সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আমাদের জন্য ইসলাম ধর্মকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। দরূদ ও শান্তির অবিরাম ধারা বর্ষিত হোক নবীকুল শিরোমণী মুহাম্মাদ (সাঃ) এবং তাঁর পবিত্র বংশধর ও সম্মানিত সাথীদের উপর।
এই প্রবন্ধে এমন এমন একটি বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করা হবে, যা থেকে বেঁচে থাকা খুব কঠিন নয়। বেঁচে থাকা খুব সহজ, কিন্তু বাঁচতে পারছে না অনেক মানুষ। সেটি হচ্ছে গীবত ও চোগলখোরী। আল্লাহ্ তাআলা কুরআনে এবং রাসূল (সাঃ) তাঁর হাদীছে অত্যন্ত কঠোর ভাষায় তা থেকে বিরত থাকতে নিষেধ করেছেন এবং তাতে কেউ লিপ্ত হলে তাকে কঠিন শাস্তির ভয় দেখানো হয়েছে।
গীবত ও চুগলখোরী অর্থঃ
মানুষের অজান্তে দোষ বর্ণনার নাম গীবত। যদিও উক্ত দোষ তার মাঝে বর্তমান থাকে। চুগলখোর ঐ ব্যক্তিকে বলা হয়, যে মানুষের মাঝে ঝগড়া লাগানোর উদ্দেশ্যে একজনের কথা অন্যজনের কাছে বর্ণনা করে। গীবতকারী ও চুগলখোরের মধ্যে পার্থক্য এই যে, চুগলখোরের মধ্যে ঝগড়া লাগানোর ইচ্ছা থাকে। আর গীবতকারীর মধ্যে তা থাকা শর্ত নয়।
গীবত ও চুগলখোরীর শাস্তিঃ
গীবতকারী ও চুগলখোরেরা মানুষের মধ্যে বিচ্ছেদ ও ঝগড়া সৃষ্টির উদ্দেশ্যে একজনের কথা অন্যজনের কাছে বর্ণনা করে থাকে। মানুষের পারস্পরিক ভালবাসাকে শত্র"তায় পরিণত করে। তারা মানুষের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট লোক এবং বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী। তাদেরকে আপনি দেখতে পাবেন যে, একজনের কাছে এক রকম এবং অন্যজনের কাছে অন্যরকম চেহারা নিয়ে উপস্থিত হচ্ছে। তারা নিজেদের ইচ্ছামত যখন যা খুশী তাই বলে থাকে। আল্লাহ তায়া'লা তাদেরকে ধমক দিয়ে বলেনঃ
وَيْلٌ لِكُلِّ هُمَزَةٍ لُمَزَةٍ
প্রত্যেক পশ্চাতে ও সম্মুখে পরনিন্দাকারীর জন্য দুর্ভোগ। (সূরা হুমাজাহঃ ১) তারা নিজেদেরে কথা এবং কাজের মাধ্যমে মানুষের দোষ বর্ণনা করে থাকে, তারা ক্রোধ ও ঘৃণার হকদার। কারণ তারা মিথ্যা, গীবত, চুগলখোরী, খিয়ানত, হিংসা এবং ধোঁকা থেকে বিরত হয় না। এ জন্যই কবরের আজাবের অন্যতম কারণ হল চুগলখোরী করা।
ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ
مَرَّ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِحَائِطٍ مِنْ حِيطَانِ الْمَدِينَةِ أَوْ مَكَّةَ فَسَمِعَ صَوْتَ إِنْسَانَيْنِ يُعَذَّبَانِ فِي قُبُورِهِمَا فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُعَذَّبَانِ وَمَا يُعَذَّبَانِ فِي كَبِيرٍ ثُمَّ قَالَ بَلَى كَانَ أَحَدُهُمَا لَا يَسْتَتِرُ مِنْ بَوْلِهِ وَكَانَ الْآخَرُ يَمْشِي بِالنَّمِيمَةِ ثُمَّ دَعَا بِجَرِيدَةٍ فَكَسَرَهَا كِسْرَتَيْنِ فَوَضَعَ عَلَى كُلِّ قَبْرٍ مِنْهُمَا كِسْرَةً فَقِيلَ لَهُ يَا رَسُولَ اللَّهِ لِمَ فَعَلْتَ هَذَا قَالَ لَعَلَّهُ أَنْ يُخَفَّفَ عَنْهُمَا مَا لَمْ تَيْبَسَا أَوْ إِلَى أَنْ يَيْبَسَا
একদা রাসূল (সাঃ) মদীনা বা মক্কার কোন একটি বাগানের পাশদিয়ে অতিক্রম করছিলেন। তথায় তিনি দু'জন এমন মানুষের আওয়াজ শুনতে পেলেন, যাদেরকে কবরে শাস্তি দেয়া হচ্ছিল। রাসূল (সাঃ)) বললেন, তাদেরকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে অথচ বড় কোন অপরাধের কারণে আজাব দেয়া হচ্ছে না। অতঃপর তিনি বললেন, তাদের একজন পেশাব করার সময় আড়াল করতনা। আর দ্বিতীয় ব্যক্তি একজনের কথা অন্যজনের কাছে লাগাত। এরপর নবী (সাঃ) একটি কাঁচা খেজুরের শাখা আনতে বললেন। অতঃপর উক্ত খেজুরের শাখাটিকে দু'ভাগে বিভক্ত করে প্রত্যেক কবরের উপর একটি করে রেখে দিলেন। রাসূল (সাঃ)কে জিজ্ঞেস করা হল, আপনি কেন এরকম করলেন? উত্তরে তিনি বললেন, হয়ত খেজুরের শাখা দু'টি জীবিত থাকা পর্যন্ত তাদের কবরের আজাব হালকা করা হবে।(বুখারী)
আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ
لَمَّا عُرِجَ بِي مَرَرْتُ بِقَوْمٍ لَهُمْ أَظْفَارٌ مِنْ نُحَاسٍ يَخْمُشُونَ وُجُوهَهُمْ وَصُدُورَهُمْ فَقُلْتُ مَنْ هَؤُلَاءِ يَا جِبْرِيلُ قَالَ هَؤُلَاءِ الَّذِينَ يَأْكُلُونَ لُحُومَ النَّاسِ وَيَقَعُونَ فِي أَعْرَاضِهِمْ
যখন আমাকে মি'রাজে নিয়ে যাওয়া হল, তখন আমি তামার নখ বিশিষ্ট একদল লোকের কাছ দিয়ে অতিক্রম করলাম। তারা নখগুলো দিয়ে তাদের মুখমন্ডল ও বক্ষদেশে আঘাত করে ক্ষত-বিক্ষত করছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে জিবরীল! এসমস্ত লোক কারা? জিবরীল (আঃ) বললেন, এরা দুনিয়াতে মানুষের গোশ্ত ভক্ষন করত এবং তাদের মান-সম্মান নষ্ট করত। অর্থাৎ তারা মানুষের গীবত ও চুগলখোরী করত। (আবু দাউদ)
কাতাদা (রঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আমাদেরকে বলা হয়েছে যে, কবরের আজাবের এক তৃতীয়াংশ হবে গীবতের কারণে, এক তৃতীয়াংশ পেশাব থেকে সাবধান না থাকার কারণে এবং এক তৃতীয়াংশ চুগলখোরীর কারণে। যেহেতু গীবতকারী এবং চুগলখোর মিথ্যা কথাও বলে থাকে, তাই সে মিথ্যাবাদীর শাস্তিও ভোগ করবে। সামুরা বিন জুন্দুব (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) এর স্বপ্নের দীর্ঘ হাদীছে এসেছে,
فَأَتَيْنَا عَلَى رَجُلٍ مُسْتَلْقٍ لِقَفَاهُ وَإِذَا آخَرُ قَائِمٌ عَلَيْهِ بِكَلُّوبٍ مِنْ حَدِيدٍ وَإِذَا هُوَ يَأْتِي أَحَدَ شِقَّيْ وَجْهِهِ فَيُشَرْشِرُ شِدْقَهُ إِلَى قَفَاهُ وَمَنْخِرَهُ إِلَى قَفَاهُ وَعَيْنَهُ إِلَى قَفَاهُ قَالَ وَرُبَّمَا قَالَ أَبُو رَجَاءٍ فَيَشُقُّ قَالَ ثُمَّ يَتَحَوَّلُ إِلَى الْجَانِبِ الْآخَرِ فَيَفْعَلُ بِهِ مِثْلَ مَا فَعَلَ بِالْجَانِبِ الْأَوَّلِ فَمَا يَفْرُغُ مِنْ ذَلِكَ الْجَانِبِ حَتَّى يَصِحَّ ذَلِكَ الْجَانِبُ كَمَا كَانَ ثُمَّ يَعُودُ عَلَيْهِ فَيَفْعَلُ مِثْلَ مَا فَعَلَ الْمَرَّةَ الْأُولَى
অতঃপর আমরা এমন এক লোকের কাছে উপস্থিত হলাম, যাকে চিৎকরে শায়িত অবস্থায় রাখা হয়েছে। একজন লোক লোহার বড়শী হাতে নিয়ে তার মাথার পাশে দাড়িয়ে আছে। দাড়ানো ব্যক্তি শায়িত ব্যক্তির মুখের একদিকে লৌহাস্ত্র প্রবেশ করিয়ে পিছনের দিকে ঘাড় পর্যন্ত চিরে ফেলছে। নাকের ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করিয়ে অনুরূপ করা হচ্ছে এবং চোখের ভিতর প্রবেশ করিয়েও অনুরূপ করা হচ্ছে। একদিকে চিরে শেষ করে অন্যদিকেও অনুরূপ করা হচ্ছে। দ্বিতীয় দিকে চিরে শেষ করার সাথে সাথে প্রথম দিক আগের মত হয়ে যাচ্ছে। আবার প্রথম দিকে নতুন করে চিরা হচ্ছে। হাদীছের শেষাংশে এসেছে, রাসূল (সাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, কি অপরাধের কারণে তাকে এভাবে শাস্তি দেয়া হচ্ছে? জিবরীল (আঃ) বললেন, এহল এমন লোক যে সকাল বেলা ঘর থেকে বের হয়েই মিথ্যা কথা বলত এবং সে মিথ্যা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়তো। (বুখারী)
হাদীছে চোগলখোরের কঠিন শাস্তির কথা এসেছে। যেমন হোযাইফা (রাঃ) রাসূল (সাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেনঃ
لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ قَتَّاتٌ
চুগলখোর জান্নাতে প্রবেশ করবেনা।
আম্মার বিন ইয়াসির (রাঃ) নবী করীম (সাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেনঃ
مَنْ كَانَ لَهُ وَجْهَانِ فِي الدُّنْيَا كَانَ لَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ لِسَانَانِ مِنْ نَارٍ
যে ব্যক্তি দুনিয়াতে দু'জনের নিকট দু'রকম কথা বলবে, কিয়ামতের দিন তার আগুনের দু'টি জিহ্বা হবে। (আবু দাউদ) ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ
سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ مَنْ حَالَتْ شَفَاعَتُهُ دُونَ حَدٍّ مِنْ حُدُودِ اللَّهِ فَقَدْ ضَادَّ اللَّهَ وَمَنْ خَاصَمَ فِي بَاطِلٍ وَهُوَ يَعْلَمُهُ لَمْ يَزَلْ فِي سَخَطِ اللَّهِ حَتَّى يَنْزِعَ عَنْهُ وَمَنْ قَالَ فِي مُؤْمِنٍ مَا لَيْسَ فِيهِ أَسْكَنَهُ اللَّهُ رَدْغَةَ الْخَبَالِ حَتَّى يَخْرُجَ مِمَّا قَالَ
আমি নবী (সাঃ)কে বলতে শুনেছি, যার সুপারিশ আল্লাহর নির্ধারিত কোন দন্ডবিধি বাস্তবায়ন করার প্রতিরোধ হয়ে দাড়াল, সে আল্লাহর সাথে সংগ্রামে লিপ্ত হল। যে ব্যক্তি জেনে-বুঝে ও অন্যায়ভাবে কারো সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হল, সে তা থেকে বিরত থাকার পূর্ব পর্যন্ত আল্লাহর ক্রোধের ভিতরে থাকবে। আর যে ব্যক্তি কোন মুমিন সম্পর্কে এমন কথা বলবে, যা তার ভিতরে নেই, সে যদি তা বর্জন করতঃ তাওবা না করে মৃত্যু বরণ করে, আল্লাহ্ তাকে রাদাগাতুল খাবালে প্রবেশ করাবেন। তার উক্ত কথার প্রায়শ্চিত্ত না হওয়া পর্যন্ত তারা সেখানে অবস্থান করবে। (আবু দাউদ)
আয়েশা (রাঃ) নবী করীম (সাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেনঃ
من أكل لحم أخيه فى الدنيا قرب له يوم القيامة فيقال كله كما أكلته حيا فيأكله و يكلح ويصيح যে ব্যক্তি দুনিয়াতে তার ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করবে, (গীবত করবে) কিয়ামতের দিন গীবতকারীর সামনে গীবতকৃত ব্যক্তিকে মৃত অবস্থায় উপস্থিত করা হবে এবং বলা হবে তুমি মৃত অবস্থায় তার গোশত ভক্ষণ কর যেমনভাবে জীবিতাবস্থায় তার গোশত ভক্ষণ করতে। অতঃপর সে অতি অনিচ্ছা সত্বেও চিৎকার করতে করতে তা ভক্ষণ করবে। (বুখারী)
বর্তমানে মুসলমানরা ব্যাপকভাবে এই অপরাধটিতে লিপ্ত রয়েছে। বিশেষভাবে মহিলাগণ একাজে বেশী লিপ্ত হয়। সমাজে ব্যাপকভাবে এর চর্চা থাকার কারণে প্রতিনিয়ত মানুষের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদের সৃষ্টি হচ্ছে। একারণেই আমি এই পুস্তিকাটিতে বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনা করেছি, যাতে করে এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিগণ সতর্ক হয়ে যায়।
আল্লাহ আমাদের সকলকে গীবতকারীদের অনিষ্টতা হতে হেফাজত করুন। আমীন।