কোনো কোনো বড় ঘটনার প্রভাব, প্রতিক্রিয়া আর প্রতিফলন সময় ও স্থানের গণ্ডী পেরিয়ে যায় এবং তা গোটা বিশ্বকে নাড়া দেয়। ইরানের ইসলামী বিপ্লব হচ্ছে এমনই এক ঐতিহাসিক ঘটনা। অনেকের জন্যই এই বিপ্লব খোদায়ী অনুপ্রেরণার অন্যতম এক মহা-উৎস। এই বিপ্লব বিজয়ের ৩৫ বছর পরও নানা দিকে অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে।
ইরানের ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পর এই বিপ্লব রফতানির প্রসঙ্গে নানা মিথ্যাচার ও অদ্ভুত ধারণা প্রচার করেছিল পাশ্চাত্য এবং তাদের নানা প্রচারযন্ত্র। বলা হয়েছিল ইরানের ইসলামী সরকার দেশে দেশে হস্তক্ষেপ করে ক্ষমতাসীন সরকারগুলোকে উৎখাত করে বিপ্লবী সরকার গঠন করবে। কিন্তু ইরানের ইসলামী বিপ্লবের রূপকার ইমাম খোমেনী (র.) এইসব প্রচারণা উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন: আমাদের বিপ্লব রফতানির অর্থ হল সব জাতিগুলোর জেগে ওঠা এবং নিজেদেরকে নানা সংকট থেকে মুক্ত করা...।
হ্যাঁ, নানা মিডিয়া বা গণমাধ্যমের সুবাদে ইসলামী বিপ্লবের আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ ও খাঁটি মুহাম্মদী ইসলামের বাণী ছড়িয়ে পড়েছে অনেক সত্য-পিপাসু এবং মুক্তিকামী মুসলমানদের কাছে। মিসেস ডোরা হলেন এমনই এক সৌভাগ্যবতী। এ বিপ্লব কিভাবে তাকে সত্য-অনুসন্ধানে উদ্বুদ্ধ করেছে সে সম্পর্কে তিনি বলেছেন: 'আমার কাছে এটা খুবই আকর্ষণীয় ব্যাপার ছিল যে, এ কোন্ আদর্শ বা ধর্ম যা এ ধরনের নেতা ও স্বাধীনচেতা ব্যক্তিদের গড়ে তোলে?'
মিসেস ডোরা জন্ম নিয়েছেন জার্মানির এক খ্রিস্টান পরিবারে। নিজের জীবন ও ইসলামের সঙ্গে পরিচয় সম্পর্কে তিনি বলেছেন:
'আমি জন্ম নিয়েছিলাম এক ক্যাথলিক পরিবারে। আমার মা বেশ ধর্মকর্ম করতেন। কিন্তু আমার বাবার কাছে ধর্ম ছিল একটি গৌণ বিষয়। আর এ সময়ই খ্রিস্ট ধর্ম সম্পর্কে একটি ধারণা বা চিত্র আমার মধ্যে প্রথমবারের মত গড়ে উঠেছিল। শৈশবেই জীবনের অর্থ ও লক্ষ্য নিয়ে ভাবনা জেগেছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এ সংক্রান্ত অনুসন্ধানে কোনো ফল পাইনি। ফলে আমার প্রাত্যহিক জীবন ও আল্লাহ বা স্রস্টার প্রতি বিশ্বাসের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। আমি ভাবতাম যদি স্রস্টার প্রতি বিশ্বাসী হই তাহলে স্বাভাবিক জীবন অব্যাহত রাখতে পারব না। আমার মন ও আত্মাকে পরিতৃপ্ত করার মত কিছুই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। যতই অনুসন্ধান করে যাচ্ছিলাম ততই হতাশ হচ্ছিলাম। আর এ জন্যই পশ্চিমা মডেলের জীবন-প্রণালীর কাছে আত্মসমর্পণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম ধীরে ধীরে। বেশ কিছু সময় অজ্ঞতা ও আরাম-আয়েশের মধ্য দিয়ে কেটে গেল। ডুবে ছিলাম বস্তুবাদে এবং পশ্চিমা জীবন-যাপন প্রণালী নিয়েই ভাবতাম।
এরপর জার্মান নারী ডোরা পরিচিত হন সাবেক ইয়োগোস্লাভিয়ার এক পুরুষ নাগরিকের সঙ্গে এবং এরপর তার সঙ্গে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন। চাহভিজ নামের এই ব্যক্তি বিশ্বের নানা বাস্তবতা সম্পর্কে অবহিত করেন ডোরাকে। পরাশক্তিগুলো যে অন্য জাতিগুলোকে শোষণ করছে ও তাদের সম্পদ লুট করছে তা স্ত্রীর কাছে তুলে ধরেন তিনি।
মিসেস ডোরা আরো বলেন, 'আমার স্বামী বঞ্চিত ও শোষিতদের দুঃখে সহানুভূতি অনুভব করতেন বলে বিশ্বের নানা বিপ্লব সম্পর্কে পড়াশুনায় আগ্রহী হন এবং এসব বিষয় সম্পর্কে আমাকেও ধারণা দেন। ফলে আমার জীবনের মোড় ঘুরে যায় পুরোপুরি। আর এ সময়ই ঘটে ইরানের ইসলামী বিপ্লব ইমাম খোমেনী (র.)'র নেতৃত্বে। আমার স্বামী লক্ষ্য করলেন যে এটাই আধুনিক যুগের একমাত্র সফল বিপ্লব যার ভিত্তি হল ধর্মীয় আদর্শ। এর আগে তিনি ভাবতেন যে ধর্ম হচ্ছে বিপ্লবের ও প্রগতির অন্তরায় এবং সমাজের পশ্চাদকামীতার কারণ। অথচ ইরানের ইসলামী বিপ্লবের নেতা হচ্ছেন একজন আলেম ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব। ফলে চাহভিজের চিন্তাধারার কাঠামোই বদলে গেল। ফলে সে ও আমি দু'জনই ইসলামী বিপ্লব সম্পর্কে গবেষণার সিদ্ধান্ত নিলাম।'
ইসলাম যে জুলুম ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের চেতনা যোগায়, ইরানের ইসলামী বিপ্লব তার প্রমাণ। তাই এ বিপ্লবের নানা সাফল্য এবং জনগণের আত্মত্যাগ ও প্রতিরোধের চেতনার বিস্তারকে পরাশক্তিগুলো সবচেয়ে বড় হুমকি বলে গণ্য করতে থাকে। অন্যদিকে ইরানের নেতৃত্বে বিপ্লবী ইসলাম পাশ্চাত্যের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠায় কেবল মুসলিম বিশ্বের জনগণের মধ্যে নয়, অমুসলিম বিশ্বেও সাম্রাজ্যবাদীদের কথিত গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের নামে প্রতারণামূলক পশ্চিমা লিবারেল জীবনাদর্শ প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের ধর্মীয় ও গণমুখী চরিত্রে মুগ্ধ হন জার্মান নারী ডোরা ও তার স্বামী। মিসেস ডোরা এ প্রসঙ্গে বলেছেন: 'ইরানে ইসলামী বিপ্লব সফল হওয়ায় ধর্ম সম্পর্কে আমার ও আমার স্বামীর ধারণা পাল্টে যায়। ফলে ইসলাম সম্পর্কে গবেষণার জন্য মুসলমানদের সঙ্গে যোগাযোগ ও সম্পর্ক গড়ে তুলি আমরা এবং শুরু করি ব্যাপক ও গভীর গবেষণা। ইসলাম যে এমন স্বাধীনচেতা নেতা গড়ে তুলতে পারে এবং পরাশক্তিগুলোর বিরোধিতা উপেক্ষা করেও যে ইসলাম ধর্ম ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব - এ দুটি বিষয় আমাকে গভীরভাবে মুগ্ধ করেছে।'
জার্মান নও-মুসলিম মিসেস ডোরা আরো বলেন,
'আমরা মূলত ইসলামী বিশ্বাস নিয়েই আলোচনা করতাম মুসলমানদের সঙ্গে। আর যতই গবেষণা করছিলাম ততই ইসলামের দিকে আকর্ষণ বাড়ছিল। এইসব গবেষণার পর স্পষ্ট হল, ইসলাম সম্পর্কে কত মিথ্যা ধারণা প্রচার করা হয় এবং পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো কত মিথ্যা সংবাদ প্রচার করছে ইসলাম সম্পর্কে। এইসব সংবাদের সঙ্গে বাস্তবতার রয়েছে আকাশ-পাতাল পার্থক্য।'
ইরানে ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পর মার্কিন সরকার ও ইউরোপ ইসলামের বিরুদ্ধে বিষাক্ত প্রচারণা জোরদার করে। কারণ, তারা ভয় করছিল যে, আবারও ইসলামী সভ্যতা বিশ্বে কর্তৃত্বশীল হয়ে উঠতে পারে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে পতাকা দীর্ঘকাল ধরে মুসলমানদের হাতে ছিল তার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে আবার। অর্থাৎ মুসলমানরা আবারো ফিরে পেতে পারে তাদের সেই হারানো সোনালী যুগের গৌরব-এই আতঙ্কে ভুগছে পাশ্চাত্য। মুসলিম বিশ্বের প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ, মুসলিম যুব সমাজের মেধা ও মুসলমানদের উন্নত জীবন-যাপন প্রণালী তথা ইসলামী জীবনাদর্শের শ্রেষ্ঠত্ব-এসবই তাদের জন্য আতঙ্কের বিষয়। বর্তমান যুগে তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের নানা সুবিধা থাকায় ইসলামী জাগরণও ছড়িয়ে পড়ছে। আর ইরানের ইসলামী বিপ্লবও প্রভাব ফেলছে এই প্রক্রিয়ায়।
বর্তমানে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান বিশ্বে অত্যন্ত প্রভাবশালী ও মর্যাদাসম্পন্ন শক্তি হিসেবে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা-প্রবাহের ওপর প্রভাব রাখছে। দেশটির ন্যায়বিচারকামী ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চেতনা বিশ্বের অন্য জাতিগুলোর মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে।
জার্মান নওমুসলিম মিসেস ডোরা এ প্রসঙ্গে বলেছেন: ইসলাম ও ইসলামী বিপ্লবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রগুলোকে চিহ্নিত করতে পেরে এবং ইসলামের সত্যতা আর শ্রেষ্ঠত্ব বুঝতে পেরে আমি ও আমার স্বামী এই মহান ধর্মের প্রতি ঈমান এনেছি। বড় রকমের এই পরিবর্তন আমার জীবনের সব দিককে করেছে আলোকিত এবং এটা জানতে পেরেছি যে কেবল নিজের জীবন সম্পর্কেই নয়, সমাজ সম্পর্কেও আমাদের রয়েছে বড় ধরনের দায়িত্ব।'
মিসেস ডোরা মুসলমান হওয়ার পর নিজের জন্য 'হালিমা' নামটি বেছে নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি, 'তিনি কেবল ইরানিদেরকেই ইসলামী প্রজাতন্ত্র উপহার দেননি; একইসঙ্গে আমাদেরকেও এর মাধ্যমে হেদায়েত করেছেন।'#