বাঙ্গালী
Sunday 24th of November 2024
0
نفر 0

হজ্ব: বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের সোপ

মোঃ সাইফুল্লাহ্ মজুমদার

‘হজ্ব' শব্দের আভিধানিক অর্থ ইচ্ছা করা, মহৎ কোন কিছুর সংকল্প করা। আরবী ভাষায় ‘হজ্ব' অর্থ যিয়ারতের সংকল্প করা। পবিত্র খানায়ে কা'বা যিয়ারতের উদ্দেশ্যে যেহেতু মুসলমানেরা পৃথিবীর চতুর্দিক থেকে নির্দিষ্ট কেন্দ্রের দিকে আসে, তাই এর নাম হয়েছে ‘হজ্ব'। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় ‘হজ্ব' অর্থ আল্লাহ্র সস্ত্তষ্টি বিধানের উদ্দেশ্যে শরীয়তের বিধান অনুযায়ী হজ্বের নিয়তে ইহ্রাম বাঁধার পর ৮ই জিলহজ্ব হতে ১৩ই জিলহজ্ব পর্যন্ত নির্দিষ্ট সময়ে মক্কার বায়তুল্লাহ্ শরীফ ও তৎসংলগ্ন কয়েকটি স্থানে আল্লাহ্র নির্দেশ ও রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) এর তরিকা মোতাবেক যিয়ারত ও অবস্থান করা এবং নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানাদি পালন করা।

হজ্বের ইতিহাসঃ

হজ্ব কোন নতুন ইবাদত নহে। অতি প্রাচীন কাল হতে লোকজন হজ্ব পালন করে আসছেন। বায়তুল্লাহ্ মানুষের ইবাদতের জন্য তৈরি করা সর্বপ্রথম ঘর।

আল্লাহ্ বলেন- ‘নিশ্চয় মক্কায় অবস্থিত ঘরখানা মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম ইবাদতের ঘর হিসেবে নির্মিত হয়েছিল যা বরকতময় ও বিশ্ববাসীর জন্য পথ প্রদর্শক।' (সূরা আলে ইমরান-৯৬)

সর্বপ্রথম যখন হযরত আদম (আঃ) হজ্ব সমাপন করেন তখন হযরত জিব্রাইল (আঃ) বলেছিলেন, আপনার ৭ (সাত) হাজার বৎসর পূর্ব হতে ফেরেশতারা এই বায়তুল্লাহ্ শরীফের তাওয়াফ করে আসতেছেন। কথিত আছে যে, হযরত আদম (আঃ) ভারত হতে পদব্রজে ৪০টি হজ্ব সমাপন করেছিলেন। সমস্ত নবী-রাসূলগণও হজ্ব পালন করেছেন। জাহেলিয়াতের যুগেও লোকেরা হজ্ব পালন করত, কিন্তু তা করত নিজেদের স্ব-কপোলকল্পিত বাতিল পন্থায়।

উম্মতে মুহাম্মদীর উপর হজ্বের বিধানঃ

আর্থিক ও শরীরিকভাবে সক্ষম প্রত্যেক বালেগ সুস্থ মস্তিস্কের অধিকারী মুসলিম নর নারীর জীবনে একবার হজ্ব করা ফরয।

আল্লাহ্ বলেন- ‘লোকদের উপর আল্লাহ্র এই অধিকার রয়েছে যে, এই ঘর পর্যন্ত পৌঁছার যার সামর্থ্য রয়েছে সে যেন উহার হজ্ব সম্পন্ন করে, আর যে এই নির্দেশ পালন করতে অস্বীকার করবে তার জেনে রাখা আবশ্যক যে, আল্লাহ্ দুনিয়াবাসীদের প্রতি কিছুমাত্র মুখাপেক্ষী নহেন।' (সূরা আলে ইমরান-৯৭)

হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত রয়েছে- রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহ্তা'আলা তোমাদের উপর হজ্ব ফরয করেছেন। সুতরাং তোমরা অবশ্যই হজ্ব পালন করবে।'- সহীহ মুসলিম

হজ্বের নিয়তঃ

প্রত্যেক কাজই নিয়তের উপর নির্ভরশীল। রাসূল (সঃ) বলেছেন- ‘ইন্নামাল আমালু বিন্নিয়াত'- অর্থাৎ সকল আমল নিয়তের অনুরূপ হয়। তাই খালেস নিয়তে আল্লাহ্র কাছে আত্মসমর্পণ করে তাঁরই সন্তুষ্টি অর্জন, তাঁর আদেশ পালন ও ফরয আদায় করার উদ্দেশ্যে হজ্ব পালন করতে হবে।

হজ্বের উদ্দেশ্যঃ

আল্লাহ্ তা'আলা মানুষের জন্য যে সকল ইবাদত নির্দিষ্ট করেছেন এর কোনটিই উদ্দেশ্যহীনভাবে করেনি। নামায-রোজা হোক, কিংবা হজ্ব হোক, এগুলোর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রশিক্ষণ। কিন্তু এসব ইবাদতের মূল উদ্দেশ্য যারা বুঝেন না বা তৎসম্পর্কে কোন ধারণা রাখেনা, তারা কেবল তাদের পূর্ববর্তী লোকদের দেখাদেখি এগুলোর নকলই করতে থাকেন, এর থেকে কোন সুফল আশা করা যায় না। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ লোক ইসলামের প্রাণকেন্দ্র মক্কায় গমন করে এবং হজ্বের সৌভাগ্য লাভ করে ফিরে আসে, কিন্তু হজ্ব যাত্রীর স্বভাব-চরিত্রে যে পরিবর্তন কাম্য ছিল তা তেমন দেখা যায় না। হজ্ব থেকে ফিরে আসার পরও তাদের মানসিক ও নৈতিক ক্ষেত্রে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না। এর মূল কারণ হচ্ছে হজ্বের আসল উদ্দেশ্য এবং মূল কাজ হতে আমরা বঞ্চিত। নিম্নে হজ্বের কয়েকটি উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হল।

(১) ইসলামের দাওয়াত সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়াঃ

সমগ্র বিশ্বের আনাচে কানাচে থেকে মুসলমানগণ হজ্বের সময় মক্কায় একিত্রত হয়। এখান থেকে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা নিয়ে তা বিশ্বের প্রতিটি জায়গায় ছড়িয়ে দিবে। হযরত মুহাম্মদ (সঃ) বিদায় হজ্বের সময় যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন তা মুসলমানদের ভবিষ্যৎ দিক নির্দেশনারই অংশ। ইসলামী আন্দোলনের আওয়াজ সমগ্র বিশ্বে পৌঁছানোর জন্য এবং এ আন্দোলনকে চিরকাল জীবিত রাখার জন্য এর চেয়ে শক্তিশালী উপায় আর কিছুই হতে পারে না।

(২) বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টিঃ

হজ্ব উপলক্ষে সমগ্র মুসলিম জাতির এক অনন্য মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এর ফলে পারস্পরিক পরিচিতি, মুসলমানদের মধ্যে একতা এবং ঐক্যের বন্ধন সৃষ্টি হয়। পৃথিবীর সকল স্থান থেকে সব বর্ণ ও গোত্রের লোক একত্রিত হয়, যাকে আধুনিক পরিভাষায় ‘বিশ্ব ইসলামী কনফারেন্স' বলে অভিহিত করা যায়। ইহা এমন একটি মহাসম্মেলন যার মাধ্যমে বিশ্ব মুসলমানদের মধ্যে এক অপূর্ব ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি হয়। এ ধরনের সম্মেলনের নজির পৃথিবীর অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।

(৩) ইসলামী শান-শওকত ও বায়তুল্লাহ্ মর্যাদার প্রদর্শনীঃ

প্রত্যেক সংগঠন এবং প্রত্যেক সম্প্রদায় তাদের ক্ষমতা, মর্যাদা ও বাৎসরিক পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য বৎসরে একবার কেন্দ্রীয় সম্মেলন ডাকে। মুসলমানেরা বীরের জাতি। ইসলাম আল্লাহ্তায়ালার মনোনীত শ্রেষ্ঠ ধর্ম। বায়তুল্লাহ্ মুসলমানদের ইবাদতের কেন্দ্র বিন্দু। তাই আল্লাহতায়ালা মুসলমানদের শক্তি, জাঁকজমক প্রদর্শন করার জন্য, বিশ্ববাসীর দৃষ্টি মুসলমানদের দিকে আকৃষ্ট করার জন্য এবং বায়তুল্লাহ্ শরীফের মর্যাদার প্রদর্শনীয় জন্য বৎসরে একবার হজ্ব অর্থাৎ বিশ্ব সম্মেলনের ব্যবস্থা করেছেন।

(৪) বিশ্ব পরিকল্পনা গ্রহণঃ

হজ্বকে কেন্দ্র করে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র প্রধান, সরকার প্রধান, উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মকর্তা, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, অর্থনীতিবিদসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সমাগম ঘটে। এর মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম নেতৃবৃন্দ তাদের কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারেন। তাদের অতীতের কর্মসমূহের পর্যালোচনা করতে পারেন। মুসলিম দেশসমূহের বিভিন্ন সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। পরবর্তী বছরগুলোর প্রয়োজনীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

 

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

বায়তুল্লাহ জিয়ারত ও হজ
প্রকৃত রোজা ও সংযমের কিছু ...
গীবত ও চুগলখোরীর ভয়াবহ পরিণাম
সফরে কসর ওয়াজিব
হজ্বঃ মানব সভ্যতার সর্বশ্রেষ্ঠ ...
হজ্ব: বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের সোপ
লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক
হাজিদের উদ্দেশ্যে ইরানের ...
মিরাজুন্নবীর (সা.) তাৎপর্য ও ...
দাসত্ব-উবুদিয়্যাহ

 
user comment