জার্মানির বিখ্যাত দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট বলেছেনঃ "পৃথিবীতে যদি এমন কোনো কিছুর অস্তিত্ব থেকে থাকে যাকে খোলা চোখে দেখা উচিত,তা হলো দ্বীন।" সেই দ্বীন এখন ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব অতিক্রম করছে। বিভিন্ন মাজহাব বিশেষ করে ইসলাম ধর্ম এখন বিচিত্রমুখী প্রতিবন্ধকতার শিকার। এতসব বাধার পরও সমাজে এখন দ্বীনের বিশেষ করে ইসলামের প্রভাব ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ প্রসঙ্গটি আমরা এক নও-মুসলিমের ভাষ্য অনুযায়ী বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবো।
গত কয়েক দশক ধরে পশ্চিমা বিশ্বের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া জগতের খ্যাতিমান অনেক তারকাসহ বিখ্যাত বহু ব্যক্তিত্বের ইসলাম গ্রহণের প্রসঙ্গ ছিল গণমাধ্যমগুলোতে বেশ আকর্ষণীয় খবর। খুব বেশিদিন হয়নি বৃটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের স্ত্রীর বোন অর্থাৎ ব্লেয়ারের শ্যালিকা লরেন বুথ ইসলাম গ্রহণ করেছেন। এ খবর বিশ্বব্যাপী আলোচনা বিশেষ করে ইসলাম সম্পর্কে পশ্চিমা বিশ্বের জ্ঞানী-গুণীদের মাঝে ব্যাপক কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে। সেই কৌতূহলের উষ্ণতা মিলিয়ে যেতে না যেতেই এবার ইসলাম গ্রহণ করলেন অস্কার বিজয়ী মার্কিন চলচ্চিত্রকার অলিভার স্টোনের ছেলে শ্যান স্টোন। তাঁর ইসলাম গ্রহণের ঘটনা সারা বিশ্বেই ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছে। তাঁর বয়স সাতাশ বছর। মার্কিন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ইসলামের ইতিহাসে পড়াশোনা করেছেন। একজন ফিল্ম ডিরেক্টর বলেছেন,ধর্ম বিষয়ে তার জানাশোনা বেশ গভীর। আসলে ইসলাম তারাই গ্রহণ করেন যারা মেধাবী এবং বুদ্ধিমান।
গত পহেলা ফেব্রুয়ারিতে ইরানে অনুষ্ঠিত হয়েছে 'হলিউড ও চলচ্চিত্র' শীর্ষক আন্তর্জাতিক সেমিনার। এ সেমিনারে যোগ দিতে শ্যান স্টোন যে সফর করেন ঐ সফর তাঁর জীবনের মোড়ই ঘুরিয়ে দিয়েছে। হযরত আলী (আ.) এর বিচিত্রমুখী চারিত্রিক সৌন্দর্য ও মহান ব্যক্তিত্বে তিনি মুগ্ধ হয়ে তাঁর নাম রেখেছেন 'আলী'। পবিত্র কোরআনে ঈমানদার এবং শুভ চিন্তার অধিকারী যুবকদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে যারা সমকালীন শেরেকি হুকুমাত মেনে নেয়নি এবং এক আল্লাহর ওপর ঈমান এনে কুফরি শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। তারা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছেঃ ‘হে পরোয়ারদেগার! তোমার পক্ষ থেকে আমাদের ওপর রহমত নাযিল করো!আমাদের জন্যে মুক্তি ও বিকাশের পথ সুগম করো! আল্লাহ তাদের দোয়া কবুল করেছেন। তাদের অন্তরে শক্তি দিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের সঠিক পথ দেখিয়েছেন।'
আল্লাহর প্রতি ঐ ঈমান ও ভালোবাসার কারণে 'আলী স্টোনের'প্রতিও আল্লাহ রহমত বর্ষণ করেছেন। ইহুদি পিতা ও খ্রিস্টান মাতার সন্তান হয়েও অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে তিনি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। মুসলমান হবার পর তিনি বলেছেনঃ "ইসলামে আল্লাহ এবং তাঁর সৃষ্ট মানুষের সাথে সরাসরি একটা সম্পর্কের সেতুবন্ধন রয়েছে। এ বিষয়টা খুবই আকর্ষণীয়। ইসলাম এমন একটি দ্বীন যে শিক্ষার মাধ্যমে যে কেউই তার অন্তরে আল্লাহকে বরণ করে নিতে পারে। এজন্যে পুরোহিত বা এ জাতীয় কারো মধ্যস্থতার প্রয়োজন পড়ে না। দ্বীনে ইসলাম হচ্ছে আল্লাহর কালামেরই ধারাবাহিকতা। যে আল্লাহ ইব্রাহিম (আ.) এবং হযরত মূসা (আ.)কে পাঠিয়েছেন এবং সকল ধর্ম ও ধর্মীয় নীতিমালাকে এক সূত্রে গেঁথে দিয়েছেন।"
নিঃসন্দেহে পশ্চিমা সমাজে চরম নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে সেখানকার যুবকরা এখন ইসলামের দিকে ঝুকেঁছে এবং এই প্রবণতা সেখানে ক্রমশ বাড়ছে। জার্মানির বিখ্যাত দার্শনিক ফ্রেডরিক নীৎসে "আনন্দময় জ্ঞান" নামক বইতে পাশ্চাত্যের নতুন সভ্যতাকে আত্মাশূন্য বলে মন্তব্য করেছেন। এক পাগলের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি লিখেছেনঃ ঐ পাগল প্রতিদিন হাতে একটা বেলুন নিয়ে বাজারে দৌড়াতো আর চীৎকার করে বলতো-আমি স্রষ্টাকে খুঁজছি। মানুষ তাকে ঠাট্টা-মশকরা করে বলতোঃ কেন কী হয়েছে? খোদা কি হারিয়ে গেছে না সফরে গেছে? আরো কতো কী-ই না বলতো। সে লোকজনের এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথার জবাবে আল্লাহর দিকে ইঙ্গিত করতো। নীৎসে এর মধ্য দিয়ে এই সত্যই ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন যে, বর্তমান বিশ্বের অবসাদগ্রস্ত মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানোর জন্যে মাজহাবের আত্মাকে পুনরায় জীবিত করা উচিত। সকল মূল্যবোধকে নতুন করে মূল্যায়ন করার মধ্য দিয়ে পুনরায় সৃষ্টি করা উচিত। কেননা কেবল দ্বীন এবং ঈমানই পারে নিজেদের ভেতরকার সুপ্ত বুদ্ধিবৃত্তির প্রকাশ ঘটাতে।
আলী স্টোন সামাজিক নীতি-নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতার উৎকর্ষ দেখতে পেয়েছেন ইসলামে। এ সম্পর্কে তিনি বলেছেনঃ "মুসলিম দেশগুলোতে একটা আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ চমৎকার অবস্থা লক্ষ্য করা যায়। এ বৈশিষ্ট্যটা মানুষকে আত্মমুখি করে তোলে।" তিনি ভবিষ্যতের দিকে সুদৃষ্টি দিয়ে বলেনঃ "আমি আশা করি আমার ইসলাম গ্রহণের ঘটনা মার্কিনীদেরকে ইসলামের প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে জানতে সাহায্য করবে এবং ইসলামের সৌন্দর্যগুলো তাদের সমাজে প্রচার করতে সহযোগিতা করবে। আমার লক্ষ্য হচ্ছে ইহুদি, খ্রিস্টান এবং মুসলমানদের মধ্যে যে সম্পর্ক রয়েছে তা সুস্পষ্ট করে ফুটিয়ে তোলা।" এ ক্ষেত্রে শিল্পমাধ্যম বিশেষ করে চলচ্চিত্রের ভূমিকা খুবই প্রভাবশালী বলে তিনি মন্তব্য করেন। স্টোন বলেনঃ 'আশা করি বিভিন্ন জাতি ও দেশের সংস্কৃতির মধ্যকার পার্থক্য বা বৈচিত্র্যের দিকে লক্ষ্য না করে বরং তাদের মাঝে সেতু রচনা করা উচিত মিলগুলোর দিকে তাকিয়ে। বিভিন্ন মাজহাবের মাঝে অভিন্ন যেসব মিল রয়েছে সেগুলোর ভিত্তিতে সমাজকে জাগিয়ে তুলতে হবে। সমাজের মানুষগুলোকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। কোনো মতাদর্শ সম্পর্কে ভীতি বা আতঙ্ক ছড়ানোর কোনো প্রয়োজন আমাদের নেই। কেবল মনে রাখতে হবে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ একজন এবং তাঁর অস্তিত্ব রয়েছে। ইসলাম, ইহুদি বা খ্রিস্টান ধর্মের বিরোধী-এ ধরনের মন্তব্য করা বা চিন্তা করাটা ভুল।'
আল্লাহর প্রতি ঈমান আনলে এক ধরনের মানসিক শক্তি তৈরি হয়। স্টোনের ভাষায়ঃ যে মুহূর্তে ইসলাম গ্রহণ করলাম একটা মধুর আধ্যাত্মিক অনুভূতি বোধ করলাম। আসলে ঐ মুহূর্তে পবিত্র এবং ইতিবাচক একটা শক্তি অর্জন করলাম। মনে হলো যেন আল্লাহর সাথে একটা বিশেষ যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা হলো। মজার ব্যাপার হলো, মার্কিন এই নওমুসলিমের বিরুদ্ধে পশ্চিমারা ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে এবং হুমকি ধমকি দিয়েছে। বাক-স্বাধীনতার দাবীদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হলিউডের সাথে নওমুসলিম এই চলচ্চিত্রকারের চুক্তিপত্রগুলোর বেশিরভাগই বাতিল করেছে। এমনকি 'গ্রে স্টোন' নামে রূঢ় একটি ফিল্ম তৈরি হচ্ছে বলেও তাঁকে জানিয়েছে। তাঁকে মন্দ লোক হিসেবে এবং ভয়াবহ লোক হিসেবে সমাজে পরিচয় করানোরও পাঁয়তারা হচ্ছে বলে তিনি জানান। মুসলমান হবার ফলে তাঁর সাথে এ ধরনের আচরণের জবাবে তিনি প্রশান্ত মনে শুধু এ কালেমাটুকু উচ্চারণ করেই আত্মতৃপ্তি বোধ করতে চানঃ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।'
(রেডিও তেহরান)