মধ্যবয়স্ক এ মুসল্লী এরপর ট্যারান্টের ফেলে দেয়া একটি বন্দুক তুলে নিয়ে হামলাকারীকে লক্ষ্য করে ট্রিগারে টিপ দেন, বুঝতে পারেন ট্রিগারটি একেবারেই শূন্য।
আবনা ডেস্ক: ক্রাইস্টচার্চে দুই মসজিদে হামলা হয়েছে। এতে শোকার্ত ওই এলাকার মানুষ। তবে ওই দিনে কিছু সাহসী মানুষের বীরত্বের গল্প ঘুরছে মানুষের মুখে মুখে। তাদের কাউকে দেওয়া হচ্ছে বীরের খেতাব বা কাউকে মরণোত্তর বীরের খেতাব। নিজেদের জীবন তুচ্ছ জ্ঞান করে এ ‘বীরেরা’ বাধা দিয়েছেন হামলাকারীকে, বাঁচিয়েছেন অসংখ্য প্রাণ। সাহসীদের পাকিস্তানের নাগরিক নাইম রশিদ ও আফগান শরণার্থী আবদুল আজিজের বীরত্বের গল্পই চাউর হয়েছে।
এর মধ্যেই সেই দিনের হামলাকারীকে ঠেকাতে প্রাণ হারানো পাকিস্তানি নাগরিক নাইম রশিদকে বীরের খেতাব দিতে যাচ্ছে পাকিস্তান। তাকে মরণোত্তর জাতীয় সম্মানে ভূষিত করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান।
গত শুক্রবার ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে সন্ত্রাসী হামলায় ৯ পাকিস্তানি নিহত হয়েছেন; ৪৯ বছর বয়সী নাইম রশিদ তাদের একজন।
রোববার টুইটারে দেয়া এক বার্তায় ইমরান খান বলেন, শেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী সন্ত্রাসীকে ঠেকাতে গিয়ে শহীদ মিয়া নাইম রশীদের জন্য পাকিস্তান গর্বিত। জাতীয় পুরস্কারের মাধ্যমে তার সাহসের স্বীকৃতি দেয়া হবে। ক্রাইস্টচার্চে নিহত পাকিস্তানিদের পরিবারকে সহায়তার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে জন্ম রশিদের। ক্রাইস্টচার্চের আল নূর মসজিদে হামলাকারী বন্দুকধারীকে ঠেকাতে গিয়ে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন তিনি। পরে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হয়। কিন্তু নির্বিচারে ছোড়া গুলির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত রশীদ চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার রাতে মারা যান।
আল নূর মসজিদে শেতাঙ্গ সন্ত্রাসী ব্রেন্টনের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন রশিদের ২১ বছর বয়সী ছেলে তালহা নাইম। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মোহাম্মদ ফয়সাল বলেন, নিহত দু'জনকে ক্রাইস্টচার্চে দাফন করা হবে। তাদের দাফনের প্রস্তুতি চলছে।
পাকিস্তান থেকে নিউজিল্যান্ডে পাড়ি জমানোর পর ক্রাইস্টচার্চে শিক্ষকতা পেশা শুরু করেছিলেন রশিদ। তার ছেলে তালহা নাইম সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেছিলেন। রশীদের স্ত্রী আমব্রিন বলেন, আমার স্বামী এবং আমার ছেলে হলো বীর।
হামলার লাইভ ভিডিওতে দেখা যায়, হামলাকারীকে ঠেকানোর চেষ্টা করছেন রশীদ। বিশ্বের মানুষ তাকে বীর হিসেবে মনে রাখবে বলে মন্তব্য করেছেন রশীদের শ্যালিকা নাইমা খান।
এদিকে বন্দুকধারী হামলকারীকে ঠেকানো একজন ৪৮ বছর বয়সী আবদুল আজিজ। যিনি ক্রেডিট কার্ড মেশিন নিয়ে ধাওয়া করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ান বন্দুকধারী ব্রেন্টন ট্যারান্টকে।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, আফগানিস্তানে জন্ম নেওয়া আজিজের সেদিনের প্রতিরোধ ট্যারেন্টের দ্বিতীয় আক্রমণকে অনেকখানিই খর্ব করেছিল।
এক বন্দুকধারী নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছে- কেউ একজন এমনটা চিৎকার করে বলার পর লিনউড মসজিদের বাইরে মুখোমুখি হয়েছিলেন ৪৮ বছর বয়সী মুসল্লি আজিজ ও ট্যারান্ট।
অস্ট্রেলিয়ান এ বন্দুকধারী তার আগেই কাছাকাছি আল নূর মসজিদ ও রাস্তায় কয়েক ডজন মানুষকে হত্যা করেন।
আজিজ বলেন, তার গায়ে ছিল সামরিক পোশাক। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না, তিনি ভালো না খারাপ মানুষ। কিন্তু যখন সে আমার দিকে ফিরে অভিশাপ দিচ্ছিল, তখনই আমি বুঝতে পারি যে সে ভালো মানুষ নয়। এমনটাই বলেছেন রয়টার্সকে আবদুল আজিজ।
আফগান বংশোদ্ভুত এ নিউজিল্যান্ডের বাসিন্দা জানান, মসজিদে হামলা হয়েছে বুঝতে পারার পরপরই তিনি হাতের কাছে পাওয়া একটি ক্রেডিট কার্ড মেশিনকে অস্ত্র বানিয়ে ট্যারেন্টকে ধাওয়া করেছিলেন।
এরপর ট্যারান্ট তার গাড়িতে ফিরে যান ও অন্য একটি বন্দুক নেন। অস্ট্রেলিয়ান এ নাগরিক যখন ফের গুলি ছোড়েন মাথা বাঁচাতে আজিজ তখন দুই গাড়ির মাঝখানে নেন আশ্রয়।
মধ্যবয়স্ক এ মুসল্লী এরপর ট্যারান্টের ফেলে দেয়া একটি বন্দুক তুলে নিয়ে হামলাকারীকে লক্ষ্য করে ট্রিগারে টিপ দেন, বুঝতে পারেন ট্রিগারটি একেবারেই শূন্য।
তিনি বলেন, আমি তার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করছিলাম। বলছিলাম- এদিকে আসো, এদিকে আসো। আমি চেষ্টা করেছিলাম, তার মনোযোগ যেন আমার দিকে থাকে।
ট্যারান্ট এরপর মসজিদে ঢুকলে তাকে ধাওয়া করে সেখানে গিয়েও মুখোমুখি হন আজিজ।
তিনি বলেন, যখন সে শটগান হাতে আমাকে দেখতে পায়, সে তার বন্দুক ফেলে দিয়ে গাড়ির দিকে দৌঁড় দেয়। আমিও তাকে ধাওয়া করি। সে তার গাড়িতে বসলে আমি হাতের শটগান তার গাড়ির জানালা বরাবার তিরের মতো ছুড়ে মারি।
প্রাণ বাঁচাতে তখন মসজিদের ভেতর আশ্রয় নিয়েছিল আজিজের চার সন্তানসহ প্রায় একশ মুসল্লী।
আজিজ বলেন, যখন আমি মসজিদে ফিরে আসি তখন দেখতে পাই সবাই আতঙ্কিত, সবাই নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য হন্তদন্ত। আমি তাদের বলি- ভাই, তোমরা এখন নিরাপদ, উঠে দাঁড়াও, সে (হামলাকারী) চলে গেছে, সে পালিয়ে গেছে। তারপরই সবাই কাঁদতে শুরু করে।
হামলার ৩৬ মিনিটের মধ্যেই আটক হন ‘উগ্র ডানপন্থি’ ট্যারান্ট। তার বিরুদ্ধে শনিবার খুনের আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনা হয়েছে।
কাবুলের বাসিন্দা আজিজ কয়েক বছর আগে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান ছেড়ে নিউ জিল্যান্ডে বসবাস শুরু করেন। আড়াই বছর ধরে ক্রাইস্টচার্চে থাকা এ মুসলিমের একটি আসবাবপত্রের দোকান আছে।
জানা গেছে, নিহতদের মধ্যে বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, সৌদি আরব, মিসর, জর্ডান, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার নাগরিক রয়েছেন। আধুনিক নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসে এটিই সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলা।
প্রসঙ্গত, শুক্রবার নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে বন্দুকধারীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে ৫০ জন নিহত হন। আহত হয়েছেন অন্তত ৪৮ জন। এই সন্ত্রাসী হামলার সময় আল নূর মসজিদে নামাজ পড়তে যাচ্ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সদস্যরা। তারা মসজিদে ঢুকার কিছুক্ষণ আগে এক পথচারীর কাছ থেকে খবর পেয়ে ফিরে আসেন।
ফলে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান ক্রিকেটাররা।এ ঘটনায় বাংলাদেশের তিনজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে।