ডা. গাজী মোঃ নজরুল ইসলাম
॥ এক ॥
বায়তুল্লাহ বা কাবা ঘর সর্বপ্রথমে ফেরেশতাগণ নির্মাণ করেন। অতঃপর হযরত আদম (আলাইহিসসাল্লাম) হযরত জিব্রাইল (আলাইহিসসাল্লাম) ইঙ্গিত মতে এর পুনর্নিমাণ করেন । তারপর হযরত নূহ (আলাইহিসসাল্লাম)-এর তুফানের সময় বায়তুল্লাহর প্রাচীর বিনষ্ট হ'লেও ভিত্তি আগের মতই থেকে যায়। পরবর্তীতে আল্লাহর হুকুমে একই ভিত্তি ভূমিতে হযরত ইব্রাহীম (আলাইহিসসাল্লাম) তা পুনর্নির্মাণ করেন।
মহান আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন বলেনঃ নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্যে নির্ধারিত হয়েছে, সেটাই হচ্ছে এ (কাবা) ঘর, যা মক্কায় অবস্থিত এবং সারা জাহানের মানুষের জন্য হেদায়েত ও বরকতময়। এ ঘরটিতে রয়েছ অনেক সুস্পষ্ট নিদর্শন, মাকামে ইব্রাহীম তার অন্যতম। যে লোক বায়তুল্লাহর ভেতরে প্রবেশ করেছে, সে নিরাপত্তা লাভ করেছে। আর বায়তুল্লাহর হজ করা হলো মানুষের উপর আল্লাহর অধিকার; যে লোকের সামর্থ রয়েছে এ পর্যন্ত পৌঁছার। আর যে লোক তা মানে না, (তার যেন রাখা উচিত) আল্লাহ সারা বিশ্ব জাহানের কোন কিছুরই পরোয়া করেন না। -(সূরা আল ইমরান ঃ আয়াত নং ৯৬-৯৭)
পুনর্নির্মাণকালে হযরত ইব্রাহীম (আলাইহিসসাল্লাম) কেন‘আন থেকে মক্কায় এসে বসবাস করেন। ঐ সময় মক্কায় বসতি গড়ে উঠেছিল এবং হযরত ইসমাঈল (আলাইহিসসাল্লাম) তখন বড় হয়েছেন এবং পিতা-পুত্র মিলেই কা‘বা গৃহ পুনর্নির্মাণ করেন। তখন থেকে হরম ও তার অধিবাসীগণ পূর্ণ শান্তি, নিরাপত্তা ও মর্যাদা সহকারে সেখানে বসবাস করে আসছেন। এ বিষয়ে আল-কুরআনের বর্ণনা হলঃ
মহান আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন বলেনঃ আমি কা'বা ঘরকে সারা বিশ্বের মানব জাতির জন্য মিলনকেন্দ্র ও শান্তির স্থান নির্ধারণ করেছি; আর তোমরা ইব্রাহীমের দাঁড়ানোর জায়গাকে নামাযের জায়গা বানাও আর আমি ইব্রাহীম ও ইসমাঈলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার ঘরকে তওয়াফকারী, অবস্থানকারী ও রুকু-সেজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখ। - (সুরা আল বাক্কারাহঃ ১২৫)
বায়তুল্লাহ শরীফে হজ এর বিষয়ে মহান আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন বলেনঃ ‘আর তুমি মানুষের মধ্যে হজের ঘোষণা জারি করে দাও। তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং (দীর্ঘ সফরের কারণে) সর্বপ্রকার কৃশকায় উটের পিঠে সওয়ার হয়ে দূর-দূরান্ত হ'তে। যাতে তারা তাদের কল্যাণের স্থান পর্যন্ত পৌঁছে যায় এবং (কুরবানীর) নির্দিষ্ট দিনগুলিতে (১০, ১১, ১২ যিলহাজ্জ তারা যেন) তাঁর দেওয়া চতুষ্পদ পশুসমূহ যবেহ করার সময় তাদের উপরে আল্লাহর নাম স্মরণ করে। অতঃপর তোমরা তা থেকে আহার কর এবং আহার করাও অভাবী ও দুস্থদেরকে' - (সুরা হজ : আয়াত নং ২৭-২৮)।
হযরত ইব্রাহীম (আলাইহিসসাল্লাম) মাক্বামে ইব্রাহীমে দাঁড়িয়ে এবং কোন কোন বর্ণনা মতে আবু কুবায়েস পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়ে দুই কানে আঙ্গুল ভরে সর্বশক্তি দিয়ে উচ্চ কণ্ঠে চারদিকে ফিরে বারবার আল্লাহর পক্ষ থেকে হজের উক্ত ঘোষণা জারি করেন। ইমাম বাগাভী হযরত ইবনু আববাস (রাদিয়াল্লাহু আনহু) -এর সূত্রে বর্ণনা করেনঃ ইব্রাহীম আলাইহিসসাল্লামের উক্ত ঘোষণা আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন সাথে সাথে বিশ্বের সকল প্রান্তে মানুষের কানে কানে পৌঁছে দেন। আর মহান আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন-এর ইচ্ছায় তখন থেকে অদ্যাবধি কা‘বা গৃহে অবিরত ধারায় হজ, উমরাহ ও ত্বাওয়াফ চালু আছে।
হযরত ইবনু আববাস (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আল্লাহর পক্ষ থেকে ইব্রাহীমী আহ্বানের জওয়াবই হচ্ছে হাজীদের ‘লাববায়েক আল্লা-হুম্মা লাববায়েক' (হাযির, হে প্রভু আমি হাযির) বলার আসল ভিত্তি। সেদিন থেকে এযাবৎ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত হ'তে মানুষ চলেছে কা‘বার পথে কেউ পায়ে হেঁটে, কেউ উটে, কেউ গাড়ীতে, কেউ বিমানে, কেউ জাহাজে ও কেউ অন্য পরিবহনে করে।
আবরাহার মত অনেকে বার বার চেষ্টা করেও আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন-এর মেহমানগণের এ মানব স্রোত কখনো ঠেকাতে পারেনি। পারবেও না কোনদিন ইনশাআল্লাহ। দিন-রাত, শীত-গ্রীষ্ম উপেক্ষা করে সর্বদা চলছে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ ও ছাফা-মারওয়ার সাঈ। আর হজের পরে চলছে কুরবানী। আর এভাবেই হযরত ইব্রাহীম ও ইসমাঈল (আলাইহিসসাল্লাম)-এর স্মৃতি চির অম্লান হয়ে আছে মানব ইতিহাসে যুগ যুগ ধরে। এক কালের চাষাবাদহীন বিজন পাহাড়ী উপত্যকা হযরত ইব্রাহীম (আলাইহিসসাল্লাম)-এর দো‘আর বরকতে হয়ে উঠলো সারা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের মিলনকেন্দ্র হিসাবে। আর হজ হল সারা বিশ্বের মুসলিম উম্মাহর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত ও বিধিবদ্ধ বাৎসরিক তালীমি ও ইসলাহী বিশ্ব সম্মেলন।
হজ যাত্রার প্রস্তুতিঃ মনে রাখবেন! যারা হজে যাচ্ছেন তারা আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন-এর মেহমান। সুতরাং যাত্রা করার আগেই আল্লাহর সম্মানিত মেহমান হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় আত্মিক, মানসিক, শারীরিক ও বৈষয়িক প্রস্তুতি নিতে হবে। যথাঃ- (১) আল্লাহর দরবারে খাঁটি তওবা করা, (২) কারো কোন প্রকার হক নষ্ট হয়ে থাকলে তার ক্ষতিপূরণ করা এবং তার কাছে ক্ষমা চাওয়া, (৩) পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, অধস্তন কর্মকর্তা-কর্মচারী, পাড়া-প্রতিবেশী ও বন্ধু-বান্ধবদেরকে কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক দ্বীনের উপর মজবুতভাবে কায়েম থাকার জন্য জীবনের শেষ নসিহতের ন্যায় বিশেষ নসিহত করা, (৪) ফিরে আসার সম্ভাব্য সময় পর্যন্ত পরিবার-পরিজনের ভরণপোষণসহ প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশন পদান করা এবং (৫) কোন প্রকার শারীয়াত সম্মত অসিয়াত থাকলে শারীয়াত মোতাবেক সাক্ষীসহ লিপিবদ্ধ করে রেখে যাওয়া।
ধারাবাহিক নিয়মাবলীঃ হজের ধারাবাহিক নিয়মাবলী সংক্ষিপ্তভাবে পেশ করছি। হজযাত্রীগণ সফরসঙ্গী হক্কানী ওলামা ও পুরনো হাজীগণের সাথে আলোচন করে বিস্তারিত ধারণা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেন। মনে রাখবেন! হজ বায়তুল্লাহ কে কেন্দ্র করে সারা জীবনে মাত্র একবার আমলের জন্য একটি বিশেষ ফরজ ইবাদাত। অনেকের কাছে ঐ সব পবিত্র স্থানসমূহ অপরিচিত থাকায় তথা হরম এলাকার মর্যাদা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণার অভাবে ভুলত্রুটি হওয়ার আশংকা থাকে। আর ভুল হয়ে গেলে শোধরানোর সুযোগ অনেকের জীবনে দ্বিতীয়বার নাও আসতে পারে। শুধু কিতাব পড়ে বাস্তব জ্ঞান লাভ করা যায় না। সুতরাং সর্বদা সফরসঙ্গী হক্কানী ওলামা ও পুরনো হাজীগণের সাথে থেকে সতর্কভাবে হজ পালন করতে হবে।
ক) বাড়ি থেকে রওনা দেয়ার আপনার ব্যাগ গুছিয়ে মালামাল চেক করে একটি তালিকা তৈরী করবেন। ইহরামের কাপড়, পা-খোলা সেন্ডেল, প্রয়োজনীয়-সম্ভাব্য ওষুধপত্র নিতে ভুলবেন না। পাসপোর্ট, ডলার, রিয়াল ও টাকা-পয়সা শরীরের সাথে রাখবেন। প্রত্যেক মনজিলে আপনার মালামাল লিস্টের সাথে মিলিয়ে দেখবেন। কখনো সহযাত্রী অন্যান্য ভাইদের উপর নির্ভর করবেন না। অন্যের কোন মালামাল বিনা অনুমতিতে ব্যবহার করবেন না। পথে কারও সাথে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হবেন না এবং কাফেলা থেকে বিচ্ছিন্ন হবেন না।
খ) যারা প্রথমে মক্কা শরীফে প্রবেশ করবেন তারা প্রথমে শুধু উমরাহ এর নিয়াতে নিজ বাড়ি থেকে বা দেশের বিমান বন্দর বা সমুদ্র বন্দর থেকে বা মীক্বাত থেকে ইহরাম বেঁধে সরবে ‘তালবিয়াহ' পড়তে পড়তে কা‘বা গৃহে পৌঁছবেন। যদি ভুলক্রমে কারও ইহরাম বাঁধা না হয়ে থাকে তবে জেদ্দা বিমান বন্দরে ইহরাম বেঁধে নিতে হবে। মনে রাখবেন! হরম এলাকার বাইরের লোকদের জন্য ইহরাম ছাড়া হরম এলাকায় প্রবেশ নিষেধ।
গ) যারা প্রথমে মদিনায় প্রবেশ করবেন তাদের নিজ বাড়ি বা দেশের বিমান বন্দর বা সমুদ্র বন্দর থেকে বা মীক্বাত থেকে ইহরাম বাঁধার এবং পথে পথে ‘তালবিয়াহ' পড়ার কোন প্রয়োজন নাই। কারণ জেদ্দা বিমান বন্দর ও মদিনার পথ হরম এলাকার বাইরে অবস্থিত । তারা মক্কায় যাত্রাকালীন মদিনা থেকে বা হরম সীমন্তে অবস্থিত মাসজিদে আয়শা (রাঃ) থেকে ইহরাম বেঁধে ‘তালবিয়াহ' পড়তে পড়তে কা‘বা গৃহে পৌঁছবেন।
ঘ) যারা প্রথম দিকের হজযাত্রী প্রথমে মক্কায় প্রবেশ করবেন, অতঃপর মদিনায় যাবেন, অতঃপর হজের পূর্বে আবার মক্কায় ফিরে আাসবেন- তারা প্রথমে শুধু উমরাহ-এর নিয়াতে নিজ বাড়ি থেকে বা দেশের বিমান বন্দর বা সমুদ্র বন্দর থেকে বা মীক্বাত থেকে ইহরাম বেঁধে সরবে ‘তালবিয়াহ' পড়তে পড়তে কা‘বা গৃহে পৌঁছবেন। অতঃপর উমরাহ শেষ করে হালাল হয়ে যাবেন। অতঃপর মক্কা থেকে মদিনায় যাবেন। এরপর হজের পূর্বে মদিনা থেকে আবার মক্কায় ফিরে আসার সময় মদিনার অবস্থান থেকে অথবা হরম সীমান্তে অবস্থিত মাসজিদে আয়শা (রাঃ) থেকে ইহরাম বেঁধে সরবে ‘তালবিয়াহ' পড়তে পড়তে কা‘বা গৃহে পৌঁছবেন।
ঙ) হজের কার্যক্রম মূলতঃ ৭ যিলহাজ্জ শুরু হবে। যারা ৭ যিলহাজ্জ-এর পূর্বে মক্কায় প্রবেশ করবেন তাদের জন্য তামাত্তু হজ (পৃথক নিয়াতে আলাদাভাবে উমরাহ ও হজ) সম্পাদন করা সহজতর হবে। আর যারা ৭ যিলহাজ্জ মক্কায় প্রবেশ করবেন তাদের জন্য কিরান হজ (একই নিয়াতে উমরাহ ও হজ) সম্পাদন করাই উত্তম।