগণ দুই ধরনের মত প্রকাশ করেছেন। কোনো কোনো মুফাসসির এই আয়াতের বক্তব্যকে জুলেখার বক্তব্য বলে মত দিয়েছেন। তাদের মতে এখানে জুলেখা বলতে চেয়েছে যে, যদিও আমার উদ্দেশ্য অসৎ ছিল কিন্তু বাস্তবে কোনো অসৎকর্ম সংঘটিত হয়নি এবং হযরত ইউসুফের পবিত্রতাও নষ্ট হয়নি। কিন্তু অধিকাংশ মুফাসসির মনে করেন, এই আয়াতের বক্তব্য হযরত ইউসুফের। তিনি কারাগার থেকে মুক্তির আগে মহিলাদের সঙ্গে ঘটনার বিষয়টি সুস্পষ্ট করার দাবি জানিয়ে মূলত: রাজাকে বুঝাতে চেয়েছেন যে, তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করেন নি। এছাড়া রাণীর কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করাও তার উদ্দেশ্য ছিল না। তিনি নিজের মান-সম্মান পুনরুদ্ধার এবং তার প্রতি মিথ্যা ধারণার অপসারন করতে চেয়েছেন মাত্র।