আমাদের সমাজে ইসলামী পরিভাষা “তাক্বদীর্”(تقدیر)-এর অর্থ গ্রহণ করা হয় ‘ভাগ্য’ বা ‘ভাগ্যলিপি’। সাধারণভাবে প্রচলিত ধারণা হচ্ছে এই যে,আমাদের ভালো-মন্দ সব কিছুই আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে পূর্ব হতেই নির্ধারণ করে রাখা হয়েছে। এর ভিত্তি হচ্ছে “ঈমানে মুফাছ্বছ্বাল্” (বিস্তারিত ঈমান) নামে শৈশবে মুসলমানদেরকে যে বাক্যটি মুখস্ত করানো হয় তার অংশবিশেষ-যাতে বলা হয়: والقدر خيره و شره من الله تعالی (আর ভাগ্য; এর ভালো ও মন্দ আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে নির্ধারিত), যদিও কোরআন মজীদের কোথাওই এ বাক্যাংশটি নেই।
এ ব্যাপারে দ্বিমতের অবকাশ নেই যে, ঈমানের মৌলিক বিষয়াদির ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে ও তার শাখা-প্রশাখার ক্ষেত্রে বিচারবুদ্ধির (عقل) রায় বা কোরআন মজীদের দলীল থাকা অপরিহার্য। বিশেষ করে কোরআন মজীদ বা বিচারবুদ্ধির রায় নয় এমন ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা-বিশ্বাসে যদি মুসলমানদের মধ্যে ‘মতৈক্য’ (ইজমা‘-اجماع) না থাকে, বরং বিতর্ক থাকে, তাহলে তা কিছুতেই ঈমানের মৌলিক বিষয়সমূহ ও তার শাখা-প্রশাখার অন্যতম বলে গণ্য হতে পারে না।
অবশ্য কোনো কোনো হাদীছে এ ধরনের বর্ণনা রয়েছে যে, মানবশিশু জন্মগ্রহণের পূর্বেই অর্থাৎ ভ্রূণ আকারে মাতৃগর্ভে থাকাকালেই আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে ফেরেশতা এসে তার ভাগ্যলিপিতে তার পুরো ভবিষ্যত জীবনের সব কিছুই লিখে দিয়ে যায়; এমনকি সে নেককার হবে, নাকি গুনাহ্গার হবে তথা বেহেশতে যাবে, নাকি দোযখে যাবে তা-ও লিখে দিয়ে যায়।
এ ধরনের হাদীছ মুসলিম উম্মাহর সকল ধারার দ্বীনী চিন্তাবিদ ও বিশেষজ্ঞদের নিকট সর্বসম্মতভাবে গৃহীত নয় এবং তা মুতাওয়াতির্ (প্রতিটি স্তরে বিপুল সংখ্যক সূত্রে বর্ণিত) নয়, বরং এগুলো খবরে ওয়াহেদ্ (অন্ততঃ প্রথম স্তরে অর্থাৎ ছ্বাহাবীদের স্তরে কম সংখ্যক সূত্রে বর্ণিত) হাদীছ। আর খবরে ওয়াহেদ্ হাদীছ পরীক্ষা-নিরীক্ষায় উতরে যাওয়া সাপেক্ষে আহ্কামের খুটিনাটি নির্ধারণে এবং অন্য অনেক জ্ঞান-বিজ্ঞানগত বিষয়ে গ্রহণযোগ্য হলেও ঈমানের মৌলিক বিষয়াদিতে ও এর শাখা-প্রশাখায় তা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর ইন্তেকালের সময় তাঁর ছ্বাহাবীর সংখ্যা ছিলো লক্ষাধিক। এমতাবস্থায় ঈমানের অন্যতম মৌলিক গুরুত্ব সম্পন্ন কোনো বিষয়ে তাঁর দেয়া বক্তব্য বা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ মাত্র দু’চার জন ছ্বাহাবীর জানা থাকবে, অন্যদের জানা থাকবে না অর্থাৎ তা মুতাওয়াতির্ পর্যায়ে উত্তীর্ণ হবে না এটা অসম্ভব।
এটা সর্বজন স্বীকৃত ঐতিহাসিক সত্য যে, হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর ইন্তেকাল এবং ছ্বিহাহ্ সিত্তাহ্ (ছয়টি নির্ভুল হাদীছ্ গ্রন্থ) হিসেবে অভিহিত হাদীছগ্রন্থ সমূহ ও অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থ সংকলনের মধ্যবর্তী দুই শতাধিক বছর সময়ের মধ্যে বহু মিথ্যা হাদীছ রচিত হয়েছিলো। হাদীছ সংকলনকারী ইমামগণ অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নির্বাচিত হাদীছের সংকলন করা সত্ত্বেও এ সব সংকলনে কতক জাল হাদীছ অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়া অসম্ভব নয়। বিশেষ করে যে সব হাদীছের বক্তব্য ‘আক্বল্-এর অকাট্য রায় ও কোরআন মজীদের বক্তব্যের সাথে সাংঘর্ষিক তা জাল হবার ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই।
অতএব, এটা সন্দেহাতীত যে, ঈমানের মৌলিক বিষয় সমূহের মধ্যকার কোনো বিষয়ে বা তার শাখা-প্রশাখায় খবরে ওয়াহেদ্ হাদীছ গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের সমাজে এ ধরনের হাদীছের ভিত্তিতে অদৃষ্টবাদকে ঈমানের অন্যতম মৌলিক বিষয় বলে গণ্য করে নেয়া হয়েছে। অবশ্য আধুনিক শিক্ষার প্রভাবে অনেকের মন-মগয থেকেই শৈশবে শেখানো অদৃষ্টবাদিতার এ অন্ধ বিশ্বাস উবে যায় এবং মানুষের কর্মক্ষমতায় বিশ্বাস তার স্থান দখল করে নেয়। তবে বর্তমান প্রজন্মের মনে মানুষের কর্মক্ষমতায় বিশ্বাসের পিছনে প্রধানতঃ পাশ্চাত্যের বস্তুবাদের প্রভাব সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকে। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা‘আলার অস্তিত্ব ও গুণাবলী এবং তাঁর নিকট জবাবদিহিতা সম্পর্কে উদাসীনতা সংমিশ্রিত থাকে।
অন্যদিকে যারা অদৃষ্টবাদের প্রবক্তা তাদের দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ কথাবার্তা ও আচরণে কিন্তু অদৃষ্টবাদের প্রতিফলন ঘটে না। বরং তারা কার্যতঃ কর্মক্ষমতায় বিশ্বাসী। কেবল ‘আক্বা’এদী বিতর্কের বেলায়ই তারা অদৃষ্টবাদের পক্ষে যুক্তি দেখায়। এভাবে আমাদের সমাজে চিন্তা ও আচরণের মধ্যে বিরাট বৈপরীত্য ও অসামঞ্জস্য সৃষ্টি হয়েছে যা আমাদের জীবনের সকল ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করেছে। ফলে মুসলমানদের কাছ থেকে যেখানে আল্লাহ্ তা‘আলার ওপর নির্ভরতা সহকারে কর্মমুখরতাই বাঞ্ছনীয় সেখানে তার পরিবর্তে দেখা যায় যে, সমাজের একটি অংশ স্থবিরতা ও হতাশায় নিমজ্জিত এবং অপর অংশটি পুরোপুরি বস্তুবাদী ধ্যানধারণা ও পার্থিবতায় নিমজ্জিত। এ উভয় ধরনের প্রান্তিকতা থেকে মুক্ত হয়ে সঠিক চিন্তা ও আচরণে উত্তরণের জন্য মানুষের জীবনের গতিধারা নিয়ন্ত্রণের কারক সমূহ ও সে সবের মধ্যকার সম্পর্ক নির্ণয় করা অপরিহার্য।
কোরআন মজীদে “ক্বাদর্” ও “তাক্বদীর্” পরিভাষা
আলোচনার শুরুতেই যেমন উল্লেখ করা হয়েছে, মুসলিম সমাজের বেশীর ভাগ অংশেই শৈশব কালেই “ঈমানে মুফাছ্বছ্বাল্” (বিস্তারিত ঈমান) নামক বাক্যে ‘ভাগ্যের’ ভালো-মন্দের কথা শিক্ষা দেয়া হয়। উল্লিখিত বাক্যে ‘ভাগ্য’ বুঝাবার জন্য القدر (আল্-ক্বাদর্) পরিভাষা ব্যবহৃত হয়েছে। অন্যদিকে সাধারণভাবে ‘ভাগ্যলিপি’ বুঝাবার জন্য تقدير (তাক্বদীর্) পরিভাষা ব্যবহার করা হয়। তাই আমরা আলোচনার শুরুতেই দেখতে চাই যে, কোরআন মজীদে এ পরিভাষা দুটি ‘ভাগ্যলিপি’ বা ‘ভাগ্যনির্ধারণ’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে কিনা। এ ব্যাপারে অনুসন্ধান থেকে যে জবাব পাওয়া যায় তা না-বাচক।
“ক্বাদর্” শব্দটি একটি ক্রিয়াবিশেষ্য। এ শব্দটি এবং এ থেকে নিষ্পন্ন শব্দাবলী (ক্রিয়াপদ, বিশেষ্য ও বিশেষণ) কোরআন মজীদে মোট একশ’ বত্রিশ বার ব্যবহৃত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সবগুলো শব্দ ও তার ব্যবহার সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে আলোচনা খুবই দীর্ঘায়িত হবে। তাই আমরা এখানে অত্যন্ত সংক্ষেপে বিষয়টির ওপর আলোকপাত করবো।
কোরআন মজীদে “ক্বাদর্” শব্দটি ও তা থেকে সরাসরি নিষ্পন্ন পদসমূহ ‘শক্তি’, ‘মর্যাদা ও মূল্যায়ন’, ‘পরিমাপ করণ’, ‘যথাযথভাবে নির্ধারণ’ ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। স্বয়ং “আল্-ক্বাদর্” শব্দটি কোরআন মজীদের সূরাহ্ আল্-ক্বাদর্-এ তিন বার উল্লিখিত হয়েছে। এ সূরায় শব্দটি তিন বারই “লাইলাতুল্ ক্বাদর্” পরিভাষার অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে যার অর্থ ‘মহিমান্বিত রজনী’।
এ ছাড়া তিনটি সূরায় আল্লাহ্ তা‘আলা প্রসঙ্গে “ক্বাদর্” শব্দটি এবং এতদসহ এ শব্দ থেকে নিষ্পন্ন একটি ক্রিয়াপদ ব্যবহৃত হয়েছে। এরশাদ হয়েছে :
وَمَا قَدَرُوا اللَّـهَ حَقَّ قَدْرِهِ
“আর তারা আল্লাহকে তাঁর যথোপযুক্ত মূল্যায়নে মূল্যায়ন করে নি।” (সূরাহ্ আল্-আন্‘আাম্: ৯১; আল্-হাজ্জ: ৭৪; আয্-যুমার্: ৬৭)
এছাড়া আরো একটি আয়াতে “ক্বাদর্ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এরশাদ হয়েছে:
إِنَّ اللَّهَ بَالِغُ أَمْرِهِ قَدْ جَعَلَ اللَّهُ لِكُلِّ شَيْءٍ قَدْرًا
“অবশ্যই আল্লাহ্ তার (তাক্ব্ওয়া অবলম্বনকারীর) কাজকে পূর্ণতায় উপনীতকারী; বস্তুতঃ আল্লাহ্ প্রতিটি জিনিসের জন্যই “ক্বাদর্” তৈরী করে রেখেছেন।” (সূরাহ্ আত্ব্-ত্বালাক্ব: ৩)
এই শেষোক্ত আয়াত থেকে সুস্পষ্ট যে, এখানে আল্লাহ্ তা‘আলা “ক্বাদর্” শব্দটিকে ‘মূল্যায়ন’ অর্থে ব্যবহার করেছেন। তিনি প্রতিটি জিনিসেরই মূল্যায়ন নির্ধারণ করে রেখেছেন বিধায়ই মুত্তাক্বীর কাজকে পূর্ণতায় উপনীত করে দেবেন।
দেখা যাচ্ছে যে, কোরআন মজীদে “ক্বাদর্” ক্রিয়াবিশেষ্য (مصدر)টি কোথাওই মানুষের ভাগ্যনির্ধারণ অর্থে ব্যবহৃত হয় নি। অনুরূপভাবে এ ক্রিয়াবিশেষ্য থেকে নিষ্পন্ন ক্রিয়াপদগুলোও ভাগ্যনির্ধারণ অর্থে ব্যবহৃত হয় নি। বরং ক্রিয়াপদগুলো ‘মূল্যায়ন করা’, ‘পরিমাপ করা’ (পরিমাণ মতো প্রদান), ‘সক্ষম হওয়া’ ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ, এরশাদ হয়েছে:
اللَّهُ يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ يَشَاءُ وَيَقْدِرُ
“আল্লাহ্ যার জন্য চান রিয্ক্ব প্রশস্ত করে দেন এবং পরিমাপ করে (বা তার পরিমাণ নির্ধারণ করে) দেন।” (সূরাহ্ আর্-রাদ্: ২৬) অর্থাৎ আল্লাহ্ তা‘আলা যাকে চান তার প্রাপ্যের চেয়েও তাকে বেশী রিয্ক্ব প্রদান করেন এবং সে বেশী পরিমাণটা সুনির্দিষ্ট করে দেন। অবশ্য অনেক মুফাসসিরের মতে, এখানে يقدر (পরিমাপ করে দেন) কথাটি যাদেরকে রিয্ক্ব প্রশস্ত করে দেন তাদের ব্যতীত অন্যদের সাথে সম্পর্কিত এবং এ কথাটির মানে হচ্ছে সে প্রকৃতই যা পাবার হক্ব্দার তাকে তা-ই প্রদান করেন অর্থাৎ তার চেষ্টা-সাধনা অনুযায়ী ও প্রাকৃতিক কার্যকারণের আওতায় তার যা প্রাপ্য তিনি তাকে তা-ই প্রদান করেন, বেশী দেন না।
অনেকে এই শেষোক্ত আয়াতে উল্লিখিত يقدر ক্রিয়াপদের অর্থ করেন ‘কমিয়ে দেন’। কিন্তু এ ক্রিয়াপদ থেকে এরূপ অর্থ গ্রহণ করার কোনো আভিধানিক বা ব্যাকরণগত ভিত্তি নেই। এরপরও, এমনকি যুক্তির খাতিরে যদি এ অর্থকে সঠিক বলে মেনে নেয়া হয়, তাহলেও এ থেকে এ ক্রিয়াপদের মূল অর্থাৎ ক্রিয়াবিশেষ্য “ক্বাদর্” শব্দ থেকে ‘ভাগ্য নির্ধারণ’ অর্থ গ্রহণের সুযোগ নেই। কারণ, আল্লাহ্ তা‘আলা যাকে চান তার রিয্ক্ব বৃদ্ধি করে দেন এবং যাকে চান তার রিয্ক্ব কমিয়ে দেন-এ কথার মানে এ নয় যে, তিনি মানুষকে সৃষ্টির সময় তার ভাগ্যে সুনির্দিষ্ট পরিমাণ রিয্ক্ব্ লিখে দিয়েছেন। কারণ, পরম জ্ঞানী আল্লাহ্ তা‘আলা যদি আগেই কোনো কিছু নির্ধারণ করে দিয়ে থাকেন, তো পরে তা বৃদ্ধি বা হ্রাস করার কোনো কারণই নেই। কারণ, স্বীয় নির্ধারিত পরিকল্পনায় পরবর্তীতে পরিবর্তন সাধন অসম্পূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী সত্তার কাজ-যার সিদ্ধান্ত গ্রহণে ত্রুটি ছিলো বিধায়ই সে পরবর্তীতে তাতে পরিবর্তন সাধন করে তা কার্যকর করে। আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে তার প্রাপ্য হতে বাড়িয়ে বা কমিয়ে দেন-এর মানে হচ্ছে তার মূল প্রাপ্য স্বয়ং আল্লাহ্ নির্ধারণ করে দেন নি, বরং তার চেষ্টাসাধনা ও প্রাকৃতিক কার্যকারণের ফলেই তা নির্ধারিত হয়েছিলো, কিন্তু আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে প্রাপ্যের চেয়ে বেশী বা কম দেয়াতেই তার বা সমষ্টির কল্যাণ দেখতে পেয়েছেন বলেই দয়া করে তাকে প্রাপ্যের চেয়ে বেশী বা কম দিয়েছেন।
অনুরূপভাবে “ক্বাদর্” ক্রিয়াবিশেষ্য থেকে নিষ্পন্ন অপর একটি শব্দ (এটিও ক্রিয়াবিশেষ্য) হচ্ছে تقدير (তাক্বদীর্)-যে শব্দটিকে ক্রিয়াবিশেষ্য হিসেবে নয়, বরং সাধারণ বিশেষ্য হিসেবে মানুষের ‘ভাগ্য’ বা ‘ভাগ্যলিপি’ অর্থে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু কোরআন মজীদে কোথাওই এ শব্দটি এ অর্থে ব্যবহৃত হয় নি। যেমন, এ শব্দটি নিম্নোক্ত আয়াতে প্রাকৃতিক বিধান অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে:
وَجَعَلَ اللَّيْلَ سَكَنًا وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ حُسْبَانًا ذَلِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ
“আর তিনি (আল্লাহ্) রাত্রিকে আরামদায়ক এবং সূর্য ও চন্দ্রকে হিসাব স্বরূপ (বর্ষ ও তিথি গণনায় সহায়ক) বানিয়েছেন। এ হচ্ছে মহাপরাক্রান্ত মহাজ্ঞানীর নির্ধারণ (তাঁর নির্ধারিত প্রাকৃতিক বিধান)।” (সূরাহ্ আল্-আন্‘আাম্: ৯৬)
অন্যত্র এরশাদ হয়েছে:
قَوَارِيرَ مِنْ فِضَّةٍ قَدَّرُوهَا تَقْدِيرًا
“তারা রৌপ্যপাত্রকে (তাতে রক্ষিত/ প্রদত্ত পানীয়কে) পরিমাণ করবে (পূর্ণ করবে) ঠিক পরিমাণ করার মতোই (অর্থাৎ ঠিক মতো পূর্ণ করবে; কমও হবে না, উপচেও পড়ব না)।” (সূরাহ্ আদ্-দাহর্: ১৬)
আরো এরশাদ হয়েছে:
وَخَلَقَ كُلَّ شَيْءٍ فَقَدَّرَهُ تَقْدِيرًا
“আর তিনি প্রতিটি জিনিসকে সৃষ্টি করেছেন এবং তার পরিমাণ (নির্ধারণ) করে দিয়েছেন ঠিক পরিমাণ করার মতোই (অর্থাৎ যথাযথভাবে)।” (সূরাহ্ আল্-ফুরক্বান্: ২) নিঃসন্দেহে এখানে পরিমাণ নির্ধারণ বলতে প্রতিটি জিনিসের গঠন-উপাদান সমূহ ও তার অনুপাত বুঝানো হয়েছে।
আল্লাহ্ তা‘আলা আরো এরশাদ করেন:
وَالْقَمَرَ قَدَّرْنَاهُ مَنَازِلَ
“আর আমি চন্দ্রের জন্য মনযিল সমূহ (চন্দ্রকলা বা তিথি সমূহ) নির্ধারণ করে দিয়েছি।” (সূরাহ্ ইয়া-সীন্: ৩৯)
অন্যত্র এরশাদ হয়েছে:
وَأَنْزَلْنَا مِنَ السَّمَاءِ مَاءً بِقَدَرٍ
“আর আমরা আসমান থেকে পানি বর্ষণ করেছি পরিমাণ মতো।” (সূরাহ্ আল্-মু’মিনূন: ১৮)
উপরোক্ত পাঁচটি আয়াতের সবগুলোতেই জড়বস্তু সম্পর্কে কথা বলা হয়েছে, মানুষ বা অন্য কোনো প্রাণশীল সৃষ্টির ভাগ্য নির্ধারণ সম্পর্কে কথা বলা হয় নি। তবে ‘তিনি প্রতিটি জিনিসকে সৃষ্টি করেছেন’ (خلق کل شیء) বলতে যদি মানুষ সহ প্রাণশীল সৃষ্টিদেরকেও অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করা হয় সে ক্ষেত্রেও পরিমাণ নির্ধারণের মানে হবে বিভিন্ন প্রাণীর গঠন-উপাদান ও সে সবের অনুপাত নির্ধারণ করে দেয়া; প্রতিটি প্রাণীপ্রজাতির প্রতিটি সদস্যের সারা জীবনের সব কিছু নির্ধারণ করে দেয়া নয়।
“ক্বাদর্” ক্রিয়াবিশেষ্য থেকে নিষ্পন্ন শব্দাবলী সম্বলিত কোরআন মজীদের সবগুলো আয়াত নিয়ে আলোচনা করলেও কোথাওই এটা পাওয়া যাবে না যে, “মানব প্রজাতিকে সৃষ্টির পূর্বে বা সৃষ্টির সমসময়ে তার ‘ভাগ্যলিপি’ বা ‘ভাগ্য নির্ধারণ’ অর্থে “ক্বাদর্” বা “তাক্বদীর্” অথবা এর কোনোটি থেকে নিষ্পন্ন ক্রিয়াপদ ব্যবহৃত হয়েছে। তেমনি আল্লাহ্ তা‘আলা প্রতি মুহূর্তে প্রতিটি মানুষের প্রতিটি কাজ সম্পাদন করেন বা তার দ্বারা সম্পাদন করিয়ে নেন-এ অর্থেও উপরোক্ত শব্দ বা তা থেকে নিষ্পন্ন শব্দাবলীর কোনোটি ব্যবহৃত হয় নি।
অদৃষ্টবাদের প্রকারভেদ
অদৃষ্টবাদে বিশ্বাস কেবল মুসলমানদের মধ্যেই প্রচলিত নয়, অমুসলমানদের মধ্যেও প্রচলিত আছে। বিভিন্ন চিন্তাধারা ও মতের অনুসারীদের অদৃষ্টবাদী চিন্তা ও বিশ্বাসের মধ্যে বিভিন্নতা রয়েছে। তবে মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত অদৃষ্টবাদী চিন্তা ও বিশ্বাসকে সংক্ষেপে চার প্রকরণে বিন্যস্ত করা যেতে পারে।
এক ধরনের অদৃষ্টবাদী চিন্তা ও বিশ্বাস অনুযায়ী আল্লাহ্ তা‘আলা সৃষ্টিকর্মের সূচনার পূর্বেই নির্ধারণ করে রেখেছেন অনন্ত কাল পর্যন্ত এ বিশ্বলোকে কী কী ঘটনা সংঘটিত হবে এবং মানুষ সহ প্রাণীকুলের প্রত্যেকে কী কী করবে; কোনো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ঘটনা এবং কোনো প্রাণশীল সৃষ্টির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কর্মও এর বাইরে নয়।
দ্বিতীয় প্রকারের অদৃষ্টবাদ অনুযায়ী আল্লাহ্ তা‘আলা প্রতি মুহূর্তের ছোটো-বড় প্রতিটি ঘটনাই সরাসরি সংঘটিত করাচ্ছেন এবং তিনি যখন যা কিছু ইচ্ছা করছেন তখন তা-ই সংঘটিত হচ্ছে।
তৃতীয় ধরনের অদৃষ্টবাদ অনুযায়ী আল্লাহ্ তা‘আলা মাঝে মাঝে সৃষ্টিকুলের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেন। যেমন: প্রতি বছর শবে বরাতের রাতে তিনি প্রত্যেকের জন্য তার পরবর্তী এক বছরের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেন যা পরবর্তী শবে কদর থেকে কার্যকর করা হয়। এটা অনেকটা বার্ষিক রাষ্ট্রীয় বাজেটের ন্যায়।
চতুর্থ ধরনের অদৃষ্টবাদ অনুযায়ী, প্রতিটি প্রাণী, বিশেষতঃ মানুষ মাতৃগর্ভে আসার কয়েক দিন পর প্রাথমিক ভ্রূণ থাকাকালে আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে তার আয়ু, সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্য ও বেহেশতী বা দোযখী হওয়া সহ তার ভবিষ্যত সারা জীবনের সকল কাজকর্ম ও অবস্থা লিপিবদ্ধ করে দেয়া হয়-যার কিছুতেই অন্যথা হয় না।
কিন্তু এ চার ধরনের অদৃষ্টবাদের মধ্যে পারস্পরিক বৈপরীত্য থাকলেও বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এই যে, অধিকাংশ মুসলমানই একই সাথে এ চার ধরনের বিশ্বাস পোষণেরই দাবী করে থাকে। তারা এ ব্যাপারে সচেতন নয় যে, তাদের বিশ্বাসের মধ্যে স্ববিরোধিতা রয়েছে এবং একই সাথে তাদের আচরণ ও দাবীকৃত এ সবগুলো বিশ্বাসের মধ্যেও পারস্পরিক বৈপরীত্য রয়েছে। তবে বিভিন্ন ধরনের অদৃষ্টবাদের মধ্যে যে বিষয়টি অভিন্ন তা হচ্ছে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতায় বিশ্বাসহীনতা।
উপরোক্ত সবগুলো অদৃষ্টবাদী বিশ্বাস অনুযায়ীই যা কিছু হচ্ছে তার সবই স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলা করছেন বা করাচ্ছেন; মানুষ নিমিত্তের ভাগী মাত্র। মানুষ নিজে কিছুই করে না এবং করার ক্ষমতাও রাখে না; তাকে দিয়ে করানো হয়। তাকে দিয়ে যা করানো হয় সে তা-ই করে; সে তা-ই করতে বাধ্য।
অদৃষ্টবাদীদের মতে, এমনকি কে বেহেশতে যাবে ও কে দোযখে যাবে তা-ও আল্লাহ্ তা‘আলা সৃষ্টিকর্মের সূচনার পূর্বে অথবা প্রাণীর ভ্রূণের প্রাথমিক অবস্থায় নির্ধারণ করে রেখেছেন। আবার এ ধরনের বিশ্বাসও আছে যে, পূর্বনির্ধারণ বা কর্মফল বলতে কিছু নেই, বরং তিনি তাঁর নিঃশর্ত অধিকারের বদৌলতে যাকে ইচ্ছা বেহেশতে নেবেন, যাকে ইচ্ছা দোযখে নিক্ষেপ করবেন।
আবার কতক অদৃষ্টবাদীর মতে, বিষয়টি এমন নয় যে, যে ব্যক্তি ভালো কাজ করবে আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে দোযখে নেবেন এবং যে মন্দ কাজ করবে তিনি তাকে বেহেশতে নেবেন, বরং তিনি যাকে বেহেশতে নিতে চান তাকে ভালো কাজের তথা বেহেশতে যাবার উপযোগী কাজের সুযোগ দেন এবং যাকে তিনি দোযখে নিতে চান সে মন্দ কাজ তথা দোযখে যাবার উপযোগী কাজের সুযোগ পায়।
মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি একটি অনস্বীকার্য সর্বজনস্বীকৃত বিষয়। কিন্তু এ সম্বন্ধে অদৃষ্টবাদীদের বক্তব্য এই যে, আল্লাহ্ তা‘আলা যাকে দিয়ে ভালো কাজ করাবার ইচ্ছা করেন বা যার জন্য তার সৃষ্টির পূর্বেই ভালো কাজ নির্ধারণ করে রেখেছেন সে-ই ভালো কাজের ইচ্ছা করবে এবং স্বেচ্ছায় ভালো কাজ করবে, অন্যদিকে তিনি যাকে দিয়ে মন্দ কাজ করাবার ইচ্ছা করেন বা যার জন্য তার সৃষ্টির পূর্বেই মন্দ কাজ নির্ধারণ করে রেখেছেন সে অবশ্যই মন্দ কাজের ইচ্ছা করবে এবং স্বেচ্ছায় মন্দ কাজ সম্পাদন করবে। অর্থাৎ তাদের মতে, আল্লাহ্ তা‘আলা মানুষকে দিয়ে ভালো কাজ ও মন্দ কাজ তথা বেহেশতে যাবার উপযোগী কাজ ও দোযখে যাবার উপযোগী কাজ করিয়ে নেন। অতএব, তাদের মত মেনে নিলে এটাই মেনে নিতে হয় যে, মানুষ যে শিরক্ করে, যুলুম-অত্যাচার করে, চুরি-ডাকাতি করে, এমনকি ব্যভিচারে লিপ্ত হয়, এ সব কাজ আল্লাহ্ই মানুষকে দিয়ে করিয়ে নেন। (সুব্হানাল্লাহে ‘আম্মা ইয়াছেফূন্-তারা আল্লাহর ওপর যে বৈশিষ্ট্য আরোপ করছে তা থেকে তিনি পরম প্রমুক্ত।)
ইতিপূর্বে যেমন আভাস দেয়া হয়েছে, অদৃষ্টবাদীদের কতকের মধ্যে এ ধরনের বিশ্বাসও প্রচলিত আছে যে, আল্লাহ্ তা‘আলা যেহেতু যা ইচ্ছা তা-ই করেন এবং যা ইচ্ছা তা-ই করার নিরঙ্কুশ অধিকার রাখেন সেহেতু তিনি তাঁর ক্ষমতা ও অধিকার প্রমাণ করার জন্যে শেষ বিচারের দিনে কতক নেককার লোককে দোযখে নিক্ষেপ করবেন এবং কতক পাপী লোককে বেহেশতে পাঠাবেন।
বস্তুতঃ অদৃষ্টবাদীদের এসব বিশ্বাস হচ্ছে ভিত্তিহীন অন্ধ বিশ্বাস-যা সুস্থ বিচারবুদ্ধির অকাট্য রায় ও কোরআন মজীদের সুস্পষ্ট ঘোষণার পরিপন্থী।
অদৃষ্টবাদী চিন্তাধারার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
স্বাভাবিকভাবেই মানুষের বিচারবুদ্ধি যা অনুভব ও লক্ষ্য করে তা হচ্ছে এই যে, সে ইচ্ছাশক্তি ও কর্মশক্তির অধিকারী একটি স্বাধীন প্রাণী। যদিও সে পুরোপুরি স্বাধীন নয়; তার কর্মের স্বাধীনতা বহু পার্থিব ও অপার্থিব উপাদানের দ্বারা বহুলাংশে নিয়ন্ত্রিত ও সীমাবদ্ধ, তবে সে স্বাধীনতাবিহীন যন্ত্রতুল্য নয়। কিন্তু মানবজাতির ইতিহাসে সব সময়ই যালেম-শোষক ও স্বৈরাচারী শ্রেণী সাধারণ মানুষকে তাদের অধিকার আদায়ের প্রচেষ্টা থেকে বিরত রাখার জন্য অদৃষ্টবাদী চিন্তাধারা ও ধ্যানধারণা প্রচার করেছে যা তারা নিজেরাই বিশ্বাস করতো না।
তারা নিজেরা কিন্তু মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতায় বিশ্বাস করতো। এ কারণে তারা কখনোই হাত-পা ছেড়ে দিয়ে বসে থাকতো না। বরং তারা সব সময়ই অত্যন্ত কর্মতৎপর থাকতো। নিজেদের বৈধ-অবৈধ স্বার্থ হাসিল ও সংরক্ষণ, অন্যদের বৈধ অধিকারের বিনাশ সাধন এবং অন্যায় বিরোধী যে কোনো চেষ্টা-সংগ্রামকে প্রতিরোধে, বরং টুটি টিপে হত্যা করার কাজে তারা খুবই সক্রিয় থাকতো। তবে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতায় তাদের সে বিশ্বাস ছিলো সৃষ্টিকর্তার নিকট জবাবদিহিতার অনুভূতি শূন্য। এমনকি তাদের অধিকাংশই ছিলো এক ও অদ্বিতীয় সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব ও পরকালীন জীবন সম্বন্ধে উদাসীন। অর্থাৎ আদৌ কোনো সৃষ্টিকর্তা আছেন কি নেই; থাকলে এক, নাকি একাধিক-কোনটি হওয়া সম্ভব এবং মৃত্যুর পরে অন্য কোনো জীবন আছে কি নেই, থাকলে সে জীবনে বর্তমান জীবনের জন্য জবাবদিহি করতে হবে কিনা-এ সম্বন্ধে চিন্তা-ভাবনা ও বিচার-বিশ্লেষণ করতে এবং বিচারবুদ্ধি (‘আক্বল্)-এর আলোকে কোনো চূড়ান্ত ফয়সালায় উপনীত হতে তারা মোটেই প্রস্তুত ছিলো না।
অবশ্য তাদের পক্ষে অতিপ্রাকৃতিক শক্তির অস্তিত্ব পুরোপুরি অস্বীকার করা বা মানুষকে তা অস্বীকার করতে বাধ্য করানো সম্ভব ছিলো না। তাছাড়া সাধারণ মানুষকে অদৃষ্টবাদে বিশ্বাসী করে তোলা তাদের কায়েমী স্বার্থের জন্য অপরিহার্য ছিলো এবং অতিপ্রাকৃতিক শক্তির অস্তিত্বের অস্বীকৃতি জনসাধারণকে অদৃষ্টবাদে বিশ্বাসী রাখার জন্য অনুকূল হতো না। তাই তারা (শাসকগোষ্ঠী-যারা ধনসম্পদেরও একচ্ছত্র মালিক ছিলো) স্বার্থান্বেষী দুনিয়াপূজারী যাজক-পুরোহিতদের সহায়তায় কল্পিত দেবদেবীর অস্তিত্ব প্রচার করে এবং তাদেরকেই মানুষের ভাগ্যনিয়ন্তা বলে দাবী করে।
তাদের প্রচারিত এ ধরনের চিন্তা-বিশ্বাসে আদি স্রষ্টার বিষয়টি হয় অনুপস্থিত থাকতো, নয়তো তাঁর অস্তিত্ব স্বীকার করে হলেও মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের সর্বময় ক্ষমতা তাঁর জন্য কল্পিত সন্তান-সন্ততিরূপ দেব-দেবীর বলে দাবী করা হতো। অন্যদিকে শাসকগোষ্ঠী প্রায়শঃই নিজেদেরকে তাদের কল্পিত তথাকথিত মহাশক্তিধর কোনো না কোনো দেবদেবীর বংশধর বলে দাবী করতো এবং আত্মবিক্রিত যাজক-পুরোহিতরা তাদের এ দাবীকে সত্য বলে প্রচার করতো। তারা দাবী করতো যে, দেব-দেবীদের অনুগ্রহেই তাদের বংশধর শাসকগোষ্ঠী শক্তি-ক্ষমতা ও ধনসম্পদের অধিকারী হয়েছে এবং দেব-দেবীদের ইচ্ছায়ই সাধারণ মানুষ তাদের অধীনস্থ দাস ও প্রজা হয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। অতএব, এটাই তাদের ভাগ্যলিপি; এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে দেব-দেবীদের আক্রোশের শিকার হয়ে তারা ধ্বংস হয়ে যাবে।
শাসকগোষ্ঠী স্বয়ং অদৃষ্টবাদে বিশ্বাস করতো না বলেই স্বীয় শক্তি-ক্ষমতা রক্ষা ও সম্প্রসারণের জন্য ভাগ্যের বা কল্পিত দেব-দেবীর অলৌকিক ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে বসে থাকতো না, বরং নিজেরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করতো। তারা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের রাজত্ব দখল করার বা তাদের আক্রমণ থেকে স্বীয় রাজত্ব রক্ষা করার চেষ্টা করতো। কিন্তু সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে তাদের ওপর নির্বিঘ্নে শাসনকার্য চালাবার লক্ষ্যে তারা বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠীকে বিভিন্ন দেব-দেবীর বংশধর বলে এবং স্বীয় কুলদেবতাকে অন্যান্য শাসকগোষ্ঠীর কুলদেবতার চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী বলে দাবী করতো। আর যুদ্ধে বিজয়ী পক্ষ সাধারণ জনগণকে এটাই বিশ্বাস করাতো যে, তাদের কুলদেবতা অধিকতর শক্তিশালী বিধায়ই তারা বিজয়ী হতে পেরেছে।
এর পাশাপাশি নাস্তিক লোকেরা মানুষকে নিরঙ্কুশ ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীন কর্মক্ষমতার অধিকারী বলে দাবী করতো। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা ও পরকালীন জীবনের অস্তিত্বে অবিশ্বাসের কারণে তাদের এ চিন্তাধারার পরিণতি জীবনকে উদ্দেশ্যহীন ও অর্থহীন গণ্যকরণ এবং হতাশাবাদ ছাড়া আর কিছুই ছিলো না এবং নয়।
কিন্তু যুগে যুগে নবী-রাসূলগণ (‘আঃ) আবির্ভূত হয়ে এ উভয় প্রান্তিক মতের অসারতা তুলে ধরেন এবং মানুষের সামনে এ ব্যাপারে ভারসাম্যপূর্ণ সঠিক ধারণা উপস্থাপন করেন-যা সুস্থ বিচারবুদ্ধির কাছেও গ্রহণযোগ্য। তাঁরা মানুষকে নিয়তির হাতের অসহায় পুতুল বলে গণ্য করেন নি, বরং স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীন কর্মক্ষমতার অধিকারী বলে গণ্য করেছেন এবং তাদেরকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সঠিক কর্ম সম্পাদনের জন্য আহবান জানিয়েছেন। তাঁরা লোকদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, (যেহেতু তারা স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও কর্ম সম্পাদনের এখতিয়ারের অধিকারী সেহেতু) তাদেরকে স্বীয় চিন্তা, কথা ও আচরণের হিসাব দিতে হবে।
তবে নবী-রাসূলগণ (আঃ) সেই সাথে তাদেরকে এ-ও জানিয়ে দিয়েছেন যে, মানুষ ও বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা তাঁর সৃষ্ট মানুষ ও এ বিশ্বজগতের ব্যাপারে উদাসীন নন। তিনি এ সব কিছুকে অর্থহীনভাবে খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করেন নি। তাই তিনি সব কিছুর প্রতি এমনভাবে দৃষ্টি রাখছেন যাতে তাঁর সৃষ্টির লক্ষ্য অবশ্যই বাস্তবায়িত হয়; মানুষ বা অন্য কোনো সৃষ্টি স্বীয় স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও কর্মের এখতিয়ারের অপব্যবহার করে সৃষ্টির লক্ষ্য বাস্তবায়ন ব্যাহত করতে উদ্যত হলে কিছুতেই তিনি তাদেরকে সে সুযোগ দেবেন না। একইভাবে তিনি ব্যক্তিমানুষদের ব্যাপারেও অমনোযোগী নন।