সলামের ইতিহাসে রাসূলে খোদার পর ধর্মীয়,সাংস্কৃতিক এবং জ্ঞান-গবেষণার ক্ষেত্রে যাঁর চেষ্টা-প্রচেষ্টাকে যুগান্তকরী বলে মনে করা হয় তিনি হলেন পবিত্র আহলে বাইতের মহান ইমাম জাফর সাদেক (আ.)।
ইমাম সাদেক (আ.) এর আন্দোলনের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হলে তাঁর সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও অবস্থা সম্পর্কে সচেতনতা প্রয়োজন। ৩৪ বছরের ইমামতিকালে ইমাম সাদেক (.আ.) সর্বমোট ৭ জন শাসকের শাসনকাল দেখেছেন। এদের মধ্যে ৫জন হলো উমাইয়া শাসক আর ২ জন আব্বাসীয়। এই দীর্ঘ সময়ে ইমাম দুটি কর্মসূচিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। একটি হলো অত্যাচারী শাসকদের জুলুম-অত্যাচারের বিরোধিতা এবং অপরটি হলো জনগণের চিন্তা চেতনার উন্নয়ন ও উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানগত বৈপ্লবিক ভিত রচনার পাশাপাশি তাদেরকে ইসলামের প্রকৃত স্বরূপ ও মৌলিক দিকগুলোর সাথে পরিচয় করানোর চেষ্টা। এই দুটি কর্মসূচির মাধ্যমে ইমাম চেয়েছেন ইসলামের উজ্জ্বল ও পবিত্র স্বরূপের ওপর যেসব বিকৃতি বা কুসংস্কার আরোপিত হয়েছিল,সেগুলোকে দূর করা।
যে সময় বনী উমাইয়া এবং বনী আব্বাস ক্ষমতার লোভে ব্যাপক দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিল,তারা তখন মহানবীর আহলে বাইতের ওপর চাপ প্রয়োগের মতো অবকাশ খুব কমই পেত। এই ফাঁকে ইমাম সাদেক (আ.) ভালো একটা সুযোগ পেয়েছিলেন তাঁর কর্মসূচি অনুযায়ী ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডগুলো পরিচালনা করার। তাঁর সমকালে মুসলিম সমাজে জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে ব্যাপক আশা-উদ্দীপনা লক্ষ্য করা গিয়েছিল। বিশেষ করে জ্ঞানের জগতে তাফসির,হাদিস,ইলমে কালাম,ফিকাহ, চিকিৎসা ও দর্শন শাস্ত্র প্রভৃতি বিষয় ছিল বেশ উজ্জ্বল এবং মানুষও বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান লাভের ব্যাপারে আগ্রহী ছিল। কিন্তু এসবের বাইরেও আরেকটি প্রবণতা ছিল সে সময়,তাহলো ইসলামী সমাজে মাযহাবগত বিভিন্ন ফের্কা বা মতাদর্শও ছিল। যার ফলে ইসলামী সমাজের ওপর বিদেশী বোধ-বিশ্বাস বা মতবাদগুলো আগ্রাসন চালানোর চেষ্টায় লিপ্ত ছিল। এ রকম একটি অবস্থায় চিন্তারাজ্যের আকাশে ইমাম সাদেক (আ.) এর চিন্তা-চেতনার সূর্য জ্বলজ্বল করে উঠলো। ঐ সূর্যের আলোয় স্নাত হলো শত্র"-মিত্র সবাই।
ইসলামের সাথে তাদের যথার্থ সম্পর্ক না থাকার কারণে কিংবা জনগণের সাথে তাদের সংশ্লিষ্টতার অভাবে ইসলামে সমাজে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা জেঁকে বসেছিল। সমাজে নাস্তিক্যবাদী চিন্তার প্রসার ঘটেছিল। ধর্মীয় আলেম-ওলামা বা মুবাল্লিগগণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাজ-দরবারের সাথে যুক্ত ছিলেন। আব্বাসীয় খলিফারাও উমাইয়া খলিফাদের মতোই ধর্মকে তাদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে ব্যবহার করতেন। এরকম একটি অবস্থা থেকে স্বাভাবিকভাবেই ইমাম সাদেক (আ.) এর কাজ যে কতোটা কঠিন ও জটিল ছিল তা অনুমান করা যায়। তারপর তিনি ইসলাম সম্পর্কে জনমনে উত্থিত সকল দ্বিধা-সংশয় আর যাবতীয় জিজ্ঞাসার যৌক্তিক জবাব দিয়ে মানুষের তৃষ্ণা দূর করেছেন। বিশেষ করে তিনি বেশকিছু ছাত্র তৈরী করে গেছেন যারা ইতিহাসে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছেন। ইতিহাসে এসেছে অন্তত ৪ হাজার ছাত্র তিনি তৈরী করে গেছেন। তারাও ইসলামের বিভিন্ন শাখায় বিভিন্ন বই লিখে তাঁদের জ্ঞানের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে গেছেন।
ইমামের অসংখ্য ছাত্রের মধ্যে একজন ছিলেন মুফাজ্জাল। তিনি তৌহিদে মুফাজ্জাল নামে একটি বই লিখেছিলেন। তিনি বলেছেন,শেষ বিকেলে অর্থাৎ সূর্য অস্ত যাবার সময় একদিন মদীনার মসজিদে বসেছিলাম। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নবীজীকে যেই সম্মান মর্যাদা আর বুযুর্গি দান করেছেন,তা নিয়ে ভাবছিলাম। এমন সময় ইবনে আবিল উজা নামে এক নাস্তিক মসজিদে এলো এবং তার এক বন্ধুর সাথে বিতর্কে জড়িয়ে পড়লো। তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল সৃষ্টিজগতের স্রষ্টা। আলোচনা করতে করতে তারা বলে উঠলো যে এই বিশ্বের বা সৃষ্টিকূলের কোনো স্রষ্টা নেই। তাদের কথা শুনে রাগে তো আমার মাথায় আগুণ ধরে যাবার উপক্রম,আমি ভীষণরকম বিরক্ত হলাম এবং ইবনে আবুল উজাকে বললাম, হে আল্লাহর শত্র"! সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করছো যে কিনা তোমাকে সবচে সুন্দর অবয়বে সৃষ্টি করেছেন? যদি নিজেকে নিয়ে ভাবো তাহলে তোমার নিজের অস্তিত্ব বা সত্ত্বার মাঝে স্রষ্টাকে খুঁজে পাবে।
ইবনে আবিল উজা বললো-আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি মোফাজ্জাল! তুমি জাফর ইবনে মোহাম্মাদ সাদেক অর্থাৎ ইমাম সাদেক (আ.) এর অনুসারী! সে তো নিজেও আমাদের সাথে এভাবে কথা বলে না। সে বহুবার আমাদের কথা শুনেছে কিন্তু কখনোই আমাদের গালি দেয় নি। সে ভীষণ ভদ্র-নম্র প্রশান্ত এবং সহনশীল। রাগ-ক্রোধ তার ওপরে কখনোই বিজয়ী হতে পারে নি। সে আমাদের কথাবার্তা খুব মনোযোগের সাথে শোনে এবং অতি অল্প কথায় যুক্তি-প্রমাণ পেশ করে আমাদের যুক্তিকে খণ্ডন করে। মোফাজ্জাল একথা শুনে বলেন, ইবনে আবুল উজার কথায় ভীষণ মর্মাহত ও অনুতপ্ত হলাম। ইমাম সাদেক (আ.) এর সান্নিধ্যে উপস্থিত হলাম এবং ঘটনাটা বললাম। আমার কথা শুনে ইমাম বললেন, হে মোফাজ্জাল! তোমাকে সৃষ্টিকূল, জন্তু-জানোয়ার, পশুপাখি,মানুষসহ সকল প্রাণীকূল এবং তাদের সৃষ্টির পেছনে আল্লাহর কৌশল বা হেকমত সম্পর্কে বলবো। উপদেশ গ্রহণকারীরা উপদেশ গ্রহণ করে,মুমিনরা তাদের জ্ঞান বৃদ্ধি করে আর কাফেররা অবাক বনে যায়। তুমি আগামীকাল সকাল থেকে আমার কাছে এসো! বর্ণনায় এসেছে যে মোফাজ্জাল একটানা ৪ দিন ইমাম সাদেক (আ.) এর খেদমতে হাজির হন এবং তিনি সৃষ্টিজগতের শুরু থেকে নিয়ে মূল্যবান বক্তব্য উপস্থাপন করেন। মোফাজ্জালও ইমামের বক্তব্যকে সংকলিত করে তৌহিদে মোফাজ্জাল নামে বইটি রচনা করেন। মূল্যবান এই গ্রন্থটি সৃষ্টিজগত সম্পর্কে কৌতূহলী পাঠকদের চিন্তার খোরাক জোগাবে নিঃসন্দেহে।
হানাফি ফেকাহর ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ও ছিলেন ইমাম জাফর সাদেক (আ.) এর সুযোগ্য ছাত্র। তিনিও ইমামের জ্ঞানের সমৃদ্ধির কথা স্বীকার করেছেন নির্দ্বিধায়। ইমাম সাদেক (আ.) এর জ্ঞান সম্পর্কে মজার একটি ঘটনা আছে। আব্বাসীয় খলিফা মানসুর ইমাম সাদেক (আ.) এর সম্মান ও মর্যাদার কারণে উদ্বিগ্ন ছিলেন। এই উদ্বেগ নিরসনের লক্ষ্যে ইমামের জ্ঞান-গরিমাগত মর্যাদা কমানোর স্বার্থে মানসুর সিদ্ধান্ত নেয় ইমামকে কঠিন কিছু বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে,যাতে তিনি সঠিক জবাব দিতে না পারেন,পরিণতিতে জনগণের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়। একজন পণ্ডিত ব্যক্তিকে এই প্রশ্ন করার কাজে সহযোগিতা করতে বলা হলো। ঐ পণ্ডিত ৪০টি জটিল বিষয়ে প্রশ্ন করলেন। ইমাম বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে ঐসব বিষয়ের সুন্দর সমাধান দিলেন। কোনো কোনো বিষয়ে বিভিন্ন মাযহাবের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার পাশাপাশি নিজের দৃষ্টিভঙ্গিও তুলে ধরে জবাব দেন। ঐ পণ্ডিত শেষ পর্যন্ত নিজেই স্বীকার করলেন যে ফিকাহ সম্পর্কে এতোবড়ো জ্ঞানী তিনি আর দেখেন নি।
মালেকি ফিকাহর ইমাম মালেক ইবনে আনাসও ছিলেন ইমাম জাফর সাদেক (আ.) এর গর্বিত ছাত্র। তিনি বলেন-"সবসময় মৃদু হাঁসি ইমামের ঠোঁটে লেগে থাকতো। আমি তাঁকে কখনো অপ্রয়োজনীয় গল্প-গুজব করতে দেখে নি। তাঁর সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে ছিল আল্লাহর ভয়। যখনই তাঁর কাছে যেতাম তাঁর পায়ের নীচের মেট বা মাদুরটি তুলে আমার পায়ের নীচে দিয়ে দিতেন। কোনোদিন এর ব্যতিক্রম ঘটে নি।
কায়েমি স্বার্থবাদীদের সাথে তিনি কোনোদিন কোনোরকম আপোষ করেন নি। তিনি বলতেন-যারা অত্যাচারী শাসকের প্রশংসা করে এবং স্বার্থ হাসিলের জন্যে তাদেরকে কুর্নিশ করে,তারা ঐ অত্যাচারী শাসকের সাথে দোযখে যাবে।
আব্বাসীয়খলিফা মানসুরবিভিন্নভাবেচেষ্টা করেছিল জনগণের সামনে ইমামের মর্যাদাকে ছোট করতে,কিন্তু কখনোই তাতে সফল হয় নি। মানসুর মাঝে মাঝে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে নিজেকে ইমামের সান্নিধ্যে নেওয়ার চেষ্টা করতো। একবার ইমামকে সে একটি চিঠিতে লিখেছিল-"আপনি আমার কাছে এসে আমাকে একটু নসীহত করুন।" ইমাম সাদেক (আ.) এই চিঠির জবাবে লিখেছিলেন-"যারা পার্থিব স্বার্থান্বেষী তারা তাদের স্বার্থ বিঘিœত হবার ভয়ে তোমাকে নসীহত করবে না। আবার যারা পরকালীন স্বার্থ কামনা করে,তারা তোমার মতো ব্যক্তির কাছে আসবে না।
নৈতিক এবং চারিত্র্যিক মহান বৈশিষ্ট্যের কারণে জনগণের মাঝে ইমাম সাদেক (আ.) এর জনপ্রিয়তা দিনের পর দিন বেড়েই যাচ্ছিলো। এতে ভয় পেয়ে গিয়েছিল আব্বাসীয় শাসকরা। জনগণ যেভাবে ইমামের সাহচর্য পিয়াসী হয়ে উঠেছিল,তাতে খলিফা মানসুর ইমামের অস্তিত্বের উজ্জ্বল সূর্যালোক সহ্য করতে পারছিল না। তাই চক্রান্ত করে ইমামকে বিষপান করিয়ে শহীদ করেছিল। তাঁর সেই শাহাদাতের বার্ষিকীতে আপনাদের সবার প্রতি রইলো আবারো সমবেদনা। ইমামের একটি বাণী উচ্চারণের মধ্য দিয়ে শেষ করবো আজকের আলোচনা। "আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু এবং ভাই তিনিই,যিনি আমার দোষগুলো ধরিয়ে দেন। "