বাঙ্গালী
Friday 22nd of November 2024
0
نفر 0

আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত ইমাম ও তাঁর দায়িত্ব

আমাদের বিশ্বাস অনুযায়ী, রাসূল (সা.) এর ইমাম বা খলিফা তথা প্রতিনিধির দু’ধরনের দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে। যথা :

একটি বাহ্যিক শাসন অপরটি আধ্যাত্মিক শাসন।

বাহ্যিক শাসন

অর্থাৎ শাসন পরিচালনা, আইনের বাস্তবায়ন, অধিকার সংরক্ষণ, ইসলামী রাষ্ট্রের সংরক্ষণ ইত্যাদি।

এক্ষেত্রে ইমাম বা খলিফা তথা প্রতিনিধির কাজ অন্যান্য শাসকদের মতই, তবে সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা কখনই ইসলামের আইন ও বিচারবিধির ওপর পূর্ণ জ্ঞান ব্যতীত সম্ভব নয়।

আধ্যাত্মিক শাসন

আধ্যাত্মিক শাসন এই অর্থে যে, ইমাম বা খলিফা তথা প্রতিনিধির কর্তব্য হচ্ছে সামাজিক গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল সমস্যার সমাধান দান ও মানুষের হেদায়েতের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলি (যা কোন কারণে বলা হয় নি) মুসলমানদের নিকট তুলে ধরা।

এক্ষেত্রে ইমাম বা খলিফা, একজন শাসকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অবশ্যই ধর্মীয় বিধি-বিধান ও কোরআনের তাফসীর বা ব্যাখ্যাও জনগণের সামনে বর্ণনা করবেন যাতে ইসলামের চিন্তা-ধারাকে যে কোন ধরনের বিচ্যুতি থেকে রক্ষা এবং বিভিন্ন ধরনের সন্দেহ-সংশয় হতে মুক্ত রাখতে পারেন। সুতরাং ইমাম বা খলিফাকে অবশ্যই রাষ্ট্রের অধিবাসীদের মধ্যে ইসলামের ভিত্তি, মানদণ্ড ও শরীয়তের বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে জ্ঞানী ও বিজ্ঞ হতে হবে। অর্থাৎ সবার চেয়ে বেশি মহানবী (সা.)-র প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের ঝর্ণা ধারা হতে পানি পান এবং তাঁর থাকাকালীন সময়ে যথেষ্ট পরিমাণ জ্ঞান ও নৈতিক লাভবান হওয়ার সৌভাগ্যের অধিকারী হতে হবে। সুতরাং ইসলামকে টিকিয়ে রাখার জন্য এরূপ ব্যক্তিত্ব বিদ্যমান থাকা অপরিহার্য যিনি রাসূল (সা.) এর পবিত্র অস্তিত্ব থেকে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত ও নৈতিক শিক্ষা লাভ করেছেন। সেই সাথে তিনি একদিকে ইসলামের জন্য অগ্রবর্তী ভূমিকা পালনকারীদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় হবেন অন্যদিকে সংবেদনশীল পরিস্থিতিতে নিজের স্বার্থের উপর মুসলমানদের ও ইসলামের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে দ্বীনকে রক্ষার জন্য আত্মোৎসর্গ করার দৃষ্টান্তের অধিকারী হবেন।

ইমাম বা খলিফার শাসনকার্যের ক্ষেত্রে মুসলমানদের সমস্ত সম্পদের উপর তার শাসন কর্তৃত্বের অধিকার থাকবে বিশেষ করে খুম্স, যাকাত, রাজস্ব ও ভূমিকর, যুদ্ধলব্ধ সম্পদ বা গণিমত, খনিজ ও অন্যান্য সাধারণ সম্পদ ইত্যাদি যা ইমাম বা খলিফার অধীনে থাকবে এবং ইমাম বা খলিফার দায়িত্ব হচ্ছে এগুলোকে কোন প্রকার অনিয়ম ছাড়াই জনগণের মাঝে বন্টন করা; অথবা ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণকর কোন কাজে লাগানো। সুতরাং তাকে অবশ্যই ইসলামের ন্যায় ভিত্তিক বন্টন ব্যবস্থা সম্পর্কে পূর্ণ অবহিত এবং দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্ত হতে হবে। এমনকি তাকে সংবেদনশীল বিশেষ মুহূর্তেও ভুল করা চলবে না অর্থাৎ তাকে জ্ঞান ও কর্ম উভয় ক্ষেত্রেই নির্ভুল হতে হবে। এমন ব্যক্তিকে মহান আল্লাহ ব্যতীত কেউই শনাক্ত করতে সক্ষম নয়। ঠিক এই দলিলের ভিত্তিতেই ইমামত তথা খেলাফত হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত যা তাঁর পক্ষ হতে উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম ও সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তিকেই প্রদান করা হয়। তাই ঐ পবিত্র পদ মানুষের নির্বাচনের নাগালের বাইরে।

অন্যভাবে বলা যায়, ইমামত তথা খেলাফত আল্লাহর মনোনীত একটি পদ যাতে মানুষের ভোটের কোন প্রভাব নেই। এ চিন্তার ভিত্তিতে আমরা রাসূল (সা.) এর স্থলাভিষিক্ত নির্ধারণের ক্ষেত্রে অবশ্যই বর্ণিত দলিল ও ঐশী নির্দেশের উপর নির্ভর করবো এবং রাসূল (সা.) এর বাণীসমূহ যা এই সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে সেগুলো নিরপেক্ষভাবে পর্যালোচনা করে তার ফলাফলের উপর সিদ্ধান্ত নিব।

হযরত আলীর (আ.) খেলাফতের অকাট্য প্রমাণ

যে সকল প্রমাণাদি সরাসরি সুস্পষ্টভাবে আলীর (আ.) খেলাফত ও নেতৃত্বকে প্রমাণ করে তার সংখ্যা এত বেশী যে যদি আমরা তা উল্লেখ করতে চাই তাহলে শুধু সেগুলিই একটা বড় গ্রন্থে রূপ লাভ করবে। তাই এখানে সামান্য কয়েকটির উল্লেখ করেই ক্ষান্ত থাকবো।

প্রথমেই বলা দরকার যে, যদিও মুসলিম সমাজ রাসূল (সা.) এর ইন্তেকালের পর নেতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ও রাসূল (সা.) এর প্রকৃত খলিফা হযরত আলীকে ২৫ বছর ধরে শাসনকার্য হতে দূরে রেখেছিল, কিন্তু এতে তাঁর সত্তাগত মর্যাদার মূল্য বিন্দু পরিমাণও কমে নি; বরং তারা নিজেরাই একজন নিষ্পাপ বা মাসুম নেতা হতে বঞ্চিত হয়েছে এবং উম্মতকেও তার সুফল থেকে বঞ্চিত করেছে। কারণ তাঁর মান-মর্যাদা বাহ্যিক খেলাফতের সাথে সম্পৃক্ত ছিল না, বরং খেলাফতের পদটি স্বয়ং আলীর (আ.) দায়িত্বভারের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। তাই তাঁকে খেলাফত থেকে দূরে রাখার কারণে রাসূলের নীতি ও সুন্নতের অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল।

যখন আমিরুল মু’মিনীন আলী (আ.) কুফা শহরে প্রবেশ করলেন, তখন এক ব্যক্তি তাঁর সামনে এসে বলল : ‘আল্লাহর কসম, হে আমিরুল মু’মিনীন! খেলাফতই আপনার মাধ্যমে মর্যাদা লাভ করেছে ও সৌন্দর্য্যমন্ডিত হয়েছে, এমন নয় যে আপনি ঐ খেলাফতের মাধ্যমে মর্যাদা লাভ করেছেন। আপনার কারণেই এই পদটি মর্যাদার উচ্চ স্তরে পৌঁছেছে, এমন নয় যে আপনি ঐ পদের কারণে উচ্চস্তরে পৌঁছেছেন। খেলাফতই আপনার মুখাপেক্ষী হয়েছিল, আপনি তার প্রতি মুখাপেক্ষী ছিলেন না।’

আহমাদ ইবনে হাম্বালের পুত্র আব্দুল্লাহ বলেছেন : “একদিন আমার পিতার নিকট বসেছিলাম। কুফার অধিবাসী একদল লোক প্রবেশ করলো ও খলিফাদের খেলাফত সম্পর্কে আলোচনা করলো; কিন্তু আলীর খেলাফত সম্পর্কে কথা-বার্তা একটু দীর্ঘায়িত হল। আমার পিতা মাথা উঁচু করে বললেন :

‘তোমরা আর কত আলী ও তার খেলাফত (শাসনকর্তৃত্ব) সম্পর্কে আলোচনা করতে চাও? খেলাফত আলীকে সুশোভিত করে নি বরং আলীই খেলাফতকে সৌন্দর্য্য দান করেছেন’।”

আমরা জানি যে, গাদীরের ঘটনা একটি প্রামাণিক ঘটনা যা ইসলামের ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়েছে এবং বেলায়াতের (কর্তৃত্বের) হাদীসও مَنْ كُنْتُ مَولاهُ فَعَليٌّ مَوْلاهُ একটি তর্কাতীত বাণী যা রাসূল (সা.) কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে। আর অর্থ ও ভাবধারার ক্ষেত্রেও কোন প্রকার অস্পষ্টতার চিহ্ন তাতে নেই; যারাই একটু আরবি ব্যকরণ সম্পর্কে জ্ঞাত ও বুদ্ধিবৃত্তিক এবং প্রচলিত সর্বগ্রাহ্য মাপকাঠি সম্পর্কে পরিচিত তারা যদি ন্যায়সঙ্গত দৃষ্টিতে পক্ষপাতহীনভাবে এই হাদীসটির প্রতি দৃষ্টিপাত করে তাহলে অবশ্যই স্বীকার করবে যে এই হাদীসটি আলী ইবনে আবী তালিবের (আ.) ইমামত, নেতৃত্ব ও প্রাধান্যতার কথাই প্রমাণ করে।

এমন কি এই হাদীসটিকে যদি না দেখার ভান করি, তারপরেও আলী (আ.) এর ইমামত ও নেতৃত্ব সম্পর্কে শিয়া এবং সুন্নীদের গ্রন্থসমূহে যথেষ্ট পরিমাণ হাদীস বর্ণিত হয়েছে যা আমাদের নিকট বিদ্যমান।

রাসূল (সা.) হতে এ সম্পর্কে যে সমস্ত হাদীস বর্ণিত হয়েছে তার কিছু নমুনা এখানে তুলে ধরবো।

মহানবী (সা.) কর্তৃক নির্ধারিত প্রতিনিধি বা খলিফা

রাসূল (সা.) বলেছেন :

 لكلِّ نَبيٍ وَصيٌّ وَ وٰارِثٌ وَ اِنَّ عَلياً وَصيّي وَ وٰارثي

অর্থাৎ ‘প্রত্যেক নবীরই ওসী বা প্রতিনিধি ও উত্তরাধিকারী আছে এবং নিশ্চয়ই আমার প্রতিনিধি ও উত্তরাধি-কারী হল আলী।’

আরো বলেন :

 أنٰا نَبِيُّ هٰذِهِ الاُمَّةِ وَ عَلِيٌّ وَصيّي في عِترَتي وَ اَهْلِ بَيتي وَ اُمَّتي مِنْ بَعدي

অর্থাৎ ‘আমি এই উম্মতের (জাতির) নবী আর আলী হচ্ছে আমার ওসী বা প্রতিনিধি।’

তিনি বলেন :

 عَليٌ أخي وَ وَزيري وَ وٰارثي وَ وَصيي وَ خَليفَتي في اُمَّتي

অর্থাৎ ‘আমার উম্মতের মধ্যে আলীই আমার ভাই, আমার সহযোগী উজীর, প্রতিনিধি, উত্তরাধিকারী ও আমার খলিফা।’

এসব হাদীসে ওসী (প্রতিনিধি) ও উত্তরাধিকারী এ দু’টি শিরোনামকে বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আর ঐ দু’টির প্রত্যেকটিই আমিরুল মু’মিনীন আলী (আ.) এর ইমামত বা খেলাফতকেই প্রমাণ করে।

ওসী বা প্রতিনিধির অধিকার

ওসী বা প্রতিনিধি তাকেই বলা হয় যিনি সমস্ত দায়-দায়িত্বের ক্ষেত্রে অসিয়তকারীর অনুরূপ অর্থাৎ যা কিছুর উপর অসিয়ত-কারীর অধিকার ও ক্ষমতা ছিল ওসীরও তার উপর অধিকার ও ক্ষমতা রয়েছে এবং তা ব্যবহার করতে পারবেন তবে যে ক্ষেত্রে তিনি নির্দিষ্টভাবে তাকে অসিয়ত করবেন কেবল সে ক্ষেত্রে নির্ধারিত সীমা পর্যন্ত তার ব্যবহারের অধিকার আছে।

এই হাদীসে রাসূল (সা.) আলী (আ.)-কে অসিয়তের ক্ষেত্রে দায়িত্বকে সীমিত করেন নি বরং তাঁকে নিঃশর্তভাবে ওসী বা প্রতিনিধি নিয়োগ করেছেন অর্থাৎ রাসূল (সা.) এর অধীনে যা কিছু আছে তার সবকিছুতে আলীর (আ.) অধিকার আছে আর এটাই হচ্ছে ইমামত বা খেলাফতের প্রকৃত অর্থ।

উত্তরাধিকারী

উত্তরাধিকারী শব্দটি শুনে প্রথম যে চিত্রটি মাথায় আসে তা হচ্ছে উত্তরাধিকারী ব্যক্তি উত্তরাধিকারী মনোনীতকারীর সমস্ত সম্পত্তির মালিক হয়; কিন্তু আলী (আ.) শরীয়তের দৃষ্টিতে রাসূল (সা.) এর সম্পদের উত্তরাধিকারী ছিলেন না। কেননা, ইমামিয়া ফিক্হের আইন অনুযায়ী মৃতের যখন কোন সন্তান থাকে, তখন অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন সম্পদের উত্তরাধিকারী হয় না (সন্তানগণ সম্পদের প্রথম পর্যায়ের উত্তরাধিকারী, তারপর অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন)। আর আমরা জানি যে, রাসূল (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় সন্তান রেখে গিয়েছিলেন। ফাতিমা যাহরা (সালামুল্লাহি আলাইহা) তাঁর (রাসূলের) ইন্তেকালের পরেও কমপক্ষে ৭৫ দিন জীবিত ছিলেন, তাছাড়াও রাসূল (সা.) এর স্ত্রীগণ, যারা সম্পদের এক অষ্টাংশের অধিকারী ছিলেন, তাঁদের অনেকেই জীবিত ছিলেন। যদি এ বিষয়গুলিকে উপেক্ষা করি তবুও আলী (আ.) রাসূল (সা.)-এর চাচাতো ভাই। আর চাচাতো ভাই তৃতীয় পর্যায়ে গিয়ে উত্তরাধিকার পায় এবং আমরা জানি রাসূল (সা.)-এর চাচা আব্বাস তাঁর (সা.) মৃত্যুর পরও জীবিত ছিলেন। আর চাচা হচ্ছেন দ্বিতীয় পর্যায়ের উত্তরাধিকারী বা ওয়ারিশ।

কিন্তু আহলে সুন্নাতের ফিকাহ্শাস্ত্র অনুযায়ী, স্ত্রী-গণকে তাদের অংশ (১/৮) দেওয়ার পর সম্পদকে দুইভাগে ভাগ করা হয়, তার এক অংশ পাবে হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.) যিনি রাসূল (সা.)-এর একমাত্র কন্যা ছিলেন। অপর অংশটি যেটা তার অংশের বাইরে : সেটা তাঁর (সা.) চাচা আব্বাসের দিকে বর্তায়। সুতরাং, হযরত আমিরুল মু’মিনীন আলী (আ.) কোনভাবেই রাসূল (সা.) এর সম্পদের উত্তরাধিকারী হতে পারেন না। অপরদিকে যেহেতু রাসূল (সা.) সরাসরি তাকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেছেন তাই অবশ্যই এই হাদীসে ‘এরস বা উত্তরাধিকারের’ বিষয়টি সম্পদ ভিন্ন অন্যকিছুকে বুঝায়। স্বাভাবিকভাবেই এই হাদীসে উত্তরাধিকারের বিষয়টি রাসূল (সা.) এর আধ্যাত্মিক ও সামাজিক মর্যাদার সাথে সংশ্লিষ্ট এবং আলী (আ.) রাসূল (সা.) এর জ্ঞান ও সুন্নাতের উত্তরাধিকারী। সেই দলিলের ভিত্তিতেই তিনি তাঁর (সা.) খলিফা বা প্রতিনিধি।

রাসূল (সা.) আলীকে (আ.) বলেছেন ‘তুমি আমার ভাই ও উত্তরাধিকারী।’ আলী (আ.) বলেন : ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনার কাছ থেকে উত্তরাধিকারী হিসেবে কি পাব?’ রাসূল (সা.) বললেন : ‘ঐ সকল জিনিস যা আমার পূর্ববর্তী নবীগণ উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে গেছেন।’ জিজ্ঞেস করলেন : ‘তাঁরা কি জিনিস উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে গেছেন?’ তিনি বললেন : ‘আল্লাহর কিতাব ও নবীদের সুন্নাত।’ আমিরুল মু’মিনীন আলী (আ.) নিজেও বলেছেন : ‘আমি রাসূল (সা.) এর জ্ঞানের উত্তরাধিকারী।’

 

মু’মিনদের পৃষ্ঠপোষক হচ্ছে আলী (আ.)

রাসূল (সা.) যখনই এমন কোন ব্যক্তির সাথে সাক্ষাত করতেন যে, আলীর (আ.) সাথে যে কারণেই হোক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছে বা যদি কেউ মূর্খতার বশে আলী (আ.) সম্পর্কে রাসূল (সা.) এর নিকট অভিযোগ করতো, তিনি তাদেরকে বলতেন :

 مٰا تريدُونَ مِنْ عَلِيٍّ اِنَّ عَلياً مِنّي وَ أَنٰا مِنْهُ وَ هُوَ وليُّ كُلِّ مُؤمِنٍ بَعدي

অর্থাৎ ‘আলীর সম্পর্কে তোমরা কি বলতে চাও সে আমার থেকে আর আমি তার থেকে। আমার পরে আলীই প্রত্যেক মো’মিনের ওয়ালী বা পৃষ্ঠপোষক (অভিভাবক)।’

যদিও বাক্যে ব্যবহৃত ‘ওয়ালী’ শব্দটির অনেকগুলো আভিধানিক অর্থ রয়েছে, তারপরেও এই হাদীসে নেতা, পৃষ্ঠপোষক বা অভিভাবক ব্যতীত অন্য কোন অর্থে ব্যবহার হয় নি; এই হাদীসে ‘আমার পরে’ শব্দটিই উক্ত মতকে স্বীকৃতি প্রদান করে। কারণ, যদি ‘ওয়ালী’ শব্দের উদ্দেশ্য বন্ধুত্ব, বন্ধু, সাথী, প্রতিবেশী, একই শপথ গ্রহণকারী, এ ধরনের অর্থই হত তাহলে ‘রাসূল (সা.) এর পরে’ যে সময়ের প্রতি বিশেষ ইঙ্গিত করা হয়েছে তার দরকার ছিল না, কারণ তাঁর (সা.) জীবদ্দশায়ই তিনি (আলী) ঐরূপ ছিলেন।

রাসূল (সা.) এর বাণীতে আলী (আ.)-র পৃষ্ঠপোষকতা বা অভিভাবকত্বকে মেনে নেওয়ার সুফলের কথা

যখনই সাহাবীগণ রাসূল (সা.) এর পরে তাঁর খলিফা বা প্রতিনিধি ও ইসলামী রাষ্ট্র নেতা সম্পর্কে তাঁর (সা.) সাথে কথা বলতেন, তখনই তিনি (কোন কোন হাদীস অনুযায়ী দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন) এবং আলীর (আ.) পৃষ্ঠপোষকতা বা অভিভাবকত্ব মেনে নেওয়ার সুফল সম্পর্কে বক্তব্য দিতেন।

তিনি বলতেন :

 إنْ وَلَّيْتُمُوهٰا عَلياً وَجَدْتُمُوهُ هٰادياً مَهْدياً يَسْلُكُ بِكُمْ عَلَى الطَّريقِ المستقيم

অর্থাৎ ‘যদি খেলাফতকে আলীর হাতে তুলে দাও, তাহলে দেখবে যে, হেদায়াত প্রাপ্ত ও হেদায়াতকারী হিসাবে সে তোমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালনা করছে।’

 أما وَالَّذي نَفْسي بِيَدِهِ لَئِنَ اَطاعُوه لَيَدْخُلُنَّ الجَنَّةَ اَجْمَعينَ اَكْتعينَ

অর্থাৎ ‘তাঁর শপথ যাঁর হাতে আমার প্রাণ আছে! যারা আলীর আনুগত্য করবে তারা সকলেই বেহেশ্তে প্রবেশ করবে।’

 اِنْ تسْتخْلِفُوا عَلياً ـ‌وَ لا اَرٰاكُمْ فَاعِلينَ‌ـ تجِدُوهُ هٰادياً مَهْدياً يَحْمِلُكُمْ عَليَ المَحَجَّةِ الْبَيْضٰاء

অর্থাৎ ‘যদি তোমরা আলীকে খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে মেনে নাও, তাহলে (আমার মনে হয় না তোমরা এমনটি করবে) দেখবে যে, সে সঠিক পথপ্রাপ্ত ও পথপ্রদর্শক; তিনি তোমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করবে।’

আলী (আ.) এর জন্য নির্ধারিত খেলাফত

রাসূল (সা.) হতে বর্ণিত আছে যে, শবে মেরাজে (ঊর্ধ্বগমনের রাতে) যখন আমি নৈকট্যের প্রান্ত সীমাতে পৌঁছলাম ও আল্লাহর সম্মুখে দণ্ডায়মান হলাম, তিনি বললেন : হে মুহাম্মদ! আমি জবাব দিলাম: ‘লাব্বাইক (আমি হাজির)।’ তিনি বললেন : ‘তুমি কি আমার বান্দাদেরকে পরীক্ষা করে দেখেছ যে, তাদের মধ্যে কে সবচেয়ে বেশি আমার অনুগত?’

আমি বললাম : ‘হে আল্লাহ তাদের মধ্যে আলীই সবচেয়ে বেশী অনুগত।’

তিনি বললেন : ‘তুমি সত্যই বলেছ হে মুহাম্মদ! তুমি কি স্বীয় খলিফা বা প্রতিনিধি নির্ধারণ করেছ যে তোমার পরে তোমার দায়িত্বগুলি পালন করবে এবং আমার বান্দাদের মধ্যে যারা কোরআন সম্পর্কে জানে না তাদেরকে কোরআন শিক্ষা দিবে?’

আমি বললাম : ‘হে আল্লাহ! আপনি নিজেই আমার জন্য প্রতিনিধি নির্ধারণ করে দিন।’

 তিনি বললেন : ‘আমি আলীকে তোমার প্রতিনিধি হিসেবে নির্ধারণ করলাম; তুমি তাকে স্বীয় প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচন কর।’

একইভাবে রাসূল (সা.) বলেছেন : ‘আল্লাহ প্রত্যেক জাতির জন্য নবী নির্বাচন করেছেন ও প্রত্যেক নবীর জন্য নির্ধারণ করেছেন তার প্রতিনিধি। আমি হলাম এই জাতির নবী আর আলী হচ্ছে আমার স্থলাভিষিক্ত প্রতিনিধি বা ওসী।’

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে যে বিষয়টি প্রতীয়মান হয় তা হচ্ছে মহানবী (সা.) আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ অনুযায়ী সর্বোত্তম ও সুযোগ্য ব্যক্তি হযরত আলী (আ.)-কে তাঁর স্থলাভিষিক্ত বা খলিফা নির্ধারণ করেছেন। তাই তাঁর আনুগত্য করা সকল মুসলমানের জন্য ফরয। তাঁকে অমান্য করার অর্থ হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ অমান্য করা। সে কারণে আমাদের সকলের দায়িত্ব হচ্ছে রাসূলে (সা.) এর নির্ধারিত ব্যক্তির অনুসরণ করা। (মো. আনিসুর রহমান, রাযীন, ১ম বর্ষ, সংখ্যা ১)

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

ফাদাক সম্পর্কে “প্রথম খলিফার ...
পবিত্র কুরআন ও সুন্নাতের আলোকে ...
কোমে হযরত ফাতেমা মাসুমার (আ.) জন্ম ...
শ্রেষ্ঠ নারী হযরত ফাতিমাতুয ...
ইমাম হাসান (আ.) এর শাহাদাত
নবী রাসূল প্রেরণের প্রয়োজনীয়তা
Apabila ada sebagian hukum Islam yang nampaknya bertentangan serta kontradiktif dengan ...
আবতার কে বা কা’রা?
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কতিপয় খুতবা ও ...
ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মহান শাহাদাতের ...

 
user comment