পাকিস্তানের চিলাস অঞ্চলের শিয়াদের গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী বালতিস্তানি যুবক আলী রেজা। উক্ত ঘটনা হতে তিনি প্রাণে বেঁচে যান এবং মর্মান্তিক ঐ ঘটনার বর্ণনা তিনি এভাবে দিয়েছেন।
আহলে বাইত (আ.) বার্ত সংস্থা আবনার রিপোর্ট : “শত শত ব্যক্তি হিংস্র পশুদের ন্যায় অসহায় ও নিরাপরাধ শিয়াদেরকে হত্যা করার পর তাদের লাশের উপর এমনভাবে আঘাত করেছে যাতে তাদেরকে সনাক্ত করা না যায়।
এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় তারিখে ‘স্কার্দূ’র (ইসলামাবাদ থেকে ৮০০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত) বাসে চড়লাম। কুহিস্তানের সড়কে পৌঁছানোর পূর্বে নিরাপত্তার খাতিরে বাসগুলো একত্রে ও কাফেলা আকারে অগ্রসর হচ্ছিল। যেহেতু গত মাসে কুহিস্তান অঞ্চলে শিয়ারা যে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিল তা এই পথেই ঘটেছিল। নিরাপত্তা জনিত কারণে বাসগুলো কাফেলা আকারে অগ্রসর হলেও আমি অনুভব করছিলাম যে, কোন দূঘর্টনা ঘটতে যাচ্ছে। আমার এ সফর সম্পর্কে আমার পরিবারকে আমি কিছুই জানায়নি, শুধুমাত্র রাওয়ালপিণ্ডির আমার এক আত্মীয়কে আমার স্কার্দূ যাওয়ার কথা জানিয়েছিলাম। যাতে কোন দূর্ঘটনা না ঘটে সে জন্য আমি দোয়া করছিলাম। আমি চিন্তা করছিলাম যদি শিয়া যাত্রীদের উপর হামলা চালানো হয় তবে নিরব বসে থাকবো না এবং এক সন্ত্রাসী’র অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাদের উপর আক্রমন করবো এবং শেষ নিঃশ্বাস অবধি তাদের সাথে যুদ্ধ করবো।
যখন আমাদের বাস চিলাস নামক স্থানে পৌঁছালো তখন শত শত লোক ‘কারাকুরুম হাইওয়ে’তে ব্যারিকেড দিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দেয় এবং সকল যাত্রীকে বাস থেকে নামিয়ে তাদের মধ্য হতে শিয়া যাত্রীদেরকে চিহ্নিত করে তাদেরকে আলাদা করতে শুরু করলো।
আমি ভয় পেয়ে বাসের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালাম, স্থানীয় পুলিশ ও শত শত লোকের সমাগম দেখে নিশ্চিত হলাম যে, আমরা নিরাপদ। ততক্ষণে শত শত লোক আমাদের বাসকে চারপাশে ঘিরে ধরেছে, তারা পাথর দিয়ে আমাদের বাসের মূল গেইট ভেঙ্গে ফেললো। আমাদের সাথে থাকা নারীরা চিত্কার করে কাঁদতে শুরু করলো। সন্ত্রাসীদের কয়েকজন চিত্কার করে সকল যাত্রীদেরকে এক এক করে বাস হতে নামার নির্দেশ দিল। বাসের প্রথম যাত্রী বাস হতে নামার সাথে সাথে অদ্ভূত এক শব্দ আমার কানে এলো, কিন্তু আমি তা বুঝতে পারলাম না যে, সেটা কিসের শব্দ ছিল।
দ্বিতীয় ব্যক্তি বাস থেকে নামার সাথে সাথে তার পরিচয় পত্র চাইলো সন্ত্রাসীরা। এ সময় শত শত লোক ‘কাফের কাফের, শিয়া কাফের’ শ্লোগান দিচ্ছিল। সকল যাত্রী কম্পিত পায়ে মহান আল্লাহর নাম স্মরণ করতে করতে বাস হতে নামছিল। এবার আমার নামার পালা, আমি বাসের ভিতরে থাকা একটি বাচ্চাকে কোলে তুলে নিয়ে তার মা’কে বললাম ইনশা আল্লাহ তার কিছু হবে না। বাস থেকে নেমে দেখলাম অস্ত্রধারী লম্বা দাঁড়ীর অধিকারী’র কিছু লোক বাসের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তারা আমার কাছে আমার পরিচয় পত্র চাইলো। আমার পরিচয় পত্র ছিল না, তাই তারা আমার জামা উঁচু করে আমার কোমরের উপরের অংশ পরীক্ষা করলো যে, আমার পিঠে কোন জঞ্জিরের চিহ্ন আছে কি না। যেহেতু আমি ইতিপূর্বে কখনই জঞ্জীর মারিনি তাই আমার পিঠে কোন চিহ্ন না পেয়ে তারা আমাকে ছেড়ে দিল।
কয়েক পা এগিয়ে দেখতে পেলাম যে, ২৫ জনকে শহীদ করা হয়েছে এবং নিথর দেহগুলোকে পদদলিত করা হচ্ছে নির্দয়ভাবে। তারা অন্যান্য বাসের যাত্রীদের সাথেও একই ধরণের আচরণ করছে। একজন নারী ও একজন পুরুষকে দেখলাম; হয়তবা স্বামী-স্ত্রী বা ভাই বোন হবে, কিন্তু তাদের মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে, তারা গিলগীত শহরের অধিবাসী।
সন্ত্রাসীরা ঐ পুরুষ লোকটিকে হত্যার জন্য নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল, আর নারীটি লোকটির হাত ধরে রেখেছিল এবং তাকে নিয়ে যাওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করে তাকে পরিত্রাণ দেওয়ার চেষ্টা করছিল। সন্ত্রাসীদের একজন ঐ নারীর সামনেই ঐ পুরুষ লোকটিকে গুলি করে হত্যা করলো।
আমি হয়তবা ঐ নারী’র ব্যাথ্যা অনুভব করতে পারবো না। ঐ সময় আমার মন চাইছিলো খালি হাতেই সন্ত্রাসীদের উপর আক্রমন করি, কিন্তু একা কোন কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমি ঐ দৃশ্য দেখার পর সহ্য করতে না পেরে অন্যত্র সরে গেলাম। সেখানে দেখলাম যে, এক বালতিস্তানীকে সন্ত্রাসীরা বাস থেকে নামিয়ে লাঠি, ভারী পাথর, ছুরি ও তলোয়ার দিয়ে আঘাত করছে। সন্ত্রাসীদের চারিদিক থেকে হামলায় ঐ ব্যক্তির সমস্ত শরীর মুহূর্তেই রক্তে জর্জরিত হয়ে যায় এবং লোকটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, আমার পক্ষে ঐ দৃশ্য আর দেখা সম্ভব ছিল না। তবে মনে আছে শেষ মুহূর্তে শুনতে পেলাম লোকটি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সময় বলছে ‘লাব্বাইক ইয়া হুসাইন’।
এ সময় এক সন্ত্রাসী একটি পাথর দিয়ে লোকটির মুখে সজোরে আঘাত করলো, আর এ আঘাতেই তার শব্দ বন্ধ হয়ে গেল, তার মুখমণ্ডল চেনার উপায় ছিল না।
আমি চিলাস ট্রাজেডির সাক্ষী, দেখলাম যে, কয়েকজন সন্ত্রাসী শহীদদের লাশ ‘সিন্ধু’ নদীর নিকটে নিয়ে পাহাড়ের উপর থেকে তাদের লাশ নদীতে নিক্ষেপ করছে। তারা শিয়াদেরকে, শিয়া হওয়ার কারণে এবং মহানবী (স.) এর আহলে বাইত (আ.) এর প্রতি ভালবাসার কারণে হত্যা করছিল।
যার কাছে লাঠি ছিল সে লাঠি দিয়ে, যার কাছু ছুরি ছিল সে ছুরি দিয়ে আঘাত করছিল, যার কাছে অস্ত্র ছিল সে তা দিয়ে গুলি ছুড়ছিল, আর যার কাছে কিছুই ছিল না সে পাথর দিয়ে অসহায় শিয়াদের মাথায় আঘাত হানছিল। বোনের উপস্থিতিতে ভাইকে, স্ত্রী’র উপস্থিতিতে স্বামীকে, পিতার সামনে পুত্রকে শহীদ করা হচ্ছিল। এমন একটি মর্মান্তিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল যে, তা পাহাড়কেও প্রকম্পিত করতে সক্ষম ছিল এবং মানবতাও এর সম্মুখে মাথা নুয়েছিল। ঐ গোলোযোগের মধ্যে দেখলাম এক যুবক সন্ত্রাসীদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। সে খালি হাতে কয়েকজন সন্ত্রাসীকে আহত করলো এবং যতক্ষণ তার শরীরে শক্তি ছিল ততক্ষণ সে নিজেকে শত্রুদের নিকট সমার্পন করেনি, কিন্তু এমন একটি সময় এল যখন সে মাটিতে পড়ে গেল এবং সন্ত্রাসী’রা তাকে ধরে নদীর ধারে নিয়ে গেল। এরপর বুঝতে পারিনি যে, ঐ যুবক কিভাবে শহীদ হয়েছে এবং তার লাশ কিভাবে নদীতে নিক্ষেপ করা হয়েছে।
চিলাস ট্রাজেডির এ প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছে যে, ঐ মর্মান্তিক ঘটনায় ৫০ এর অধিক শিয়া শহীদ হয়েছে, যখন পাকিস্তান পত্র-পত্রিকা ও প্রচার মাধ্যমসমূহ ঘোষণা করেছিল যে, এ ঘটনায় ১৬ ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছে।
উল্লেখ্য, পাকিস্তানের শিয়া হত্যার ধারাবাহিকতায়, সিপাহে সাহাবা সন্ত্রাসীরা কয়েকদিন পূর্বে গিলগীত অঞ্চলের চিলাস এলাকায় শিয়াদেরকে বহনকারী বাসের রাস্তায় ওঁত পেতে থাকে, বাসগুলো তাদের নাগালে আসার সাথে সাথে তারা বাসের গতিরোধ করে বাসের সকল যাত্রীকে নামিয়ে তাদের মধ্যে হতে শিয়াদেরকে আলাদা করে তাদের উপর নৃশংসভাবে গুলি চালিয়েছে। এ ঘটনায় প্রায় ৬০ জন শিয়া শাহাদাত বরণ করেছেন।
(সূত্র : পাকিস্তান ছাত্র পরিষদ, হাওযা ইলমিয়া কোম)