বাঙ্গালী
Friday 22nd of November 2024
0
نفر 0

শীয়া মাযহাবের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ- ৬ষ্ঠ পর্ব

শীয়া মাযহাবের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ- ৬ষ্ঠ পর্ব

ইসলামে শিক্ষা গ্রহণ ও শিক্ষা প্রদান

জ্ঞান অর্জন ইসলামের একটি ধর্মীয় কর্তব্য । মহানবী (সা.) বলেছেনঃ ‘জ্ঞান অর্জন করা প্রতিটি নর-নারীর জন্য ফরয’ । আর এ ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রাপ্ত যেসব হাদীস রয়েছে, তা থেকে বোঝা যায় যে, জ্ঞান বলতে ইসলামের মৌলিক তিনটি বিষয় ও তদসংশ্লিষ্ট জ্ঞানের কথাই বোঝানো হয়েছে । আর তা’ হলঃ

১. তাওহীদ (আল্লাহর একত্ববাদ)

২. নবুয়ত

৩. কেয়ামত (পুনরূত্থান দিবস)

আর প্রতিটি ব্যক্তির জন্য তার প্রয়োজন মাফিক ইসলামী আইন ও তার ব্যখ্যাসহ সে সংক্রান্ত প্রয়াজনীয় বিস্তারিত জ্ঞান অর্জন করা তার অবশ্য কর্তব্য । অবশ্য এটা বলা বাহুল্য যে, ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস সংক্রান্ত জ্ঞানের ব্যাপারে মোটামুটিভাবে দলিল প্রমাণ সহ জ্ঞান অর্জন করা সবার জন্যেই সহজ । কিন্তু অকাট্য দলিল প্রমাণ সহকারে মূল কুরআন ও হাদীস থেকে ইসলামী আইন-কাননু প্রণয়ন ও প্রমাণ করার মত বিস্তারিত ও সুক্ষ্ণাতিসুক্ষ্ণ জ্ঞান অর্জন করা সবার জন্য সহজবোধ্য ব্যাপার নয় । এটা শুধুমাত্র অল্প কিছুসংখ্যক লোকের ক্ষেত্রেই সম্ভব । আর ইসলাম সাধ্যাতীত কোন কাজই দায়িত্ব হিসেবে মানুষের উপর চাপিয়ে দেয়নি । এ কারণেই দলিল প্রমাণ সহকারে ইসলামী আইন শাস্ত্রের বিস্তারিত জ্ঞান অর্জনের বিষয়টিকে ইসলামে ‘ওয়াজিবে কিফায়ী’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে । অর্থাৎ এ ধরণের ব্যাপক জ্ঞান অর্জনের যোগ্যতাসম্পন্ন অল্প কিছুসংখ্যক লোকের জন্যেই এটা দায়িত্ব স্বরূপহু আর অন্যান্য লোকদের দায়িত্ব হচ্ছে এ বিষয়ে তারা প্রয়োজন বোধে ঐসব ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞদের শরণাপন্ন হবে । জ্ঞানীর কাছে জ্ঞানহীনদের শরণাপন্ন হওয়া’ মূলনীতির উপরই উপরোক্ত নীতির মূলভিত্তি প্রতিষ্ঠিত । ইসলামী আইন-শাস্ত্রে পারদর্শী বিশেষজ্ঞরা ‘মুজতাহীদ’ বা ‘ফাকীহ’ নামে পরিচিত । মুজতাহিদদের কাছে ইসলামী আইন সংক্রান্ত বিষয়ে শরণাপন্ন হওয়ার মাধ্যমে মুজতাহীদদের অনুসরণকেই ‘তাকলীদ’ (অনুসরণ) বলা হয় । অবশ্য এখানে মনে রাখা দরকার যে, ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস সংক্রান্ত বিষয়ে কারও অনুসরণ করাকে ইসলাম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছে ।

মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন : যে বিষয়ে তোমাদের কোন জ্ঞান নেই, তার অনুসরণ করো না । (-সূরা আল ইসরা, ৩৬ নং আয়াত ।)

এটা সবার জানা থাকা প্রয়োজন যে, শীয়া মাযহাবে মৃতব্যক্তির তাকলীদের মাধ্যমে তাকলীদের সূচনা করা জায়েয নয় । অর্থাৎ যে ব্যক্তি ইজতিহাদ সংক্রান্ত জ্ঞানে পারদর্শী নয়, তাকে অবশ্যই ইসলামী আইন সংক্রান্ত ব্যাপারে কোন না কোন মুজতাহিদের শরণাপন্ন হতে হবে । কিন্তু এ ব্যাপারে অবশ্যই তাকে কোন জীবিত মুজতাহিদের মতামতের শরণাপন্ন হতে হবে । সেক্ষেত্রে কোন মৃত মুজতাহিদের মতামতের অনুসরণ করা তার জন্য বৈধ হবে না । ঐ মুজতাহিদ জীবিত থাকাকালীন সময়েই যদি ঐ ব্যক্তি কোন বিষয়ে তার মতানুসরণ করে থাকে তাহলে উক্ত মুজতাহিদের মৃত্যুর পরও সে ঐ পূর্বোক্ত মতের অনুসরণ অব্যাহত রাখতে পারবে । তবে এ ব্যাপারে তাকে সমসাময়িক জীবিত অন্য কোন মুজতাহিদের অনুমতি গ্রহণের প্রয়োজন হবে । আর এ বিষয়টি শীয়া মাযহাবের ইসলামী ফেকহ্ (আইন) শাস্ত্রের চিরঞ্জীব ও চিরন্তন হিসেবে টিকে থাকার ব্যাপারে একটি অন্যতম কারণ বটে । এ কারণে শীয়া মাযহাবের অসংখ্য ব্যক্তি একের পর এক ইজতিহাদি জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের প্রচেষ্টায় প্রতিনিয়ত ব্যস্ত থাকেন । কিন্তু আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের ব্যাপারটি ভিন্ন ধরণের । হিজরী পঞ্চম শতাব্দীর দিকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আলেমদের ‘ইজমা’ (ঐক্যমত) অনুসারে চার জন মুজতাহিদের চার মাযহাবের কোন একটির অনুসরণকে ওয়াজীব হিসেবে ঘোষণা করা হয় । ঐ চার মাযহাব হচ্ছে: ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেয়ী এবং ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের মাযহাব । তাদের মতে স্বাধীন ইজতিহাদ ও উপরোক্ত চারজন ফকীহ্ বা মুজতাহিদ ছাড়া অন্য কারও তাকলীদ বা অনুসরণ করা তাদের মতে বৈধ নয় । এর ফলে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের ফেকাহ্ বা আইন শাস্ত্রের গুণগতমান এখনও প্রায় সেই বারশত বছর পূর্বের অবস্থায় অবস্থান করছে । অবশ্য বর্তমানে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অনেক আলেমই তথাকথিত ‘ইজমা’র সিদ্ধান্ত মানেন না । তারা স্বাধীনভাবে ইজতিহাদের পক্ষপাতি এবং তার প্রচেষ্টাও চালাচ্ছেন ।

কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক জ্ঞান এবং শীয়া মাযহাব

ইসলামী জ্ঞান মোটামুটি দু’শ্রেণীতে বিভক্ত : (১) বুদ্ধিবৃত্তিগত জ্ঞান এবং (২) বর্ণনা ভিত্তিক জ্ঞান ।

বর্ণনা ভিত্তিক জ্ঞান মূলতঃ কুরআন ও সুন্নাহ থেকে বর্ণিত জ্ঞানের উপরই নির্ভরশীল । যেমন : আরবী ভাষা, হাদীস, ইতিহাস ইত্যাদি । তবে বুদ্ধিগত জ্ঞান অন্য ধরণের । গণিত, দর্শন ইত্যাদি বুদ্ধিগত জ্ঞান বা বিদ্যার উদাহরণ । এতে কোন সন্দেহ নেই যে, পবিত্র কুরআনই ইসলামের ‘বর্ণনা’ ভিত্তিক বিদ্যার মূল উৎস । অবশ্য এছাড়াও ইতিহাস, বংশ পরিচিতি শাস্ত্র এবং ভাষালংকার শাস্ত্রও এই ঐশী পুস্তকের এক অমূল্য অবদান । মুসলমানরা ইসলামী জ্ঞানের গবেষণা ও অনুসন্ধিৎসা মেটানোর লক্ষ্যে এসব শাস্ত্রের চর্চা ও গ্রন্থ রচনায় প্রয়াসী হন । ঐসব বিদ্যার মধ্যে মূলত্ঃ আরবী ভাষা ও সাহিত্য এবং তার ব্যাকারণ, ভাষা অলংকার, অভিধানসহ ইত্যাদি বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল । এছাড়াও তাজবীদ (কুরআন উচ্চারণ বিধিশাস্ত্র), তাফসীর, হাদীস, রিজাল (হাদীস বর্ণনাকারীদের নির্ভরযোগ্যতা যাচাই শাস্ত্র), দিরায়াহ্ (হাদীসের সত্যতা যাচাই শাস্ত্র), উসুল (ইসলামী আইন প্রণয়নের মূলনীতি শাস্ত্র), এবং ফিকহ ও (ইসলামী আইন শাস্ত্র) এসবের অন্তর্ভুক্ত । শীয়ারাও ইসলামী জ্ঞানের উপরোক্ত শাখাগুলোর বিকাশ ও উন্নয়নে যথেষ্ট অবদান রেখেছে । এমনকি উক্ত জ্ঞানের শাখাসমূহে অনেকগুলোর প্রতিষ্ঠাতাই ছিলেন শীয়া মাযহাবের অনুসারী । যেমন: আরবী ব্যাকারণের ‘নাহু’ (শব্দের স্বরচিহ্ন নির্ণয়বিদ্যা) শাস্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জনাব আবুল আসাদ আদ দোয়ালী । ইনি ছিলেন রাসূল (সা.) এবং ইমাম আলী (আ.)-এর একজন সাহাবী । তিনি হযরত আলী (আ.)-এর নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধনে এই শাস্ত্র রচনা করেন । আরবী ভাষার অলংকার শাস্ত্রের একজন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ‘আলে বুইয়া’ বংশীয় শীয়া রাজ্যের জনৈক শীয়া মন্ত্রী । তার নাম ছিল সাহেব বিন ই’বাদ ।

জনাব খলির বিন আহমাদ বসরী নামক জনৈক বিখ্যাত শীয়া শিক্ষাবিদ সর্বপ্রথম ‘আল আইন’ নামক আরবী ভাষার অভিধান রচনা করেন । তিনিই আরবী ভাষায় ‘কাব্যের ছন্দপ্রকরণ শাস্ত্রও’ প্রথম আবিস্কার করেন । এ ছাড়াও আরবী ব্যাকারণের ‘নাহু’ (শব্দের স্বরচিহ্ন নির্ণয়, পদবিন্যাস প্রকরণ) শাস্ত্রের অসাধারণ ও বিখ্যাত পণ্ডিত জনাব ‘সিবাওয়াই’ ছিলেন শীয়া মাযহাবের অনুসারী । পবিত্র কুরআন পঠনের বিখ্যাত ও স্বতঃসিদ্ধ সাতটি পদ্ধতির মধ্যে ‘কিরাআতে আসেম’ অন্যতম যার সূত্রও হযরত আলী (আ.) । পবিত্র কুরআনের তাফসীর (ব্যাখা) শাস্ত্রের অন্যতম মুফাচ্ছির ও বিখ্যাত সাহাবী হযরত ইবনে আব্বাস ছিলেন হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর শিষ্য । হাদীস ও ফিকাহ্ শাস্ত্রে আহলে বাইতগণ (আ.) ও শীয়াদের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । শীয়াদের পঞ্চম ইমাম [বাকের (আ.)] ও ষষ্ঠ [ইমাম জাফর সাদিক (আ.)] ইমামের সাথে আহলে সুন্নার মাযহাবের ইমামগণের জ্ঞানগত বিষয়ের সম্পর্ক সর্বজনবিদিত ব্যাপার । এমনকি ‘উসুলে ফিকহ’ (ইসলামী আইন প্রণয়নের মূলনীতি বিষয়ক শাস্ত্র) শাস্ত্রে শীয়াদের আশ্চর্য জনক উন্নতিও বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় । জনাব ওয়াহীদ বেহবাহানীর (মৃত্যু -১২০৫ হিঃ) যুগে এই শাস্ত্রে সাধিত উন্নতি, বিশেষ করে জনাব শেইখ মুরতাদা আনসারীর (মৃত্যু -১২৮১ হিঃ) অবদান ইসলামী বিশ্বের এক নজির বিহীন ঘটনা, গুণগত মানের দিক থেকে যার সাথে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের ‘উসুলে ফিকাহ’ শাস্ত্রের আদৌ কোন তুলনা করা চলে না ।

বুদ্ধিগত, দার্শনিক ও কালামশাস্ত্রীয় চিন্তা

ইতিপূর্বেই আমরা আলোচনা করেছি যে পবিত্র কুরআন বুদ্ধিবৃত্তিগত চিন্তাধারাকে সমর্থন করে এবং একে ধর্মীয় চিন্তাধারার অংশ বলে গণ্যও করে । অবশ্য এর বিপরীতেও বুদ্ধিবৃত্তিগত চিন্তাধারাই মহানবী (সা.)-এর নবুয়ত ও তার সততাকে প্রমাণ করেছে । এছাড়া ঐশীবাণী কুরআনের বাহ্যিকরূপ, মহানবী (সা.) ও তার পবিত্র আহলে বাইতের পবিত্র বাণীকে বুদ্ধিবৃত্তিক অকাট্য দলিলের সারিতে স্থান দেয়া হয়েছে । মানুষ খোদাপ্রদত্ত স্বভাব (ফিতরাত) অনুযায়ী যেসব বুদ্ধিবৃত্তিগত অকাট্য দলিলের সাহায্যে নিজস্ব মতামত প্রমাণ করার প্রয়াস পায় তা প্রধানত দু’ধরণের : (১) বরহান (২) জাদাল বা তর্ক ।

বুরহানঃ এমন এক ধরণের দলিল, যার ভিত্তি বাস্তব সত্যের উপর রচিত । যদিও চাক্ষুষ অথবা দ্বিধাহীন না হয় । আরও সহজ ভাষায়, এমন কোন খবর যা মানবসত্তা তার খোদাপ্রদত্ত অনুভুতির মাধ্যমে প্রমাণিত সত্য হিসেবে উপলদ্ধি করে । যেমনি ভাবে আমরা জানি তিন সংখ্যাটি পরিমাণ গত দিক থেকে চার হতে ক্ষুদ্র । এ জাতীয় চিন্তা প্রক্রিয়াও বুদ্ধিগত চিন্তার অন্তর্ভুক্ত । আর যদি ঐ বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার মাধ্যমে ‘সমগ্র বিশ্বের অস্তিত্ব ও পরিচালনার’ সত্যতা বা বাস্তবতা উদঘাটনের চেষ্টা করা হয়, তাহলে সেটি হবে দার্শনিক চিন্তা । উদাহরণ স্বরূপ সৃষ্টির আদি, অন্ত ও বিশ্ববাসীর অস্তিত্ব সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা ।

জাদালঃ তর্ক এমন একটি প্রমাণ পদ্ধতি যার প্রাথমিক ভিত্তির আংশিক বা সমস্তটাই শতঃসিদ্ধ বাস্তবতা থেকে সংগৃহীত হয় । যেভাবে প্রতিটি ধর্ম মাযহাবের মধ্যে প্রচলিত আছে । তারা তাদের অভ্যন্তরীণ মাযহাবী সূত্র প্রমাণে ঐ মাযহাবের শতঃসিদ্ধ মূলসূত্রের সাথে পরস্পর তুলনা করে থাকে । পবিত্র কুরআনও উপরোক্ত পদ্ধতিদ্বয়কে কাজে লাগিয়েছে । তাই পবিত্র কুরআনে ঐ পদ্ধতিদ্বয়ের ভিত্তিতে অসংখ্য আয়াত বিদ্যমান ।

প্রথমতঃ পবিত্র কুরআন সমগ্র বিশ্বব্রম্ভান্ড ও বিশ্বের নিয়ম শৃংঙ্খলা সম্পর্কে স্বাধীন ভাবে চিন্তা করার নির্দেশ দিয়েছে । শুধু তাই নয়, আমাদের দৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত ঐশী নিদর্শন সমূহ আসমান, জমিন, দিন, রাত, বৃক্ষ, প্রাণী, মানুষ এবং অন্যান্য বিষয় নিয়েও গভীর চিন্তার নির্দেশ দেয় । এ জাতীয় চিন্তার প্রতি গুরুত্বারোপ করতে গিয়ে মহান প্রভু স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তি পরিচালনাকে সমুন্নত ভাষায় প্রসংশা করেছেন ।

দ্বিতীয়তঃ সাধারণত বুদ্ধিবৃত্তিক তর্ক পদ্ধতিকে কালাম শাস্ত্রের একটি মাধ্যম হিসেবে গন্য করা হয় । তবে এই শর্তে যে সর্বোৎকৃষ্ট পন্থায় উপস্থাপন করা উচিত ।

এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেনঃ ‘‘আপন পালনকর্তার পথের প্রতি আহবান করুন জ্ঞানের কথা বুঝিয়ে ও উপদেশ শুনিয়ে উত্তমরূপে এবং তাদের সাথে বিতর্ক করুন পছন্দনীয় পন্থায় ।’’ (-সূরা আন্ নাহল ১২৫ নং আয়াত ।)

ইসলামে দর্শন ও কালামশাস্ত্রীয় চিন্তার বিকাশে শীয়াদের অবদান

এটা অত্যন্ত স্পষ্ট ব্যাপার যে জন্মলগ্ন থেকেই শীয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে পরিণত হয় । ফলে সেদিন থেকেই বিরোধীদের মোকাবিলায় তাদেরকে টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয় । এ জন্যে তারা তর্কযুদ্ধে নামতে বাধ্য হন । স্বাভাবিক ভাবেই তর্কযুদ্ধের দু’পক্ষই সমান ভাবে অংশ গ্রহণ করে । কিন্তু এ ক্ষেত্রে শীয়ারা সর্বদাই আক্রমণকারী এবং বিপক্ষীয়রা আত্মরক্ষাকারীর ভূমিকা পালন করেছে । তাই এ তর্কযুদ্ধের সাজ-সরঞ্জাম আয়োজনের দায়িত্ব সাধারণত আক্রমণকারীকেই পালন করতে হয় । এভাবে ‘কালাম’ (যুক্তি ভিত্তিক মৌলিক বিশ্বাস সংক্রান্ত শাস্ত্র) শাস্ত্রের ক্রমোন্নতি ঘটে । হিজরী ২য় শতক ও ৩য় শতকের প্রথম দিকে ‘মু’তাযিলা’ সম্প্রদায়ের প্রসারের পাশাপাশি উক্ত কালামশাস্ত্র উন্নতির শীর্ষে আরোহণ করে । আর এক্ষেত্রে আহলে বাইতের আদর্শের অনুসারী শীয়া আলেম ও গবেষকগণের স্থান ছিল মুতাকাল্লিমদের (‘কালাম’ শাস্ত্রের পণ্ডিত) শীর্ষে । এছাড়াও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের ‘‘আশআরিয়া’’ ও ‘’মু’তাযিলা’’ সম্প্রদায়সহ কালাম শাস্ত্রের অন্য সকল পৃষ্ঠপোষকরাও সূত্র পরস্পরায় শীয়াদের প্রথম ইমাম হযরত ইমাম আলী (আ.)-এ গিয়ে মিলিত হয় । মহানবীর (সা.) সাহাবীদের জ্ঞান বিষয়ক রচনাবলী ও অবদান সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে (প্রায় বার হাজরের মত সাহাবীর মাধ্যমে হাদীস বর্ণিত হয়েছে) তারা সবাই জানেন যে, এসবের একটিও আদৌ কোন দার্শনিক চিন্তাধারা প্রসূত নয় । এর মধ্যে কেবল মাত্র আমিরুল মু’মিনীন হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক বর্ণনাযুক্ত সর্বস্রষ্টা আল্লাহ সংক্রান্ত বিষয়াবলীই সুগভীর দার্শনিক চিন্তাধারা প্রসূত । সাহাবীগণ তাদের অনুসারী তাবেঈন আলেমগণ ও পরবর্তী উত্তরাধিকারীগণ এবং তদানিন্তন আরবরা মুক্ত দার্শনিক চিন্তাধারার সাথে আদৌ পরিচিত ছিলেন না । এমনকি হিজরী প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীর ইসলামী পণ্ডিতগণের বক্তব্যেও দার্শনিক অনুসন্ধিৎসার আদৌ কোন নমুনা খুজে পাওয়া যায় না । একমাত্র শীয়া ইমামদের বক্তব্য, বিশেষ করে প্রথম ও অষ্টম ইমামের বাণী সমূহেই সুগভীর দার্শনিক চিন্তাধারার নিদর্শন খু্জে পাওয়া যায় । তাদের সেই মূল্যবান বাণী সমূহই দর্শনের অনন্ত ভান্ডার স্বরূপ । তারা একদল শিষ্যকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দার্শনিক চিন্তাধারার প্রকৃতির সাথে তাদেরকে পরিচিত করে তুলেছেন । হ্যাঁ, আরবরা হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্ত দর্শনের সাথে আদৌ পরিচিত ছিল না । অতঃপর হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রথম ভাগে গ্রীক দর্শনের কিছু বই তাদের হাতে আসে । এরপর হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর প্রথম ভাগে গ্রীক ও সুরিয়ানী ভাষায় রচিত বেশ কিছু দার্শনিক গ্রন্থ আরবী ভাষায় অনুদিত হয়, এর ফলে আরবরা গণভাবে দার্শনিক চিন্তাধারার সংস্পর্শে আসে । কিন্তু তদানিন্তন অধিকাংশ ফকিহ্ (ইসলামী আইন শাস্ত্রবিদ) এবং মুতাকাল্লিমগণই (কালাম শাস্ত্রীয় পণ্ডিত) নবাগত ঐ অতিথিকে (দর্শন ও অন্যান্য বুদ্ধিবৃত্তিজাত জ্ঞান বিজ্ঞান) হাসি মুখে বরণ করেননি ।

দর্শন ও বুদ্ধিবৃত্তিগত শাস্ত্রের বিরোধীতায় তারা তৎকালীন প্রশ্বাসনের পূর্ণ সমর্থন পেয়ে ছিলেন । কিন্তু এতদসত্ত্বেও ঐ বিরোধীতা বাস্তবে তেমন একটা কার্যকর হয়নি । কিছুদিন পরই ইতিহাসের পাতা সম্পূর্ণ পাল্টে গেল । দর্শনশাস্ত্র নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পাশাপাশি দর্শন সংক্রান্ত সকল বই পুস্তক সাগরে নিক্ষিপ্ত হল । ‘ইখওয়ানুস সাফা’ (বন্ধু বৎসল ভ্রাতৃ সংঘ) নামক একদল অজ্ঞাত পরিচয় লেখকের রচনাবলী (রিসাইলু ইখওয়ানুস সাফা) ঐসব ঘটনাবলীর সাক্ষী ও স্মৃতি বাহক । ঐসব ঘটনাবলী আমাদেরকে সে যুগের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির কথাই “স্মরণ করিয়ে দেয় । এর বহুদিন পর হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর প্রথমভাগে আবু নাসের ফারাবীর মাধ্যমে দর্শনশাস্ত্র পুনরায় জীবন লাভ করে । এরপর হিজরী পঞ্চম শতাব্দীর প্রথমভাগে বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক আবু আলী সীনার আপ্রাণ সাধনায় দর্শনশাস্ত্র সামগ্রিকভাবে প্রসার লাভ করে । হিজরী ৬ষ্ঠ শতকে জনাব শেইখ সোহরাওয়ার্দী, আবু আলী সীনার অনুসৃত ঐ দার্শনিক মতবাদের সংস্কার ও বিকাশ সাধান করেন । আর এই অপরাধেই তিনি সুলতান সালাহ্ উদ্দীন আইয়ুবী কর্তৃক নিহত হন । এর ফলে ধীরে ধীরে জনসাধারণের মাঝে ‘দর্শনের’ যবনিকা পতন ঘটে । এরপর আর উল্লেখযোগ্য কোন দার্শনিকের সৃষ্টি হয়নি । হিজরী সপ্তম শতাব্দীতে ইসলামী খেলাফত সীমান্ত ‘আন্দালুসে’ (বর্তমান স্পেন) ইবনে রূশদ নামক এক ইসলামী দার্শনিকের জন্ম হয় । তিনিও ইসলামী দর্শনের সংস্কার ও বিকাশে আপ্রাণ সাধানা করেন ।

দর্শন ও বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানের বিকাশে শীয়াদের অন্তহীন প্রচেষ্টা

দার্শনিক চিন্তাধারার সৃষ্টি ও বিকাশে শীয়া সম্প্রদায়ের অবদান তার উন্নতির ক্ষেত্রে এক বিরাট কারণ হিসেবে কাজ করেছিল । এ ছাড়াও এজাতীয় চিন্তাভাবনা ও বুদ্ধিবৃত্তিজাত বিজ্ঞানের প্রসারের ক্ষেত্রেও শীয়া সম্প্রদায় ছিল মূলভিত্তি স্বরূপ । তারা এক্ষেত্রে অবিরামভাবে তাদের নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে । তাই আমরা দেখতে পাই যে, ইবনে রূশদের মৃত্যুর পর যখন আহলে সুন্নাতের মধ্যে দার্শনিক চিন্তাধারার গণবিস্মৃতি ঘটে, তখনও শীয়া সম্প্রদায়ের মাঝে দার্শনিক চিন্তাধারার প্রবল গণজোয়ার পূর্ণোদ্দমে অব্যাহত ছিল । তারপর শীয়াদের মধ্যে খাজা তুসী, মীর দামাদ ও সাদরূল মুতাআল্লিহীন নামক বিশ্ব বিখ্যাত ইসলামী দার্শনিকদের অভ্যুদয় ঘটে । তারা একের পর এক দর্শন শাস্ত্রে বুৎপত্তি অর্জন, বিকাশ সাধান ও তার রচনায় আত্মনিয়োগ করেন । একইভাবে দর্শন ছাড়াও বুদ্ধিবৃত্তি অন্যান্য বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে খাজা তুসী, বীরজান্দিসহ আরও অনেক ব্যক্তিত্বের অভ্যুদয় ঘটে । এসকল বুদ্ধিবৃত্তিক বিজ্ঞান, বিশেষ করে অধিবিদ্যা [Metaphsics] শীয়াদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে সুগভীর উন্নতি সাধিত হয় । খাজা তুসী, শামসুদ্দীন তুর্কী, মীর দামাদ সাদরুল মুতাআল্লিহীনের রচনাবলীই এর সুস্পষ্ট উদাহরণ ।

শীয়াদের মধ্যে দর্শনশাস্ত্র টিকে থাকার কারণ

আমরা পূর্বেই বলেছি যে, দার্শনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান চর্চার উদ্ভব ও বিকাশের মূলভিত্তির রচয়িতা ছিল শীয়া সম্প্রদায় । এর কারণ ছিল শীয়াদের মাঝে ইসলামী জ্ঞানের অমূল্য ভান্ডারের উপস্থিতি ।

আর ছিল শীয়াদের ইমামদের রেখে যাওয়া স্মৃতি স্বরূপ অমূল্য জ্ঞানভান্ডার । শীয়ারা আজীবন ঐ অমূল্য জ্ঞানভান্ডারকে অত্যন্ত পবিত্রতা ও সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে । এ বক্তব্য প্রমাণের লক্ষ্যে পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) জ্ঞানভান্ডারকে এযাবৎ রচিত ঐতিহাসিক দার্শনিক গ্রন্থাবলীর সাথে মিলিয়ে দেখা উচিত । তাহলে আমরা দেখতে পাব যে ইতিহাসে দর্শনশাস্ত্রের বিকাশধারা ক্রমেই আহলে বাইতগণের (আ.) জ্ঞানভান্ডারের নিকটবর্তী হয়েছে । এভাবে হিজরী একাদশ শতাব্দীতে এসে বর্ণনাগত সামান্য কিছু মতভেদ ছাড়া এ দু’টো ধারাই প্রায় সম্পূর্ণ রূপে মিলিত হয়ে গেছে ।

কয়েকজন ক্ষণজন্মা শীয়া ব্যক্তিত্ব

ক) সিকাতুল ইসলাম মুহাম্মদ বিন ইয়াকুব কুলাইনী (মৃত্যু : ৩২৯ হিঃ) :

শেইখ কুলাইনী ছিলেন শীয়াদের সর্বপ্রথম ব্যক্তি, যিনি শীয়াদের সংগৃহীত হাদীসগুলোকে ‘উসুল’ (মুহাদ্দিসগণ আহলে বাইতগণের (আ.) হাদীস সমূহকে ‘আসল’ নামক গ্রন্থে সংগৃহীত করেন । ‘আসল’ এর বহুবচন ‘উসুল’) থেকে সংগ্রহ করে সেগুলোকে বিষয়বস্তু অনুসারে বিভিন্ন অধ্যায়ে বিভক্ত করেন । ফিকহ্ (ইসলামী আইন) ও মৌলিক বিশ্বাস সংক্রান্ত বিষয়ের ভিত্তিতে হাদীসগুলোকে সুসজ্জিত করেন । তার সংকলিত হাদীস গ্রন্থের নাম ‘কাফী’ । এ গ্রন্থটি মূলত: তিনভাগে বিভক্ত : উসুল (মৌলিক বিশ্বাস অধ্যায়), ফুরূঊ (ইসলামের আইন সংক্রান্ত অধ্যায়) এবং বিবিধ অধ্যায় । উক্ত গ্রন্থে সংকলিত মোট হাদীস সংখ্যা ষোল হাজার, একশত নিরানব্বইটি ।

উক্ত হাদীস গ্রন্থই শীয়াদের সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য ও বিখ্যাত গ্রন্থ হিসেবে পরিচিত । এ ছাড়া আরও তিনটি বিখ্যাত হাদীস গ্রন্থ রয়েছে যা, ‘কাফী’র পরবর্তী পর্যায়ের । ‘কাফীর পরবর্তী পর্যায়ে তিনটি বিখ্যাত হাদীস গ্রন্থগুলো হচ্ছে :

১. ‘মান লা ইয়াহযুরুল ফাকীহ’

২. ‘আত তাহযীব’

৩. ‘আল ইসতিবসার’

‘মান লা ইয়াহযুরুল ফাকীহ’ নামক হাদীস গ্রন্থের সংকলক হচ্ছেন, জনাব শেইখ সাদুক মুহাম্মদ বিন বাবাওয়াই কুমী । তিনি হিজরী ৩৮১ সনে মৃত্যুবরণ করেন । ‘আত্ তাহযীব’ ও ‘আল ইসতিবসার’ নামক হাদীস গ্রন্থদ্বয়ের সংকলক ছিলেন জনাব শেইখ তুসী । তিনি হিজরী ৪৬০ সনে মৃত্যু বরণ করেন ।

খ) জনাব আবুল কাসিম জাফার বিন হাসান বিন ইয়াহইয়া হিল্লী ওরফে মুহাক্কিক : তিনি হিজরী ৬৭৬ সনে মৃত্যুবরণ করেন । তিনি ফিকহ্ (ইসলামী আইন শাস্ত্র) শাস্ত্রে এক অসাধারণ জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন । তিনি ছিলেন শীয়া ফকিহদের কর্ণধার স্বরূপ । তাঁর রচিত ফিকহ্ শাস্ত্রীয় ‘মুখতাসারূন নাঈম’ ও আশ্ শারায়িঈ’ অন্যতম । দীর্ঘ সাত শতাব্দী পার হওয়ার পরও এ দু’টো গ্রন্থ আজও ফকিহদের (ইসলামী আইনবিদ) বিস্ময় ও সম্মানের পাত্র হিসেবে টিকে আছে । জনাব মুহাক্কিকের পরই ফিকহ্ শাস্ত্রের জনাব ‘শহীদে আউয়াল’ (ফকীহদের মধ্যে প্রথম শহীদ) শামসুদ্দিন মুহাম্মদ বিন মাক্কির নাম উল্লেগযোগ্য । হিজরী ৭৮৬ সনে শুধুমাত্র শীয়া মাযহাবের অনুসারী হওয়ার অপরাধে সিরিয়ার দামেস্কে তাকে হত্যা করা হয় । ‘ফিকহ’ শাস্ত্রে তার বিখ্যাত গ্রন্থসমূহের মধ্যে ‘আল্ লুমআতুদ্ দামেস্কীয়া’র নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । তিনি জেলে থাকাকালীন সময়ে মাত্র সাতদিনের মধ্যে এ গ্রন্থটি রচনা করেন । জনাব শেইখ জাফর কাশিফুল গিতা, তিনি হিজরী ১২২৭ সনে মৃত্যুবরণ করেন । তিনি ফেকহ্ শাস্ত্রে শীয়াদের আরেকজন অন্যতম ব্যক্তিত্ব ছিলেন । তার বিখ্যাত ‘ফিকহ’ গ্রন্থের নাম ‘কাশফুল গিতা’ ।

গ) জনাব শেইখ মুর্তজা আনসারী শুশতারী (মৃত্যু -১২৮১ হিঃ) : তিনি ‘ইলমূল উসুলের’ (ইসলামী আইন প্রণয়নের মূলনীতি শাস্ত্র) সংস্কার সাধান করেন । ‘ইলমূল উসুলের’ গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ‘ব্যবহারিক বিষয়ক মূলনীতি’ (উসুলুল আ’মালিয়াহ) অংশের ব্যাপক উন্নয়ন সাধান ও পুস্তক আকারে তা রচনা করেন । তার রচিত ইতিহাস বিখ্যাত ঐ জ্ঞানগর্ভ গ্রন্থটি এক শতাব্দী পর আজও শীয়া ফকীহদের একটি অন্যতম পাঠ্য পুস্তক হিসেবে প্রচলিত ।

ঘ) জনাব খাজা নাসির উদ্দিন তুসী (মৃত্যু -৬৫৬ হিঃ) : তিনিই সর্বপ্রথম ‘কালাম’ শাস্ত্রকে (মৌলিক বিশ্বাস বিষয়ক শাস্ত্র) একটি পূর্ণাংগ শৈল্পিক রূপ দান করেন । তাজরীদুল কালাম নামক গ্রন্থটি তার রচিত বিখ্যাত গ্রন্থাবলীর অন্যতম । আজ প্রায় সাত শতাব্দী অতিবাহিত হওয়ার পরও ঐ গ্রন্থটি ‘কালাম’ শাস্ত্রের জগতে এক বিস্ময়কর গ্রন্থ হিসেবে নিজস্বমান বজায় রেখে চলেছে । এমন কি তার রচিত ঐ বিখ্যাত গ্রন্থটির ব্যাখা স্বরূপ বহু শীয়া ও সুন্নী পণ্ডিত অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন । কালাম’ শাস্ত্র ছাড়া দর্শন ও গণিতশাস্ত্রে জনাব খাজা তুসী তার সমসাময়িক যুগের এক অসাধারণ জ্ঞানী ব্যক্তি হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন । বুদ্ধিবৃত্তিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তার রচিত অসংখ্য মূল্যবান গ্রন্থই একথার সবচেয়ে বড় সাক্ষ্য স্বরূপ । ইরানের ‘মারাগে’ অঞ্চলের বিখ্যাত ‘মাণমন্দিরটি’ তারইঁ প্রতিষ্ঠিত ।

ঙ) জনাব সাদরুদ্দিন মুহাম্মদ সিরাজী (জন্ম -হিঃ ৯৭৯ ও মৃত্যু : হিঃ ১০৫০ সন) : তিনিই সর্বপ্রথম ইসলামী দর্শনকে বিক্ষিপ্ত ও বিশৃংখল অবস্থা থেকে মুক্তি দেন । তিনি ইসলামী দর্শনের বিষয়গুলোকে গণিতের মত একটি সুশৃংখল শাস্ত্রে রূপায়িত করেন । তার ঐ ঐতিহাসিক অবদানের ফলে ইসলামী দর্শনের ক্ষেত্রে এক নবযুগ সাধিত হয় ।

প্রথমতঃ যেসব বিষয় ইতিপূর্বে দর্শনের আলোচ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব ছিলনা, তা তারই অবদানে দর্শন শাস্ত্রের আলোচ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত ও তার সমস্যাগুলোর সমাধান করা সম্ভব হয়েছে ।

দ্বিতীয়তঃ ইসলামের আধ্যাত্মিকতা (ইরফান) সম্পর্কিত কিছু বিষয় যা ইতিপূর্বে সাধারণ জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার দ্বারা উপলদ্ধির নাগালের বাইরে বলেই গণ্য হত, তাও খুব সহজেই সমাধান করা সম্ভব হয়েছে ।

তৃতীয়তঃ কুরআন ও আহলে বাইতগণের (আ.) অনেক জটিল ও দূর্বোধ্য সুগভীর দার্শনিক বাণীসমূহ যা শতশত বছর যাবৎ সমাধানের অযোগ্য ধাঁধা ও ‘মুতাশাবিহাত’ (সংশয়যুক্ত দূর্বোধ্য বিষয়) বিষয় হিসেবে গণ্য হত, তারও সহজ সমাধান পাওয়া গেল । যার ফলে ইসলামের বাহ্যিক দিক, আধাত্মিকতা (ইরফান) ও দর্শন পরস্পর ঐক্যবদ্ধ হল এবং একই গতিপথে প্রবাহিত হতে শুরু করল । ‘সাদরুল মুতা’আল্লিহীনের পূর্বেও হিজরী ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে ‘হিকমাতুল ইশরাক’ গ্রন্থের লেখক জনাব শেইখ সোহরাওয়ার্দী এবং হিজরী অষ্টম শতাব্দীর দার্শনিক জনাব শামসুদ্দিন মুহাম্মদ তুর্কের মত প্রমুখ পণ্ডিতবর্গ এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন । কিন্তু কেউই এপথে পূর্ণাংগ সাফল্য অর্জন করতে পারেননি । একমাত্র জনাব ‘সাদরুল মুতাআল্লিহীনই’ এ ব্যাপারে পূর্ণ সাফল্য অর্জনের সৌভাগ্য লাভ করেন । জনাব সাদরুল মুতাআল্লিহীন, সত্তার গতি (হারাকাতে জওহারী) নামক মতবাদের সত্যতা প্রমাণ করতে সক্ষম হন । ‘চতুর্থদিক’ (বো’দু রাবি’ই) ও ‘আপেক্ষিকতা’ সংক্রান্ত মতবাদও তিনিই আবিস্কার করেন । এ ছাড়াও তিনি প্রায় পঞ্চাশটির মত গ্রন্থ ও পুস্তিকা রচনা করেন । তার অমূল্য অবদানের মধ্যে চার খণ্ডে সমাপ্ত ‘আসফার’ নামক বিখ্যাত দর্শনশাস্ত্রের গ্রন্থটি অন্যতম ।

তথ্যসূত্র :

১. বিহারুল আনওয়ার ১খণ্ড ১৭২পঃ।

২. এ বিষয়ে মূলনীতি বিষয়ক শাস্ত্র (এলমে উসুলের) এর ইজতিহাদ ও তাকলীদ অধ্যায় দেখুন।

৩. ‘ওয়াফিয়াত ইবনে খালকান’ ৭৮ নং পৃষ্ঠা, এবং ‘আইয়ানুশ শীয়া’ ১১তম খণ্ড ২৩১ নং পৃষ্ঠা।

৪. ‘ওয়াফিয়াত ইবনে খালকান’ ১৯০ নং পৃষ্ঠা, এবং ‘আইয়ানুশ শীয়া।’

৫. ‘ইতকান’ (সুয়ুতী)।

৬. ‘শারহু ইবনি আবিল হাদীদ’ ১ম খণ্ড, ১ম অধ্যায়।

৭. ‘আখবারুল হুকমা’ ও ‘ওফিয়াত’ গ্রন্থ দ্রষ্টব্য ।

 

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

কুরআন ও ইমামত সম্পর্কে ইমাম জাফর ...
ফাদাক সম্পর্কে “প্রথম খলিফার ...
পবিত্র কুরআন ও সুন্নাতের আলোকে ...
কোমে হযরত ফাতেমা মাসুমার (আ.) জন্ম ...
শ্রেষ্ঠ নারী হযরত ফাতিমাতুয ...
ইমাম হাসান (আ.) এর শাহাদাত
নবী রাসূল প্রেরণের প্রয়োজনীয়তা
Apabila ada sebagian hukum Islam yang nampaknya bertentangan serta kontradiktif dengan ...
আবতার কে বা কা’রা?
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কতিপয় খুতবা ও ...

 
user comment