বাঙ্গালী
Sunday 24th of November 2024
0
نفر 0

হজ্ব: খোদার প্রেমে দগ্ধ হবার সফর

পবিত্র হজ্ব প্রেমাস্পদের উদ্দেশ্যে তথা আল্লাহর প্রেমে নিজেকে পোড়ানোর সফর। এ সফরে খোদা-প্রেমিকরা আমৃত্যু খোদার প্রেমে নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার দৃঢ় অঙ্গীকার ঘোষণা করেন।

ইসলামের অন্যান্য এবাদতের মত হজ্বের লক্ষ্যও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। তাই এই পবিত্র নিয়ত নিয়েই পুণ্যভূমি মক্কাতে প্রবেশের আগে মীকাত বা হজ্বযাত্রা শুরুর স্টেশনগুলো থেকে শুরু হয় হজ্বের আনুষ্ঠানিকতা। এখানে এহরামের কাপড় পড়ে হজ্বযাত্রীরা বলেন, লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা...। এর তাৎপর্য হ'ল , সব কিছুই আল্লাহকে স্মরণ করে শুরু করতে হয়। আমরা সব সময়ই আল্লাহর আহ্বানে সাড়া দিতে প্রস্তুত বা তাঁর পূর্ণ অনুগত হতে প্রস্তুত। আমরা দুনিয়ার অসৎ, শোষক ও স্বৈরাচারী প্রবল শক্তিগুলোকে অস্বীকার করছি। অস্বীকার করছি আল্লাহ ছাড়া অন্য সব শক্তির প্রভুত্বের দাবীকে। আজ আমরা আল্লাহর সামনে উপস্থিত হয়েছি এমন একজন প্রকৃত ‘‘মানুষ'' হিসেবে সেই পোশাক পরিধান করে যে পোশাক পরে একদিন আমরা কিয়ামতের ময়দানে আপনার সামনে উপস্থিত হব।

 

এভাবে হজ্বের সূচনাতেই হজ্বযাত্রী নিজেকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার শপথ নেন। বংশ-গৌরব, সম্পদের গৌরব ও পদমর্যাদার গৌরবসহ সমস্ত পার্থিব আকর্ষণ ভুলে গিয়ে হজ্বযাত্রী পরিধান করেন শুভ্র সাদা কাফনের কাপড়। ইসলামের দৃষ্টিতে সব মানুষই যে সমান এবং শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি যে একমাত্র খোদাভীরুতা হজ্বযাত্রীদের সবার পোশাক তারই বার্তা বহন করে।

 

এহরাম বাঁধার পর হজ্বযাত্রীরা বিশেষ কিছু প্রাত্যহিক কাজসহ অনেক বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা মেনে চলেন। যেমন, চুল ও নখ না কাটা, পশু-পাখী বা কীটপতঙ্গকে আঘাত না করা, স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকা প্রভৃতি। এসবের উদ্দেশ্য হল, আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধি এবং আধ্যাত্মিক উন্নয়ন।

 

পবিত্র মক্কার কাছে আসার পর একটি নির্দিষ্ট এলাকা থেকে শুরু হয় হারাম বা পবিত্র অঞ্চল। এই গোটা অঞ্চলে যুদ্ধ, ঝগড়া-বিবাদ, শিকার, হত্যা, গাছ উপড়ানো এসব নিষিদ্ধ।

 

এরপর হজ্বযাত্রীরা প্রবেশ করেন পবিত্র মক্কা শহরে। হযরত ইব্রাহীম ও ইসমাইল (আঃ) ও বিবি হাজরার স্মৃতি বিজড়িত এই শহর বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র পবিত্র জন্মভূমি। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) মক্কাকে নিরাপদ শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানিয়েছিলেন। হজ্বের মওসুমে এখানে পাখীরাও নিরাপদ। ইসলাম যে শান্তির ধর্ম এবং সবার জন্য ন্যায় বিচার চায় তা এ বিষয় থেকে স্পষ্ট। ইসলাম ধর্ম পশুপাখি ও এমনকি উদ্ভিদেরও অধিকার রক্ষা করতে বলে।

 

মক্কায় অবস্থিত কাবা ঘর মানুষের জন্য নির্ধারিত এবাদতের প্রথম গৃহ। এই কাবাঘর তাওহীদ বা একত্ববাদের প্রতীক। সব ধরনের মূর্তিপূজা অস্বীকার করে ও মহান আল্লাহকে ভালবেসে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) গড়ে তুলেছিলেন এই ঘর। এই ঘরের সাথেই লেগে ছিল বিবি হাজরা ও হযরত ইসমাইল (আঃ)'র ঘর। কিউব আকৃতির এই ঘরই মুসলমানদের কেবলা। অর্থাৎ এই কাবামুখী হয়েই মুসলমানরা নামাজ আদায় করেন। কাবা সমস্ত দিক নির্দেশ করে আবার একইসাথে কোনো বিশেষ দিকই নির্দেশ করে না। আর এ জন্যই কাবা আল্লাহর প্রকৃত নিদর্শন। তাই পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, পূর্ব ও পশ্চিম সব দিকের মালিকই আল্লাহ, আর যেখানেই তুমি থাকো না কেন, তুমি আল্লাহরই মুখোমুখি রয়েছ।

 

বলা হয় মহান আল্লাহর দুটি ঘর রয়েছে। একটি কাবা ঘর ও অন্যটি মানুষের হৃদয়। কাবা ঘর যেমন, শির্ক, অংশীবাদীতা ও মূর্তিপূজার মত বিভিন্ন কলুষতা থেকে মুক্ত তেমনি মানুষের হৃদয়েও আল্লাহ ছাড়া অন্য সব কিছুর আকর্ষণ থেকে মুক্ত থাকা উচিত।

 

হজ্বযাত্রীরা এহরাম ও লাব্বাইক ধ্বনি দেয়ার পর এই কাবা ঘরের চারদিকে সাত বার তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করেন ও আল্লাহর প্রশংসা বা তাসবিহ ও দোয়া পাঠ করেন। এই প্রদক্ষিণ আল্লাহর প্রতি ভালবাসার প্রকাশ। আল্লাহর ঘর তাওয়াফের অর্থ হল, মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই মানুষের সব তৎপরতার লক্ষ্য হওয়া উচিত, দুনিয়ার ঘর-বাড়ী নয়, আল্লাহর ঘরই মানুষের প্রকৃত ঠিকানা।

 

হাজরে আসওয়াদ বা পবিত্র কালো পাথরে হাত রাখা বা চুমো দেবার তাৎপর্য হলো আল্লাহর প্রতীকী হাতে হাত রেখে তাঁর নির্দেশ পালনের অঙ্গীকার করা বা তাঁর নিদের্শকেই শিরোধার্য মনে করা।

 

হজ্বের আরেকটি আনুষ্ঠানিকতা হল সাফা ও মারওয়ার মধ্যে সাঈ করা। সাঈ বা সাফা ও মারওয়াতে দৌড়ানোর অর্থ হলো ভয় ও আশার মাঝামাঝি অনুভূতি নিয়ে ইহকালীন এবং পারলৌকিক কল্যাণ লাভের জন্য চেষ্টা-সাধনা করা। এর সাথে জড়িয়ে আছে নব-জাতক সন্তানের পিপাসা মেটানোর জন্য বিবি হাজেরার প্রচেষ্টার পুণ্য-স্মৃতি।

আরাফাতে অবস্থানের তাৎপর্য হল আল্লাহ সম্পর্কে জানা, আল্লাহ যে সর্বশক্তিমান এবং সব জানেন ও সব-কিছুই যে তাঁর কাছেই চাওয়া উচিত- এইসব বিষয়ে চেতনাকে শানিত করা।

 

আরাফাত ও মিনার মধ্যবর্তী স্থান মাশআরুল হারাম বা মুজদালিফা নামক স্থানে রাত্রি যাপন হজ্বের আরেকটি বড় দিক। এখানে রাত্রি যাপনের দর্শন হল নিজের মধ্যে খোদাভীতির চেতনা ও শ্লোগানকে বদ্ধমূল করা। এখানে থেকে হজ্বযাত্রীরা শয়তানকে পাথর মারার জন্য পাথরের নুড়ি সংগ্রহ করেন। শয়তানের সাথে মোকাবেলার জন্য খোদাভীতি অর্জন পূর্ব শর্ত। মিনায় শয়তানকে পাথর বা কঙ্কর নিক্ষেপের সাথে জড়িয়ে আছে হযরত ইব্রাহীম (আঃ)'র স্মৃতি। তিনি যখন একমাত্র সন্তান ইসমাইল (আঃ)কে কোরবানি করতে উদ্যত হন তখন শয়তান মানুষের ছবি ধরে তাঁকে এ কাজে বিরত রাখার জন্য কুমন্ত্রণা দেয়ার চেষ্টা করে। এ অবস্থায় তিনি শয়তানকে তাড়ানোর জন্য কঙ্কর নিক্ষেপ করেছিলেন। নিজের মনকে ও সমাজকে শয়তানের বা তাগুতি শক্তিগুলোর হাত থেকে রক্ষার মহাশিক্ষা রয়েছে এ ঘটনায়।

 

বর্তমান যুগে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোই শয়তানের ভূমিকায় অবতীর্ণ। তাই তাদের দোসর ও অনুচরদের বিরুদ্ধে সক্রিয় হবার শপথ নেয়া এবং সমাজে প্রকৃত ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য সাংস্কৃতিক, আর্থিক, রাজনৈতিক ও প্রয়োজনে সামরিক সংগ্রামে লিপ্ত হওয়া হজ্বের অন্যতম শিক্ষা।

 

কোরবানি করার সুপ্ত অর্থ হল নিজের মনের সমস্ত কুপ্রবৃত্তি এবং কামনা-বাসনাকে আল্লাহর নির্দেশের কাছে বিসর্জন দিতে হবে। যে প্রাণ বা সন্তান-সন্ততি মানুষের সবচেয়ে প্রিয় তা-ও প্রয়োজনে আল্লাহর জন্য বিলিয়ে দেয়ার শিক্ষা দিয়ে গেছেন হযরত ইব্রাহীম ও হযরত ইসমাইল (আঃ)।

 

কাবা ঘর তাওয়াফ শেষ করার পর হজ্বযাত্রীকে মাকামে ইব্রাহীমের পেছনে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে হয়। এর প্রতীকী তাৎপর্য হল, হজ্বযাত্রীকে বা হাজ্বিকে ইব্রাহিম (আঃ)'র মত পবিত্র হতে হবে এবং একনিষ্ঠ একত্ববাদী হয়ে নামাজ পড়তে হবে। এভাবে নিজেকে শুদ্ধ, পবিত্র ও যোগ্য করার পরই হাজ্বি বা ঈমানদার মানুষ সমাজ-সংস্কারে নিয়োজিত হতে পারেন।

 

হজ্বের অন্যতম প্রধান দিক হল, ইসলামের সামাজিকতা ও আন্তর্জাতিকতা। হজ্ব আধ্যাত্মিক এবাদতের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সামাজিক এবাদত। মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক ও সামাজিক ঐক্য গড়ে তোলা হজ্বের অন্যতম লক্ষ্য। হজ্বের সময় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলমানরা পরস্পরের দুঃখ-দুর্দশা ও সমস্যা সম্পর্কে জানার পাশাপাশি একে-অপরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে পারে এবং কাফির ও মুশরিকদের ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। আর এ জন্যই বারাআত বা কাফির-মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা হজ্বের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ।

 

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম হুসাইন (আঃ) পবিত্র হজ্বের সময় মক্কার মুসলমানসহ হজ্ব উপলক্ষে সমবেত বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলমানদের কাছে বক্তব্য রেখে এজিদের স্বৈরতান্ত্রিক তাগুতি শক্তির বিপদ সম্পর্কে সচেতন করার চেষ্টা করেছিলেন।

 

হজ্বের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হল, আল্লাহর নির্দেশ ও আইনকে সব কিছুর উপরে প্রাধান্য দেয়া এবং ইসলামের স্বার্থে চরম আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকা। প্রতি বছর হজ্ব আমাদেরকে সে জন্য প্রস্তুতি নেয়ার, প্রশিক্ষণ নেয়ার এবং যোগ্যতা অর্জনের ডাক দিয়ে যায়। #

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

বায়তুল্লাহ জিয়ারত ও হজ
প্রকৃত রোজা ও সংযমের কিছু ...
গীবত ও চুগলখোরীর ভয়াবহ পরিণাম
সফরে কসর ওয়াজিব
হজ্বঃ মানব সভ্যতার সর্বশ্রেষ্ঠ ...
হজ্ব: বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের সোপ
লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক
হাজিদের উদ্দেশ্যে ইরানের ...
মিরাজুন্নবীর (সা.) তাৎপর্য ও ...
দাসত্ব-উবুদিয়্যাহ

 
user comment