হিজরী ৮ রবিউস সানি মুসলিম বিশ্বের জন্যে একটি আনন্দের দিন। কেননা ২৩২ হিজরির এই দিনে পবিত্র এক শিশুর জন্মের সুসংবাদ পুরো মদিনা শহরে আনন্দের আমেজ ছড়িয়ে দিয়েছিল। তিনি আর কেউ নেন। ইমাম হাদি (আ) এর সন্তান ইমাম হাসান আসকারি (আ)। আহলে বাইতের সম্মানিত ইমামদের জন্মদিন সবার জন্যেই আনন্দের এবং খুশির বার্তা বয়ে নিয়ে আসে। কেননা তাঁদের চিন্তাদর্শন, তাঁদের চারিত্র্যিক সুষমা, তাঁদের আধ্যাত্মিক মহিমা সমগ্র মানব জাতির জন্যেই কল্যাণবহ। তাঁরই হলেন সত্য ও ন্যায়ের পতাকাবাহী, নৈতিকতা ও চারিত্র্যিক মাধুর্যের অনন্য নিদর্শন।
নবীজীর আহলে বাইতের জ্ঞান-গরিমা সবসময়ই অনুসরণীয়। মানবজাতি তাদের জীবনপ্রবাহের যে-কোনো ক্রান্তিলগ্নেই ইমামদের জ্ঞানের পবিত্র আলোয় নিজেদেরকে আলোকিত করতে পারে। ইমামগণ মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁদের জীবনাদর্শ তাই আজো বিশ্বমানবতার পথপ্রদর্শক।
ইমাম হাসান আসকারী (আ) তাঁর ২৮ বছরের সংক্ষিপ্ত অথচ সমৃদ্ধ জীবনে পৃথিবীবাসীর জন্যে রেখে গেছেন অমূল্য সব অবদান। ছোটবেলায় পিতা ইমাম হাদি (আ) এর সাথে তিনি মদিনা ত্যাগ করতে বাধ্য হন। জীবনের বেশিরভাগ সময়ই তিনি ইরাকের সামেরায় আব্বাসীয় সেনাদের নজরদারিতে কাটান। তারপরও তাঁর অনুসারীদের কাছ থেকে তাঁকে আলাদা করা যায় নি। তিনি সবসময় জনগণকে আল্লাহর পথে ডেকেছেন এবং বিপথগামিতা বা গোমরাহীর পথ থেকে মানুষকে বিরত রেখেছেন। ইমাম সবসময় তাঁর অনুসারীদেরকে সৎ চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং অসৎ চিন্তা পরিহার করার প্রেরণা জুগিয়েছেন।
ইমাম হাসান আসকারি (আ) তাঁর ৬ বছরের ইমামতির মেয়াদকালে ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিস্তারে ব্যাপক অবদান রেখেছেন। একদিকে তিনি অসংখ্য মেধাবি ছাত্র তৈরি করে গেছেন এবং অপরদিকে ইসলামী সমাজকে যেসব ভ্রান্ত মতবাদ অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো দূরদর্শী চিন্তার মাধ্যমে তিনি সেসব মোকাবেলা করেছেন। কোরআনের জীবন ঘনিষ্ট তাফসিরের মাধ্যমে এবং ইসলামের নীতি-নৈতিকতা ও বিশ্বাসগত মূল্যবোধের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর ব্যাপক খেদমত করে গেছেন। ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার আসর করে, ছাত্রদের যথার্থ প্রশিক্ষণ দিয়ে ইমাম হাসান আসকারি (আ) আব্বাসীয় অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মৌলিক ভিত রচনা করেন। তিনি একটি বিষয় স্পষ্ট করে বলতেন তাহলো অন্যায় ও অত্যাচারী শাসন ব্যবস্থা একটি সমাজে মানব মুক্তির সনদ ধর্মের যথাযথ বাস্তবায়নের অন্তরায়। তাছাড়া দুর্নীতিগ্রস্ত শাসনে জনগণের অধিকার ব্যাপকভাবে ভূলুণ্ঠিত হয়।
ইমাম হাসান আসকারীর ইমামতিকালে আব্বাসীয় খলিফাদের বেশ কয়েকজন শাসক মুসলমানদের ওপর শাসন করেছে। কিন্তু কেউই ইমামের সত্যতার মর্যাদা না দিয়ে বরং তাঁকে উপেক্ষা করেছে। কেবল উপেক্ষাই করে নি বরং তাঁকে অনেক কষ্টও দিয়েছে। আব্বাসীয় শাসকদের মধ্যে ইমামকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছে মু'তামেদ। মু'তামেদ ইমামকে এবং ইমামের অনুসারীদের অনেককেই কারাগারে আবদ্ধ রেখেছে। কারণটা হলো মু'তামেদ ছিল খুবই ক্ষমতালিপ্সু। সে জানতো ইমাম হাসান আসকারি (আ) যদি স্বাধীনভাবে জনগণকে শিক্ষা-দীক্ষায় সচেতন করে তোলার সুযোগ পান তাহলে আজ হোক কাল হোক তাঁর অনুসারীরা তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেই ছাড়বে। অন্যদিকে নবীজীর একটি বাণী আব্বাসীদের শাসকদের কানে পৌঁছেছিল,তাহলো ইমাম হাসান আসকারি (আ) এমন এক সন্তানের অধিকারী হবেন, যেই সন্তান সারাবিশ্ব থেকেই অত্যাচারী শাসনের অবসান ঘটাবেন।
সেজন্যে ইমাম হাসান আসকারি (আ)'র ওপর কড়া নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। শুধু তাই নয় যেই কারাগারে তাঁকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল সেই কারারক্ষী এবং তার সহযোগিরা ছিল নির্দয় পাথরের মতো নিষ্ঠুর মনের অধিকারী। কিন্তু ইমাম তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ব্যবহার ও আচার-আচরণের সাহায্যে সেই পাথর-হৃদয় কারা কর্তৃপক্ষের মনে নির্মলতার সুশীতল ঝর্ণাধারা বইয়ে দিলেন। তারা অচিরেই সদয় ও সহৃদয় হয়ে উঠলো। তারপর তারা তাদের পূর্বেকার নির্দয় আচরণের জন্যে লজ্জাবোধ করলো। পবিত্র আহলে বাইতের সম্মানিত ইমামগণের সান্নিধ্যটাই ছিল এরকম প্রভাব বিস্তারকারী। পূর্ণিমার চাঁদের জ্যোৎনায় চারদিক যেমন নির্মলতায় ভরে যায় তেমনি ইমামগণের পবিত্র সাহচর্যে কঠিন হৃদয়ও হয়ে যেত অনাবিল সুন্দর, কোমল।
ইমাম হাসান আসকারি (আ) ছিলেন দান-সদকার ক্ষেত্রে উদারহস্ত। জনগণের সাহায্যে তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। যে-কোনোভাবেই হোক জনগণের কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারলে তিনি আত্মতৃপ্তি বোধ করতেন। বহু মানুষ তাঁর কাছ থেকে উপকৃত হয়েছে। আবু ইউসুফ নামে আব্বাসীয়দের রাজদরবারের একজন কবি ছিলেন। তিনি নিজ থেকে বর্ণনা করেছেন-আমি একটি সন্তানের পিতা হয়েছিলাম। কিন্তু আমার দিনকাল খুব একটা ভালো কাটছিল না। অভাব-অনটনের মধ্যে ছিলাম। এতোই অভাবী ছিলাম যে নিরুপায় হয়ে শাসকদের উচ্চ পদস্থদের অনেকের কাছেই আমার সমস্যার কথা জানিয়ে চিঠি লিখেছিলাম। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপারটি হলো কেউই আমার সাহায্যে এগিয়ে আসে নি। তাদের কাছ থেকে বিমুখ হয়ে হতাশ বনে গেলাম। হঠাৎ মনে পড়লো ইমাম হাসান আসকারি (আ) এর কথা। মনে পড়তেই আমি তাঁর দরোজায় গিয়ে হাজির হলাম। দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলাম আদৌ ইমামের কাছে আমার সমস্যাটার কথা বলবো কি বলবো না। কারণ আমি তো আব্বাসীয় শাসকের দরবারের একজন কবি ছিলাম কিছুসময়। এ কারণে ভয় পাচ্ছিলাম যে ইমাম আমাকে হয়তো সাহায্য নাও করতে পারেন। এরকম একটা অস্থিরতা নিয়ে ইমামের ঘরের আশেপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিলাম। এক পর্যায়ে সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেললাম এবং ইমামের ঘরের দরোজায় টোকা দিলাম। টোকা দিতে না দিতেই দরোজা খুলে গেল এবং ইমাম হাসান আসকারি (আ) এর সঙ্গীদের একজন টাকার একটি ব্যাগ নিয়ে বাইরে এসে আমাকে বললো-এই চার শ' দেরহাম নাও! ইমাম তোমাকে বলেছেন,তুমি যেন তোমার নবজাতক শিশুটির জন্যে এই টাকাটা খরচ করো! আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই শিশুর মধ্যে তোমার জন্যে কল্যাণ ও বরকত রেখেছেন।' এই ঘটনায় আমি হতবাক হয়ে গেলাম। টাকার ব্যাগটা নিয়ে আমি এরকম একজন মানুষের অস্তিত্বের জন্যে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলাম।
ইবাদাত-বন্দেগির ক্ষেত্রে ইমাম হাসান আসকারি (আ) ছিলেন অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত। ইমামের একজন সাথী ছিলেন আবু হাশেম জাফারি নামে। তিনি বলেছেন, যখন নামাযের সময় হতো,ইমাম তখন সকল কাজকর্ম বন্ধ করে দিতেন। নামাযের ওপর অন্য কোনো কিছুকেই অগ্রাধিকার দিতেন না। নামাযের ক্ষেত্রে ইমাম ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী। একমাত্র আল্লাহর কাছেই নিজের সকল অভাব-অভিযোগের কথা বলার উপদেশ দিতেন ইমাম। অন্যের কাছে অভাবের কথা বলে বেড়ালে ব্যক্তিত্বের হানি ঘটে। তাই তিনি অভাব অনটনে জনগণকে ধৈর্য ধারণ করার উপদেশ দিতেন। তিনি বলেছেন, যতোক্ষণ পর্যন্ত পারো ধৈর্য ধরো, সহ্য করো! কারো দ্বারস্থ হয়ো না! কেননা প্রতিদিনের জন্যেই নতুন করে রিযিকের ব্যবস্থা হয়। জেনে রাখো চাহিদা মেটানোর জন্যে পীড়াপীড়ি করলে মানবীয় মূল্যবোধ এবং ব্যক্তিত্ব নষ্ট হয়। তাই ধৈর্যধারণ করো যতোক্ষণ না আল্লাহ তোমার জন্যে দ্বার উন্মুক্ত না করেন। আল্লাহর নিয়ামতের প্রত্যেকটারই নির্দিষ্ট সময় আছে। তাই যে ফলটি এখনো পাকে নি,তাড়াহুড়ো করো না,সময়মতো সে ঠিকই পাকবে।'
ইমামের এই বাণী থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। আমরা যতোই ইবাদাত করি এবং আল্লাহর দরবারে বিভিন্ন সাহায্য প্রার্থনা করি, সেসবের ব্যাপারে হতাশ হবার কিছু নেই। আমরা অনেক সময় আল্লাহর কাছে চেয়ে পেলাম না বলে মনে মনে হতাশ হই, রুষ্ট হই। এটা ঠিক নয়। বরং আল্লাহর কাছে মুনাজাত দিয়ে ধৈর্য ধারণ করুন। সময়মতো আল্লাহ নিশ্চয়ই প্রতিদান দেবেন। কখন কোথায় কীভাবে দেবেন-যদিও আমরা সে ব্যাপারে কিছুই জানি না।