মুসলমানদের সাথে ওয়াহাবীদের বিরোধের অন্যতম বিষয় হলো কবরের উপর গম্বুজ ও সৌধ নির্মাণ সম্পর্কিত। ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে মুসলমানগণ এই রীতিটি অনুসরণ করে এসেছে এবং এ বিষয়টি জায়েয ও মুস্তাহাব হওয়ার সপক্ষে কোরআন ও হাদীস হতে দলিল প্রমাণ উপস্থাপন করেছে। উপরন্তু এ কর্মটি যৌক্তিক এবং তা বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন ব্যক্তিদের অনুসৃত রীতির সাথে সামঞ্জস্যশীল। কিন্তু ইবনে তাইমিয়ার সময় হতে এই রীতির বিরোধিতা শুরু হয়। তিনি কবরের উপর সৌধ ও গম্বুজ তৈরিকে শিরক বলে ঘোষণা করেন। হিজাযে আলে সউদের আধিপত্যের সময় এই বিশ্বাস তুঙ্গে পৌঁছায় ও সউদী শাসকগণ এই ফতোয়ার ব্যবহারিক বাস্তবায়নে রত হয়। ওয়াহাবী আলেমদের ফতোয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তারা সকল মাজার,কবরের উপরে নির্মিত সৌধ ও গম্বুজ ধ্বংসকার্যে রত হয়। মহানবীর কবর ব্যতীত সকল সৌধ তারা ধ্বংস করে। তাঁর পবিত্র রওজা ধ্বংসের ইচ্ছা থাকলেও মুসলমানদের প্রতিরোধের ভয়ে তারা তা করতে পারে নি। তারা তাদের এ ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছে এ প্রবন্ধে আমরা এই বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা করব।
কবরের উপর সৌধ নির্মাণ ও পবিত্র কোরআন
পবিত্র কোরআন কবরের উপর সৌধ নির্মাণের বিষয়টি নিয়ে সুস্পষ্ট কিছু না বললেও কোরআনের আয়াত হতে এ সম্পর্কিত বিধান পাওয়া যায়। এ যুক্তিতে যে-
১। কবরের উপর সৌধ নির্মাণ আল্লাহর নিদর্শনসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের শামিল। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে তাঁর নিদর্শনসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে নির্দেশ দিয়েছেন,কারণ তা অন্তরের পরহেজগারীর (আত্মসংযম) প্রমাণ। যেমন বলা হয়েছে,
وَمَنْ يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوبِ
“যারা আল্লাহর ( দ্বীনের) নিদর্শনসমূহের সম্মান করে তা অন্তরের পরহেজগারীর প্রমাণস্বরূপ ।”(সূরা হাজ্জ্ব : ৩২।)
‘ شعائر ’ শব্দটি‘ شعیره ’ শব্দের বহুবচন যার অর্থ নিদর্শন ও প্রমাণ।‘ আল্লাহর নিদর্শন’ (شعائر الله )হলো এমন কোন প্রতীক যা আল্লাহর দিক নির্দেশক। যদি কেউ আল্লাহর নিকট পৌঁছাতে চায় (নৈকট্য পেতে চায়) তবে ঐ প্রতীকের মাধ্যমে তাতে পৌঁছাতে পারে। অবশ্য‘ আল্লাহর নিদর্শন’ অর্থ যদি তাঁর দ্বীনের নিদর্শন বুঝায় তবে আয়াতটির অর্থ হবে যদি কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে চায় তবে তাঁর দ্বীনের নিদর্শনসমূহের স্থান প্রদর্শনের মাধ্যমে তা অর্জন করতে হবে।
পবিত্র কোরআনে সাফা ও মারওয়াকে আল্লাহর নিদর্শন ও চিহ্ন বলা হয়েছে:
إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ
“নিশ্চয়ই সাফা ও মারওয়া (পর্বত দু ’ টি) আল্লাহর (দ্বীনের) নির্দশন। ” (সূরা বাকারা : ১৫৮।)
কোরবানীর উদ্দেশ্যে যে উটকে মিনায় নিয়ে যাওয়া হয় তাকেও আল্লাহর নিদর্শন বলা হয়েছে,
وَالْبُدْنَ جَعَلْنَاهَا لَكُمْ مِنْ شَعَائِرِ
“আমরা কোরবানীর হৃষ্টপুষ্ট উষ্ট্রকে তোমাদের জন্য আল্লাহর ( দ্বীনের) নিদর্শন বানিয়েছি।” (সূরা হাজ্জ্ব : ৩৬।)
এ বিষয়গুলো ইবরাহীমের ধর্মের (দ্বীনে হানিফের) নিদর্শনসমূহরে অন্তুর্ভুক্ত। মুজদালিফাকেمَشعَر বলা হয়,কারণ তা আল্লাহর দ্বীনের নিদর্শন ও প্রতীক স্বরূপ। হজ্জ্বের সকল আচারই আল্লাহর দ্বীনের নিদর্শন কারণ তা একত্ববাদী ও অবিকৃত ধর্মের প্রতীকস্বরূপ।
যেহেতু এই আচারসমূহ আল্লাহর দ্বীনের নিদর্শনস্বরূপ এবং মানবজাতিকে একত্ববাদী ও অবিকৃত ঐশী দ্বীনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়,সেহেতু নিঃসন্দেহে বলা যায়,আল্লাহর নবী ও ওলিগণ তাঁর দ্বীনের সর্বোচ্চ নিদর্শন। কারণ তারা হলেন নিষ্পাপ,কখনোই অন্যায়কর্ম করেন না এবং তাদের বাণী ও কর্ম সত্যের অনুরণন। তাঁরা এমন এক আদর্শ যাদের অনুসরণে একত্ববাদ ও মহাসত্যের পথ খুঁজে পাওয়া যায়।
যখন মহানবী (সা.),তাঁর স্থলাভিষিক্ত প্রতিনিধি (পবিত্র ইমামগণ) ও আল্লাহর অন্যান্য ওলিগণ এরূপ বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী তখন তাদের সকল স্মৃতি সংরক্ষন যেমন তাঁদের কবর,তা সংরক্ষনের নিমিত্তে তার উপর সৌধ ও গুম্বুজ নির্মাণ আল্লাহর নিদর্শনের প্রতি সম্মানেরই নমুনা স্বরূপ। কারণ এরূপ কর্ম সেই ব্যক্তিবর্গের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে করা হয়,যাদের কর্ম,বাণী ও নির্দেশনা মানুষকে আল্লাহর দিকে পরিচালিত করে।
কুরতুবী তাঁর তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন,‘আল্লাহর নিদর্শন হলো এমন কিছু যা তাঁর দ্বীনের চিহ্ন ও স্মৃতি বহন করে বিশেষত যে সকল বিষয় দ্বীনের আচারের পথে সংশ্লিষ্ট। (তাফসীরে কুরতুবী,১২তম খণ্ড,পৃ. ৫৬।)
মিশরীয় লেখক প্রফেসর আব্বাস মাহমুদ আল আক্কাদ কারবালা ও ইমাম হুসাইনের মাজার সম্পর্কে বলেছেন : ‘কারাবালা এমন একস্থান যেখানে মুসলমানরা শিক্ষাগ্রহণ ও ইমাম হুসাইনের স্মরণের জন্য যায়। অমুসলমানরাও সেখানে দর্শনের জন্য যায়। কিন্তু যদি ঐ ভূমির প্রকৃত মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হয় তবে অবশ্যই তা সেই সব ব্যক্তিদের জিয়ারতের স্থান হওয়া উচিত যারা স্বজাতির জন্য বিশেষ পবিত্রতা ও মর্যাদায় বিশ্বাসী। কারণ জিয়ারতের স্থানগুলোর মধ্যে ইমাম হুসাইনের মাজার হতে উত্তম কোন স্থানের কথা আমার জানা নেই।’
২। মহানবীর পবিত্র আহলে বাইতের সদস্যদের কবরসমূহের উপর সৌধ নির্মাণ মহানবীর নিকটাত্মীয়দের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ স্বরূপ।
পবিত্র কোরআন সুস্পষ্টরূপে আল্লাহর নবীর রক্তসম্পর্কীয় নিকটাত্মীয়দের প্রতি ভালবাসা পোষণের নির্দেশ দিয়েছে-
قُلْ لَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِلَّا الْمَوَدَّة
“তোমাদের হতে আমি আমার ( রিসালাতের দায়িত্বের) কোন বিনিময় চাই না কেবল আমার অতিনিকটাত্মীয়দের প্র তি ভালোবাসা ছাড়া । (সূরা শুরা : ২৩)
নিঃসন্দেহে মহানবীর অতিনিকটাত্মীয়দের কবর সংরক্ষণের নিমিত্তে তার উপর সৌধ নির্মাণ করে জিয়ারতকারীদের জন্য তা চিহ্ন হিসেবে উপস্থাপন তাঁদের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ স্বরূপ। কারণ প্রতিটি ভালোবাসারই প্রকাশ আছে এবং শুধু তাঁদের আনুগত্য করা ও তাঁদের প্রতি আন্তরিক ভালবাসা পোষণ করাই ভালোবাসার নিদর্শন নয়,বরং সৌধ নির্মাণের মাধ্যমে তাঁদের কবর সংরক্ষণও তাঁদের প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন,যেহেতু এরূপ কর্ম কোন সূত্রেই নিষিদ্ধ করা হয় নি। (আবুশ শুহাদা,পৃ. ৫৬)
৩। আল্লাহর ওলীদের কবরের উপর সৌধ নির্মাণ পবিত্র গৃহসমূহকে সমুন্নত রাখার নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত,মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে অনুমতি দিয়েছেন যেসকল গৃহে আল্লাহর নাম স্মরণ করা হয় তা সমুন্নত করার।
فِي بُيُوتٍ أَذِنَ اللَّهُ أَنْ تُرْفَعَ وَيُذْكَرَ فِيهَا اسْمُهُ يُسَبِّحُ لَهُ فِيهَا بِالْغُدُوِّ وَالْآصَالِ رِجَالٌ لَا تُلْهِيهِمْ تِجَارَةٌ وَلَا بَيْعٌ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ
“আল্লাহ যেসব গৃহকে (যাতে তাঁর নূর রয়েছে) মর্যাদায় উন্নীত করার এবং সেগুলোতে তাঁর নাম উচ্চারণ করার আদেশ দিয়েছেন, সেখানে সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে এমন লোকেরা যাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে, নামাজ প্রতিষ্ঠা করা থেকে এবং জাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখে না। ” (সূরা নূর : ৩৬-৩৭)
উপরিউক্ত আয়াত হতে আমাদের বক্তব্যের সপক্ষে দু’ টি প্রমাণ উপস্থাপন করা যায়।
প্রথমত উপরিউক্ত আয়াতে গৃহ বলতে শুধু মসজিদ বুঝানো হয়নি,বরং আয়াতের উদ্দেশ্য মসজিদসহ যে কোন স্থান যেখানে আল্লাহর নাম স্মরণ করা হয়,যেমন নবিগণ ও তাঁদের স্থলাভিষিক্ত পবিত্র প্রতিনিধিদের গৃহ। এমনকি এ দাবীও সত্য যে,উপরিউক্ত আয়াতটিতে মসজিদ ভিন্ন অন্য গৃহের বা গৃহসমূহের কথা বলা হয়েছে। কারণ গৃহ বলতে যে কোন চার দেয়াল ও ছাদ বিশিষ্ট স্থানকে বুঝানো হয়। যেমন পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে :
وَلَوْلَا أَنْ يَكُونَ النَّاسُ أُمَّةً وَاحِدَةً لَجَعَلْنَا لِمَنْ يَكْفُرُ بِالرَّحْمَنِ لِبُيُوتِهِمْ سُقُفًا مِنْ فِضَّةٍ وَمَعَارِجَ عَلَيْهَا يَظْهَرُونَ
“যদি সব মানুষের এক মতাবলম্বী (কাফের) হয়ে যাওয়ার আশংকা না থাকত তবে যারা দয়াময়কে (আল্লাহকে) অস্বীকার করে তাদের গৃহসমূহের ছাদ ও সিঁড়িকে যা দ্বারা তারা উপরে যেত আমি রৌপ্য নির্মিত করে দিতাম। ” (সূরা যুখরুফ : ৩৩)
উপরিউক্ত আয়াত হতে বোঝা যায় আরবী ভাষায় যে,কোন ছাদ বিশিষ্ট কক্ষকেই গৃহ((بیت)) বলা হয়। তদুপরি হাদীসসমূহে বলা হয়েছে মসজিদ ছাদবিহীন হওয়া মুস্তাহাব। তাই উল্লিখিত আয়াতে গৃহ বলতে মসজিদ ভিন্ন অন্য গৃহের কথা বলা হয়েছে। উপরন্তু রাসূলের আহলে বাইতের সূত্রে ইমাম বাকির (আ.) হতে বর্ণিত হয়েছে যে,উপরিউক্ত আয়াতে গৃহ বলতে নবিগণ ও হযরত আলীর গৃহের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।(তাফসীরে আল বুরহান,বাহরানী,৩য় খণ্ড,পৃ. ১৩৭)
পবিত্র কাবাগৃহকে বাইতুল্লাহ্ বলা হয়,কারণ তার ছাদ রয়েছে।
দ্বিতীয়ত আয়াতে যে সমুন্নত করার কথা বলা হয়েছে তার দু’ রকম অর্থ হতে পারে :
ক) গৃহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও আধ্যাত্মিক মর্যাদা দান যেমনটি আমরা এ আয়াতটিতে পড়ি
وَرَفَعْنَاهُ مَكَانًا عَلِيًّا
“আমরা তার মর্যাদাকে সমুন্নত করেছি। ” (সূরা মারইয়াম : ৫৭।)
খ) আয়াতের লক্ষ্য বাহ্যিক ও বস্তুগত উন্নয়ন অর্থাৎ ঐরূপ গৃহ বা স্থানের যেমন ওলীদের কবরের উপর সৌধ নির্মাণের মাধ্যমে গৃহ বা কবরকে উন্নীত করা।
জামাখশারী তাঁর তাফসীর গ্রন্থে বলেছেন : গৃহকে উন্নীত করার অর্থ গৃহের কাঠামোকে উচ্চ করা যেমনটি নিম্নোক্ত আয়াতে বলা হয়েছে-
وَإِذْ يَرْفَعُ إِبْرَاهِيمُ الْقَوَاعِدَ مِنَ الْبَيْتِ وَإِسْمَاعِيلُ
“(স্মরণ কর) যখন ইবরাহীম ও ইসমাঈল কাবাগৃহের ভিত্তিকে উন্নীত করেছিল। ” অথবা কাবাগৃহের প্রতি মর্যাদা দেখানোও সম্মান প্রদর্শন।" (আল কাশশাফ,২য় খণ্ড,পৃ. ৩৯০)
তাফসীরে রুহুল বায়ানে বলা হয়েছে(أن ترفع) উন্নীত করার অর্থ উচ্চ করা অথবা সেগুলোর মর্যাদাকে বৃদ্ধি করা।(রুহুল বায়ান,৬ষ্ঠ খণ্ড,পৃ. ১৫৮।)
যদি আয়াতটিতে উন্নীত করার অর্থ বাহ্যিক ও কাঠামোগত উন্নয়নের কথা বলা হয়ে থাকে তবে তা সুস্পষ্টভাবে আল্লাহর নবী ও ওলীদের কবরকে উন্নীত করণের দলিল হবে। বিশেষত যখন মহানবী (সা.) সহ তাঁর আহলে বাইতের কয়েকজন ইমাম তাঁদের গৃহেই সমাধিস্থ হয়েছিলেন। আর যদি উন্নীত করণের অর্থ মর্যাদা দান ও অবস্তুগত উন্নয়ন হয়ে থাকে তবে তার অর্থ হবে নবী ও আল্লাহর ওলীদের গৃহ ও কবরসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নিমিত্তে তা সংরক্ষন করা,সৌধ নির্মাণ ও তার মেরামত করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। আল্লামা সুয়ূতী আনাস ইবনে মালিক ও কুরাইদা হতে বর্ণনা করেছেন যে,মহানবী (সা.)فی بیوت اذن أن ترفع আয়াতটি পাঠ করলে একব্যক্তি তাঁকে জিজ্ঞেস করল :‘ এখানে কোন গৃহসমূহের কথা বলা হয়েছে?’
রাসূল (সা.) বললেন :‘ নবিগণের গৃহসমূহ’ । হযরত আবু বকর রাসূলকে তখন হযরত আলী ও ফাতিমার গৃহের দিকে ইঙ্গিত করে জিজ্ঞেস করলেন :‘ হে আল্লাহর রাসূল! এই গৃহটিও কি ঐসব গৃহের অন্তর্ভুক্ত,আল্লাহ ও আপনার দৃষ্টিতে যার প্রতি মর্যাদা প্রদর্শন করা উচিত।’ তিনি বললেন :‘ এই গৃহটি ঐ গৃহসমূহের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ।’ (দুররূল মানসূর,৫ খণ্ড,পৃ. ৫০)
প্রাথমিক যুগের অনুসরণীয় মুসলমানদের কর্ম ধারায় কবরের উপর স্মৃতিসৌধ নির্মাণ
ইসলামের ইতিহাসের প্রতি লক্ষ্য করলে আমরা দেখি,ইসলামের আবির্ভাবের যুগ থেকেই মুসলমানদের মধ্যে কবরের উপর সৌধ নির্মাণের প্রচলন ছিল এবং এ বিষয়টি কখনোই সাহাবী ও তাবেয়ীদের প্রতিবাদের মুখোমুখি হয় নি। ইতিহাসের পরিক্রমায় প্রথমবারের মত ওয়াহাবীরা এ রীতির বিরুদ্ধে মৌখিক ও ব্যবহারিকভাবে প্রতিবাদ শুরু করে। মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত এ রীতির কিছু উদাহরণ এখানে উল্লেখ করছি :
১। মুসলমানগণ রাসূলের পবিত্র দেহ মোবারককে ছাদ বিশিষ্ট গৃহে দাফন করেন। তখন থেকেই তা সাহাবাদের সম্মানের স্থান হিসেবে পরিগণিত হতো।
হুসাইন ইবনে আহমান ইবনে মুহাম্মদ যিনি আবিল খাজ্জাজ বাগদাদী নামে প্রসিদ্ধ তৃতীয় ও চতুর্থ শতাব্দীর একজন কবি যিনি হযরত আলীর প্রশংসায় রচিত উচ্চমানের কাসীদা যা তিনি তাঁর পবিত্র রওজার সন্নিকটে রচনা করেছেন তাতে আমিরুল মুমিনিনের কবরের উপর নির্মিত সাদা গুম্বুজের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন :
‘হে নাজাফের সাদা গম্বুজের অধিকারী,
যে আপনাকে জিয়ারত করে শাফা (আরোগ্য) চায় সে শাফা লাভ করে,
তোমরা হেদায়েতকারী আবুল হাসানের (আলীর) কবর জিয়ারত কর,
যাতে পুরস্কার,সৌভাগ্য ও নৈকট্যের অধিকারী হতে পার।’
(ওয়াফিয়াতুল আইয়ান,১ম খণ্ড,পৃ. ১৭০;আল মুনতাজাম,৭ম খণ্ড,পৃ. ২১৬,রওজাতুল জান্নাত,৩য় খণ্ড,পৃ. ১৪৮)
৩। বুখারী তাঁর সহীহ্তে বর্ণনা করেছেন যে,হাসান ইবনে হাসান ইবনে আলী (আঃ) মৃত্যুবরণ করলে তাঁর স্ত্রী তাঁর কবরের উপর ছাউনী দিয়ে তাঁর নিকট বসে একবছর নিয়মিত ক্রন্দন করেছিল।(সহীহ বুখারী,কিতাবুল জানাযিয়া,হাদীস নং ৬২)
মোল্লা আলী কারী উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেছেন:‘ বাহ্যিকভাবে বোঝা যায় কবরের উপর ছাউনী এ উদ্দেশ্যে দেয়া হয়েছিল যে,যাতে করে তার বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা তার কবরের নিকট এসে কোরআন তেলাওয়াত,জিকির করতে পারে এবং তার সঙ্গীরা তার জন্য দোয়া ও মাগফেরাত কামনার জন্য সেখানে যায়।’
৪। সাইয়্যেদ বাকরী বলেছেন :‘ কবরের উপর সৌধ নির্মাণের নিষেধাজ্ঞা হতে নবিগণ,শহীদ ও সৎকর্মশীল বান্দারা বহির্ভূত।’ (ইয়ানাতুত তালেবীন,২য় খণ্ড,পৃ. ১২০)
৫। ইবনে শাবাহ বর্ণনা করেছেন,‘ আকীল ইবনে আবি তালিব তার নিজগৃহে কূপ খনন করার সময় একটি পাথরের সন্ধান পান যাতে লেখা ছিল : এই কবরটি সাখর ইবনে হারবের কন্যা হাবীবার। আকীল তখন কবরটি ঢেকে দিয়ে তার উপর একটি গৃহ নির্মাণ করলেন।’ (তারিখুল মাদিনাতুল মুনাওয়ারাহ,১ম খণ্ড,পৃ. ১২০)
৬। সামহুদী হযরত হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিবের কবরের বর্ণনা দিয়ে বলেন :‘ তার কবরের উপর সুন্দর,মজবুত ও উঁচু একটি গম্বুজ রয়েছে. আব্বাসীয় খলিফা নাসিরুদ্দীনের (৫৭৫-৬২২) শাসনামলে তা নির্মিত হয়েছে। (ওয়াফাউল ওয়াফা,২য় খণ্ড দ্রষ্টব্য)
৭। ইবনে সা’ দ তার তাবাকাত গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন,‘ উসমান ইবনে মাজউনের মৃত্যুর পর জান্নাতুল বাকীতে তাকে দাফনের পর রাসূল (সা.) তার কবরের উপর স্থায়ী কিছু স্থাপন করলেন এবং বললেন :‘ এটি তার কবরের চিহ্ন।’ (তাবাকাতে ইবনে সা’ দ,৩য় খণ্ড,পৃ. ২৯১)
আমর ইবনে হাজম বলেছেন :‘ উসমান ইবনে মাজউনের কবরের নিকট উঁচু কিছু স্থাপিত দেখলাম যা প্রতীকের মত ছিল।’ (তাবাকাতে ইবনে সাদ,৩য় খণ্ড,পৃ. ২৮৯)
মুতাল্লাব বর্ণনা করেছেন,‘ উসমান ইবনে মাজউনের মৃত্যু ও দাফনের পর মহানবী (সা.) নির্দেশ দিলেন পাথর জাতীয় কিছু আনার। একব্যক্তি ভারী একটি পাথর আনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে মহানবী (সা.) আস্তিন গুটিয়ে পাথরটি উঠালেন ও উসমান ইবনে মাজউনের কবরের নিকট স্থাপন করলেন এবং বললেন :‘ তার কবরের চিহ্ন রাখতে চাই।’ (সুনানে আবি দাউদ,৩য় খণ্ড,পৃ. ২১১;আস সিরাতুল হালাবীয়া,২য় খণ্ড,পৃ. ৯৫)
৮। ইবনে সা’ দ ইমাম বাকির (আ.) হতে বর্ণনা করেছে,‘ রাসূলের কন্যা ফাতিমা হযরত হামজার কবরের নিকট যেতেন ও তা পরিপাটি ও সংস্কার করতেন।’ (তাবাকাতে ইবনে সাদ,২য় খণ্ড,পৃ. ১১৯)
৯। বুখারী বর্ণনা করেছেন যে,আবদুর রহমান ইবনে আবি বাকরের মৃত্যুর পর হযরত আয়েশা নির্দেশ দিয়েছিলেন তার কবরের উপর তাঁবু স্থাপনের এবং একজনের উপর তা দেখাশোনার দায়িত্ব আরোপ করেন।(সহীহ বুখারী,২য় খণ্ড,পৃ. ১১৯)
১০। হযরত উমর রাসূলের স্ত্রী জয়নাব বিনতে জাহাশের কবরের উপর তাঁবু নির্মাণের নির্দেশ দেন এবং কেউ তার এ কাজে বাধা দেয় নি। (তাবাকাতে ইবনে সাদ,৮ম খণ্ড,পৃ. ৮০)
আল্লাহর ওলীদের সৌধের ইতিবাচক প্রভাবসমূহ
যেহেতু মহানবীর স্থলাভিষিক্ত ও মনোনীত প্রতিনিধিগণ আল্লাহর ওলী এবং ইসলামের পথে সর্বপ্রকার আত্মত্যাগ করেছেন এ কারণে কিয়ামত পর্যন্ত তাঁরা মুসলমানদের জন্য আদর্শ। নিঃসন্দেহে মনস্তাত্ত্বিক ও শৈল্পিক কর্মের মাধ্যমে ইসলামের অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বদের জাগরিত রাখা ইসলামের সাথে মুসলমানদের বন্ধনকে দৃঢ় করে। যে ব্যক্তি জীবনে অন্তত একবার মক্কা ও মদীনায় জিয়ারতে যাবে এবং সেখানে অবস্থিত ইসলামের প্রাথমিক যুগের নিদর্শনসমূহ ও মহান ব্যক্তিবর্গের জৌলুসপূর্ণ রওজা দর্শন করবে তাঁদের মহান আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করবে ও তাঁদের মর্যাদা ও সম্মান তাদের অন্তরপটে প্রতিফলিত হবে। ফলে তারা তাদের প্রভু আল্লাহর সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবে এই বলে যে,ঐ মহান ব্যক্তিবর্গের পথে চলবে এবং দৃঢ় শপথ নেবে তাঁদের পথে অবিচল থাকার। এটি ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের চির জাগরুক রাখার একটি পদ্ধতি। যে কেউ আল্লাহর ওলীদের কবর,গম্বুজ ও সৌধ দেখে তাঁদের শিক্ষার বিষয়ে প্রত্যয় অর্জন করে।
খ্রিস্টান বিশ্ব একটি বিশেষ সময় হযরত ঈসার অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহে পতিত হয়েছিল,কারণ তাঁর স্মৃতির কোন চিহ্নই বর্তমান নেই। একজন মার্কিন ঐতিহাসিক তার‘ সভ্যতার ইতিহাস’ গ্রন্থে হযরত ঈসার বিষয়ে খ্রিস্ট বিশ্ব যে দু’ শ বছর সন্দেহে পতিত হয়েছিল তার উল্লেখ করেছেন।
নেপোলিয়ান ১৮০৮ সালে একজন জার্মান ঐতিহাসিক উইলেন্ডকে প্রশ্ন করেন হযরত ঈসা যে এক ঐতিহাসিক সত্য তা সে বিশ্বাস করে কি না?
কিন্তু ইতিহাসের পরিক্রমায় মুসলমানগণ সবসময় মাথা উঁচু করে রয়েছে। কারণ আমাদের ঐতিহাসিক ব্যক্তিবর্গের কবরসমূহ এখনও বিদ্যমান এবং কিছুদিন পরপরই তাঁদের কবরের নিকট উপস্থিত হয়ে আমরা তাঁদের সঙ্গে সম্পর্ককে ও পথ চলার প্রতিশ্রুতিকে নবায়ন করি যে পথ অতিক্রম করলে নিঃসন্দেহে আল্লাহর সন্তুষ্টি,পূর্ণতা ও বেহেশতে পৌঁছা যাবে।