ইয়াজিদ-বাহিনীর হাতে ৬১ হিজরির দশই মহররম বা আশুরার দিনে বিশ্বনবী (সা.)’র দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)সহ তাঁর মহান পরিবারের (ইমাম সাজ্জাদ বা যেইনুল আবেদীন-আ.ছাড়া) প্রায় সব পুরুষ সদস্যসহ মোট ৭২ জন বীর মুসলিমের শাহাদতের পর বন্দী করা হয়েছিল নবী পরিবারের নারী সদস্যদেরকে।
এরপর কুফায় ইবনে জিয়াদের দরবারসহ নানা স্থানে এবং দামেস্কে ইয়াজিদের দরবারে বন্দী অবস্থায় ইমাম হুসাইন (আ.)’র বোন হযরত যেইনাব (সা.) যেসব সাহসী বক্তব্য রেখেছিলেন তা ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।
কুফায় তাঁর ভাষণ শ্রবণকারী একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেছিল, আল্লাহর শপথ, "এমন আর কোনো লজ্জাশীলা নারীকে কখনও এমন ভাষণ দিতে শুনিনি।" তার ভাষণে ছিল পিতা হযরত আলী (আ.)'র বীরত্ব, বাগ্মিতা ও নারীসুলভ লজ্জাশীলতা।
কুফা নগরীর প্রবেশ দ্বারের কাছে মাত্র দশ-বারোটি বাক্যে তিনি তাঁর ভাষণ শেষ করেছিলেন। কুফাবাসীরা তাদের প্রতি যেইনাব(সা.)'র যৌক্তিক ও মর্মস্পর্শী তিরস্কার শুনে অনুশোচনা ও বিবেকের দংশনের তীব্রতায় নিজেদের আঙুলগুলো মুখে ঢুকিয়ে কামড়াচ্ছিল। এখানে নারীসুলভ মর্যাদা বজায় রেখে সাহসী বীর নারী ইমাম হুসাইন (আ.)'র কন্যা ফাতিমা একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। সে সময়ও সবাই অশ্রু-সজল হয়ে পড়ে।
হযরত যেইনাব (সা.) কুফাবাসিকে তিরস্কার করে যেসব বক্তব্য রেখেছিলেন তার একাংশে বলেছিলেন, " তোমরা নিজেদের জন্য চিরন্তন অপরাধ ও লজ্জা রেখে এসেছ এবং চিরন্তন লাঞ্ছনা খরিদ করেছ। তোমরা কোনোদিনই এ লাঞ্ছনা দূর করতে সক্ষম হবে না। আর কোনো পানি দিয়েই তা ধুয়ে ফেলতে পারবে না। কারণ, তোমরা হত্যা করেছ হুসাইনকে যিনি হচ্ছেন খাতামুন্নাবিয়্যিনের(সা.)'র কলিজার টুকরা, বেহেশতে যুবকদের নেতা।"
যেইনাব (সালামুল্লাহি আলাইহা)সহ নবী পরিবারের বন্দীদেরকে কুফায় ইবনে জিয়াদের দরবারে নিয়ে আনা হলে জিয়াদ তাঁকে বিদ্রূপ করে বলেছিল: সকল প্রশংসা আল্লাহর যিনি তোমাদের লাঞ্ছিত করেছেন, তোমাদের পুরুষদের হত্যা করেছেন এবং তোমাদের বাগাড়ম্বরকে মিথ্যা প্রমাণ করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে যেইনাব (সা.) জবাব দিয়েছিলেন: "সব প্রশংসা আল্লাহর যিনি নবী মুহাম্মাদ(সা.)'র বদৌলতে আমাদেরকে সম্মানিত করেছেন এবং আমাদেরকে সব অপবিত্রতা থেকে মুক্ত করেছেন। অবশ্যই ফাসেক লাঞ্ছিত হবে এবং ফাজের বা পাপাচারী মিথ্যা বলছে, (যার বাগাড়ম্বরের কথা সে বলছে) সে ব্যক্তি আমরা ছাড়া অন্য কেউ। তাই সব প্রশংসা আল্লাহর।"
ইবনে জিয়াদ এবার বিদ্রূপ করে বলল: আল্লাহ তোমার ভাইয়ের সাথে যে আচরণ করলেন তা কেমন দেখলে? সে খলিফা ইয়াজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল ও প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, তাই আল্লাহ তাকে হতাশ করলেন এবং ইয়াজিদকে সাহায্য করলেন।
জবাবে যেইনাব (সা.) বলেছিলেন, " আমরা এতে উত্তম ছাড়া অন্য কিছু দেখিনি। আল্লাহ আমার ভাইকে শাহাদতের মর্যাদা দিয়ে সম্মানিত করেছেন, এটা তথা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হওয়া সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য।...আল্লাহ তোমাকে এবং তুমি যাদের হত্যা করেছ তাঁদের সবাইকে খুব শিগগিরই বিচারের জন্য নিজ দরবারে হাজির করবেন, সেদিনের জন্য প্রস্তুত হও তুমি, সেদিন কী জবাব দিবে তুমি, সেদিনের জন্য উদ্বিগ্ন হও। কে সেদিন বিজয়ী ও সফল হবে, হে যেনাকারিণীর পুত্র?"
এরপর নেকড়ের মত ক্ষিপ্ত হয়েও নির্লজ্জের মত জিয়াদ বলে, " আমি খুশি হয়েছি, কারণ, যা চেয়েছি তা পেয়েছি। "
জবাবে যেইনাব (সা.) বলেছিলেন,
" তুমি দুনিয়ার মাধ্যমে নেশাগ্রস্ত, প্রতারিত ও ফিতনাহগ্রস্ত। তুমি কি মনে করেছ হুসাইনের পরে তুমি আনন্দের সঙ্গে পৃথিবীতে চিরদিন টিকে থাকবে? স্বস্তিতে থাকবে? কখনও না, তুমি স্বস্তির মুখ দেখবে না। তুমি কখনও তোমার অভীষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হতে পারবে না। হে ইবনে জিয়াদ! তুমি নিজের হাতে নিজের ওপর যে কলঙ্ক লেপন করেছ তা অনন্তকাল পর্যন্ত থেকে যাবে।"
এতে দিশেহারা, অস্থির ও ক্ষিপ্ত হয়ে ইবনে জিয়াদ চিতকার করে বলে: " আমাকে এ নারীর হাত থেকে মুক্তি দাও; ওদেরকে কারাগারে নিয়ে যাও।"
মহাপাপিষ্ঠ ও নরাধম ইয়াজিদের দরবারে উপনীত হলে তার বেয়াদবিপূর্ণ নানা কথা ও বিদ্রূপের জবাবে হযরত যেইনাব (সা.) এক দীর্ঘ ও ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। সে ভাষণের একাংশে তিনি বলেছিলেন: "আমাদের শাসন-কর্তৃত্ব (তোমার হাতে পড়ায়) তুমি মহিমান্বিত আল্লাহর সেই বাণী ভুলে গিয়েছ: 'কাফেররা যেন মনে না করে যে আমরা তাদের যেঅবকাশ দান করি, তা নিজেদের জন্য কল্যাণকর। বরং আমরা তো তাদেরকে এ জন্যই অবকাশ দেই যাতে করে তাদের পাপগুলো বাড়তে থাকে এবং তাদের জন্য অপমানজনক শাস্তি অবধারিত।"
তিনি ইয়াজিদকে 'সে ব্যক্তির পুত্র যাকে বন্দী করার পর ছেড়ে দেয়া হয়েছিল' বলেও সম্বোধন করেন!(কারণ, আমির মুয়াবিয়া মক্কা বিজয়ের সময় বন্দী হয়েছিল মুসলিম বাহিনীর হাতে, ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেয়ায় তাকে মুক্তি দেয়া হয়)
হযরত যেইনাব (সা.) তাঁর ঐতিহাসিক সেই ভাষণে পবিত্র নবী বংশের, বিশেষ করে ইমাম হুসাইন (আ.)'র মর্যাদা তুলে ধরার পাশাপাশি ইয়াজিদ বাহিনীর জুলুম ও নৃশংসতাও তুলে ধরেছিলেন ।
তিনি ইমাম হুসাইন (আ.)'র সঙ্গে ইয়াজিদের নানা বেয়াদবী এবং নবী বংশের ওপর তার বাহিনীর নৃশংস জুলুম নির্যাতন চালানোসহ হত্যাযজ্ঞের জন্য তাকে খোদায়ী কঠোর শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে বলে উল্লেখ করেন। হযরত যেইনাব (সা.) এক পর্যায়ে ইয়াজিদের দরবারেই তাকে বলেন, "যদিও ঘটনাচক্রে আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে বাধ্য হয়েছি, কিন্তু আমি তোমাকে খুবই তুচ্ছ ও নীচ মনে করি এবং তোমাকে কঠোরভাবে তিরস্কার করছি ও অনেক বেশি নিন্দা করছি, কিন্তু (আমার ভাইয়ের হত্যার কারণে মুসলমানদের ) দৃষ্টিগুলো অশ্রুসজল আর হৃদয়গুলো কাবাবের মত দগ্ধীভূত।"
বিশ্বনবী (সা.)'র আহলে বাইতের প্রতি উম্মতের ভালবাসা ও তাঁদের স্মরণ যে ইয়াজিদ গোষ্ঠী কখনও বিলুপ্ত করতে পারবে না এবং আহলে বাইতের মর্যাদার ধারে কাছেও যে পৌঁছুতে পারবে না ইয়াজিদ গোষ্ঠী তিনি তাও ভবিষ্যদ্বাণী করেন। জালিমদের ওপর যে আল্লাহর লানত বর্ষিত হবে এবং ইহকালে তাদের পতন ও চরম লাঞ্ছনা এবং পরকালেও আরো কঠোর শাস্তি অপেক্ষা করছে হযরত যেইনাব (সা.) তাও উল্লেখ করেন ওই ভাষণে।
তাঁর সেইসব অবিস্মরণীয় ভাষণ ও বক্তব্যগুলো দিকে দিক প্রচারিত হয়ে দামেশক ও কুফাসহ মুসলিম বিশ্বের জনগণের মধ্যে বিক্ষোভের আগুন প্রজ্জ্বলিত করেছিল। গোটা আরব উপদ্বীপের চার লাখ মানুষ হুসাইন (আ.) হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য অভ্যুত্থান করে। ফলে খুব শিগগিরই কুফায় মুখতারের নেতৃত্বে নবী বংশের অবমানানকারী ও ঘাতকরা লাঞ্ছনার শিকার এবং নির্মূল হয়। আর এ জন্যই নবী(সা.) -নাতনী হযরত যেইনাব (সা.)-কে কারবালা বিপ্লবের অন্যতম সফল সংগঠক ও প্রধান পরিচালক বলা যায়।
উল্লেখ্য, কুফার জনগণ ইয়াজিদের প্রতি ইমাম হুসাইন (আ.)'র আনুগত্য প্রকাশ না করার কথা শুনে তাঁর প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল। এই শহরের জনগণ প্রকৃত ইসলামী খেলাফতের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য ও তাঁদেরকে মুক্ত করার জন্য ইমামের প্রতি আকুল আবেদন জানিয়ে অন্তত ১৮ হাজার চিঠি পাঠিয়েছিল। প্রতিটি চিঠিতে অন্তত ১০০ জনের স্বাক্ষর ছিল। কিন্তু তাঁরা প্রয়োজনের সময় ইমামের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। এমনকি কুফার প্রকৃত অবস্থা যাচাই করার জন্য যখন চাচাত ভাই মুসলিম ইবনে আকিল (রা.)-কে কুফায় পাঠান এই মহান ইমাম তখনও তারা ইমামের এই দূতকে সাহায্য করতে ব্যর্থ হয় এবং তিনি নৃশংসভাবে শহীদ হয়েছিলেন।
কিন্তু আকিল (রা.)'র শাহাদতের পরও ইমাম হুসাইন (আ.) যদি দোদুল-মনা কুফাবাসীদের আহ্বানে সাড়া না দিতেন , তাহলে ইতিহাসে এই ইমামকে কাপুরুষ বলে উল্লেখ করা হত এবং বলা হত লাখো মানুষের মুক্তির আহ্বানকে উপেক্ষা করে ইমাম হুসাইন (আ.) নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করেছিলেন।
কুফার পথে যাওয়ার সময় আকিল (রা.)'র শাহাদতের খবর শুনে কেঁদে ফেলেন ইমাম হুসাইন (আ.)। কিন্তু তবুও তিনি বিপ্লব চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেন। এ সময় ইমাম আবৃত্তি করেছিলেন পবিত্র কুরআনের একটি আয়াত যেখানে বলা হয়েছে: "মুমিনদের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা পূর্ণ করেছে। তাদের কেউ কেউ মৃত্যুবরণ করেছে এবং কেউ কেউ (শাহাদতের জন্য) প্রতীক্ষা করছে। তারা তাদের সংকল্প মোটেই পরিবর্তন করেনি।"(সুরা আহজাব, ২৩)
source : http://bangla.irib.ir