আলম শামস : বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার ফুল্লশ্রী গ্রামের সিরাজ মোল্লার মেয়ে পলি (৮) ও তার ভাড়াটিয়া বজলুর তালুকদারের মেয়ে মিম (৯)সহ ৪/৫ জন গত ৭ জুন বাড়ির পুকুরে গোসল করতে নামে। সাঁতার না জানার কারণে এক পর্যায়ে পলি ও মিম পানিতে ডুবে মারা যায়।
মাগুরা পৌর এলাকার পারনান্দুয়ালী গ্রামের গোলাম রব্বানীর ১১ বছরের ছেলে আবদুল্লাহ গত ১৩ মে নবগঙ্গা নদীতে গোসল করতে গিয়ে সাঁতার না জানার কারণে ডুবে মারা যায়। কক্সবাজার জেলার মহেশখালীর ঠাকুরতলা গ্রামের বিজয় চরণ দাশের ৯ বছরের ছেলে সুমন দাশ। গত ৭ মে দুপুরে বাড়ির আঙিনার পুকুর পাড়ে খেলা করছিল। প্রচ- গরমে সমবয়সীদের সাথে গোসল করতে পুকুরে নামে। সাঁতার না জানায় সে পুকুরে ডুবে মারা যায়।
সন্তান হারিয়ে বাবা মা আহাজারি করছে। প্রতিবেশী ও স্বজনরা সান্ত¡না দিচ্ছেন। কিন্তু প্রাণ প্রিয় সন্তান তো আর ফিরে আসবে না। শুধুমাত্র সাঁতার না জানার কারণে অকালে ঝরে গেল ৪টি অবুঝ তাজাপ্রাণ। পলি, মিম, আবদুল্লাহ ও সুমন দাশের মতো সাঁতার না জানার কারণে প্রতিমাসে শত শত শিশু পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে।
ইউনিসেফ'র এক জরিপে জানা যায়, ‘শুধুমাত্র সাঁতার না জানার কারণে বাংলাদেশে গড়ে ১৭ হাজার শিশু প্রতি বছর পানিতে ডুবে মারা যায়। যা বিশ্বের সর্বোচ্চ।'
নদীমাতৃক দেশ আমাদের এই সোনার বাংলাদেশ। নদীবিধৌত এই জনপদে প্রতিটি বাড়িতে না হলেও বাড়ির আশপাশে পুকুর কিংবা ডোবা থাকা খুবই স্বাভাবিক। আর খাল বিল তো রয়েছেই। তাইতো পা বাড়ালেই কোন জলাধার খুঁজতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না আমাদের উপরন্ত এমন কোনো বছর নেই যে বছর বন্যা আঘাত হানে না বাংলাদেশে। আর বন্যার পানিও নিচু এলাকায় জমে থাকে কয়েক সপ্তাহ, কখনো বা মাসব্যাপী। পানির এই সহজ লভ্যতার কারণেই সাঁতার না জানা শত শত শিশু প্রতি বছর পানিতে ডুবে মারা যায় বাংলাদেশে।
বাংলাদেশি শিশুদের সাঁতার শিখার জন্য ইউনিসেফের সংগঠন সেন্টপার ফর ইনজিউরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ বা সিইপিআরবি প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে ২০০৫ সাল থেকে। তাদের লক্ষ্য বাংলাদেশের প্রতিটি শিশুকে সাঁতার শেখানো। যেনো পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার কমে আসে। এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের ৩০ হাজার শিশুকে সাঁতার শিখিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ান এক সাঁতার প্রশিক্ষক জেস মস-এর মতে, পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা বাংলাদেশে খুবই বেশি। কিন্তু আমরা যদি একটি শিশুকে শেখাতে পারি কিভাবে ৯০ সেকেন্ড সাঁতার কাটা যায় বা ভেসে থাকা যায় তবে তার জীবন রক্ষা করা সম্ভব।
ইউনিসেফের স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি বিভাগের বাংলাদেশ প্রধান ব্রিথ লোকেটেলি-রসি বলেন, তারা ৪ থেকে ১০ বছরের শিশুদের সাঁতার প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। যা শিশুদের পানিতে ভেসে জীবন রক্ষা করতে সাহায্য করবে।
শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. জহিরুল হক সাগর বলেন, সাঁতার শিক্ষা প্রতিটি মানুষের জীবন সুরক্ষার জন্য জরুরি প্রয়োজন। সাঁতার শিখার উত্তম সময় হলো শিশুকাল। ৫ বছর বয়স থেকে সাঁতার শিক্ষা শুরু করা যায়। শহরের ও গ্রামের সকল বাবা মায়ের প্রতিটি সন্তানকে সাঁতার শিখানো উচিত।
ডা. সাগর আরো জানান, পানির ওপর ভেসে ভেসে বিশেষ কৌশলে জলপথ অতিক্রম করার নাম সাঁতার। সাঁতারের উদ্দেশ্য হলো পানিতে না ডুবে ভেসে থাকা। পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, সমাজ ও অভিভাবকদের অসচেতনায়ই এর মুখ্য কারণ। অধিকাংশ শিশু পানিতে পড়ার কারণ হলো মা যখন দুপুরের রান্না বা বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকেন, এ সুযোগে শিশু আপন মনে খেলা করে, ইচ্ছে মত এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতে থাকে, আর তখন ঘটে এই অনাকাংখিত দুর্ঘটনা।
আমাদের দেশে জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মৎস্য ও পানির উৎস নদী। নদী আমাদের জীবনের সঙ্গে বিভিন্নভাবে জড়িত। এই নদী থেকে বিভিন্ন সুবিধা গ্রহণ করতে আমাদের সাঁতার শিক্ষা আবশ্যক।
বাংলাদেশে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্য রোধে কাজ করতে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মাইকেল বস্লুমবার্গ ফাউন্ডেশন ৭৭ কোটি টাকা সহায়তা দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি এই অর্থে দুই বছর মেয়াদী প্রকল্পের আওতায় ৮০ হাজার শিশুর দেখভালসহ সাঁতারে মতো প্রশিক্ষণে ব্যবস্থা করা হবে। প্রাথমিকভাবে যেসব অঞ্চলে এই মৃত্যুর হার বেশি সেসব অঞ্চলকে প্রাধান্য দিয়েই কাজ শুরু করবে প্রতিষ্ঠানটি। শুরুতে প্রতিষ্ঠানটি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকা ডে কেয়ার ও কমিউনিটি সেন্টারগুলোর মাধ্যমে এ কার্যক্রম চালাবে। যার মাধ্যমে দুই বছর মেয়াদী প্রকল্পে ৮০ হাজার শিশু দেখাশোনাসহ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।
প্রতিষ্ঠানটির এক গবেষণায় জানানো হয়, পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুহার শহর এলাকার চেয়ে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেশি। বাড়ির পাশেই ছোট ছোট ডোবা-নালায় বেশি মৃত্যুবরণ করে শিশুরা। দাতা প্রতিষ্ঠানটির একজন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. কেলি হেনি জানান, পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনা আসলেই হৃদয় বিদারক। তার মতে, কছিু পদক্ষেপ নিলেই এই মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
গত ২১ এপ্রিল প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক সংবাদে জানা যায় ‘এক যুগে কক্সবাজারের সাগরে ডুবে ৮৫ জন, আর সেন্ট মার্টিনে ১৪ জন পর্যটক মারা গেছেন। কক্সবাজারের ১২০ কিলোমিটার সমুদ্র সৈকতের ১১১ কিলোমিটার এখনো সম্পূর্ণ অরক্ষিত।' সাঁতার জানা থাকলে এই হৃদয় বিদারক ঘটনা নাও ঘটতে পারতো।
চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার চান্দ্রা ইমাম আলী স্কুর এন্ড কলেজের শরীরচর্চা শিক্ষক শেখ মুহাম্মদ নূরে আলম বলেন, সাঁতার একটি উত্তম ব্যায়াম। সাঁতার জানা মানুষ নিজ জীবন সুরক্ষাসহ পানিতে ডুবে ডাওয়া অপরকেও বাঁচাতে পারে। পানিতে ডুবে শিশু মারা যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার অন্যতম ব্যবস্থা হচ্ছে সকল শিশুকে ৫ বছর বয়স থেকে বাধ্যতামূলকভাবে সাঁতার শেখানো।
রাজধানীতে রয়েছে অনেক সাঁতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এদের কোর্স ফি ও কোর্সের কারিকুলাম বিভিন্ন রকম। বিস্তারিত জানতে যোগাযোগ করা যেতে পারে- ১. হোটেল সোনারগাঁও, ফোন-৮১৪০৪০১, ২. হোটেল র্যাডিসন ফোন-৮৭৫৪৫৫৫, ৩. বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম সুইমিংপুল ফোন-৯৫৬৭৭১৪, ৪. জাতীয় সুইমিং কমপ্লেক্ষ মিরপুর, ফোন-৯০০১২৭২, ৫. বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থা ফোন- ৯১১৯৭০৪, ৬. অফিসার্স ক্লাব ফোন-৯৩৪৬৬৭৭, ০১৯২৩-৬২৫০৯৬, ০১৬৭১-৬৮৩১৭১, ৭. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সুইমিংপুল ফোন-০১৭১৯৮৭৮৯৪৮।
এছাড়া জনকল্যাণমূলক কাজের অংশ হিসেবে ৬ থেকে ১০ বছর বয়সী ছেলে/মেয়েদের সাঁতার শিখাতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অস্থায়ী সুইমিংপুরের তৈরি করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে ওউজঈ ইধহমষধফবংয, ঈওচজই, অঁংঃৎধষরধহ মড়াবৎহসবহঃ ধরফ ঢ়ৎড়মৎধস, ঞঅঝঈ, জড়ুধষ খরভব ঝধারহম নামক কিছু এনজিও সংস্থা।
বাংলাদেশ হেলথ অ্যান্ড ইনজুরি (বিএইচআইএস) মতে বাংলাদেশে অপঘাতে প্রতিবছর ৩০ হাজার শিশু মারা যায়। এর অর্ধেক শিশুর মৃত্যু হয় পানিতে ডুবে। ১ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের পানিতে ডুবে মৃত্যুর হর সবচেয়ে বেশি। প্রতি বছর ১৭ হাজার শিশু এভাবে মারা যায়। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ৪৬ শিশু এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর শিকার হচ্ছে।
পানিতে ডুবে এই অস্বাভাবিক মৃত্যু রোধে সাঁতার শিখার পাশাপাশি সমাজের সবাইকে সচেতন হতে হবে। সাঁতার না জানা শিশুদের নজরে রাখতে হবে। স্কুলে শিশুদের সাঁতার। মসজিদে জুমার খুতবায় অভিভাবকেদেরকে শিশুর সাঁতার শিক্ষার ওপর তাগিদ দিতে হবে। বিভিন্ন সভা সমাবেশ করে সাঁতার শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে হবে। গণমাধ্যমগুলোতে সাঁতার শিক্ষার ওপর নাটিকা, কার্টুন ও বিজ্ঞাপন প্রচার করতে হবে। তবেই পানিতে ডুবে এই অস্বাভাবিক মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে। বাসস ও ইউনিসেফ ফিচার।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক