হযরত যয়নাব (আ.) এর মহান ভ্রাতা হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) যেদিন কারবালায় শাহাদাতবরণ করলেন তার পরদিনই তিনি অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে হযরত রাসুলে আকরাম (সা.) এর বংশধরদের অধিকার পয়মাল হওয়ার বিষয়টি কুফাবাসীদের সামনে তুলে ধরলেন। তিনি কুফাবাসীদের সামনে জ্বালাময়ী ভাষণের মাধ্যমে এ বাস্তবতাকে তুলে ধরলেন। তাঁর ভাষণের ফলে কুফাবাসীদের মধ্যে তাদের অতীত ভূমিকার জন্য আক্ষেপ সৃষ্টি হল, লজ্জায় ও আত্মধিক্কারে তাদের মস্তক অবনত হল, তাদের মধ্যে যন্ত্রণার সৃষ্টি হল এবং কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনার কষ্টকর অনুভূতি তাদের মধ্যে সঞ্চারিত হল।
হযরত যয়নাব (আ.) তাদের সামনে ভাষণ দিয়ে তাদের অন্তরে যন্ত্রণার অনুভূতি সৃষ্টি করে চলে গেলেন। কিন্তু তাঁর কন্ঠস্বর সেখানেই থেকে গেল, অনবরত তাদের কর্ণে অনুরণিত হতে থাকল, তাদের আশপাশে সর্বত্র যায়নাবের (আ.) কন্ঠস্বরে পরিপূর্ণ হয়ে থাকল, তাদেরকে তাদের অতীত অন্যায় অপরাধের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে লাগল, যার ফলে আত্মধিক্কারে তাদের পিঞ্জর চূর্ণবিচূর্ণ হতে লাগল।
হযরত যয়নাব (আ.) এর এ কন্ঠস্বর এখনো একইভাবে অণুরণিত হয়ে চলেছে। কারবালার নৃশংস হত্যাকান্ড ইসলামের ইতিহাসে যে অশুভ পরিণতি নিয়ে আসে তা অনেক কিছুকে ধ্বংস করলেও হযরত যয়নাবের (আ.) কন্ঠস্বরের এ অনুরণকে বিলুপ্ত করতে পারেনি। বস্তুত হযরত যয়নাবের (আ.) এ কন্ঠস্বরই কারবালার খলনায়কদের কাছ থেকে শহীদগণের রক্তের বদলা গ্রহণ করেছিল।
প্রকৃতপক্ষে কারবালার নৃশংস হত্যাকান্ডের পাপের বোঝা এ হত্যাকান্ডে প্রত্যভাবে অংশ গ্রহণকারীদের তুলনায় কুফাবাসীদের ঘাড়েই বেশী বর্তায়। কারবালার ৭২ জন লোককে শহীদ করার জন্য যে চার হাজার ইয়াজিদী সৈন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং কাপুরুষোচিতভাবে তাঁদেরকে হত্যা করেছিল তাদের তুলনায় হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) এর অনুসারী ও ভক্ত হবার দাবিদার কুফাবাসীদের ভূমিকা ছিল জঘন্যতম। তাদের ভূমিকাই ছিল বেশী হৃদয়বিদারক।
ইয়াজিদের দলবল হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) এর সাথে যে আচরণ করেছিল তা কি তাঁর সমর্থক ও অনুসারী হবার দাবিদার কুফাবাসীদের আচরণের সাথে তুলনীয় ছিল?
কারবালার মহীয়সী নারী হযরত যয়নাব (আ.) তাঁর মহান ভ্রাতা হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) এর শাহাদাতের পর দেড় বছরের বেশী জীবিত ছিলেন না।
কিন্তু এই স্বল্পকালের মধ্যেই তিনি কারবালার ঘটনাবলী তুলে ধরতে ও ইতিহাসের ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হন। বনি উমাইয়া ধারণা করেছিল যে, হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) ও নবী পরিবারের অন্য সমস্ত পুরুষ সদস্য (একমাত্র অসুস্থ হযরত ইমাম যয়নুল আবেদীন) (আ.) ও তাঁর অনুসারীদের ইতিহাসের সর্বশেষ অধ্যায়ে পরিণত হয়েছে। তাদের এ ভিত্তিহীন ধারণার পেছনে ছিল তাদের অজ্ঞতা, অতিরিক্ত ও অবাস্তব আত্মবিশ্বাস, মিথ্যা অহমিকা ও আত্মপ্রচার প্রবণতা। তা এক্ষেত্রে অত্যন্ত অগভীর, হালকা ও ভাসা ভাসা হিসাব-নিকাশ করেছিল। কেননা, হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) ও তাঁর সঙ্গী-সাথী পুরুষগণের মধ্যে একজন অসুস্থ ব্যক্তি ও শিশুরা ছাড়া সকলেই নিহত হয়েছিলেন। আর শুধু ইয়াতিম কন্যারা ও বিধাবারাই বেঁচে ছিলেন। তাই কিছুতেই তারা কল্পনা করতে পারেনি যে, হযরত আলী (আ.) এর পরিবারের পক্ষ থেকে পুনরায় কেউ তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারেন, বিশেষ করে ইতোপূর্বে স্বয়ং হযরত আলী (আ.) যখন শাহাদাতবরণ করেন তখন এর প্রতিক্রিয়ায় অভাবিত কিছুই ঘটেনি, জীবনের চাকার ঘূর্ণন থেমে যায়নি বা তা পথও পরিবর্তন করেনি, বরং সবকিছু আগের ন্যায়ই অব্যাহত ছিল। এরপর হযরত ইমাম হাসান (আ.) এর শাহাদাতের পরেও ভিন্নতর কোন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি। হযরত ইমাম হাসান (আ.) কে তাঁর স্ত্রী বিষ প্রয়োগ করায় তিনি শহীদ হন। তৎকালে জনগণের মধ্যে প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী আমীর মুয়াবিয়া হযরত ইমাম হাসান (আ.) এর এক স্ত্রীকে প্রলোভন দিয়ে বশীভূত করে বিষ প্রয়োগে ইমামকে হত্যার জন্য প্ররোচিত করেছিলেন। জনসাধারণ এ ঘটনা জানা সত্ত্বেও এর বিরুদ্ধে কোন প্রতিক্রিয়া হয়নি, বরং ঘটনাবলী মুয়াবিয়ার স্বার্থের অনুকূলেই প্রবাহিত হয়েছিল।
এরপর হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁর অনুসারী হবার দাবিদার কুফাবাসীদের চোখের সামনে কারবালার উন্মুক্ত প্রান্তরে অস্ত্রাঘাতে শহীদ হলেন। এরপরও হযরত যয়নাব (আ.) যদি ময়দানে আবির্ভূত না হতেন এবং ঘটনা চাপা পড়ে যাবার আগেই কুফাবাসীদের ও বনি উমাইয়ার খোদাদ্রোহীদের তিরস্কার না করতেন এবং অভিশাপ না দিতেন তাহলে তারা যেরূপ ভেবেছিল যে, ইতোপূর্বে যেভাবে তারা পরিস্থিতিকে সম্পূর্ণ নিজেদের অনুকূলে রাখতে পেরেছিল তদ্রুপ নিজেদের অনুকূলে রাখতে পারবে। তারা মনে করেছিল, তারা হযরত ইমাম হাসান (আ.) ও হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) কে যেভাবে হত্যা করেছে ঠিক সেভাবেই ইমাম হোসাইন (আ.) এর পুত্র হযরত ইমাম আলী বিন হোসাইন (আ.) (যয়নুল আবেদীন)-কে নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে দুশমনদের হাতে তুলে দেবে এবং তার পর তাঁর সাথে যা খুশী আচরণ করা হবে, কোনই বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে না।
কিন্তু ঐদিন থেকেই তাদের কাজ গোপন থাকেনি। আর এ ধরণীপৃষ্ঠে ও তার অভ্যন্তরভাগে যা কিছু আছে তা যেদিন সম্পূর্ণরূপে ওলটপালট হয়ে যাবে সেদিনের পূর্ব পর্যন্ত তাদের এ জঘন্য কীর্তিকলাপ আর কোনদিন কেউ গোপন করতে সক্ষম হবে বলে মনে হয় না।
হযরত যয়নাব (আ.) ইয়াজিদ, ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ ও বনি উমাইয়াকে বিজয়ের আস্বাদন করার সুযোগ দেননি। হযরত যয়নাব (আ.) তাঁর ওফাতের পূর্বেই তাদের বিজয়োৎসবের পান পাত্রে কয়েক ফোঁটা মরণ বিষ দিয়ে যান। তাই তাদের আনন্দোৎসব স্থায়ী হতে পারেনি এবং তাদের বিজয় সাময়িক ও স্থিতিহীন বিজয়ে পর্যবসিত হয়। তাই খুব শীঘ্রই তাদের ওপর পরাজয় ও লাঞ্ছনা আপতিত হয় এবং বনি উমাইয়ার রাজত্বের বিলুপ্তি ঘটে।
হযরত যয়নাব (আ.) ইয়াজিদের শাহী দরবারে জ্বালাময়ী ভাষণ দেয়ার পর তখনো দরবার থেকে বহির্গত হননি। কিন্তু ইতোমধ্যেই ইয়াজিদের আনন্দ দুশ্চিন্তায় পর্যবসিত হয়। কারবালায় হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) কে হত্যা করার মধ্য দিয়ে ইয়াজিদ যে বিজয়, যে আনন্দ অর্জন করেছিল সহসাই তার জন্য তা এক বিপদ ও বিপর্যয় বলে পরিগণিত হতে লাগল। পরে ইয়াজিদের মধ্যে এ দুশ্চিন্তা ও তজ্জনিত মানসিক অশান্তি-অস্থিরতা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। ইয়াজিদ অনুভব করতে থাকে যে, সে যা করেছে তা তার জন্য আত্মধ্বংসী কাজে পর্যবসিত হয়েছে। তাই এ কাজের জন্য আত্মধিক্কার ছাড়া তার সামনে অন্য কিছু করণীয় ছিল না। তাই দেখা যায় এরপর সে যে আরো তিন বছর বেঁচে ছিল, এ সময় তার জীবনে কেউ কোনরূপ আনন্দ ও সুখ-শান্তি লাভ করেনি, বিষন্নতা, দুশ্চিন্তা, আত্মধিক্কারই ছিল তার একমাত্র পরিণতি। শুধু সে-ই নয়, ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদও এ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। তাবারী ও ইবনে আছির লিখেছেনঃ ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ হোসেন বিন আলী (আ.) কে হত্যার পরে যখন শহীদগণের মাথা ইয়াজিদের নিকট পাঠাল, তখন প্রথমে ইয়াজিদ তাঁদের হত্যায় খুবই খুশী হয়। এ কারণেই তার কাছে ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের গুরুত্ব ও মর্যাদা বেড়ে যায়। কিন্তু খুব শীঘ্রই হোসেন (আ.) কে হত্যার জন্য ইয়াজিদ অনুতপ্ত ও লজ্জিত হয়। তখন থেকে সে সব সময় বলত, “আমি যদি কষ্ট স্বীকার করতাম এবং তিনি যা চাইতেন তাই যদি করতাম আমার কি হত? আল্লাহ মারজানের পুত্রের ওপর লানত বর্ষণ করুন। কারণ ও-ই হোসাইনকে মদীনা থেকে বহির্গত হতে বাধ্য করেছিল, এরপর তাঁকে হয়রান ও নিরুপায় করে তুলেছিল, শেষ পর্যন্ত তাঁকে হত্যা করেছে। আর তাঁকে হত্যা করার মাধ্যমে আমাকে মুসলমানদের নিকট ঘৃণিত করে তুলেছে। তাদের অন্তরে আমার বিরুদ্ধে শত্রুতার বীজ বপন করেছে। কারণ আমার হাতে হোসাইনের নিহত হওয়াকে তারা এক বিরাট অমার্জনীয় অপরাধ হিসাবে গণ্য করেছে।”
শেষের দিকে ইয়াজিদ ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের উপর ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল।
হযরত যয়নাব (আ.) আল্লাহ তায়ালার নিকট যে সব দোয়া করেছিলেন অচিরেই তার বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায়। তাই তাঁর দোয়া কবুল হওয়া সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে আলোচনা হতে থাকে। কেননা, কারবালার মাটি শহীদদের খুনে রঞ্জিত হবার এবং নবী পরিবারের মর্যাদাহানির পর খুব শীঘ্রই এর সাথে জড়িত লোকদের ওপর একের পর এক আসমানী গযব নাজিল হতে থাকে। সাধারণ মানুষের নৈশকালীন বৈঠকসমূহের মূল আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায় নতুন কোথায় কে আসমানী গযবের শিকার হয়েছে।
অতঃপর ইতিহাস লেখকগণও এসব ঘটনা ও কাহিনী থেকে পুরোপুরি চোখ বন্ধ করে রাখতে পারেন নি। এসব ঘটনার গুরুত্বের কারণে তাঁরা এগুলো তাঁদের ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ করতে বাধ্য হয়েছেন। এ কারণেই দেখা যায়, কারবালার নৃশংস ঘটনায় যারা কোন না কোনভাবে জড়িত ছিল তাদের বিভিন্ন ধরনের আসমানী গযবের শিকার হবার এবং আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণের কাহিনী বর্ননা করেননি এমন কোন ইতিহাস লেখককে পাওয়া যায় না।
বনি দারেম গোত্রের এক ব্যক্তি হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) এর সামনে ফোরাত থেকে পানি সংগ্রহের পথরোধ করে দাঁড়িয়েছিল। হযরত ইমাম তাকে এই বলে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে, সে সব সময়ই তৃষ্ণার্ত থাকবে, তার তৃষ্ণা কিছুতেই মিটবে না। পরে ঐ ব্যক্তি বর্ণনা করেন, “আল্লাহর শপথ, আমি তাকে দেখেছি, তার সামনে অনেকগুলো কুঁজো ভর্তি পানি এবং অনেকগুলো গামলা ভর্তি দুধ রাখা হয়েছে। এত পানি ও দুধ পান করার পরেও সে বলছিল : হায়! তোমরা কি করছ, আমাকে পানি দাও, আমি পিপাসায় মরে গেলাম। তখন তার জন্য আবারো কুঁজো ভর্তি পানি ও গামলা ভর্তি দুধ আনা হত, সে তা পান করত। কিন্তু সামান্য পরেই সে আবার বলতো : হায়! তোমরা কি করছ। আমাকে পানি দাও, পিপাসায় আমার প্রাণ বেরিয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত সে পেট ফুলে মারা যায়।”
এ ধরনের আরো এক ব্যক্তিকে হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) একই ধরনের অভিশাপ দিয়েছিলেন। তিনি দোয়া করেছিলেন, “হে আল্লাহ! ওকে তৃষ্ণার সাহায্যে মৃত্যু দাও।” ঐ ব্যক্তিকে অসুস্থ অবস্থায় দেখতে গিয়েছিলে এমন এক ব্যক্তি বর্ণনা করেছেন, “সেই আল্লাহর কসম যিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, তাকে দেখেছি, সে অনবরত পানি পান করছে এবং পরপরই বমি করে উগলে দিচ্ছিল। তারপর আবার পানি পান করছিল। সে কখনেই পিপাসা নিবৃত্ত করতে পারেনি। মৃত্যু পর্যন্ত সে এ অবস্থায় ছিল।”
তৃতীয় আরেক ব্যক্তি হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) এর শাহাদাতের পর তাঁর রক্তমাখা টুপিযুক্ত শাল চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। বনি কান্দাহর এ ব্যক্তি বস্ত্রটি নিয়ে তার বাড়ীতে যায় এবং রক্ত ধুয়ে ফেলার কাজে মশগুল হলে তার স্ত্রী তা দেখে ফেলে। এ মহিলা ছিলেন খোদাভীরু। তিনি তাঁর স্বামীকে বললেন, “তুমি এটি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কন্যার পুত্রের শরীর থেকে খুলে নিয়ে এসেছ এবং আমার ঘরে নিয়ে এসেছ? এক্ষুণি এটি আমার ঘর থেকে বাইরে নিয়ে যাও।”
ঐ ব্যক্তির বন্ধুদের বর্ণনানুযায়ী দারিদ্র তাকে এমনভাবে পেয়ে বসে যে, সে কিছুতেই তা থেকে মুক্তি পাচ্ছিল না। অতঃপর এ অবস্থায়ই সে মারা যায়।
চতুর্থ ব্যক্তি হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) এর পা থেকে মোজা খুলে নেয় এবং তাঁর লাশকে নগ্ন অবস্থায় ফেলে রেখে যায়। তার সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, অনবরত তার হাত ফেটে গিয়ে তা থেকে রক্ত ঝরত এবং গড়িয়ে মাটিতে পড়ে যেত। আর গ্রীষ্মকালে সে শুকিয়ে কাঠের মত হয়ে যেত।
যদিও এসব ঘটনা প্রধানত কাহিনীর গল্পকারদের অথবা কেরামত বর্ণনাকারীদের বর্ণনা। কিন্তু ইতিহাস লেখকগণ এ ব্যাপারে সন্দেহ পোষন করেন না যে, হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) এর রক্ত প্রবাহিত হবার পর তিন বছরও গত হতে পারেনি সেই ক্রোধ ও গযবের ছাই চাপা আগুন ধীরে ধীরে ছাই ভেদ করে উঠে আসে, দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে, তার শিখাসমূহ একত্র হয়ে এক লাফে সুউচ্চ প্রাসাদসম উঁচুতে পৌঁছে যায়। কুফাবাসীরা অচেতনতার নিদ্রা থেকে সহসাই জেগে উঠল। তারা ঐক্যবদ্ধভাবে ধ্বনি তুলল, “ইমাম হোসাইন (আ.) এর খুনের প্রতিশোধ নেব।”
হিজরী ৬৬ সালে ইরাকে আরেকটি বড় ধরনের হত্যার ঘটনা দেখতে পাওয়া যায়। এ হত্যার ঘটনা ছিল কারবালার শহীদানের রক্তের বদলা গ্রহণের লক্ষ থেকে সৃষ্টি যুদ্ধজনিত হত্যা। হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) এর হত্যায় অংশ গ্রহণ করেছিল এমন ২৮৪ ব্যক্তিকে এ সমসয় এক জায়গায়ই হত্যা করা হয়।
এ ঘটনার হাত থেকে যারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় তাদের পিছু ধাওয়া করা হয়। পিছু ধাওয়ার ফলে তারা দিশাহারা ও নিরুপায় হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত তারা ধরা পড়ে যায়। আটক করার পর তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হয়, “হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) এর ভাগ্যে কি ঘটেছিল যার প্রতি দরূদ পাঠানোর জন্য তোমাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তোমরা কি তাকেই হত্যা করেছ? অতঃপর তাদের প্রত্যেকের ব্যাপারে হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) কে হত্যার ঘটনায় অংশ গ্রহণের মাত্রার প্রতি লক্ষ রেখে মৃত্যুদন্ডের ধরণ নির্ধারণ করা হয় এবং তদনুযায়ী তাদেরকে হত্যা করা হয়।
এদের মধ্যে একজনকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। একজনকে হাত-পা কেটে ফেলে রাখা হয় এবং এ অবস্থায় থেকেই সে রক্তরণের ফলে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। অন্য একজনকে দুম্বা জবেহ করার ন্যায় মাথা কেটে হত্যা করা হয়।
চতুর্থ এক ব্যক্তি স্বীকার করে, “আমি হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) এর পরিবারের এক যুবকের প্রতি তীর নিক্ষেপ করেছিলাম। তিনি তাঁর চেহারাকে তীরের আঘাত থেক বাঁচারবার জন্য দুই হাত দিয়ে চেহারা ঢেকে ফেলেন। তখন তাঁর হাতের ওপর এত তীর নিক্ষেপ করি যে, তাঁর দুই বাহু ঝাঁঝরা হয়ে যায়।
বর্ণিত আছে যে, ঐ ব্যক্তির হস্তদ্বয় তার চেহারার ওপর স্থাপন করে তীর নিক্ষেপ করা হয় এবং এভাবেই তাকে হত্যা করা হয়।
সেদিন যাদেরকে হত্যা করা হয় তাদের মধ্যে একজন ছিল ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ। একইভাবে আমর বিন সা’দ ও তার পুত্র হাফসকে হত্যা করা হয়। আশআস বিন কায়েস পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়। তখন যিয়াদ বিন সুমাইয়া তার বাড়ী ঘর ধ্বংস করে দেয় এবং সে জায়গায় হাজার বিন আদী আল কিন্দীর জন্য বাড়ী তৈরী করে দেন। শেষ পর্যন্ত তাদের সকলকেই হত্যা করা হয়। এবারে নিহতদের মাথা দামেস্কে নয়, মদীনায় পাঠানো হয়। কিন্তু এ কাহিনী কারবালার শহীদানের খুনের বদলা গ্রহণের মধ্য মদীনায় হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়র (রাঃ) এর অভ্যুত্থান এবং ইরাকে হযরত মাছআব (আ.) এর অভ্যুত্থান ছিল প্রধান।
এরপর উমাইয়া সরকারের পতন ঘটে এবং বনি আব্বাসের উত্থান ঘটে। আব্বাসীয়রা যখন উমাইয়াদের বিরুদ্ধে উত্থান ঘটায় এবং জনগণের প্রতি এতে অংশ গ্রহণের জন্য আহবান জানায়, তখন আহলে বাইতের অনুসারী শিয়াদের ধারণা হয়েছিল যে, আব্বাসীরা হযরত আলী (আ.) এর বংশধরদের অনুকূলে উত্থান করেছে। কিন্তু কার্যত দেখা গেল তা নয়, বরং উমাইয়াদের ন্যায় আব্বাসীরাও আহলে বাইতের সাথে দুর্ব্যবহার করে। এরপর মাগরেবে (উত্তর আফ্রিকায়) ফাতেমী সরকার ক্ষমতায় আসে। ইতিহাস বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ সমস্ত ঘটনাই ছিল হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) এর শাহাদাতের প্রতিক্রিয়া।
বরং এ সময় এসব রাজনৈতিক ঘটনা ও যুদ্ধবিগ্রহের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা সংঘটিত হয়। তা হচ্ছে শিয়া মাজহাবের জাফরী ফিকাহর প্রতিষ্ঠা। এ ঘটনা প্রাচ্য ভূখন্ডে মুসলিম জাতিসমূহের রাজনৈতিক ও মাজহাবী জীবনে বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছিল।
আর একমাত্র হযরত যয়নাব (আ.)-ই ছিলেন এসব ঘটনামালার সূচনাকারী। এ কোনরূপ অতিশয়োক্তি নয়, বরং এই হচ্ছে ইতিহাসের রায়।
(সূত্র : নিউজ লেটার)