অনেকের ধারণার উর্ধ্বে আহলে বাইত (আ.) এর অনুসারী শিয়াদের ন্যায় অনেক সুন্নি আলেমও নিজেদের গ্রন্থে স্পষ্ট ভাষায় এ কথা লিখেছেন যে, ইমাম মাহদি (আ.) ২৫৫ হিজরীর শাবান মাসের ১৫ তারিখে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং তার পিতার নাম হাসান আসকারি (আ.)।
আহলে বাইত (আ.) বার্তা সংস্থা (আবনা): মুসলমানদের মাঝে সর্বকালে আলোচিত বিষয়গুলোর একটি হল ইমাম মাহদি (আ.) এর জন্ম হয়েছে নাকি হয় নি?
এর উত্তর খুঁজতে যদি মহানবি (স.) এর আহলে বাইত (আ.) এর অনুসারী শিয়া মুসলিমদের শরণাপন্ন হই তবে বুঝবো, এ বিষয়ে তাদের মধ্যে কোন মতভেদ নেই যে, ইমাম মাহদি (আ.) এর জন্ম হয়েছে এবং তিনি বর্তমানে লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়েছেন। আর মহান আল্লাহর অনুমতিক্রমেই তার আবির্ভাব ঘটবে এবং তিনি এ পৃথিবীকে ন্যায়-নিষ্ঠায় পূর্ণ করবেন যেভাবে পৃথিবী অন্যায়-অত্যাচারে পূর্ণ হয়ে যাবে।
অপরদিকে আহলুস সুন্নাহ’র আলেমরা ইমাম মাহদি (আ.) এর আগমনের বিষয়ে ঐকমত্য রাখেন যে, তিনি আসবেন এবং পৃথিবী থেকে জুলুম-অত্যাচারকে সমূলে উৎপাটিত করবেন। তবে তার জন্মের বিষয়ে সুন্নি আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে কেউ কেউ মনে করেন তিনি এখনও জন্মগ্রহণ করেননি।
কিন্তু অনেকের ধারণার উর্ধ্বে আহলে বাইত (আ.) এর অনুসারী শিয়াদের ন্যায় অনেক সুন্নি আলেমও নিজেদের গ্রন্থে স্পষ্ট ভাষায় এ কথা লিখেছেন যে, ইমাম মাহদি (আ.) ২৫৫ হিজরীর শাবান মাসের ১৫ তারিখে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং তার পিতার নাম হাসান আসকারি।
আহলুস সুন্নাহ’র যে সকল আলেম ইমাম মাহদি (আ.) এর জন্মগ্রহণের বিষয়ে মত দিয়েছেন তাদের উক্তিগুলো এ নিবন্ধে তুলে ধরা হয়েছে।
১। মুহাম্মাদ বিন তালহা হালাবি শাফেয়ী তার মাতালেবুস সুউল ফি মানাকিবি আলির রাসুল (স.) গ্রন্থের ১২তম অধ্যায়ে হযরত মাহদি (আ.) এর নাম ও উপাধীসমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছে লিখেছেন: “ইমাম মাহদি (আ.) ঐতিহাসিক সামেরা শহরে জন্মগ্রহণ করেছেন। (মাতালেবুস সুউল ফি মানাকিবি আলির রাসুল, পৃ. ৮৮, ১২৮৭ ইরানি বর্ষ, ইরানে প্রকাশিত)
২। মুহাম্মাদ বিন ইউসুফ কাঞ্জি শাফেয়ী তার আল-বায়ান ফি আখবারি সাহিবিয যামান গ্রন্থে লিখেছেন হযরত ইমাম মাহদি (আ.) হচ্ছেন হযরত হাসান আসকারির (আ.) সন্তান। পবিত্র এ সত্তা তার গায়বাত তথা অন্তর্ধানের যুগ থেকে জীবিত এবং সুস্থ অবস্থায় জীবন-যাপন করছেন। (আল-বায়ান ফি আখবারি সাহিবিয যামান, পৃ. ৩৩৬)
এছাড়া তিনি একই গ্রন্থে ইমাম মাহদি (আ.) এর জীবিত থাকার বিষয়ে বিভিন্ন দলিল প্রণয়নের পর লিখেছেন: যেভাবে হযরত ঈসা, খিজর ও ইলিয়াস (আলাইহিমুস সালাম) শত শত বছর ধরে জীবিত আছেন, সেহেতু ইমাম মাহদি (আ.) এর জীবিত থাকার বিষয়টি অসম্ভব নয়। (আল-বায়ান ফি আখবারি সাহিবিয যামান, দারুল মুহাজ্জাতুল বাইদা, বৈরুত, ১৪২১ হি., পৃ. ৭৯।)
৩। মুহাম্মাদ বিন আহমাদ মালেকি ওরফে ইবনে সাব্বাগ তার আল-ফুসুলুল মুহিম্মাহ গ্রন্থে লিখেছেন: “আবুল কাসেম, মুহাম্মাদ, হুজ্জাত (আ.) হচ্ছেন হাসান আসকারি (আ.) এর সন্তান। তিনি সামেরা শহরে ২৫৫ হিজরীর শাবান মাসের মাঝামাঝি (তথা ১৫ই শাবান) জন্মগ্রহণ করেছেন। (আল-ফুসুলুল মুহিম্মাহ, পৃ. ২৭৩)
৪। সিবতে ইবনে জওযি স্বীয় গ্রন্থ তাযকিরাতুল খাওয়াসের ‘ফাসলুন ফি যিকরিল হুজ্জাতিল মাহদি’ অধ্যায়ে হযরত আসকারি (আ.) এর সন্তানদের বিষয়ে লিখেছেন: তাঁর সুউচ্চ নাম মোবারক হচ্ছে মুহাম্মাদ। তিনি হাসান আসকারি আলাইহিস সালামের সন্তান এবং তার উপাধী হচ্ছে আবুল কাসেম। তাকে খালাফুল হুজ্জাহ, সাহেবুজ জামান, আল-কায়েমুল মুন্তাজার উপাধীতেও ডাকা হয়। আর তিনি হলেন সর্বশেষ ইমাম। (তাযকিরাতুল খাওয়াস, নতুন সংস্করণ, পৃ. ৩৬৩, পুরোনো সংস্করণ, পৃ. ৮৮)
৫। ইবনে হাজার হাইতামি তার সাওয়ায়েকুল মুহরেকা গ্রন্থে হযরত হাসান আসকারি (আ.) সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন: আবুল কাসেম মুহাম্মাদ আল-হুজ্জাহ (আ.) ছাড়া হযরত হাসান আসকারি (আ.) আর কোন সন্তান রেখে যাননি। পিতার শাহাদাতের সময় তাঁর বয়স ছিল ৫ বছর। কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাকে গভীর ও অলৌকিক হিকমত ও প্রজ্ঞা দান করেছেন (আস সাওয়ায়েকুল মুহরেকা, পৃ. ১২৭, মিসরে প্রকাশিত, প্রকাশকাল ১৩০৮)
৬। শাবরাভি শাফেয়ী তার আল-ইত্তিহাফ বিহুব্বিল আশরাফ গ্রন্থে লিখেছেন: আসকারি নামে প্রসিদ্ধ ১১তম ইমামের সন্তান হলেন ইমাম মাহদি (আ.)। তিনি ২৫৫ হিজরীর ১৫ শাবান ঐতিহাসিক সামেরা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। (আল-ইত্তিহাফ বিহুব্বিল আশরাফ, পৃ. ১৭৮)
৭। আব্দুল ওয়াহাব শা’রানি তার আল-ইয়াওয়াকিত ওয়াল জাওয়াহির গ্রন্থে লিখেছেন: ইমাম মাহদি (আ.); ইমাম আসকারি (আ.) সন্তানদের একজন এবং তিনি ২৫৫ হিজরীর ১৫ই শাবান জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জীবিত আছেন এবং মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে হযরত ঈসা (আ.) তার আবির্ভাবের সময় আসমান থেকে নেমে আসবেন এবং তাঁর সাথে সাক্ষাত করবেন। (আল-ইয়াওয়াকিত ওয়াল জাওয়াহির, খণ্ড ২, পৃ. ১৪৩, মিসর)
৮। ইবনে আসির জাযরি স্বীয় গ্রন্থ আল-কামিল ফিত তারিখের ৭ম খণ্ডের ২৭৪ পৃষ্ঠায় ২৫৫ হিজরিতে ইমাম মাহদি (আ.) এর জন্মের বিষয়টি স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেছেন। তিনি এও লিখেছেন যে, ইমাম আসকারি (আ.) এর ইন্তিকালের সময় ইমাম মাহদি জীবিত ছিলেন।
৯। বাহজাত এফেন্দি তুর্কি ভাষায় লেখা তার তারিখে আলে মুহাম্মাদ গ্রন্থে লিখেছেন: ইমাম মাহদি (আ.) ২৫৫ হিজরীর ১৫ই শাবান জন্মলাভ করেছেন এবং তার মায়ের নাম হল নারজিস (সা. আ.)। (মুন্তাখাবুল আসার, পৃ. ৩৩৮ এবং দিফা আনিল কাফি, খণ্ড, ১, পৃ. ৫৮৭)
১০। সুলায়মান কান্দুযী হানাফি তার ইয়ানাবিউল মুয়াদ্দাহ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন: হযরত হাকিমা থেকে হযরত মাহদি (আ.) এর জন্মের বিষয়ে একটি রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে যার মাধ্যমে উলামা ও বিশ্বস্ত মুসলিম ব্যক্তিত্বরা সুনিশ্চিত হয়েছেন যে, তাঁর জন্ম ২৫৫ হিজরীর ১৫ শাবান ঐতিহাসিক সামেরা শহরে হয়েছে। (ইয়ানাবিউল মুয়াদ্দাহ, পৃ. ৪৪৯-৪৫২, ইরান)
১১। আবু নসর সাহল বিন আব্দুল্লাহ তার কিতাব ‘সিররুস সিলসিলাতিল আলাভিয়্যাহ গ্রন্থের ৩৯ নং পৃষ্ঠায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম আসকারি (আ.) এর সন্তান হযরত মাহদি (আ.) ভূমিষ্ট হয়েছেন এবং তাকে কায়েম ও হুজ্জাত বলে জানে। তিনি আরও লিখেছেন: তাঁর বংশ পরিচয়ের বিষয়ে কোন সংশয় নেই।
১২। শিবলাঞ্জি শাফেয়ী তার নূরুল আবসার গ্রন্থে লিখেছেন: হযরত আসকারি (আ.) ২৬০ হিজরীর ৮ রবিউল আওয়াল ইন্তিকাল করেন। মৃত্যুকালে তিনি ১ সন্তান রেখে যান; যার নাম ছিল ‘মুহাম্মাদ’ (নূরুল আবসার, পৃ. ১৮৫)
১৩। ইবনুল খিশাব লিখেছেন: হযরত আসকারি (আ.) এর যোগ্য সন্তান ও উত্তরসূরী ছিলেন মাহদি (আ.); তাকে ‘আল-খালাফুস সালেহ’ নামেও ডাকা হত। তিনিই হলেন সাহেবুজ জামান এবং পবিত্র মাহদি নামেও যার প্রসিদ্ধি রয়েছে।
১৪। আব্দুল হাক দেহলভি স্বীয় গ্রন্থে লিখেছেন: খালাফে সালেহ হচ্ছে হযরত আসকারি (আ.) এর সন্তানদের একজন এবং তিনিই হলেন সাহেবুজ জামান (আ.)।
১৫। মুহাম্মাদ আমিন বাগদাদি তার সাবায়েকুয যাহাব গ্রন্থে ইমাম মাহদি (আ.) এর জন্ম সম্পর্কে লিখেছেন: হযরত মাহদি (আ.) এর সম্মানিত পিতার ইন্তিকালের সময় তার বয়স ছিল ৫ বছর। (সাবায়েকুয যাহাব, পৃ. ৭৮)
১৬। ইবনে ওয়ারদি তার ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন, হযরত আসকারি (আ.) সন্তান মাহদি ২৫৫ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেছেন।
১৭। যারকুলি তার আল-আ’লাম গ্রন্থে লিখেছেন: হযরত মাহদি সামেরাতে জন্মলাভ করেন, ৫ বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। বলা হয় যে, ২৫৫ হিজরীর শাবান মাসের অর্ধেকে তথা ১৫ শাবান তিনি জন্মলাভ করেন।
১৮। তাফসিরে কাবিরের রচয়িতা ফাখরে রাজি (মৃত্যুকাল ৬০৬ হিজরি) তার আশ-শাজারাতুল মুবারাকাহ ফি আনসাবিত তালিবিয়্যাহ গ্রন্থে লিখেছেন: হযরত হাসান (আ.) সালামের দু’টি কন্যা ও দু’টি পুত্র সন্তান ছিল। তার পুত্রদের একজনের নাম ছিল সাহেবুজ জামান (আ.) এবং দ্বিতীয় জনের নাম ছিল মুসা। মুসা পিতার জীবদ্দশাতেই ইন্তিকাল করেন (আশ-শাজারাতুল মুবারাকাহ ফি আনসাবিত তালিবিয়্যাহ, পৃ. ৭৮)
১৯। শামসু্দ্দীন যাহাবি তারা সিয়ারু আ’লামুন নুবালা গ্রন্থে লিখেছেন: ইমাম আসকারি (আ.) এর সন্তান হযরত মাহদি (আ.) ২৫৬ অথবা ২৫৮ হিজরীতে জন্মলাভ করেছেন। (সিয়ারু আ’লামুন নুবালা, খণ্ড ১৩, পৃ. ১১৯)
২০। আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ মুতাইরি শাফেয়ী মাসুম ইমামগণ আলাইহিমুস সালামের নাম উল্লেখ করতে গিয়ে হযরত আসকারি (আ.) এর নাম উল্লেখ করার পর লিখেছেন ১২তম ইমাম হযরত মাহদি (আ.) হচ্ছেন হযরত হাসান আসকারী (আ.) সন্তান। তার নাম মুহাম্মাদ ও কায়েম এবং তিনি মাহদি নামেও পরিচিত।
শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে বিশ্বের মুসলমানরা বিশেষ মর্যাদার সাথে পালন করে থাকে। শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে মুসলিম আলেমরা ইমাম মাহদি (আ.) এর জন্মের কথা স্বীকার করেছেন এমনকি তার জন্মের তারিখও উল্লেখ করেছেন।
একটি বিষয় আপনাদের বিচক্ষণ দৃষ্টি এড়াতে পারেনি যে, সৌদি রাজ পরিবারের পোশাকধারী একদল দরবারি আলেম প্রতিনিয়তই ১৫ শাবান তথা শবে বরাতকে বিদআত বলে ফতওয়া দিয়ে যাচ্ছে। তারা নিশ্চিত হয়েছে যে, মূলতঃ শবে বরাতে ইমাম মাহদি (আ.) এর জন্মদিন। মুসলমানরা মহান আল্লাহর ইচ্ছায় জেনে অথবা অজানায় মহাকালের ত্রাণকর্তা, মহানবি হযরত মুহাম্মাদ (স.) এর সর্বশেষ প্রতিনিধি এবং জমিনের বুকে মহান আল্লাহর সর্বশেষ হুজ্জাত হযরত ইমাম মাহদি (আ.) এর পবিত্র জন্মবার্ষিকী পালন করছে। আর তাই দরবারি আলেমরা জেনে বা অজানায় ইসলামের চিরশত্রুদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে তাদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের মাধ্যমে মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার বিশাল দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। তাদের বাপ-দাদারাও একই দায়িত্ব পালন করেছেন এবং নবি পরিবারের সাথে শত্রুতার বিভিন্ন দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। তবে মহান আল্লাহ্ যে নূরকে জ্বালিয়ে রাখেন তা কখনই নেভে না।
সতর্ক থাকবেন, ইতিমধ্যে ইমাম মাহদি (আ.) এর আগমনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কর্মসূচী হাতে নিয়েছে ইমাম মাহদি (আ.) এর শত্রুরা। এ সকল কর্মসূচী অন্যতম হল ১৫ শাবানের গুরুত্ব ও তাৎপর্যকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মন থেকে কমিয়ে আনা। যাতে সাধারণ মুসলমানরা ইমাম মাহদি (আ.) সম্পর্কে পরিচিতি অর্জনের সুযোগ টুকুও হারায়। এ শত্রুরা সংখ্যায় খুবই নগন্য। মুসলমানদের বেশিরভাগ অনুষ্ঠানাদির সাথেই এদের সমস্যা রয়েছে।
এটা অজানা নয় যে, কোন আকিদাকে সমাজ থেকে সরাতে শত্রু পক্ষ আস্তে আস্তে পরিকল্পনা করে। তারই অংশ হিসেবে শবে বরাতকে টার্গেট করা হয়েছে। যদি তারা এটাতে সফল হয় তাহলে নতুন কর্মসূচী হাতে নেবে এবং মুসলিম সমাজকে এমন একটি পর্যায়ে এনে দাঁড় করাবে যে, এক সময় তারা অনায়াসে ইমাম মাহদি (আ.) এর আগমনকেও অস্বীকার করতে দ্বিধা করবে না।#