১৭ আগস্ট (রেডিও তেহরান): ইসলামী ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী সম্প্রতি (গত ১৩ আগস্ট,২০১৪) তার দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বহির্বিশ্বের ইরানি কূটনৈতিক মিশনগুলোর কর্মকর্তা ও কর্মীদের এক সমাবেশে মার্কিন সরকারের সঙ্গে তেহরানের সম্পর্ক,পরমাণু আলোচনা এবং পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক নানা দিক সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন। তার ওই বক্তব্যের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
ইসলামী ইরানের সর্বোচ্চ নেতা সম্প্রতি ইরানি কূটনীতিকদের এক সমাবেশে দেশের পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে জরুরি দিক-নির্দেশনা দিতে গিয়ে বলেছেন: পরমাণু ও নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে মার্কিন সরকারের সঙ্গে ইরানের আলোচনাগুলোয় তেহরানের কোনো লাভ হয়নি এবং সাম্রাজ্যবাদী এই সরকার আগের চেয়েও বেশি দাম্ভিকে পরিণত হয়েছে ও ইরানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা না কমিয়ে বরং আগের চেয়েও বাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি কৌশলী ও জোরালো তথা সক্রিয় কূটনীতির ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, এ ধরনের কূটনীতি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, মানবিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে এমন সব বড় সাফল্য বয়ে আনতে পারে যা ব্যয়বহুল অনেক যুদ্ধের মাধ্যমেও অর্জন করা সম্ভব হয় না।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কর্মকর্তা ও কর্মীদেরকে এই বিভাগের তথা 'কূটনীতির সুশৃঙ্খল সেনা' এবং পররাষ্ট্র বিষয়ে প্রভাব রাখার ক্ষেত্রে মূল দায়িত্বশীল কর্মী হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন: কোনো কোনো শক্তি এ অঞ্চলে অস্ত্র ও গায়ের জোরে তাদের স্বার্থ হাসিল করতে চেয়েছে, কিন্তু এতে সফল হয়নি, অন্যদিকে সূক্ষ্মদর্শিতা, কৌশল ও গতিশীলতার মাধ্যমে অনেকেই নিজ স্বার্থ ভালোভাবেই অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী 'উপযুক্ত পরিচালনা বা সুসমন্বয়'-কে সফল 'কূটনীতির দ্বিতীয় শর্ত' বলে মন্তব্য করেছেন। এই 'উপযুক্ত পরিচালনা বা সুসমন্বয়' হতে হবে লক্ষ্যকে সামনে রেখে। তিনি কূটনৈতিক ক্ষেত্রে সময়মত প্রভাব সৃষ্টি করতে পারা, লক্ষ্যের প্রতি গভীর আন্তরিকতা বা নিষ্ঠা ও নমনীয় হওয়াসহ কূটনীতিবিদদের নানা যোগ্যতা অর্জনের ওপরও গুরুত্ব আরোপ করেছেন। আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী সফল কূটনীতিবিদ হিসেবে হযরত ইমাম হাসান মুজতবা (আ.)'র নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছেন। তিনি বলেছেন: এইসব বৈশিষ্ট্যের অন্য নাম হল 'বীরত্বপূর্ণ নমনীয়তা' বা সাহসিকতার সঙ্গে অবস্থান বা কৌশল পরিবর্তন করা এবং ইমাম হাসান (আ.)'র শান্তি-চুক্তিই এই অবস্থার উজ্জ্বলতম ঐতিহাসিক নিদর্শন। আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী একই প্রসঙ্গে আরো বলেছেন, কুস্তি প্রতিযোগিতার সময় প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও জরুরী নমনীয়তার অধিকারী না হলে ধরাশায়ী হওয়া বা পরাজয় অনিবার্য, অন্যদিকে শক্তি ও নমনীয়তার যথাযথ ব্যবহার বিজয়কে অনিবার্য করে। লক্ষ্যের প্রতি গভীর বিশ্বাস ও ঈমান ছাড়া কূটনীতি সফল হয় না বলেও তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেছেন: কূটনীতির ময়দান হচ্ছে যুদ্ধের ময়দানের মত। তিনি সফল কূটনীতির জন্য বিরামহীন প্রচেষ্টার ওপরও গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বর্তমান যুগকে এক নতুন বিশ্ব-ব্যবস্থা গড়ে ওঠার ক্রান্তিকাল হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন: এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় প্রথাগত বা প্রচলিত খেলোয়াড়দের জায়গায় নতুন খেলোয়াড় প্রবেশ করেছে এবং তারা উদীয়মান নতুন বিশ্ব-ব্যবস্থায় নিজ অবস্থান পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করছে। আর এ পরিস্থিতিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ও দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার গুরুত্ব বেড়ে গেছে বলে তিনি মন্তব্য করেছেন। সুযোগগুলোকে কাজে লাগিয়ে সেসবের যথাযথ ব্যবহার করা সম্ভব না হলে নতুন বিশ্ব-ব্যবস্থায় ইসলামী ইরান তার উপযুক্ত অবস্থান অর্জনে ব্যর্থ হবে বলে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা সতর্ক করে দিয়েছেন।
তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইসলামী ইরানের যুক্তি তথা ধর্ম-ভিত্তিক জনগণের শাসন ব্যবস্থার যুক্তি তুলে ধরার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন: এটি খুব বড় লক্ষ্য যা অর্জনের জন্য সক্রিয় হতে হবে এবং ইসলামী বা মুসলিম বিশ্বে এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রসহ সব ক্ষেত্রে ইসলামী আচরণ-বিধি এবং নীতিমালা পালনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন: আমেরিকাসহ পরাশক্তিগুলোর ক্রোধ বা রক্তচক্ষুকে ভয় না পাওয়া ইরানি কূটনীতির বৈশিষ্ট্য। ইসলামী বিপ্লবের পর থেকে ইরানের এই নীতি জাতিগুলোর হৃদয় জয় করেছে এবং বিশ্বের রাজনীতিবিদরাও মুখে স্বীকার করুক বা গোপন করুক ইরানের এই নীতির প্রশংসা করতে বাধ্য হয়েছেন।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতার মতে মজলুমের প্রতি দৃঢ় ও বাস্তব সমর্থন ইসলামী ইরানের কূটনীতির আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য। তিনি এ প্রসঙ্গে মজলুম ফিলিস্তিনি সংগ্রামী ও লেবাননি জাতিসহ অন্যান্য জাতির প্রতি ইসলামী ইরানের সাহায্য সমর্থনের কথা তুলে ধরেছেন।
আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ীর মতে আমেরিকাসহ বলদর্পী শক্তিগুলোর বিরোধিতা করা ইসলামী ইরানের পররাষ্ট্রনীতির আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য। ইরান বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে কোনো রকম দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছাড়াই আমেরিকাসহ বলদর্পী শক্তিগুলোর উপস্থিতির বিরোধিতা করে যাচ্ছে ও ভবিষ্যতেও করে যাবে বলে তিনি জোর দিয়ে উল্লেখ করেছেন।
আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী জাতীয় সম্পদ,পুঁজি ও জাতীয় স্বার্থ আদায় এবং এইসব বিষয় রক্ষার নীতিতে অবিচল থাকার ওপরও জোর দিয়েছেন। তিনি এ প্রসঙ্গে জাতীয়, ইসলামী, বিপ্লবী ও ঐতিহাসিক পরিচিতিকে জাতীয় পুঁজি হিসেবে অভিহিত করেন এবং দেশীয় চিন্তাবিদ ও বিজ্ঞানীদের তৎপরতাকেও জাতীয় পুঁজি হিসেবে রক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
তিনি তার ভাষণের শেষাংশে সারা বিশ্বের সঙ্গে ইরানের আলোচনা, পারস্পরিক সহযোগিতা ও সম্পর্ক প্রসঙ্গে বলেছেন: কেবল ইহুদিবাদী ইসরাইল ও মার্কিন সরকার ছাড়া বিশ্বের সবার সঙ্গে এই সম্পর্ক রাখতে চায় ইরান। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এ প্রসঙ্গে যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন: 'আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক ও আলোচনা বিশেষ কয়েকটি ক্ষেত্র ছাড়া ইসলামী ইরানের জন্য লাভজনক তো নয়ই,বরং ক্ষতিকর, আর কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি লাভহীন কাজের পেছনে লেগে থাকে?কেউ কেউ এমনটা দেখানোর চেষ্টা করে যে মার্কিন সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসলেই আমাদের বেশিরভাগ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। অথচ আমরা অনেক আগেই জানতাম যে এমন ধারণা সত্য নয়, গত এক বছরের ঘটনাগুলো বার বার এই বাস্তবতাকে প্রমাণ করেছে।' তিনি এ প্রসঙ্গে আরো বলেছেন:
'অতীতে মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমাদের কর্মকর্তাদের কোনো সম্পর্কই ছিল না, কিন্তু গত এক বছরে পরমাণু বিষয়ে মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যায়ের যেসব আলোচনা হয়েছে তাতে কোনো লাভ তো হয়নি, বরং আমেরিকার সুর আরো কড়া ও অবমাননাকর হয়েছে এবং তারা আলোচনার বৈঠকগুলোতে ও সাধারণ সমাবেশগুলোতে আগের চেয়েও বেশি পাওনাদারসুলভ ভঙ্গীতে কথা বলছে। অবশ্য আমাদের কর্মকর্তারা এইসব মোড়লীপনাসুলভ আচরণের জবাবে আরো শক্ত ও কোনো কোনো সময় অনেক বেশি আঁতে ঘা লাগানোর কথা বলেছেন। যাই হোক,সামগ্রিকভাবে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, আমেরিকার সঙ্গে আলোচনা ইরানকে কোনো ক্ষেত্রেই সহায়তা দিচ্ছে না।' ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আরো বলেছেন,মার্কিনীরা শত্রুতা না কমিয়ে বরং নিষেধাজ্ঞার সংখ্যাও বাড়িয়েছে, যদিও তারা বলছে, এটা নতুন কোনো নিষেধাজ্ঞা নয়, কিন্তু বাস্তবে এইসব নিষেধাজ্ঞা নতুন নতুন নিষেধাজ্ঞা এবং নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রেও আলোচনায় কোনো লাভই হয়নি।
তিনি মার্কিন সরকারের সঙ্গে রুহানি সরকারের সংলাপ চালিয়ে যাওয়ার প্রতি সমর্থন জানিয়ে আরো বলেছেন,
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডক্টর জারিফ ও তার বন্ধুদের টিম যে আলোচনা শুরু করেছেন তাতে তারা এ পর্যন্ত ভালোই অগ্রসর হয়েছেন, কিন্তু এর ফলে সবার কাছেই এই মূল্যবান অভিজ্ঞতা স্পষ্ট হয়েছে যে,মার্কিন সরকারের সঙ্গে বৈঠক ও আলোচনার ফলে ইরানের সঙ্গে তাদের শত্রুতা হ্রাসে বিন্দুমাত্র প্রভাব পড়েনি এবং এইসব বৈঠক ও আলোচনায় কোনো লাভ নেই।
মার্কিন সরকারের সঙ্গে বৈঠকের ক্ষতির দিকগুলো তুলে ধরতে গিয়ে ইরানের দুই মেয়াদের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও প্রায় ২৫ বছর ধরে সর্বোচ্চ নেতার আসনে থাকা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী আরো বলেছেন, এ ধরনের পদক্ষেপের ফলে বিশ্বের জাতি ও সরকারগুলো আমাদের বিরুদ্ধে দোদুল্যমনতার অভিযোগ আনছে এবং পশ্চিমারাও তাদের ব্যাপক প্রচারণায় ইসলামী ইরানকে কোণঠাসা রাষ্ট্র ও দ্বিধাযুক্ত বলে তুলে ধরছে। আর এ ধরনের বৈঠক ও আলোচনার ফলে আমেরিকার অবৈধ খাহেশ বা আবদার যে বেড়ে যাচ্ছে তাও তিনি তুলে ধরেছেন।
ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক ও সহযোগিতা আর যোগাযোগ প্রসঙ্গে আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেছেন, এটি একটি অসম্ভব বিষয়।
আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক ও সহযোগিতা আর যোগাযোগ প্রসঙ্গে আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেছেন,
'মার্কিন সরকার ও সংসদ যতদিন ইরানের সঙ্গে শত্রুতা এবং ইরান-বিদ্বেষী বক্তব্য দেয়া অব্যাহত রাখবে ততদিন ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক ও সহযোগিতার পদক্ষেপ নেয়া কোনোক্রমেই সম্ভব নয়।'
গাজায় ইসরাইলি অপরাধযজ্ঞের প্রতি মার্কিন সমর্থনের কারণে এই সরকারের প্রতি জাতিগুলোর ঘৃণা বেড়ে যাওয়ার কথা তুলে ধরে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেছেন: বিশ্বে এমন কেউ নেই যে মার্কিন সরকারকে গাজায় দখলদার, নেকড়েসুলভ, ঘাতক, কাফির ও জালিম ইসরাইলের অপরাধযজ্ঞ এবং জাতিগত শুদ্ধি অভিযানের শরিক বলে মনে করে না। তাই মার্কিন সরকার এখন আগের চেয়েও বেশি দুর্বল অবস্থায় রয়েছে।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা গাজায় যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে ফিলিস্তিনিদের যুক্তির প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেছেন: রক্তপায়ী ও হিংস্র ইহুদিবাদীরা ইচ্ছামত সব ধরনের বিপর্যয় ঘটাচ্ছে এবং এরপর কোনো ক্ষতিপূরণ না দিয়েই অতীতের মতই অবরোধ ও চাপ বাড়িয়ে চলেছে। তাই গাজার ওপর অবরোধ তুলে নেয়ার ফিলিস্তিনি দাবি যৌক্তিক। তিনি ইরাকের নতুন সরকারের সাফল্য কামনা করে বলেছেন: ইনশাল্লাহ ইরাকে নতুন সরকার ও প্রধানমন্ত্রী দেশটির সংকটগুলোর সুরাহা করবেন এবং দাঙ্গাবাজদের উচিত শিক্ষা দেবেন।#