বাঙ্গালী
Sunday 24th of November 2024
0
نفر 0

নৈতিকতা, ধর্ম ও জীবন: ৫ম পর্ব

নৈতিকতা, ধর্ম ও জীবন: ৫ম পর্ব

গত আসরে আমরা বলেছি, মানুষ হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি এবং মানুষের উচিত পৃথিবীর নেয়ামতকে কাজে লাগিয়ে আধ্যাত্মিক ও নৈতিক কল্যাণ ও পূর্ণতা নিশ্চিত করা। আমরা এও বলেছি যে, মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ মানুষকে বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ, ঐশী ধর্ম ও নবী-রাসূলের অস্তিত্ব এবং প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধির ক্ষেত্রে মানুষের জন্য বিবেকের অস্তিত্ব জরুরি। এ কারণে ইসলাম ধর্মও মানুষের বিবেককে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। তবে অনেক জটিলতা ও অচলাবস্থার ক্ষেত্রেই বিবেকের কার্যকারিতা আর থাকে না। সে ক্ষেত্রে ধর্মের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া আর উপায় থাকে না। ঐশী ধর্মই কেবল এ ধরনের জটিলতার সমাধান দিতে পারে। এছাড়া, মানুষের রয়েছে জন্মগত প্রকৃতি বা ফিতরাত। নিজেকে চেনার ক্ষেত্রে ফিতরাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আজকের আসরে আমরা ইসলামি নীতি-নৈতিকতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার চেষ্টা করবো।
 
 
সব ধর্ম ও মতবাদেই নৈতিক প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করা হয়। তবে নৈতিক প্রশিক্ষণের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে ব্যাপক মতপার্থক্য রয়েছে। ইসলাম ধর্ম একত্ববাদে বিশ্বাসী। ইসলামে বিশ্বাসের অন্যতম প্রধান বিষয়ই হলো, তাওহীদ‌‌ অর্থাৎ একত্ববাদে বিশ্বাস। তাওহীদে বিশ্বাস মানুষকে মানুষের দাসত্ব হতে মুক্ত ও স্বাধীন করে। কারণ তাওহীদ বা একত্ববাদের অর্থ হলো, পরিপূর্ণভাবে একমাত্র আল্লাহর বশ্যতা ও অধীনতা স্বীকার করা এবং তার সঙ্গে কাউকে অংশীদার না করা। ইসলাম ধর্মমতে, সব কিছুর মালিক হচ্ছেন এক আল্লাহ। আল্লাহর ইচ্ছায় পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে এবং এর মূলে রয়েছে কল্যাণ, দয়া ও শুভকামনা। একত্ববাদে এ বাস্তবতা তুলে ধরা হয় যে, বিশ্বের সব সৃষ্টিই সমন্বিতভাবে একই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে চলেছে। প্রতিটি সৃষ্টির পেছনেই কোনো না কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে। সৃষ্টির মধ্যে মানুষ হচ্ছে বিশেষ মর্যাদাপ্রাপ্ত এবং মানুষের রয়েছে বিশেষ কিছু দায়িত্ব। মানুষের নানা দায়িত্বের একটি হলো, আত্মপরিশুদ্ধির মাধ্যমে সমাজ সংশোধন। পৃথিবী হচ্ছে মানুষের জন্য শস্যক্ষেত্র। মানুষকে তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও চেষ্টা-প্রচেষ্টার আলোকে পুরষ্কার দেয়া হবে।
 
 
একত্ববাদ মানুষের জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তোলে। এর ফলে মানুষ আত্মিক ও আধ্যাত্মিক পূর্ণতার পথে পরিচালিত হয়। বৈষয়িক জীবন ব্যবস্থা পরিচালিত হয় নৈতিক ও আত্মিক পূর্ণতার উদ্দেশ্যে। একত্ববাদে বিশ্বাসের কারণে নিরাশার অতল গহ্বরে ডুবে যাওয়ার মহাবিপদ থেকে রক্ষা পায় মানব সমাজ। ইরানের খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ আয়াতুল্লাহ মোর্তজা মোতাহারি ঈমান ও নৈতিকতা প্রসঙ্গে বলেছেন, ঈমানবিহীন নীতি-নৈতিকতা হচ্ছে ভিত্তিহীন মুদ্রার মতো। তিনি আরো বলেছেন, আল্লাহর প্রতি ঈমান সব নৈতিক মূল্যবোধকে অর্থপূর্ণ ও লক্ষ্যপূর্ণ করে তোলে। যে কোনো পরিস্থিতিতে ন্যায়ের ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত থাকা ইসলামী নীতি-নৈতিকতার একটি বড় ভিত্তি। মক্কা বিজয়ের পরও মুসলমানদেরকে বিদ্বেষের বশবর্তী না হয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। আমরা জানি যে, মক্কাতেই শত্রুদের আঘাতে রাসূল(সা.)’র দাঁত ভেঙে গিয়েছিল। রাসূলকে ওই শহর থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। এমনকি ওই শহরেই নবীজীর বহু প্রিয় সাহাবিকে শহীদ করা হয়েছিল।
 
 
এরপরও আল্লাহতায়ালা সূরা মায়েদার ৮ নম্বর আয়াতের মাধ্যমে মুসলমানদেরকে এই বলে সতর্ক করে দেন যে, কোনো একটি দলের শত্রুতা তাদেরকে যেন এমন উত্তেজিত করে না দেয়, যার ফলে তারা ন্যায়বিচার থেকে সরে যায়। শত্রুতা ও মিত্রতার কথা বাদ দিয়ে ন্যায়ের ভিত্তিতে আচরণের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। নীতি-নৈতিকতার ভিত্তি হতে হবে, ‘ঐশী ধর্ম’ ও ‘ঈমান’। মুসলমানেরা পৃথিবীকে আল্লাহর রহমতের প্রকাশস্থল হিসেবে গণ্য করে এবং মানুষ হচ্ছে সৃষ্টির সেরা জীব। ইসলামী নীতি-নৈতিকতা মানুষের জীবনের সব কিছুকেই শামিল করে। ইসলামী নীতি-নৈতিকতার একটা বড় বৈশিষ্ট্যও এটা। অন্য কোনো ধর্মই মানব জীবন প্রণালীকে এতো বেশি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেনি। ইসলাম ধর্ম মানব জীবনের সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম বিষয়েও কথা বলেছি। ইসলাম ধর্মের অর্থ কেবল আল্লাহর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নয়। কেবল কিছু ইবাদত বন্দেগির সমষ্টিই ইসলাম নয়। বরং ইসলাম ধর্মে যেমন আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে তেমনি মানুষের সঙ্গে মানুষের এবং মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্কের বিষয়ে সীমা-পরিসীমা বর্ণনা করা হয়েছে।
 
 
ইসলাম ধর্মে আত্মিক ও নৈতিক প্রশিক্ষণ সম্পর্কে সবচেয়ে গভীর ও সূক্ষ্ম বিষয়গুলোকেও অতি সহজভাষায় এবং সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়েছে। নৈতিক সংশোধনের ক্ষেত্রে বাস্তবধর্মী দিক-নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। ইসলামী নৈতিকতার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, প্রত্যেক ব্যক্তিই চিন্তাগত ও আধ্যাত্মিক পূর্ণতার প্রতিটি পর্যায়েই তার উপলব্ধি ক্ষমতা অনুসারে উপকৃত হতে পারে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব মানুষের জন্যই রয়েছে ইসলামি দিক-নির্দেশনা। ইসলামী নৈতিক শিক্ষা সবার জন্যই প্রযোজ্য। মানুষ চিন্তাগত ও আধ্যাত্মিক পূর্ণতার পথে যত বেশি অগ্রসর হবে,  ইসলামি শিক্ষার তাৎপর্য ততবেশি উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে। ইসলামি শিক্ষা সহজেই যেমন বোধগম্য ঠিক তেমনি এর শিকড় অতি গভীরে। ইসলামি নৈতিক শিক্ষার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, মানব অস্তিত্বের সব দিকগুলোকে বিবেচনায় নেয়া। শারীরিক, আত্মিক, বৈষয়িক নানা ইস্যুর পাশাপাশি আবেগ-অনুভূতি, মায়া-মমতা, ভালোবাসার মতো বিষয়গুলোও ইসলামি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মধ্যে পড়েছে। বিশিষ্ট চিন্তাবিদ শহীদ অধ্যাপক মোর্তজা মোতাহারি বলেছেন, যে নিজের ভেতরে সব মানবীয় মূল্যবোধকে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করতে পারে, সেই হচ্ছে পরিপূর্ণ মানুষ।
 
 
প্রতিটি মানবিক মূল্যবোধ বিকশিত করার মধ্যদিয়ে মানুষের জন্মগত সুবৈশিষ্ট্য বিকশিত হয়। মানুষ তখনি চূড়ান্ত পূর্ণতায় পৌঁছে যখন তার সব যোগ্যতা ও দক্ষতা পুরোপুরি বিকশিত হয়। এর মধ্যদিয়ে ব্যক্তির ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ যেমন নিশ্চিত হয়,তেমনি উপকৃত হয় গোটা বিশ্ব। মানব জীবনে সুখ, শান্তি ও মঙ্গল বয়ে আনতে হলে ইসলামি নৈতিকতার বিকল্প নেই। এ কারণে আমাদের সন্তানদেরকে শিশু বয়স থেকেই ধর্ম ও নৈতিকতার শিক্ষা দিতে হবে। সন্তানদের নীতি ও আদর্শের মূর্ত প্রতীকরূপে গড়ে তুলতে পারলে ভবিষ্যৎ পৃথিবী হয়ে ওঠবে সুখ ও শান্তির নীড়।(রেডিও তেহরান)

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

আল্লাহর প্রতি ইমান
মৃত্যুর পর মানুষকে কতদিন কবরে ...
শিয়া-সূন্নীর মধ্যে পার্থক্য কি?
নামাজ : আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের ...
মিথ্যা কথা বলা
শিয়া মুসলমানরা কত ওয়াক্ত নামাজ ...
বারজাখের জীবন
সূরা ইউনুস;(১৬তম পর্ব)
দরিদ্রতার চেয়ে মৃত্যু ভাল
দোয়া কবুলের মাস

 
user comment