ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লবে যে প্রচার পদ্ধতি অনুসরণ করেন তার গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য প্রথমে ভূমিকা স্বরূপ কিছু কথা বলা প্রয়োজন।
ইসলামের ইতিহাসে হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর ওফাত ও হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর শাহাদাতের মধ্যে কালগত ব্যবধান পাঁচ দশকের। এ সময়ের মধ্যে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বরং অসাধারণ ঘটনা সংঘটিত হয়। বর্তমান যুগের সমাজতত্ত্বের মূলনীতি সম্পর্কে সচেতন গবেষকগণ এসব ঘটনার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় (point) লক্ষ্য করেছেন। বিশেষ করে আব্দুল্লাহ ‘আলায়েলী আহলে সুন্নাতের অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও এ বিষয়টির প্রতি অন্য সকলের চেয়ে বেশী গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
আব্দুল্লাহ ‘আলায়েলী বলেনঃ সকল আরব গোত্রের (কুরাইশ ও অ-কুরাইশ নির্বিশেষে) বিপরীতে বনি উমাইয়্যা কেবল এক বংশ ভিত্তিক জনগোষ্ঠিমাত্র ছিলো না। বরং তারা ছিলো এমন এক বংশ ভিত্তিক জনগোষ্ঠি যাদের কর্মপদ্ধতি ও কর্মতৎপরতা ছিলো এক রাজনৈতিক দলের কর্মপদ্ধতি ও কর্ম তৎপরতার অনুরূপ । অর্থাৎ তারা এক বিশেষ ধরনের সামাজিক চিন্তাধারা পোষণ করতো যা প্রায় আমাদের যুগের ইয়াহুদীদের অনুরূপ-যারা তাদের গোটা ইতিহাস জুড়ে এমন একটি বংশ ভিত্তিক জনগোষ্ঠি যারা একটি বিশেষ চিন্তা ও বিশেষ মতাদর্শের অধিকারী এবং সে মতাদর্শ ভিত্তিক লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার উদ্দেশ্যে যে জনগোষ্ঠির সকল সদস্যের মধ্যে সমন্বয় রয়েছে শুধু তা-ই নয়,বরং এ জন্য একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাও রয়েছে। প্রাচীন ঐতিহাসিকগণ বনি উমাইয়্যাকে একটি ধুর্ত ও শয়তানী বৈীমষ্ট্যের অধিকারী বংশ ভিত্তিক জনগোষ্ঠি হিসাবে উল্লেখ করেছেন। আর বর্তমানে তাদের সম্পর্কে এভাবে উল্লেখ করা হয় যে,বনি উমাইয়্যা হচ্ছে সেই জনগোষ্ঠি,ইসলামের অভ্যুদ্যয়ের কারণে অন্য যে কোনো জনগোষ্ঠির তুলনায় যারা অনেক বেশী বিপদ অনুভব করে এবং ইসলামকে নিজেদের জন্য বিরাট মুছিবত বলে গণ্য করে। এ কারণে তারা সর্বশক্তিতে ইসলামের বিরুদ্ধে লড়াই করে। অতঃপর হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) কর্তৃক মক্কা বিজয়ের সময় তারা নিশ্চিত হয়ে যায় যে,ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও সংগ্রামে আর কোনোই লাভ হবে না। এ কারণে তারা বাহ্যতঃ ইসলাম গ্রহণ করে। ‘আম্মার ইয়াসিরের ভাষায়ঃ .
.. مَا اَسْلَمُوا وَ لَکِنْ
‘‘তারা ইসলাম গ্রহণ করে নি,তবে........।
আর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)ও তাদের সাথে ‘‘মুআল্লাফাতু কুলুবিহিম ’’ (অর্থাৎ যাদের মন জয় করার উদ্দেশ্যে যাকাত থেকে প্রদান করার নিয়ম রয়েছে) নীতি অনুযায়ী আচরণ করতেন। অর্থাৎ তারা এমন লোক যারা বাহ্যতঃ ইসলাম গ্রহণ করেছিলো কিন্তু ইসলাম তাদের অন্তরের গভীরে প্রবেশ করে নি।
হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) (বনি উমাইয়্যার ইসলাম গ্রহণের পর) যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন বনি উমাইয়্যার ওপর কোনো মৌলিক কাজের দায়িত্বই অর্পণ করেন নি। কিন্তু তার ওফাতের পর ক্রমান্বয়ে বনি উমাইয়্যা ইসলামী প্রশাসনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে ও এতে প্রবেশলাভ করে। আর হযরত ওমর বিন খাত্তাবের শাসনামলে যে সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক ও রাজনৈতি ভুল করা হয় তা হচ্ছে ,আবু সুফিয়ানের পুত্রদের অন্যতম ইয়াযীদ বিন আবু সুফিয়ানকে শামের প্রশাসক (গভর্ণর) নিয়োগ করা হয় এবং তার পরে মু‘আবিয়া শামের প্রশাসক হন ও হযরত ওসমানের শাসনামলের শেষ পর্যন্ত বিশবছর যাবত সেখানে রাজত্ব করেন। ফলে সেখানে বনি উমাইয়্যার পা রাখার জন্য একটি জায়গা তৈরী হয়ে যায় এবং তা ছিলো কতই না বড় একটি ‘পা রাখার জায়গা’!
এরপর হযরত ওসমান খলীফা হলেন। মনে হচ্ছে ,মন-মানসিকতার দিক থেকে বনি উমাইয়্যার অন্যান্য লোকের সাথে তার পার্থক্য ছিলো। তিনি ছিলেন একজন ব্যতিক্রম;আবু সুফিয়ানের মতো ছিলেন না। কিন্তু তা সত্ত্বেও উমাইয়্যা বংশের লোক বৈ ছিলেন না। হ্যাঁ,তার যুগে ইসলামী প্রশাসনে বনি উমাইয়্যার ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী পদ,যেমনঃ মিসর,কুফা ও বসরার মতো বিরাট ও গুরুত্বপূর্ণ জায়গার প্রাদেশিক হুকুমত বনি উমাইয়্যার কুক্ষিগত হলো। এমনকি স্বয়ং খলীফা ওসমানের মন্ত্রীর পদও মারওয়ান ইবনে হাকামের হাতে পড়লো। বনি উমাইয়্যার লক্ষ্য হাসিলের পথে এটা ছিলো এক বিরাট পদক্ষেপ। এ অবস্থার সুযোগ নিয়ে বিশেষ করে শামের আমীর মু‘আবিয়া দিনের পর দিন স্বীয় অবস্থা সুদৃঢ় ও সুসংহত করতে লাগলেন।
হযরত ওসমানের শাসনামল পর্যন্ত বনি উমাইয়্যা শুধু দু’টি শক্তির অধিকারী ছিলো। এক ছিলো রাজনৈতিক পদ ও রাজনৈতিক শক্তি ,অপর ছিলো বায়তুল মাল তথা আর্থিক শক্তি। হযরত ওসমানের নিহত হওয়ার পর মু‘আবিয়া আরো এক শক্তি হস্তগত করলেন। তা হচ্ছে ,তিনি নিহত খলীফার মযলুম অবস্থার বিষয়টিকে কাজে লাগাতে লাগলেন। খলীফা ওসমানের মযলুম অবস্থায় নিহত হবার কাহিনী প্রচার করে তিনি বহু জনগোষ্ঠির (অন্ততঃ শামে) ধর্মীয় অনুভূতিকে নিজের পক্ষে টেনে নিতে সক্ষম হন। তিনি বলতেনঃ খলীফাতুল মুসিলমীন,খলীফাতুল ইসলাম মযলুম অবস্থায় নিহত হয়েছেন। আর
مَنْ قُتِلَ مَظْلُوماً فَقَدْ جَعَلْنَا لِوَلِيِّهِ سُلْطَاناً
‘‘(আল্লাহ বলেনঃ) যে ব্যক্তি মযলুম অবস্থায় নিহত হয় আমরা তার উত্তরাধিকারীকে (প্রতিশোধ গ্রহণের) অধিকার দান করেছি।’’ অতএব,খলীফার রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণ করা ফরয;এর প্রতিশোধ গ্রহণ করতেই হবে।’’
মু‘আবিয়া স্বীয় উদ্দেশ্য হাসিলের অনুকূলে এভাবে লক্ষ লক্ষ লোকের-হয়তো বা নিযুত নিযুত সংখ্যক লোকের-সহানুভূতি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। আল্লাহই ভালো জানেন মু‘আবিয়ার এ প্রচারের ফলে লোকেরা হযরত ওসমানের কবরের ওপর কী পরিমাণ অশ্রুপাত করেছিলো। আর এসব ঘটানো হয় আমীরুল মু‘মিনীন হযরত আলী (আঃ)-এর খেলাফত কালে।
হযরত আলী (আঃ)-এর শাহাদাতের পর মু‘আবিয়া মুসলমানদের ওপর সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী খলীফা হলেন। ফলে সকল ক্ষমতাই তার হস্তগত হলো। এখানে তার পক্ষে চতুর্থ আরেকটি শক্তিকেও নিজের অনুকূলে কাজে লাগানো সম্ভব হয়। তা হচ্ছে ,তিনি দীনী ব্যক্তিবর্গকে (এ যুগের পরিভাষায়,সমকালীন ওলামায়ে কেরামকে) ভাড়া করেন। তখন থেকে হঠাৎ করেই হযরত ওসমানের প্রশংসায়,এমন কি হযরত আবু বকর ও হযরত ওমরের প্রশংসায়ও,মিথ্যা হাদীছ রচনা শুরু হলো। কারণ,মু‘আবিয়া তাদের মর্যাদাকে অনেক বেশী উচ্চে তুলে ধরাকে তার নিজের জন্য লাভজনক ও হযরত আলী (আঃ)-এর জন্য ক্ষতিকর মনে করতেন। আর এ কাজের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়। আমীরুল মু’মিনীন হযরত আলী (আঃ) তার বিভিন্ন উক্তিতে বনি উমাইয়্যা যে ইসলামের জন্য এক বিরাট বিপদ সে কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি তার এক ভাষণের শুরুর দিকে খারেজীদের ওপর আলোকপাত করেন এবং তাদের শেষ পরিণতির কথাও উল্লেখ করেন। এরপর তিনি বলেনঃ
-فَاَنَا فَقَّأْتُ عَيْنَ الْفِتْنَةِ
‘‘অতঃপর আমি ফিৎনার চোখ উৎপাটন করলাম।’’ (নাহজুল বালাগা,ফয়জুল ইসলাম,খোতবাঃ ৯২,পৃষ্ঠাঃ ২৭৩) এরপর সহসাই তিনি তার কথার মোড় ঘুরিয়ে দেন এবং বলেনঃ .
اَلَا وَ اِنَّ اَخْوَفَ الْفِتَنِ عِنْدِی عَلَيْکُمْ، فِتْنَةُ بَنِی اُمَيَّةَ فَاِنِّهَا فِتْنَةٌ عَمْيَاءٌ مُظْلِمَةٌ
‘‘সাবধান! আমি আমার সামনে তোমাদের জন্য একটি ফিৎনার আগমনের ভয় করছি,তা হচ্ছে বনি উমাইয়্যার ফিৎনা। নিঃসন্দেহে তা হবে ঘোরতর অন্ধকারাচ্ছন্ন সর্বগ্রাসী ফিৎনা।’’ (প্রাগুক্ত) অর্থাৎ বনি উমাইয়্যার ফিৎনা হবে খারেজীদের ফিৎনার চেয়েও অধিকতর ভয়াবহ।
বনি উমাইয়্যার ফিৎনা সম্পর্কে হযরত আলী (আঃ)-এর অনেক উক্তি রয়েছে। তিনি বনি উমাইয়্যার যে সব বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ,ইসলামের সাম্যনীতি তাদের দ্বারা পুরোপুরি পদদলিত হবে এবং ইসলাম যে সকল মানুষকে মানুষ হিসাবে সমান গণ্য করেছে তাদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে তার আর কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। তখন লোকেরা কর্তা ও গোলাম-এই দুই ভাগে বিভক্ত হবে এবং তোমরা (জনগণ) কার্যতঃ তাদের গোলামে পরিণত হবে। তার এ ধরনের একটি উক্তিতে তিনি বলেনঃ .
حَتَّی لَا يَکُونَ انْتِصَارُ اَحَدِکُمْ مِنْهُمْ اِلَّا کَانْتِصَارِ الْعَبْدِ مِنْ رَبِّهِ
‘‘এমনকি তাদের সাথে তোমাদের কারো আচরণই স্বীয় মনিবের সাথে দাসের আচরণের ন্যায় বৈ হবে না।’’ (প্রাগুক্ত ,পৃষ্ঠাঃ ২৭৪) মোদ্দা কথা,তাদের সকলেই হবে মালিক আর তোমরা হবে তাদের সকলেরই দাস সমতুল্য । এ ব্যাপারে হযরত আলী (আঃ)-এর আরো অনেক উক্তি রয়েছে।
আমীরুল মু’মিনীন হযরত আলী (আঃ)-এর উক্তিতে দ্বিতীয় একটি বিষয় এসেছে ভবিষ্যদ্বাণী আকারে এবং পরে তা বাস্তবে প্রতিফলিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে,তার যুগের পরে সমাজের চিন্তাশীল ও বুদ্ধিজীবী হিসাবে পরিচিত মহল বিনষ্ট হয়ে যাবে। তিনি বলেনঃ
عَمَّتْ خُطَّتُهَا وَ خُصَّتْ بَلِيَّتُهَا.
‘‘এর মুছিবত হবে সর্বজনীন,তবে এর প্রতি আপতিত হবে শ্রেণী বিশেষের ওপর।’’ (প্রাগুক্ত) তিনি অত্যন্ত নিখুঁতভাবে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেনঃ
وَ اَصَابَ الْبَلَاءُ مَنْ اَبْصَرَ فِيهَا وَ اَخْطَأَ الْبَلَاءُ مَنْ عَمِیَ عَنْهَا
‘‘এই মুছিবত চক্ষুষ্মানদের ওপর আপতিত হবে এবং এ মুছিবতের দ্বারা তারাই ক্ষতিগ্রস্থ হবে যারা এ ব্যাপারে অন্ধ ।’’ (প্রাগুক্ত) অর্থাৎ যে কেউই দৃষ্টিশক্তি তথা দূরদৃষ্টির অধিকারী হবে,আজকের পরিভাষায় বলা যায়,যে কেউই চিন্তাশীল বা বুদ্ধিজীবী হবে এ ফিৎনা তাকেই গ্রাস করবে। কারণ,ওরা চায় না সমাজে তীক্ষ্ণদৃষ্টি লোকের অস্তিত্ব থাকুক। আর ইতিহাস সাক্ষ দেয় যে,বনি উমাইয়া দ্বারা ঐ যুগের বুদ্ধিজীবি ও দূরদর্শীদেরকে ঠিক পাখী যেমন খাদ্যদানা গুলোকে এক এক করে জমা করে,তেমনি করে তাদেরকে জমা করতো এবং গর্দান দিত। আর এভাবে তারা কি নৃশংসতাই না চালিয়েছে!
তৃতীয় বিষয়টি হলো ঐশ্বরিক মর্যাদা সমূহকে ক্ষুন্ন করা।
لَا يَدْعُوا لِلَّهِ مُحَرَّماً اِلَّا اسْتَحْلُوهُ وُلَا عَقْداً اِلَّا حَلُّوهُ
অর্থাৎ,আর কোনো হারাম বাকী থাকবে না যা তারা করবে না আর ইসলামের আর কোনো বন্ধন বাকী থাকবে না যা তারা তুলে ফেলবে না। (নাহজুল বালাগা,ফয়জুল ইসলাম,খোতবা নং ৯৭,পৃষ্ঠা নং ২৯০) চতুর্থ কথাটি হলো ঘটনার এখানেই শেষ নয়। বরং প্রকাশ্যে কার্যত : তারা ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ করে। আর যাতে জনগণকে উল্টিয়ে ফলতে পারে এজন্য ইসলামকেই উল্টিয়ে দেয়।
لُبِسَ الْاِسْلاَمُ لُبْسَ الْفَرْوِ مَقْلُوباً
অর্থাৎ, ইসলামকে জনগণের শরীরে এমন ভাবে পরিয়ে দিল যেভাবে পশমী পোশাককে উল্টিয়ে পরানো হয়। (নাহজুল বালাগা,ফয়জুল ইসলাম,খোতবা নং ১০৭ পৃষ্ঠা নং ৩২৪)
পশমী কাপড়ের বৈশিষ্ট্য হলো এটা গরম করে এবং এর পশমের মধ্যে সৌন্দর্যময় বৈচিত্র বাহার থাকে। আর সেটা তখনই প্রকাশ পায় যখন সেটা ঠিকভাবে পরিধান করা হবে। কিন্তু এটাকে যদি উল্টিয়ে পরা হয় তাহলে এতে তো কোনো গরম উৎপাদন হবেই না;উপরন্তু এমন এক ভয়াল আতঙ্কজনক দৃশ্যের অবতারণা করবে যা ঠাট্রা বিদ্রুপেরও খোরাক যোগাবে বটে। আলী (আঃ) যখন শহীদ হয়ে গেলেন তখন মুআবিয়ার ভবিষ্যদ্বাণী যে নিহত হওয়ার মাধ্যমে আলীর সবকিছু নিঃশেষ হয়ে যাবে এর বিপরীতে বরং তিনি একটি প্রতীক হিসাবে সমাজে জীবিত হলেন। যদিও একজন ব্যক্তি হিসাবে তিনি নিহত হয়েছেন। অর্থাৎ আলীর চিন্তাধারা তার মৃত্যুর পরে আরো বেশী বিস্তার লাভ করে। এরপরে শিয়ারা উমাইয়্যা দলের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হলো। ফলে চিন্তা চেতনায় ঐক্যতান সৃষ্টি হলো এবং মূলতঃ তখন থেকেই আলী (আঃ) এর শিয়ারা একটি সম্প্রদায় হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।
মুআবিয়া নিজ শাসনামলে আলীর চিন্তার সাথে বহু লড়াই চালিয়ে যান। মেম্বারের উপরে বসে আলী (আঃ) এর বিরুদ্ধে গালিগালাজ ও অভিশাপ বর্ষণ করা হতো। রাষ্ট্রীয় ভাবে অধ্যাদেশ জারী করা হয়েছিল যেন ইসলামী সম্রাজ্যের সর্বত্র মসজিদে মসজিদে জুমআর নামাজের মধ্যে আলীকে অভিসম্পাত করা হয়। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে আলী (আঃ) একটি শক্তি ও প্রতীক হিসাবে মানুষের আত্মার মধ্যে চিন্তা ও বিশ্বাস হিসাবে জীবিত ছিলেন। একারণে,মুআবিয়া এর বিরুদ্ধে নানা অপরাধ সংঘটিত করে,কাউকে বিষক্রিয়ায় হত্যা করে,কারো শিরোচ্ছেদ করে কাটা শির বর্শার মাথায় তোলে ইত্যাদি। এগুলো তো ছিলই উপরুন্তু মুআবিয়া জনসাধারণকে প্রতারিত করার জন্য বাহ্যিক বেশভূষায় কিছুটা মেনে চলতো। কিন্তু ইয়াযীদের সময় আসার সাথে সাথে সম্পূর্ণ রূপে মুখোশ খুলে পড়ে যায়। তাছাড়া অদক্ষ ইয়াযীদ এতদিনের উমাইয়া রাজনীতিকেও বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়। বরং সে এমন কিছু করে যাতে উমাইয়াদের গোপনীয়তার পর্দা বিদীর্ণ হয়ে যায়। আর এমনই পরিস্থিতিতে ইমাম হোসাইন (আঃ) স্বীয় আন্দোলনের সূচনা করেন। এবার ইমামের এ আন্দোলন সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা যাক। পবিত্র কোরআনের আয়াত মালার এক বৈশিষ্ট্য হলো বিচিত্র ধরনের সুর ধারণের ক্ষমতা। ভাষাগত বিশুদ্ধতা ও প্রঞ্জলতা ছাড়াও সূর ধারণ করার এই অভাবনীয় ক্ষমতার কারণে কোরআনের আয়াতসমুহ অনায়াসে অন্তরে অন্তরে জায়গা করে নেয়ার একটি অন্যতম কারণ হয়েছে। তদ্রুপ মানুষ যখন আশুরার ঘটনার ইতিহাসকে দেখে তখন তার দ্বারা ‘শাবিহ’ তৈরী করার উপযোগীতা খুজে পায়। কোরআন যেমন সূর ধারণের জন্যে তৈরী হয়নি কিন্তু এরূপ আছে তেমনি কারবালার ঘটনাও শাবিহ তৈরীর জন্য সংঘটিত হয়নি,তবে এরূপ আছে।
জানি না,হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) হয়তো এ বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি রেখেছিলেন। অব বিষয়টা আমরা সঠিক বলেও রায় দিচ্ছি না,আবার প্রত্যাখ্যানও করছি না। কারবালার কাহিনী এখন থেকে বারোশ’ বছর আগে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ হয়েছে। এমন এক সময় তা লিপিবদ্ধ করা হয় যখন কারো পক্ষে ধারণা করা সম্ভব ছিলো না যে,এ কাহিনী এত ব্যাপকভাবে প্রচারিত হবে। এ ঘটনার ইতিহাস মূলতঃ এক নাটক আকারে লিখিত হয়েছিলো বলে মনে হয়;নাটকের সাথে এর খুবই মিল লক্ষ্য করা যায়। মনে হচ্ছে যেন কেউ তা মঞ্চায়নের উপযোগী করে লেখার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। আমরা ইতিহাসে অনেক মর্মান্তিক শাহাদাতের ঘটনা লক্ষ্য করি,কিন্তু প্রশ্ন জাগে,এ ঘটনা যে ধরনের তা কি ঘটনাক্রমে ও অনিচ্ছাকৃতভাবে সংঘটিত হওয়া সম্ভব? হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) কি বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি দেন নি? জানি না,কিন্তু শেষ পর্যন্ত এমনটাই ঘটলো এবং বিশ্বাস করতে পারছি না যে,তা ইচ্ছাকৃত নয়।
হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর নিকট ইয়াযীদের অনুকূলে বাই‘আত দাবী করা হয়। এর তিনদিন পর তিনি মদীনা থেকে মক্কার উদ্দেশে রওয়ানা হন,তথা পারিভাষিক দৃষ্টিতে,হিজরত করেন। তিনি আল্লাহ তা‘আলার হারামে-আল্লাহ যাকে নিরাপদ ঘোষণা করেছেন,সেখানে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং স্বীয় তৎপরতা শুরু করেন। প্রশ্ন হচ্ছে ,কেন তিনি মক্কা গেলেন? তিনি কি এ কারণে মক্কা গিয়েছিলেন যে,মক্কা হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক নিরাপদ ঘোষিত হেরেম শরীফ? তিনি কি বিশ্বাস করতেন যে,বনি উমাইয়্যা মক্কার প্রতি সম্মান দেখাবে? অর্থাৎ তিনি কি বনি উমাইয়্যা সম্বন্ধে এরূপ বিশ্বাস পোষণ করতেন যে,তাদের রাজনীতির দাবী যদি এই হয় যে,তারা তাকে হত্যা করবে তথাপি তারা মক্কার সম্মানার্থে এ কাজ থেকে বিরত থাকবে? নাকি অন্য কিছু ?
প্রকৃতপক্ষে হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর মদীনা থেকে মক্কায় হিজরতের পিছনে প্রথমতঃ উদ্দেশ্য ছিলো এই যে,স্বয়ং এই হিজরতই ছিলো বনি উমাইয়্যার সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। তিনি যদি মদীনায় থেকে যেতেন এবং বলতেন যে,আমি বাই‘আত হবো না,তাহলে তার এ প্রতিবাদী কণ্ঠ ইসলামী বিশ্বে অতখানি পৌঁছতো না। এ কারণে তিনি একদিকে যেমন ঘোষণা করেন যে,আমি বাই‘আত হবো না,অন্য দিকে প্রতিবাদ স্বরূপ আহলে বাইতকে নিয়ে মদীনা থেকে বেরিয়ে পড়েন এবং মক্কায় চলে আসেন। এর ফলে তার কণ্ঠ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। সবাই বুঝতে পারে যে,হোসাইন বিন আলী (আঃ) বাই‘আত হতে রাযী হননি এবং এ কারণে তিনি মদীনা থেকে মক্কায় চলে গেছেন। আমাদের এ ধারণা যদি সঠিক হয়ে থাকে তাহলে তার এ পদক্ষেপ ছিলো জনগণের নিকট স্বীয় লক্ষ্য ও বাণীকে পৌঁছে দেয়ার জন্যে এক ধরনের প্রচারমূলক পদক্ষেপ।
এর চেয়েও বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে এই যে,হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) ৩রা শা‘বান মক্কা শরীফে প্রবেশ করেন। এরপর তিনি পুরো শা‘বান,রামাযান,শাওয়াল ও যিলক্বাদ মাস এবং যিলহজ্ব মাসের আট তারিখ পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। অর্থাৎ যে দিনগুলোতে ওমরা করা মুস্তাহাব এবং যখন চারদিক থেকে লোকেরা মক্কায় ছুটে আসে তখন তিনি সেখানেই অবস্থান করলেন। এরপর হজ্বের দিনগুলো এসে গেলো এবং শুধু চারদিক ও আশপাশ থেকেই নয়,এমনকি খোরাসানের মতো তৎকালীন ইসলামী জাহানের দূরতম প্রান্তবর্তী ভূখণ্ড থেকেও লোকেরা মক্কায় ছুটে এলো। এরপর এলো ৮ যিলহজ্ব-যেদিন লোকেরা হজ্বের উদ্দেশ্যে নতুন ইহরাম পরিধান করে অর্থাৎ আরাফাত ও মিনায় যাবার জন্য তথা হজ্ব সম্পাদনের জন্য প্রস্তুত হয়। তখন সহসাই ইমাম হোসাইন (আঃ) ঘোষণা করেনঃ আমি ইরাকের দিকে যাবো,আমি কুফার দিকে যাবো। অর্থাৎ এমনি এক সময় ও পরিস্থিতিতে তিনি কা‘বার দিকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেন,হজ্বের দিকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেন। অর্থাৎ এভাবে তিনি প্রতিবাদ জানান। তিনি এভাবেই,এ পন্থায়ই প্রতিবাদ,সমালোচনা ও অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। তিনি বুঝিয়ে দিলেন যে,কা‘বা তো এখন বনি উমাইয়্যার কুক্ষিগত;যে হজ্ব পরিচালিত হবে ইয়াযীদের দ্বারা মুসলমানদের জন্য সে হজ্ব অর্থহীন।
এমন একটি দিনে কা‘বা ও হজ্বের অনুষ্ঠানাদির প্রতি পৃষ্ঠপ্রদর্শন এবং ঘোষণা দান যে,আমি আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির লক্ষ্যে জিহাদের দিকে মুখ ফিরাচ্ছি ও হজ্বের দিকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করছি,আমর বিল মা‘রুফ ওয়া নাহি ‘আনিল মুনকার (ভালো কাজের আদেশ দান ও মন্দ কাজের প্রতিরোধ)-এর দিকে অগ্রসর হচ্ছি ও হজ্বের প্রতি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করছি-এর তাৎপর্য সীমাহীন;এটা কোনো ছোটোখাটো ব্যাপার ছিলো না। এখানে এসে তার পদক্ষেপের প্রচারমূলক গুরুত্ব এবং কাজের পদ্ধতি তুঙ্গে উপনীত হয়।
এ পর্যায়ে এসে ইমাম হোসাইন (আঃ) এমন এক সফরের সিদ্ধান্ত নেন যাকে ‘ বুদ্ধিমান’ লোকেরা (অর্থাৎ যারা সব কিছুকেই পার্থিব স্বার্থের মানদণ্ডে বিচার করেন) হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর জন্য ব্যর্থতা ডেকে আনবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেন। অর্থাৎ তারা ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে,তিনি এ সফরে নিহত হবেন। আর হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) বিভিন্ন প্রসঙ্গে তাদের এ ভবিষ্যদ্বাণীকে সঠিক বলে স্বীকার করেন। তিনি বলেনঃ আমি নিজেও এটা জানি।
তার এ কথার পরে তারা বলেনঃ তাহলে নারী ও শিশুদেরকে কেন সাথে নিয়ে যাচ্ছেন ?
তিনি বললেনঃ তাদেরকেও সাথে নিয়ে যেতে হবে।
বস্তুতঃ ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর আহলে বাইত কারবালার মঞ্চে উপস্থিত থাকায় সে মঞ্চ হয়ে ওঠে অধিকতর উত্তপ্ত ,অধিকতর মর্মান্তিক। প্রকৃতপক্ষে ইমাম হোসাইন (আঃ) এমন একদল মুবাল্লিগ (প্রচারক)কে সাথে নিয়ে যান তার শাহাদাতের পরে যাদেরকে দুশমনের হুকুমতের হৃদপিণ্ডে অর্থাৎ শামে পৌঁছে দেয়া হয়। আসলে এটা ছিলো এক বিস্ময়কর কৌশল ও একটি অসাধারণ কাজ। এর উদ্দেশ্য ছিলো এই যে, কণ্ঠস্বর যেন যত বেশী সম্ভব বিশ্বের বিভিন্ন পৌঁছে যায়,বিশেষ করে যেন তৎকালীন ইসলামী জাহানের সর্বত্র পৌঁছে যায় এবং ইতিহাসের অনেক বেশী দিককে ও কালের অনেক দিককে উম্মুক্ত করে দেয়,আর এর পথে যেন কোনোরূপ বাধাবিঘ্ন না থাকে।
হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) পথিমধ্যে যে সব কাজ সম্পাদন করেন তাতেও ইসলামের প্রকৃত সত্য প্রকাশিত হয়। এতে ইসলামের মহানুভবতা ও মানবতা এবং ইসলামের চেতনা ও সত্যতা প্রকাশিত হয়। এর প্রতিটিরই নিজস্ব গুণ রয়েছে। এটা কোনো সাধারণ ব্যাপার নয়। চলার পথে একটি মনযিলে উপনীত হবার পর তিনি বেশী করে পানি নেয়ার জন্য নির্দেশ দেন। তিনি বলেনঃ যত মশক আছে তার সবগুলোই পূর্ণ করে নাও এবং লাগাম হাতে ধরে পায়ে হেটে তোমাদের বাহনগুলোকে এগিয়ে নাও এবং তাদের পিঠে পানি তুলে নাও। বস্তুতঃ এ ছিলো এক ভবিষ্যদ্বাণী।
চলার পথে হঠাৎ ইমামের জনৈক অনুসারী চীৎকার দিয়ে বললেনঃ ‘‘লা হাওলা ওয়া লা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ ।’’ অথবা বললেনঃ ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ।’’ অথবা ‘‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজে‘উন।’’ মনে হলো তিনি যেন উচ্চৈঃরে যিকর করছেন। লোকেরা জিজ্ঞেস করলো, ব্যাপার কী? তিনি বললেন,আমি এ ভূখণ্ডের সাথে ভালোভাবে পরিচিত। এটা এমন একটি ভূখণ্ড যেখানে কোনো খেজুর বাগান নেই। কিন্তু মনে হচ্ছে যেন দূরে খেজুর বাগান দেখা যাচ্ছে ;খেজুর গাছের ডাগরের মতো চোখে পড়ছে। লোকেরা বললো,খুব ভালো করে দেখো।’’ যাদের দৃষ্টি শক্তি অনেক বেশী প্রখর তারা ভালো করে দেখে বললো,না জনাব! খেজুর বাগান নয়;ওগুলো পতাকা। দূর থেকে মানুষ আসছে,ঘোড়া আসছে। অন্যরা বললো,হয়তো ভুল দেখছো। তখন স্বয়ং ইমাম হোসাইন (আঃ) দেখলেন এবং বললেন,ঠিক বলেছো। তারপর তিনি সঙ্গীসাথীদেরকে নির্দেশ দিলেন, তোমাদের বামবিক একটি পাহাড় আছে;তোমরা ঐ পাহাড়কে তোমাদের পিছনে প্রতিরক্ষা দেয়াল স্বরূপ গ্রহণ করো।
হুর এসে হাযির হলেন,সাথে এক হাজার সৈন্য । বস্তুতঃ এখানে ইমাম হোসাইন (আঃ) সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলেন এবং প্রতিপক্ষকে বিপর্যস্ত করার জন্য তার হাতে সুযোগ ছিলো। কিন্তু তিনি কাপুরুষতার আশ্রয় নেন নি;এ সুযোগ কাজে লাগান নি,ঠিক যেভাবে তার মহানুভব পিতা হযরত আলী (আঃ) শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে সুযোগকে কাজে না লাগিয়ে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছিলেন। বরং তার দৃষ্টিতে,এরূপ পরিস্থিতিতে ইসলামী মহানুভবতা প্রদর্শন করা অপরিহার্য। তাই হুর ও তার লোকজন এসে পৌঁছার সাথে সাথেই ইমাম হোসাইন (আঃ) বললেন,ঐখান থেকে পানি নিয়ে এসো এবং তাদের ঘোড়াগুলোকে পানি পান করাও,লোকদেরকেও পানি পান করাও। স্বয়ং তিনি নিজেই দেখাশোনা করেন যে,তাদের ঘোড়াগুলোর পুরোপুরি পিপাসা নিবৃত্তি হয়েছে কিনা। এক ব্যক্তি বলেন,আমার কাছে একটি মশক দেয়া হলো,কিন্তু আমি মশকটির মুখ খুলতে পারলাম না। তখন হযরত এসে নিজের হাতে মশকটির মুখ খুলে আমার কাছে দিলেন। এমনকি ঘোড়াগুলো যখন পানি পান করছিলো তখন তিনি বলেন,এগুলো যদি ক্ষুধার্ত থেকে থাকে তাহলে এক বারে পিপাসা নিবৃত্তি করে পানি পান করবে না। তাই এগুলোকে দুই বার বা তিন বার পানি পান করতে দাও। তেমনি তিনি কারবালাতেও যুদ্ধ শুরু না করার ব্যাপারে সতর্ক থাকেন।
অন্য একটি বিষয় এমন যে ব্যাপারে আমি সম্মানিত লেখক শহীদ জাভীদের সাথে একমত হতে পারি নি। আমি তাকে বলেছিলাম,ইমাম হোসাইন (আঃ) যখন কুফার লোকদের কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার ব্যাপারে হতাশ হয়ে গেলেন এবং যখন পরিস্কার হয়ে গেলো যে,কুফা পুরোপুরি ইবনে যিয়াদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে,আর মুসলিমও নিহত হয়েছেন,এর পর কেন তার ভাষণগুলো অধিকতর কড়া হয়েছিলো? কেউ হয়তো বলতে পারে যে,ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর সামনে তো আর ফিরে যাওয়ার পথ খোলা ছিলো না!
মানলাম,তার জন্য ফিরে যাওয়ার পথ খোলা ছিলো না। কিন্তু আশূরার রাতে তিনি যখন তার সঙ্গী-সাথীদেরকে বললেন যে,আমি তোমাদের ওপর থেকে আমার বাই‘আত তুলে নিলাম,আর তারা বললেন,না,আমরা আপনাকে ছেড়ে যাবো না,তখন তিনি বলেন নি যে,এখানে থাকা তোমাদের জন্য হারাম;কারণ,তারা আমাকে হত্যা করতে চায়;তোমাদের সাথে তাদের কোনো সমস্যা নেই। তোমরা যদি এখানে থেকে যাও তাহলে অযথাই তোমাদের রক্তপাত হবে,আর তা হারাম হবে। কেন তিনি তা বলেন নি? কেন তিনি বলেন নি যে,এখান থেকে চলে যাওয়া তোমাদের জন্য ফরয? বরং তারা যখন তাদের দৃঢ়তা ও অবিচলতার ঘোষণা দিলেন তখন ইমাম হোসাইন (আঃ) তাদের এ অবস্থানকে পুরোপুরি মেনে নেন এবং এর পরই তাদের নিকট সেই সব রহস্য তুলে ধরেন যা এর আগে কখনো প্রকাশ করেন নি।
আশূরার রাতে অর্থাৎ নয়ই মহররমের সূর্যাস্তের পর এটা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলো যে,পরিদন কী হতে যাচ্ছে । এ সত্ত্বেও ইমাম হোসাইন (আঃ) হাবীব বিন মাযাহারকে বনি আসাদ গোত্রের লোকদের কাছে পাঠান যাতে সম্ভব হলে তিনি তাদের মধ্যে থেকে কতক লোককে নিয়ে আসেন। বুঝাই যাচ্ছিলো যে,তিনি নিহতদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে চাচ্ছিলেন। কারণ,শহীদদের রক্ত যত বেশী পরিমাণে প্রবাহিত হবে তার এ আহবান তত বেশী বিশ্বের ও বিশ্ব বাসীর কাছে পৌঁছে যাবে।
আশূরার দিন হুর তওবা করলেন এবং এরপর ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর নিকট চলে এলেন। ইমাম (আঃ) বললেন,ঘোড়া থেকে নেমে এসো। হুর বললেন,না,হুজুর,অনুমতি দিন,আমি আপনার পথে আমার রক্ত ঢেলে দেবো। তখন ইমাম হোসাইন (আঃ) বললেন না যে,আমার পথে তোমার রক্ত ঢেলে দেবে এ কথার মানে কী? এর মানে কি এই যে,তুমি নিহত হলে আমি মুক্তি পেয়ে যাবো? এর ফলে আমি তো মুক্তি পাবো না। তিনি এ জাতীয় কোনো কথাই বললেন না।
এসব বিষয় এটাই প্রমাণ করে যে,ইমাম হোসাইন (আঃ) চাচ্ছিলেন কারবালার ময়দান যত বেশী পরিমাণে সম্ভব রক্তাক্ত হোক। বরং বলা চলে যে,তিনি নিজেই এ রণাঙ্গনকে রঞ্জিত করেন। এ কারণেই আমরা দেখতে পাই যে,আশূরার আগে এক বিস্ময়কর দৃশ্যপটের অবতারণা হয়। মনে হয় যেন,তিনি স্বেচ্ছায় ও পরিকল্পিতভাবে তার অবতারণা করেছিলেন যাতে তিনি যা বলতে ও বুঝাতে চাচ্ছেন তা অধিকতর সুস্পষ্ট হয়,তার অধিকতর প্রদশর্নী ঘটে। এ কারণেই এ ঘটনা অনুরূপ ঘটনার জন্য প্রেরণায় পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশী পরিমাণে বেড়ে যায়।
মরহুম আয়াতী তার ‘‘বার্রাসিয়ে তারীখে আশূরা’’ (আশূরার ইতিহাস পর্যালোচনা) গ্রন্থে একটি বিষয়ের ওপরে খুবই গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি বলেনঃ ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে রক্তের রং হচ্ছে সর্বাধিক স্থায়িত্বের অধিকারী রং। ইতিহাসে ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলীতে যে রং কখনোই মুছে যায় না তা হচ্ছে লাল রং,রক্তের রং। আর হোসাইন বিন আলী (আঃ) এ উদ্দেশ্য পোষণ করতেন যে,স্বীয় ইতিহাসকে এ স্থায়ী ও অমোচনীয় রং দ্বারা লিপিবদ্ধ করবেন;স্বীয় বাণীকে তার নিজের খুন দ্বারা লিখে যাবেন।
শোনা যায়,এমন কতক লোক ছিলো যারা তার আগে নিজের রক্তের দ্বারা স্বীয় বক্তব্য লিখে গেছে,বাণী লিখে গেছে। বুঝাই যায়,কেউ যখন নিজের রক্ত দ্বারা কোনো কথা বা কোনো বাণী লিখে তার এক বিশেষ প্রভাব থাকে। জাহেলিয়্যাতের যুগে একটি নিয়ম ছিলো এবং কখনো কখনো এমন ঘটতো যে,দু’টি গোত্র এমন মৈত্রীচুক্তি সম্পাদন করতে চাইতো যা কখনো ছিন্ন হবে না। তখন তারা একটি পাত্রে রক্ত নিয়ে আসতো (অবশ্য তাদের নিজেদের রক্ত নয়) এবং তার মধ্যে হাত ডুবাতো। তারা বলতো,এ চুক্তি আর কখনো ভঙ্গ করার নয়;এটা রক্তের চুক্তি,আর রক্তের চুক্তি ভঙ্গ করার মতো নয়।
মনে হচ্ছে ,ইমাম হোসাইন (আঃ) যেন আশূরার দিনকে রং দিয়ে রঞ্জিত করতে চাচ্ছিলেন,তবে তা ছিলো রক্তের রং। কারণ,ইতিহাসে যে রং সবচেয়ে বেশী স্থায়ী তা হচ্ছে এই রক্তের রং। তাই তিনি তার ইতিহাসকে রক্তের দ্বারা লিপিবদ্ধ করেন।
অনেক ক্ষেত্রে আমরা শুনতে পাই বা ঐতিহাসিক গ্রন্থাবলীতে দেখতে পাই,অনেক রাজা-বাদুশা এবং এ ধরনের পদবীর অধিকারীরা নিজেদের নাম ইতিহাসের বুকে অমর করে রাখার লক্ষ্যে এখন থেকে শত শত বছর পূর্বে ধাতব বা পাথরের ফলকে খোদাই করে লিখিয়ে রেখে গেছেনঃ ‘আমি অমুক,অমুকের পুত্র ,অমুক দেবতাদের বংশধর’;‘আমি হচ্ছি ঐ ব্যক্তি যার সামনে অমুক ব্যক্তি যার সামনে এসে হাটু গেড়ে বসেছিলো’...। প্রশ্ন হচ্ছে ,তারা ধাতব বা প্রস্তর ফলকে তাদের নাম খোদাই করাতেন কেন? কারণ,তা যেন বিনষ্ট হয়ে না যায়,তা যেন টিকে থাকে। আমরা যে সব নিদর্শন পাচ্ছি তাতে যেমন দেখতে পাচ্ছি ,ইতিহাস তাদেরকে মাটির স্তুপের নীচে চাপা দিয়েছে;কেউই তাদের খবর রাখতো না। অতঃপর হাজার হাজার বছর পরে ইউরোপীয় প্রত্নতত্ত্ব বিশারদগণ এলেন এবং মাটি খনন করে সেগুলোকে উদ্ধার করে আনলেন। হ্যাঁ,সেগুলোকে মাটির নীচ থেকে বের করে আনা হয়েছে ঠিকই,তবে তাতে কিছু আসে-যায় না। এটা কোনো ব্যাপারই নয়। কারণ,তাদেরকে কেউ তেমন একটা গুরুত্ব দেয় না। কারণ,তারা তাদের কথাগুলো পাথরের ওপর লিখে রেখে গেছেন;মানুষের হৃদয় পটে লিখে রেখে যেতে পারেন নি।
ইমাম হোসাইন (আঃ) স্বীয় বাণীকে না পাথরের ওপর রং-কালি দিয়ে লিখেছেন,না খোদাই করে রেখে গেছেন। তিনি যা কিছু বলেন তা বাতাসে আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং লোকদের কানে ঝঙ্কৃত হয়। তবে তা লোকদের হৃদয়ে এমনভাবে রেকর্ড হয়ে যায় যে,কখনোই তা হৃদয়পট থেকে মুছে যায় নি। আর তিনি এ সত্যের ব্যাপারে পুরোপুরি সচেতন ছিলেন। তিনি তার সম্মুখস্থ ভবিষ্যতকে সঠিকভাবে দেখতে পাচ্ছিলেন। তা হচ্ছে ,অতঃপর আর কেউ হোসাইনকে হত্যা করতে পারবে না এবং তিনি আর কখনোই নিহত হবেন না।
আপনারা লক্ষ্য করুন,এসব কী? এসব কি ঘটনাক্রমে ঘটে থাকতে পারে? ইমাম হোসাইন (আঃ) আশূরার দিন ঐ সময়,ঐ শেষ মুহুর্তগুলোতে আল্লাহ তা‘আলার নিকট সাহায্যয্যের জন্য দো‘আ করেন। অর্থাৎ এই বলে দো‘আ করেন যে,তার জন্য এমন সাহায্যকারীরা আসুক যারা নিহত হবে; এই বলে দো‘আ করেন নি যে,সাহায্যকারীরা আসুক এবং তাকে নিহত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করুক। এতে কোনোই সন্দেহ নেই যে,ইমাম হোসাইন (আঃ) চান নি তার নিহত হওয়ার পর তার সঙ্গী-সাথীরা,তার ভাইয়েরা ও তার পুত্র-ভ্রাতুস্পুত্ররা বেঁচে থাকুক। তা সত্ত্বেও তিনি সাহায্য ও সাহায্যকারী চাচ্ছিলেন;চাচ্ছিলেন যে,সাহায্যকারীরা আসুক ও নিহত হোক। ইমাম হোসাইন (আঃ) যে বলছিলেনঃ
هَلْ مِنْ نَاصِرٍ يَنْصُرُنِی
‘‘এমন কোনো সাহায্যকারী আছে কি যে আমাকে সাহায্য করবে?’’
এটাই ছিলো তার এ আবেদনের প্রকৃত তাৎপর্য।
ইমাম হোসাইন (আঃ) এর এ আবেদন তাঁবুগুলোতে পৌঁছে গিয়েছিলো,আর নারীরা বিলাপ করছিলেন;তাদের বিলাপের শব্দ উচ্চকিত হচ্ছিলো। ইমাম হোসাইন (আঃ) তার ভাই আব্বাস ও অন্য এক ব্যক্তিকে পাঠালেন,বললেন,যাও,নারীদেরকে নীরব হতে বলো। তারা গেলেন এবং নারীদেরকে নীরব হতে বললেন;নারীরা নীরব হলো। এরপর তারা দু’জন ইমামের তাঁবুতে ফিরে এলেন।
এ সময় হযরত ইমামের (আঃ) দুগ্ধপোষ্য শিশুকে এনে তার কোলে দেয়া হলো। ইমাম হোসাইনের (আঃ) বোন হযরত যায়নাব (আঃ) শিশুটিকে কোলে করে নিয়ে এসে তার ভাইয়ের কোলে দিলেন। তিনি শিশুটিকে কোলে নিলেন। তিনি বললেন না,প্রিয় বোন! এ মুছিবতের মধ্যে-যেখানে কোনোরূপ নিরাপত্তা নেই এবং অপর পক্ষ থেকে তীর নিক্ষেপ করা হচ্ছে ,আর দুশমন ওৎ পেতে আছে,এহেন পরিবেশে এ শিশুকে নিয়ে এলে কেন? বরং তিনি তার শিশুটিকে কোলে তুলে নেন। আর ঠিক তখনই দুশমনদের দিক থেকে তীর ছুটে এলো এবং নিস্পাপ শিশুর পবিত্র গলদেশে বিদ্ধ হলো। ইমাম হোসাইন (আঃ) তখন কী করলেন? দেখুন রং করার কাজ কী ধরনের। এভাবে শিশু শহীদ হলে তিনি তার হাতে শিশুর রক্ত নিয়ে আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিলেন। যেন তিনি বলছেনঃ হে আসমান! দেখো এবং সাক্ষী থাকো।
ইমাম হোসাইন (আঃ) এর জীবনের শেষ সময়;আঘাতে আঘাতে তার পবিত্র শরীর জর্জরিত। তিনি আর দাড়িয়ে থাকতে পরলেন না;মাটিতে পড়ে গেলেন। ঐ অবস্থায় তিনি হাঁটুতে ভর দিয়ে কিছুটা এগিয়ে গেলেন,তারপর পড়ে গেলেন। তিনি আবার উঠে দাঁড়াবার প্রচেষ্টা করলেন;এ সময় তীর এসে তার গলায় বিদ্ধ হলো। ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন,তিনি পুনরায় তার হাতে রক্ত নিলেন এবং তার চেহারায় ও মাথায় মাখালেন এবং বললেনঃ আমি আমার প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাত করতে যাচ্ছি ।
এগুলো হচ্ছে কারবালার হৃদয়স্পর্শী দৃশ্য। এগুলো হচ্ছে এমন ঘটনা যা হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর বাণীকে দুনিয়ার বুকে চিরদিনের জন্য স্থায়ী ও টেকসই করে দিয়েছে।
নয়ই মহররমের বিকালে যখন দুশমনরা হামলা করে তখন হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) তার ভাই আব্বাসকে দুশমনদের কাছে পাঠান এবং তাকে বলেন,আমি আজ রাতে আমার প্রতিপালকের সাথে একান্ত আলাপন করবো,নফল নামায আদায় করবো,দো‘আ ও ইস্তেগফার করবো। তুমি যেভাবেই পারো এদেরকে বুঝিয়ে আজ রাতের জন্য-কাল সকাল পর্যন্ত তাদেরকে হামলা থেকে বিরত রাখো। আমি কাল এদের সাথে যুদ্ধ করবো। শেষ পর্যন্ত শত্রুরা ঐ রাতের জন্য হামলা থেকে বিরত থাকে।
ইমাম হোসাইন (আঃ) নয়ই মহররম দিবাগত রাতে অর্থাৎ আশূরার রাতে কয়েকটি কাজ আঞ্জাম দেন যা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে। সে রাতে তিনি যে সব কাজ আঞ্জাম দেন তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে,তিনি তার সঙ্গী সাথীদেরকে (বিশেষ করে যারা এ কাজে সুদক্ষ ছিলেন) নির্দেশ দেনঃ ‘‘তোমরা আজ রাতের মধ্যেই তোমাদের তলোয়ার ও বর্শাগুলোকে (যুদ্ধের জন্য ) প্রস্তুত করো।’’ আর তিনি নিজেই তাদের কাজ তদারক করতে লাগলেন। জুন নামে এক ব্যক্তি অস্ত্র মেরামত ও ধারালো করার কাজে সুদক্ষ ছিলেন;হযরত ইমাম (আঃ) নিজে গিয়ে তার কাজ তদারক করেন।
ইমাম হোসাইন (আঃ) সে রাতে অপর যে কাজ করেন তা হচ্ছে,ঐ রাতের মধ্যেই তাঁবুগুলোকে খুব কাছাকাছি এনে খাটানোর নির্দেশ দেন-এতই কাছাকাছি যাতে এক তাঁবুর রশি বাধার খুটা অন্য তাঁবুর রশির আওতায় পোঁতা হয় এবং দুই তাঁবুর মাঝখান দিয়ে যেন একজন লোক অতিক্রম করার মতোও ফাঁক না থাকে। এছাড়া তিনি তাঁবুগুলোকে অর্ধচন্দ্রাকৃতি আকারে স্থাপনের এবং সে রাতের মধ্যেই তাঁবুগুলোর পিছনে সুগভীর পরীখা খনসনের নির্দেশ দেন-এমন আয়তন ও গভীরতা বিশিষ্ট্য পরীখা যাতে ঘোড়ার পক্ষে তা লাফ দিয়ে ডিঙ্গানো সম্ভব না হয় এবং শত্রু যাতে পিছন দিক থেকে হামলা করতে না পারে। এছাড়া তিনি মরুভূমি থেকে শুকনো আগাছা এনে তার পিছন দিকে স্তুপীকৃত করে রাখার ও আশূরার দিন সকালে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন যাতে যতক্ষণ আগুন জ্বলতে থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত দুশমনরা তাঁবুগুলোর পিছন দিক থেকে হামলা করতে না পারে। তিনি ডান,বাম ও সামনের দিক থেকে দুশমনদের সাথে মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নেন এবং এভাবে তিনি পিছন দিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) ঐ রাতে অপর যে কাজ করেন তা হচ্ছে,তিনি তার সকল সঙ্গীসাথীকে এক তাঁবুতে সমবেত করেন এবং শেষ বারের মতো হুজ্জাত (হুজ্জাত মানে অকাট্য সুস্পষ্ট প্রমাণ।হুজ্জাত পুর্ণ করার মানে হচ্ছে কোনো বিষয়কে প্রমাণ করার জন্য এমনভাবে তুলে ধরা যাতে শ্রোতার কাছে তার সত্যতার প্রশ্নে বিন্দুমাত্র ও সংশয়ের অবকাশ না থাকে,তা বাহ্যতঃ শ্রোতা তা স্বীকার করুক বা না-ই করুক এবং মানুক বা না-ই মানুক। এখানে হযরত ইমাম হোসেন (আঃ) কর্তৃক হুজ্জাত পূর্ণ করার মানে হচ্ছে তার সঙ্গী সাথীদের শহীদ হওয়ার বিষয়টির পুরোপুরি স্বতঃস্ফূর্ততা নিশ্চিত করা। অর্থাৎ কেউ যেন এভাবে জীবন দেয়াকে অর্থহীন মনে করেও কেবল ইমামের প্রতি বাই‘আতের খাতিরে জীবন না দেন) পরিপূর্ণ করেন। তিনি প্রথমে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান যার ভাষা ছিলো অত্যন্ত প্রাঞ্জল ও যার তাৎপর্য ছিলো খুবই সুগভীর। তিনি যেমন তার পরিবারের সদস্যদের প্রতি,তেমনি তার সঙ্গী-সাথীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং এরপর বলেন,আমি আমার আহলে বাইতের চেয়ে উত্তম কোনো আহলে বাইতের এবং আমার সঙ্গী সাথীদের তুলনায় অধিকতর আনুগত শীল সঙ্গী সাথীর কথা জানি না। এতদসত্ত্বেও তিনি বলেন,তোমরা সকলেই জানো যে,ব্যক্তিগতভাবে আমাকে ছাড়া আর কারো ব্যাপারে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। তাদের লক্ষ্য কেবল আমি। তারা আমাকে হাতে পেলে তোমাদের কাউকে নিয়েই মাথা ঘামাবে না। তোমরা চাইলে রাতের আধারকে কাজে লাগিয়ে সকলেই চলে যেতে পারো।
এরপর তিনি বলেন,তোমাদের প্রত্যেকেই এই শিশুদের ও আমার পরিবারের একেক জন সদস্যকে সাথে নিয়ে চলে যেতে পারো। তিনি এ কথা বলার সাথে সাথেই চারদিক থেকে সকলেই বলতে শুরু করলেন,হে আবু আব্দুল্লাহ ! আমরা তা করবো না। সকলের আগে যিনি একথা বললেন তিনি হলেন হযরত ইমামের (আঃ) মহান ভ্রাতা আবুল ফজল আব্বাস। (বিহারুল আনোয়ার,খণ্ডঃ ৪৪,পৃষ্ঠাঃ ৩৯৩,ইরশাদ-শেখ মুফীদ,পৃষ্ঠঃ ২৩১,এ’লামুল ওয়ারা,পৃষ্ঠাঃ ২৩৫)
এ পর্যায়ে এসে বাস্তবিকই আমরা ঐতিহাসিক ও নাট্যসুলভ কথাবার্তা শুনতে পাই। প্রত্যেকেই তার মতো করে কথা বলেন। একজন বলেন,আমাকে যদি হত্যা করা হয় এবং আমার শরীরকে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়,আর তার ভস্ম বাতাসে ছড়িয়ে দেয়া হয়,তারপর আবার আমাকে জীবন্ত করা হয় এবং এভাবে সত্তর বার এর পুনরাবৃত্তি করা হয়,তাহলেও আমি আপনাকে ছেড়ে যাবো না। আমার এ তুচ্ছ জীবন তো আপনার জন্য উপযুক্ত কুরবানীও নয়। আরেক জন বলেন,আমাকে যদি হাজার বার হত্যা করা ও জীবন্ত করা হয় তথাপি আপনাকে ছেড়ে যাবো না। কেবল পরিপূর্ণ আন্তরিকতা ও ইখলাছের অধিকারী লোকেরাই যাতে তার সাথে থেকে যান সে জন্য যা কিছু করা দরকার হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) তার সব কিছুই করলেন।
হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর সঙ্গী সাথীদের মধ্যে এক ব্যক্তির কাছে আশূরার সে দিনগুলোতেই খবর এলো যে,তার পুত্র অমুক কাফেরদের হাতে বন্দী হয়েছে। বন্দী একটি যুবক ছেলে বৈ নয়;তার ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছিলো তা নিশ্চিত করে বলার উপায় ছিলো না। ছেলের খবর শুনে তিনি বললেন,আমি চাই নি যে,আমি বেঁচে থাকতে আমার ছেলের ভাগ্যে এমনটা ঘটবে।
ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর নিকট সংবাদ পৌঁছলো যে,আপনার অমুক সঙ্গীর ছেলে কাফেরদের হাতে বন্দী হয়ে আছে। ইমাম (আঃ) তাকে ডাকালেন এবং তিনি এলে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন ও তার অতীতের ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা স্মরণ করলেন,তারপর বললেন,তোমার পুত্র বন্দী হয়ে আছে। কারো না কারো টাকা-পয়সা ও উপঢৌকনাদি নিয়ে সেখানে যাওয়া দরকার যাতে তাদেরকে তা দিয়ে বন্দীকে মুক্ত করতে পারে। সেখানে কিছু মালামাল ও পোশাক-পরিচ্ছদ ছিলো যা বিক্রি করে টাকা-পয়সার ব্যবস্থা করা সম্ভব ছিলো। ইমাম হোসাইন (আঃ) তাকে বললেন,তুমি এগুলো নিয়ে অমুক জায়গায় গিয়ে বিক্রি করো,তারপর প্রাপ্ত অর্থ নিয়ে যাও তোমার ছেলেকে মুক্ত করো। ইমাম হোসাইন (আঃ) এ কথা বলার সাথে সাথে ঐ ব্যক্তি বললেনঃ
اَکَلَتْنِی السِّبَاعُ حَيّاً اِنْ فَارَقْتُک
অর্থাৎ হিংস্র পশুরা আমাকে জীবন্ত ভক্ষণ করুক যদি আমি আপনাকে ছেড়ে যাই। (বিহারুল আনোয়ার,খণ্ডঃ ৪৪,পৃষ্ঠাঃ ৩৯৪) তার কথা হলো,আমার পুত্র বন্দী হয়ে আছে;থাকুক না। আমার পুত্র কি আমার কাছে আপনার তুলনায় অধিকতর প্রিয়?
ইমাম হোসাইন (আঃ) কর্তৃক হুজ্জাত পূর্ণ করার পর যখন সকলেই এক জায়গায় ও এক বাক্যে সুস্পষ্ট ভাষায় তাদের নিষ্ঠা ও আনুগত্যের ঘোষণা দিলেন এবং বললেন যে,আমরা কখনো আপনাকে ছেড়ে চলে যাবো না,তখন সহসাই পট পরিবর্তিত হয়ে গেলো। ইমাম (আঃ) বললেন,ব্যাপার যখন এই,তখন সকলেই জেনে রাখো যে,আমরা নিহত হতে যাচ্ছি । তখন সকলে বললো,আল-হামদুলিল্লাহ-আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা করছি যে,তিনি আমাদেরকে এ ধরনের তাওফীক দান করেছেন। এটা আমাদের জন্য এক সুসংবাদ,একটি আনন্দের ব্যাপার। ইমাম হোসাইন (আঃ) এর মজলিসের এক কোণে একজন কিশোর বসে ছিলেন;বয়স বড় জোর তেরো বছর হবে। এ কিশোরের মনে সংশয়ের উদয় হলোঃ আমিও কি এ নিহতদের অন্তর্ভুক্ত হবো? যদিও ইমাম বলেছেন ‘তোমরা এখানে যারা আছা তাদের সকলে’,কিন্তু আমি যেহেতু কিশোর ও নাবালেগ,সেহেতু আমার কথা হয়তো বলা হয় নি। কিশোর ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর দিকে ফিরে বললেনঃ
؟ يَا عَمَّاه وَ اَنَا فِی مَنْ قُتِلَ؟
অর্থাৎ,চাচাজান! আমিও কি নিহতদের অন্তর্ভুক্ত হবো? এ কিশোর ছিলেন হযরত ইমাম হাসান (আঃ)-এর পুত্র কাসেম। ইতিহাস লিখেছে,এ সময় হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) স্নেহশীলতার পরিচয় দেন। তিনি প্রথমে জবাব দানে বিরত থাকেন,এরপর কিশোরকে জিজ্ঞেস করেন,ভাতিজা! প্রথমে তুমি আমার প্রশ্নের জবাব দাও,এরপর আমি তোমার প্রশ্নের জবাব দেবো। তুমি বলো,তোমার কাছে মৃত্যু কেমন;মৃত্যুর স্বাদ কী রকম? কিশোর জবাব দিলেন,আমার কাছে মধুর চেয়েও অধিকতর সুমিষ্ট । আপনি যদি বলেন যে,আমি আগামী কাল শহীদ হবো তাহলে আপনি আমাকে সুসংবাদ দিলেন। তখন ইমাম হোসাইন (আঃ) জবাব দিলেন,হ্যাঁ,ভাতিজা! কিন্তু তুমি অত্যন্ত কঠিন কষ্ট ভোগ করার পর শহীদ হবে। কাসেম বললেনঃ আল্লাহর শুকরিয়া,আল-হামদুলিল্লাহ-আল্লাহর প্রশংসা যে,এ ধরনের ঘটনা ঘটবে।
এবার আপনারা ইমাম হোসাইন (আঃ) এর এ ভূমিকা নিয়ে চিন্তা করে দেখুন যে,পরদিন কী বিস্ময়কর এক বাস্তব নাটকের দৃশ্যের অবতারণা হওয়া সম্ভব!