২০১১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার ১১তম বার্ষিকী পালিত হচ্ছে আমেরিকায়। ওই দিনের ঘটনাকে পুঁজি করে মার্কিন সরকার বিশ্বব্যাপী তথাকথিত সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের নামে শুরু করেছিল ইসলাম ও মুসলিম বিরোধী যুদ্ধ; যা আজো চলমান।
বার্তা সংস্থা আবনা : ২০১১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার ১১তম বার্ষিকী পালিত হচ্ছে আমেরিকায়। ওই দিনের ঘটনাকে পুঁজি করে মার্কিন সরকার বিশ্বব্যাপী তথাকথিত সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের নামে শুরু করেছিল ইসলাম ও মুসলিম বিরোধী যুদ্ধ; যা আজো চলমান। বিশ্বের মানুষের মনে ইসলাম সম্পর্কে ভীতি সৃষ্টি করার হাতিয়ার হিসেবে মার্কিন সরকার ৯/১১'কে ব্যবহার করছে জঘন্য কায়দায়।
অথচ নিউইয়র্কের বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের টুইন টাওয়ারে যাত্রীবাহী বিমান আঘাত হানার ১১ বছর পরও সে ঘটনায় জড়িতদের সম্পর্কে সঠিক কোন কূলকিনারা করা যায়নি। কে ওই হামলার পরিকল্পনা করেছিল, কেনোই বা হামলা হয়েছিল, ঘটনার দিন টুইন টাওয়ারে কর্মরত একজন ইহুদিও কেনো কর্মস্থলে উপস্থিত ছিল না- এসব প্রশ্নের কোন সদুত্তর মার্কিন প্রশাসন দিতে পারেনি। তারা শুধু দাবি করে যাচ্ছে, ওই ঘটনায় 'মুসলিম জঙ্গীরা' জড়িত ছিল।
অথচ আমেরিকার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে যার বিন্দুমাত্র ধারণা আছে তিনি জানেন, মার্কিন নিরাপত্তা বিভাগের সহযোগিতা ছাড়া কোনো মানুষের পক্ষে যাত্রীবাহী বিমান অপহরণ করে তা নিয়ে টুইন টাওয়ার অথবা মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর- পেন্টাগনে আছড়ে পড়া সম্ভব নয়। এ ছাড়া, ভেতর থেকে ধ্বংস করা না হলে একটিমাত্র বিমানের আঘাতে এত সুউচ্চ টাওয়ারও ধসে পড়তে পারে না বলেও বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছেন। তারা ওই ঘটনার ছবি ও ভিডিওচিত্র তুলে ধরে বলেছেন, টাওয়ারের যে স্থানে যাত্রীবাহী বিমান আঘাত হেনেছে, ধসে পড়ার সময় টাওয়ারের সে স্থানটি অক্ষত ছিল। এ ব্যাপারে ওয়াশিংটনের রহস্যজনক নীরবতা ১১ই সেপ্টেম্বরের ঘটনার সত্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
এসব প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা আমাদের উদ্দেশ্য নয়, আমরা আজ ভিন্ন আঙ্গিকে ৯/১১ –এর ঘটনা বিশ্লেষণের চেষ্টা করবো। বিশ্বব্যাপী মুসলিম বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়ার হাতিয়ার হিসেবে কীভাবে ওই ঘটনাকে ব্যবহার করা হয়েছে এবং এর ফলাফল কী হয়েছে- সেদিকেই নজর দেবো আমরা।
৯/১১-এর ঘটনার পর এ ব্যাপারে মার্কিন সরকারের গৃহিত পদক্ষেপগুলো থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়, ওয়াশিংটন দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের একটি ঘটনার অপেক্ষায় ছিল। আমরা যদি সেদিনের ঘটনার ব্যাপারে মার্কিন সরকারের প্রচার করা কাহিনীকে সত্য বলেও ধরে নেই, তারপরও দেখবো দু'টি মুসলিম দেশ ইরাক ও আফগানিস্তান দখলের অজুহাত হিসেবে ৯/১১কে ব্যবহার করা হয়েছে।
১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমেরিকা কার্যত বিশ্বে নিজেকে প্রতিদ্বন্দ্বি ও শত্রুহীন অবস্থায় দেখতে পায়। অথচ অর্ধশতাব্দি ধরে কমিউনিজমের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ব্যাপক প্রস্তুত নিয়ে রেখেছিল সে। গণবিধ্বংসী অস্ত্রসহ নানা অস্ত্রে সজ্জিত হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঘায়েল করার লক্ষ্যে। কিন্তু হঠাত করে সোভিয়েত রাশিয়া ধসে পড়ায় আমেরিকা যতটা না খুশি হয়েছিল তার চেয়ে বেশি হয়েছিল হতাশ; 'অস্ত্রের জোরে' শত্রুকে ঘায়েল করতে না পারার কারণে। আরো একটি আফসোস হয়েছিল মার্কিন সরকারের। আর তা হলো সোভিয়েত ইউনিয়নের জুজুর ভয় দেখিয়ে এতদিন যেসব দেশকে নিজের নব্য উপনিবেশবাদী শাসনের প্রভাব বলয়ে নিয়ে এসেছিল তাদেরকে ধরে রাখাতো এখন মুশকিল হয়ে যাবে।
কাজেই একটি নতুন শত্রুর প্রয়োজন পড়ে আমেরিকার। হোক সে কল্পিত শত্রু; কিন্তু তাকে ব্যবহার করে, তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নিজের শক্তিমত্তা জাহির করার পাশাপাশি বিশ্বের বুকে একক অধিপতি হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করা যাবে। এ লক্ষ্যে পাল্টে যায় মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি। কমিউনিজমের স্থলাভিষিক্ত করা হয় ইসলামকে।
নব্য শত্রু হিসেবে ইসলামকে বেছে নেয়ার পেছনেও রয়েছে একাধিক বলিষ্ঠ কারণ। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের ফলে কৌশলগত দিক দিয়ে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার স্বার্থ বিপন্ন হয়ে পড়ে। ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে মার্কিন প্রভাব বলয় থেকে ইরানের বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা ছিল আমেরিকার জন্য মারাত্মক চপেটাঘাত। এ কারণে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের প্রভাব যাতে অন্যান্য মুসলিম দেশেও ছড়িয়ে পড়তে না পারে সে লক্ষ্যে ইসলাম ও ইরান ভীতি ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টায় মাঠে নামে ওয়াশিংটন।
এরইমধ্যে সোভিয়েত রাশিয়ার পতন ঘটলে আমেরিকার কাছে ইসলাম আতঙ্ক ও ইসলাম বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়ার অপরিহার্যতা বেড়ে যায়। এতদিন ইসলাম সম্পর্কে ভীতি ছড়ানোর প্রচেষ্টা শুধুমাত্র প্রচারমাধ্যমকেন্দ্রিক হলেও এবার সভ্যতা ও সংস্কৃতির ঝাণ্ডা নিয়েও মাঠে নামে ওয়াশিংটন। সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পরের বছর ১৯৯২ সালে স্যামুয়েল হান্টিংটনের মাধ্যমে 'সভ্যতার মধ্যে সংঘাত' নামক মতবাদ প্রচার করা হয়। হান্টিংটন দাবি করেন, ভবিষ্যত যুদ্ধ হবে সভ্যতাগুলোর মধ্যে এবং পশ্চিমা সভ্যতার জন্য প্রধান হুমকি হয়ে উঠবে মুসলিম সভ্যতা।
হান্টিংটনের এ মতবাদকে গ্রহণ করে মার্কিন প্রশাসন। তারা ওই ভ্রান্ত মতবাদকে পুঁজি করে এ সিদ্ধান্তে উপনিত হয় যে, ভবিষ্যতে মুসলিম বিশ্ব পাশ্চাত্যের জন্য প্রধান হুমকিতে পরিণত হবে। এ কারণে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার সিদ্ধান্ত নেয় পাশ্চাত্য।
কিন্তু মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিনা কারণে তো আর যুদ্ধে নামা যায় না; এজন্য চাই বস্তুনিষ্ঠ তথ্যপ্রমাণ। এ তথ্যপ্রমাণ তৈরির আগে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনার আওতায় পশ্চিমা গণমাধ্যম ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ন্যাক্কারজনক প্রচারণা শুরু করে। প্রথমদিকে এ বিষাক্ত প্রচারণায় কাজ হতে শুরু করে এবং পাশ্চাত্যের জনমত অবাস্তব ও একতরফা প্রচারণায় প্রভাবিত হয়ে মানুষের মনে ইসলাম সম্পর্কে খারাপ ধারনা তৈরি হয়। তাদের মনে এ ভিত্তিহীন ধারনাটি বদ্ধমূল হয় যে, ইসলাম একটি কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও সহিংস ধর্ম, এটি সন্ত্রাসবাদের বিস্তার ঘটায় এবং এ ধর্ম মানবাধিকারের পরিপন্থী।
অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, ইসলাম শান্তিকামী ও মানবতাবাদী ধর্ম এবং জ্ঞানবিজ্ঞানের উন্নতির পৃষ্ঠপোষক। কুংস্কার ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেই এ ধর্ম বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ইসলামের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়টি শুরু হয় সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর। আর এ যুদ্ধের চূড়ান্ত রূপটি স্পষ্টভাবে বিশ্ববাসীর সামনে ধরা পড়ে ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর। এ পর্যায়ে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমগুলো পাশ্চাত্যের সঙ্গে মুসলিম বিশ্বের সম্পর্কের ভিত্তিকে সম্পূর্ণ ওলট-পালট করে দেয়। 'ইসলাম ও পাশ্চাত্যের সংঘাত শুরু হয়ে গেছে'- বলে ব্যাপক প্রচার করে তারা।
১১ই সেপ্টেম্বরের ঘটনার দু'দিন পর মার্কিন দৈনিক হেরাল্ড ট্রিবিউন এক নিবন্ধ প্রকাশ করে। জন উইনকারের লেখা ওই নিবন্ধে বলা হয়, ১১ই সেপ্টেম্বরের ঘটনায় পশ্চিমা সভ্যতার সঙ্গে মুসলিম সভ্যতার সংঘাত শুরু হয়ে গেছে। ইতালির ততকালীন প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বার্লুসকোনি দাবি করেন, পাশ্চাত্য সভ্যতা মুসলিম সভ্যতার চেয়ে অনেক প্রাচীন ইতিহাসের অধিকারী। তিনি এজন্য ইসলাম সম্পর্কে অপমানজনক কথা বলতেও দ্বিধা করেননি। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, ইসলাম যখন পশ্চিম ইউরোপে সভ্যতার আলো ছড়িয়েছিল তখন ইউরোপীয়রা চরম অন্ধকার যুগে বসবাস করতো। ইসলামের কাছ থেকেই মূলত পাশ্চাত্য জগত সভ্য হতে শিখেছে।
ইসলামকে অপমান করার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরের ঘটনার একমাস পর বিখ্যাত মার্কিন চিন্তাবিদ ফুকুইয়ামা ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেন, ইসলাম হচ্ছে একমাত্র সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা যা পশ্চিমা আধুনিকতার প্রধান হুমকি। তিনি বলেন, আধুনিকতা বিরোধী মুসলিম প্রতিরোধ আন্দোলনগুলোর বিরুদ্ধে আমেরিকার উচিত নিজের সমরশক্তি ব্যবহার করা।
সাবেক মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী উইলিয়াম কোহান এ সম্পর্কে বলেন, "আমেরিকা ও তার মিত্র দেশগুলোর ইসলাম বিরোধী যুদ্ধ চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধে রূপ নেবে।" এ সময় ততকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ মুসলমানদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় ক্রুসেড শুরু করার কথা বলেন। সেইসঙ্গে ইহুদিবাদী চিন্তাধারায় প্রভাবিত মার্কিন পাদ্রী রড পার্সলি 'আর নীরবতা নয়'-নামে একটি বই প্রকাশ করেন। তিনি এতে দাবি করেন, সৃষ্টিকর্তা ইসলামকে পরাজিত করার দায়িত্ব মার্কিন সরকারকে দিয়েছেন। তিনি আরো দাবি করেন, ইসলামকে ধ্বংস করার প্রেরণা নিয়েই মূলত আমেরিকা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
এভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ উস্কে দিয়ে পশ্চিমা জনমত গঠন করার পর ইঙ্গোমার্কিন বাহিনী ২০০১ সালে আফগানিস্তান ও ২০০৩ সালে ইরাক দখল করে। মানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর অবমাননাকর কার্টুন প্রকাশ করে পাশ্চাত্যের গণমাধ্যম এবং একজন উগ্র চলচ্চিত্র পরিচালক ইসলাম বিদ্বেষী সিনেমা 'ফেতনা' তৈরি করেন।
কিন্তু এসব প্রচার-প্রপাগান্ডার ফল হয় সম্পূর্ণ উল্টো। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে শান্তি ও মানবতার ধর্ম ইসলামের বিরুদ্ধে এতসব অপপ্রচার সত্ত্বেও পশ্চিমা দেশগুলোতেই ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটছে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে। আমেরিকা, ফ্রান্স ও রাশিয়াসহ পাশ্চাত্যের আরো বহু দেশে মুসলমানরা আজ সর্ববৃহত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। ফলে দেখা যাচ্ছে, এ ধর্মের প্রসার রোধ করার লক্ষ্যে ইসলাম সম্পর্কে এত প্রচারণা চালানো হলেও কার্যক্ষেত্রে তার ফল হয়েছে উল্টো। সাধারণ মানুষ প্রচারণায় প্রভাবিত হওয়ার পরিবর্তে ইসলাম সম্পর্কে আরো বেশি জানতে আগ্রহী হয়ে উঠছে এবং যারা এ ধর্মের সংস্পর্শে এসেছে তারাই এর সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের বাণীতে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছে।
কাজেই ১১ বছর আগে যে লক্ষ্যে ৯/১১-এর জন্ম দেয়া হয়েছিল আজ তা পাশ্চাত্যের জন্য বুমেরাং হয়ে উঠতে শুরু করেছে। পশ্চিমা দেশগুলোতে যে হারে মানুষ ইসলাম গ্রহণ করছে তাতে ধারণা করা হচ্ছে, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বে ইসলাম সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মে পরণত হবে। আবার দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়বে ইসলামের সুমহান শিক্ষা। অন্যায়, অবিচার ও বৈষম্য থেকে মুক্তি পাবে শত শত কোটি মানুষ।#
(সূত্র : রেডিও তেহরান)